কলকাতার বুকে, নিউ গড়িয়ার এই আকাশচুম্বী এক অ্যাপার্টমেন্টের ছাদে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সায়না রায়। বেশি দূরে নেই হাওড়া সেতু, তার ঝলমলে আলো চোখ ধাঁধাচ্ছে। কিন্তু আজ আমার মন কোনো আলোয় আলোকিত হয় না, বরং গভীর অন্ধকারে ডুবে আছে।
একটু আগেই ঘটেছে এমন এক ঘটনা, যা আমার জীবন বদলে দিয়েছে চিরতরে। আমি এমন এক কাজ করে ফেলেছি, যার ফল ভয়াবহ হতে পারে। ফিরে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই, সামনে শুধু অজানা পথ। ছাদে ঠান্ডা বাতাস আমার গায়ে লাগছে, কিন্তু আমি কিছুই অনুভব করছি না। মনটা যেন কঠিন পাথরে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।
এই ছাদে এসে দাঁড়ানোর আগে, আমি ল্যাবে ছিলাম। বছরের পর বছর ধরে নিরলস গবেষণা, অবশেষে সফল হয়েছিল। আমি সৃষ্টি করেছিলাম ‘অতীতস্ফূর্তী’ নামক এক যন্ত্র। এই যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষের চেতনাকে অতীতে পাঠানো সম্ভব। কী অবিষ্কার! কী সম্ভাবনা! ইতিহাস গবেষণায় এক নতুন দিগন্ত খুলে যাওয়ার কথা! কিন্তু আমি উচ্ছ্বাসে আত্মহারা হয়ে যাইনি। জানতাম, এই যন্ত্রের সঙ্গে নৈতিক দিকটাও বিবেচনা করা দরকার। তাই কঠোর নিয়মকানুন ঠিক করেছিলাম। অতীতে পাঠানো যাবে কেবলমাত্র পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে। কোনো পরিস্থিতিতে সেই সময়ের ঘটনাবলিতে কোনো পরিবর্তন আনা যাবে না।
কিন্তু আবেগ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। খুব কাছের এক মানুষের জন্য, একটা ভুলের ফল সারিয়ে দেওয়ার জন্য, নিয়ম ভঙ্গ করে ফেলেছি। অতীতে পাঠিয়েছি তাকে। অতীত যেখানে পরিবর্তন সৃষ্টি করলে, বর্তমানে ভয়াবহ ফল হতে পারে।
এখন ছাদে দাঁড়িয়ে, আকাশের তারাগুলোর দিকে চেয়ে ভাবছি, আমি কী করেছি! হয়তো সব শেষ। হয়তো আমার এই একটা সিদ্ধান্ত পুরো মানবসমাজের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। ভবিষ্যৎ এখন এক অজানা, অন্ধকার গর্ত।
কিন্তু হঠাৎ মনে পড়ে গেল, প্রফেসর সেন। আমার গুরু, যিনি সবসময় আমাকে সঠিক পথে চলতে শিখিয়েছেন। তিনিই বলেছিলেন, “বিজ্ঞানের পথ কঠিন, কিন্তু আশা হারানো যাবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে সমাধান খুঁজতে হবে।”
প্রফেসর সেন আর নেই। কিন্তু তার কথাগুলো আমার মাঝে জেগে উঠেছে। না, আমি হাল ছাড়ব না। হয়তো এখনো সময় আছে সব ঠিক করে ফেলার। আমি ল্যাবে ফিরে যাব। ল্যাবে ঢুকেই চোখে পড়ল কন্ট্রোল প্যানেলের ঝলকানি লাল আলো। এটা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। ‘অতীতস্ফূর্তী’ যন্ত্রটির সঙ্গে কোনো সমস্যা হয়েছে, সেটা স্পষ্ট। জরুরি অবস্থা মোড সক্রিয় হয়েছে। কম্পিউটারে লগ ইন করে ডাটা দেখলাম, অতীতে পাঠানো ব্যক্তির চেতনা ফিরিয়ে আনার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
