কলকাতার ছেলে বোধন, আপনাদের কাছে লেখক অজিত মিত্র. আজ আপনাদের নিয়ে যাচ্ছি এক অবিশ্বাস্য, বিজ্ঞান আর রহস্যের মেলবন্ধনে গড়া গল্পের জগতে। এই গল্পের নাম – ‘ঈশ্বরের সন্ধানে’।
শ্রীমতি সানবিদা সেন, সকলকে সোনা বলেই জানা যায়, একজন উঠতি জ্যোতিবিজ্ঞানী। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছেন তিনি। তার গবেষণার বিষয় – ‘কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বর নির্মাণ এবং আকাশপথ চলাচল’। রাতের নীরবতায় ল্যাবে কাজ করছিলেন সোনা। হঠাৎ, কম্পিউটারের পর্দায় এক অবিশ্বাস্য ফলাফল দেখতে পেলেন তিনি। মহাবিশ্বের গভীর থেকে পাঠানো তথ্য বিশ্লেষণ করে সোনা একেবারেই আশ্চর্যজনক এক সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন – এই মহাবিশ্বের কোন স্রষ্টা, কোন ঈশ্বর নেই!
এই আবিষ্কার সোনাকে কাঁপিয়ে দিল। বারবার ফলাফল যাচাই করলেন তিনি। কিন্তু ফলাফল একই। নিজের বিশ্বাস, মানুষের চিরকালের ধারণা, সবকিছুই যেন কে এক ঝটকায় ধসিয়ে দিল। সোনা জানতেন, এই আবিষ্কার প্রকাশ্যে এলে তা বিশ্বজগতের চেহারা বদলে দেবে। কিন্তু একা একা এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তিনি ছুটলেন তার গাইড ও প্রেমিক, অভিজিৎ ঠাকুরের কাছে।
অভিজিৎ, একজন খ্যাতন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। সোনার গবেষণায় সবসময় তার সহায় ছিলেন তিনি। সোনার কাছ থেকে সব শুনে অভিজিजीৎ অবাক। কিন্তু সোনার তথ্য খতিয়ে দেখলেন তিনি। আর দেখে সত্যিই তো! সোনার আবিষ্কার সঠিক। কোন ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই।
এই আবিষ্কারের ফলে সৃষ্টি হলো এক বিশাল ঝড়ের। বিজ্ঞান জগৎ স্তম্ভিত। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর রক্ষণশীলরা ক্ষোভে ফুঁসে উঠলেন। কীভাবে হয়, ঈশ্বর থাকবেন না! কিন্তু সোনা আর অভিজিৎ তাদের গবেষণাপত্র নিয়ে বেরিয়ে এলেন প্রকাশ্যে। বিজ্ঞান সম্মেলন, সংবাদমাধ্যম, সর্বত্র তাদের আবিষ্কারের আলোড়ন।
মানুষের মধ্যে দ্বিধা, সংশয়, এবং রোষের ঢেউ উঠতে থাকলো। কিছু মানুষ এই আবিষ্কারকে আশীর্বাদ হিসেবে গ্রহণ করলেন। তারা মনে করলেন, এখন বিজ্ঞান আর ধর্মের মাঝে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিছু আবার ধর্মীয় গ্রন্থের নতুন ব্যাখ্যা খুঁজতে লাগলেন। কিন্তু অনেকেই সহ্য করতে পারলেন না এই সত্য। সোনা আর অভিজিৎ হয়ে উঠলেন প্রাণভীতির শিকার। ধর্মীয় জঙ্গিদের হামলার হুমকি ও নিরাপত্তা কারণে সোনা ও অভিজিৎকে সরিয়ে দেওয়া হলো একটি গোপন সরকারি সুবিধায়। সেখানে, সশস্ত্র পাহারায় নিরাপত্তা আর বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তাদের গবেষণা নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। প্রশ্ন উঠলো – কীভাবে কোন ঈশ্বর নেই এটা সম্ভব? মহাবিশ্বের সৃষ্টি, নিয়ম, সবকিছুই তো এক অদৃশ্য হাতের নির্দেশেই চলে!
কিন্তু সোনার আবিষ্কার ছিলো মৌলিক পদার্থবিজ্ঞানের নতুন এক সূত্র। তার তত্ত্ব অনুসারে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো এক বিরাট বিস্ফোরণের মাধ্যমে। সেই বিস্ফোরণের পর থেকেই মহাবিশ্বের নিয়মগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে আসছে। কোন হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই। কৃষ্ণ গহ্বরের গভীরতা থেকে পাওয়া তথ্যই এই তত্ত্বের স্বাক্ষর।
অভিজিৎ আরো ব্যাখ্যা করলেন, “এই আবিষ্কার ঈশ্বরের অস্তিত্বকে নাকচ করে না, বরং মহাবিশ্বের সৃষ্টির নতুন এক দৃষ্টিকোণ দেয়। ধর্মীয় ধারণার সঙ্গে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারকে মিশিয়ে নতুন এক চিন্তাধারা গড়ে উঠতে পারে।”
কিন্তু পরিস্থিতি এত সহজ ছিলো না। ধর্মীয় গোঁড়ামি আর রাজনৈতিক স্বার্থ এই আবিষ্কারকে হাতিয়ার করতে চাইল। বিজ্ঞানীদের একটি অংশও সোনা ও অভিজিৎ এর গবেষণা মানতে রাজি হলেন না। তাদের মতে, এটা বিশ্বাসের জায়গা, এখানে বিজ্ঞানের কোনো প্রমাণ লাগে না।
এই টানাপড়েনের মধ্যে, সোনা আর অভিজিৎ তাদের কাজ চালিয়ে গেলেন। তারা কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বর নির্মাণের গবেষণায় নতুন মাত্রা যোগ করলেন। তাদের লক্ষ্য ছিলো এই আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে মহাবিশ্বের নতুন নতুন সীমানায় পৌঁছানো।
কিন্তু সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো মানুষের মনের পরিবর্তন। এই আবিষ্কারের ফলে মানুষের নৈতিকতা, দর্শন, সবকিছুই নতুন করে ভাবার দরকার পড়লো। ঈশ্বরের ভয় না থাকলে, তাহলে কি মানুষ আর সৎ থাকবে না? নাকি বিজ্ঞানের নতুন আলোয় মানবতা আরো সুদৃঢ় হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সোনা ও অভিজিৎ তাদের গবেষণার পাশাপাশি মানুষের সঙ্গেও কথা বলতে শুরু করলেন। বিশ্ববিদ্যালয়, সভা-সমিতি, সর্বত্র তারা মানুষকে জানালেন, এই আবিষ্কার বিশ্বাসের অপমান নয়, বরং বিজ্ঞানের বিস্ময়। মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়েই আমরা হয়তো ঈশ্বরের ধারণাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে পারি।
কীভাবে এই গল্পের সমাধান হবে, সেটা সময়ই বলে দেবে।
বছর দুয়েক কেটে গেল। সোনা আর অভিজিৎয়ের গবেষণা চলতেই থাকলো। তাদের আবিষ্কার বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলে দিলেও, পরিস্থিতি আস্তে আস্তে স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। কিছু ধর্মীয় গোষ্ঠী এখনও প্রতিবাদ জানালেও, আর আগের মতো জোর দেখানো হয় না।
এর মধ্যেই সোনা ও অভিজিৎ এক চমকপ্রদ ঘোষণা দিলেন। তারা কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বর নির্মাণে সফল হয়েছেন। কিন্তু এই কৃষ্ণ গহ্বর আকারে ক্ষুদ্র, মাত্র কয়েকটি মৌলিক কণার সমান। তবে এটি একটি মাইলফলক। এই কৃষ্ণ গহ্বরের সাহায্যে তারা মহাবিশ্বের অগম্য স্থানের তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন বলে আশা করছেন।
ঘোষণার পর বিজ্ঞানীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের ঢেউ বয়ে গেল। এই আবিষ্কার মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত খুলে দিল। কিন্তু সবার মনেই ছিলো একটা প্রশ্ন – এই কৃষ্ণ গহ্বর দিয়ে যাওয়া হবে কোথায়? মহাবিশ্বের কোন স্থানে পাঠানো হবে প্রথম সংকেত?
সোনা ও অভিজিৎ এর উত্তর ছিলো অবাক করা। তারা জানালেন, তারা প্রথম সংকেত পাঠাবেন সেই দূর অতীতে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির মুহূর্তে! কৃষ্ণ গহ্বরের বিশেষত্ব হলো, এটি সময়কেও বাঁকিয়ে দিতে পারে। তাই এই গহ্বরের সাহায্যে অতীতে পাঠানো সংকেত হয়তো মহাবিশ্বের সৃষ্টির রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে।
এই ঘোষণার পর আবারো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ মনে করলেন, এটা সম্পূর্ণ পাগলামি। অতীতে কোনো সংকেত পাঠানো সম্ভব নয়। আবার কেউ বিশ্বাস করলেন, সোনা ও অভিজিৎ হয়তো সত্যিই অসাধ্য কিছু করতে চলেছেন।
নির্দিষ্ট এক সকালে, গোটা বিশ্বের চোখ ছিলো ভারতের সেই বিশাল গবেষণা কেন্দ্রের দিকে। সোনা ও অভিজিৎ তাদের দলবল সহ সেখানে উপস্থিত। উত্তেজনা চরমে। সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা, শেষবারের মতো যাচাই করলেন অভিজিৎ। তারপর এক গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে তিনি চাপ দিলেন চালু করার বাটনে।
কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বর জ্বলে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চারপাশে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর হঠাৎ করেই যন্ত্রগুলোতে নড়াচড়া শুরু হলো। স্ক্রিনে বিভিন্ন রঙের লাইন ঝকমকে উঠলো।
কন্ট্রোল রুমে নিঃশব্দতা। সবাই মনঃসংযোগ দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করেই, এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী চিৎকার করে উঠলেন, “সংকেত পাওয়া গেছে! অতীত থেকে সংকেত পাওয়া গেছে!”
কন্ট্রোল রুমে হুলুস্থুল কাণ্ড। সোনা ও অভিজিৎ একে অপরের দিকে চেয়ে হাসলেন। তাদের বছরের পর বছরের গবেষণা, সফল! কিন্তু আসল রহস্য এখনো গোপন। অতীত থেকে পাওয়া এই সংকেত ঠিক কী বলছে, সেটাই জানা বাকি।
দিনরাত এক করে কাজ করলেন বিজ্ঞানীরা। বিভিন্ন কম্পিউটার প্রোগ্রাম, জটিল অ্যালগোরিদমের সাহায্যে অতীতের সেই সংকেতকে ডিকোড করার চেষ্টা চললো। কয়েক সপ্তাহ পর, অবশেষে সফলতা। সংকেতটি ছিলো মাত্র কয়েকটি সংখ্যার সমষ্টি। কিন্তু সেই সংখ্যাগুলো ছিলো এতই জটিল, এতই অবাক করা, যে বিজ্ঞানীরা তা ব্যাখ্যা করতে পারলেন না।
এই নতুন রহস্য আরো চাঞ্চল্য ছড়িয়ে দিল। এটা কি কোনো প্রাকৃতিক কোড? নাকি মহাবিশ্বের সৃষ্টির সময় কোনো অজানা শক্তি এই সংকেত পাঠিয়েছিল? প্রশ্নের উত্তর না পাওয়ার হতাশা জড়িয়ে ধরলো সবাইকে। সোনা ও অভিজিৎ জানতেন, এই রহস্য উদঘাটনে সময় লাগবে। কিন্তু তারা আশা ছাড়লেন না।
এই ঘটনার পর বিশ্বজগতের চেহারা বদলে গেল। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও, ধর্মীয় বিশ্বাস একেবারেই মুছে যায়নি। বরং বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে এক নতুন সেতুবন্ধন তৈরি হলো। মানুষ বুঝতে পারলো, মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে তারা হয়তো ঈশ্বরের ধারণাকে নতুন করে ব্যাখ্যা করতে পারবে। অথবা ঈশ্বর না থাকলেও, এই বিশাল মহাবিশ্বের চলমান নিয়মের মধ্যেই কোনো অজানা শক্তি, কোনো অદৃশ্য নিয়ন্ত্রকর্তা থাকতে পারে।
সোনা ও অভিজিৎ তখনো থামলেন না। তারা কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বরের গবেষণা আরো এগিয়ে নিয়ে গেলেন। তাদের লক্ষ্য ছিলো এই গহ্বরকে আরো বড়, আরো স্থিতিশীল করা, যাতে তার মধ্য দিয়ে মানুষকে দূরের গ্রহে পাঠানো যায়। হয়তো সেই নতুন গ্রহেই মানুষ নতুন সভ্যতা গড়ে তুলবে। কিন্তু সেই গল্প, হয়তো আরেকদিন…
বছরের পর বছর কেটে গেল। সোনা ও অভিজিৎয়ের গবেষণায় চমকপ্রদ অগ্রগতি হলো। কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বরকে তারা আরো বড় আকারে তৈরি করতে সক্ষম হলেন। এটি এখন একটি ছোট্ট কক্ষের সমান। তবে এটা যথেষ্ট। এটির মধ্য দিয়ে মানুষ পাঠানো সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কোথায় পাঠানো হবে?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাকাশের অতল গহীণ পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন। বহুদূরে, একটি তারার চারপাশে সোনালি আভাযুক্ত একটি গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেল। সেই গ্রহের পরিবেশ পৃথিবীর অনেকটাই মিল। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন, এটাই হতে পারে নতুন মানব বসতি স্থাপনের জায়গা।
নির্বাচিত হলো এক দল अंतरिक्षচারী। বছরের পর বছর ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হলো। অবশেষে, সেই মুহূর্ত এলো। কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বরের পাশে দাঁড়িয়ে, হৃদয় কাঁপিয়ে উঠলো সবার। এই গহ্বরের মধ্য দিয়ে যাত্রা মানে হয়তো ফিরে আসার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু মানব সভ্যতার ভবিষ্যৎ, নতুন জগতের আহ্বান, সবকিছু ছাপিয়ে গেল তাদের মনের ভয়কে।
চারপাশে ক্যামেরা ঝলকানি, বিদায়ের আলিঙ্গন। সশব্দে চালু হলো কৃত্রিম কৃষ্ণ গহ্বর। তার মধ্য দিয়ে ঢুকে গেল अंतरिक्षযানটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সবকিছু নিঃশব্দ হয়ে গেল। কন্ট্রোল রুমে সবাই চোখ বন্ধ করে প্রার্থনা করতে লাগলেন।
কয়েক ঘণ্টা পর, একটি দুর্বল সংকেত পৃথিবীতে এলো। আকাশযানটি নিরাপদে নতুন গ্রহে অবতরণ করেছে! খবরটি ছড়িয়ে পড়তেই পৃথিবী উৎসবে মুখরিত হয়ে উঠলো। মানুষের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
কিন্তু গল্পটা এখানেই শেষ নয়। নতুন গ্রহে পা রাখা মহাকাশচারীরা সেখানে অবাক করা এক আবিষ্কার করলেন। প্রাচীন ভগ্নস্তুপ, অদ্ভুত চিত্রকর্ম – সবকিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল, এই গ্রহে কোনো এক উন্নত সভ্যতা ছিল। আর সেই সভ্যতারা হয়তো কোনো অজানা কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এই আবিষ্কার আরো রহস্যের জন্ম দিল। এই সভ্যতারা কিভাবে বিলুপ্ত হলো? তারা কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করতো? নতুন গ্রহে পা রেখে মানুষ এক নতুন রহস্যের সম্মুখীন হলো। ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, নতুন জ্ঞানের সন্ধান, নতুন সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগের আশা জাগিয়ে তুললো মানবজাতিকে।