প্যানিক না হওয়ার চেষ্টা করলাম। গভীর শ্বাস নিয়ে সমস্যাটা সমাধানের চিন্তা করতে শুরু করলাম। ‘অতীতস্ফূর্তী’ এতটা জটিল যন্ত্র যে, এর সমস্যা নিজে সমাধান করা কঠিন। কিন্তু অন্য কোনো উপায় নেই। সহকারীদের ডাকার সময় নেই। নিজের জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা দিয়েই সমাধান খুঁজতে হবে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেল। ঘামে ভিজে গেছে গা। কিন্তু হাল ছাড়িনি। অবশেষে, একটি পুরোনো গবেষণাপত্রের কথা মনে পড়ল, প্রফেসর সেনের লেখা। সেখানে তিনি একটি বিকল্প সংযোগ পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেছিলেন।
সেই গবেষণাপত্রটি হাতে নিয়ে আগ্রহে পড়তে শুরু করলাম। পদ্ধতিটা ছিল জটিল, ঝুঁকিপূর্ণ। এটা এমন এক পদ্ধতি যা কখনো পরীক্ষা করা হয়নি, কিন্তু অন্য কোনো উপায় না থাকায়, চেষ্টা করে দেখা ছাড়া আর কোনো অপশন ছিল না।
পদ্ধতি অনুযায়ী, যন্ত্রের কয়েকটা কম্পোনেট খুলে ফেললাম। তারপর নিজের তৈরি করা একটা অস্থায়ী সংযোগকারী ডিভাইস লাগালাম। হাত কাঁপছিল, কিন্তু থামা যাবে না। সবশেষে, সবকিছু সেটআপ করার পর, কন্ট্রোল প্যানেলে একটা বাটন টিপলাম।
কয়েকটা সেকেন্ডের জন্য কিছুই হলো না। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। ব্যর্থ হয়েছি কি? ঠিক সেই সময়, প্যানেলে জ্বলে উঠলো সবুজ আলো। জরুরি অবস্থা মোড নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল।
আমি চিৎকার করে উঠলাম, আনন্দে, উচ্ছ্বাসে। সফল হয়েছি! কিন্তু খুশি হওয়ার সময় এখনো হয়নি। এখন জরুরি ছিল অতীতে পাঠানো ব্যক্তিকে ফিরিয়ে আনা।
পুনরায় কন্ট্রোল প্যানেলের সাথে সংযোগ স্থাপন করলাম। এবার স্ক্রিনে দেখা গেল, ঝাপসা ছবি। অতীতে আটকে থাকা ব্যক্তিটির চেহারা পরিষ্কার নয়, তবে সন্দেহ নেই সেই আমিই তাকে পাঠিয়েছিলাম।
গভীর শ্বাস নিয়ে, ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করলাম। এটাও ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। নতুন পদ্ধতির কারণে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। কিন্তু এখন আর কোনো বিকল্প ছিল না। কিছুক্ষণ পর, যন্ত্রের চারপাশে আলোর ঝলকানি শুরু হল। ধীরে ধীরে সেই ঝলকানি আরও তীব্র হতে লাগল। হঠাৎ, শব্দটা হলো। একটা ঝাঁকুনি খেল ল্যাবটা। ধুলো উড়ে গেল সবদিকে। আমি চোখ খুললাম। যন্ত্রের ঠিক সামনেই পড়ে আছেন সেই ব্যক্তি। নিঃশ্বাস নিতে পারছিলেন না, চোখ দুটো বন্ধ। তৎক্ষণাৎ কাছে গিয়ে তাকে ধাক্কা দিলাম। কয়েক সেকেন্ড পর, চোখ খুললেন তিনি। অ বিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকালেন।
“সায়না? আমি কোথায়? কি হলো?”
আমি জানতাম, সব ঠিক না। এই অবিশ্বাসের চোখ, এমন অভিব্যक्ति, আমি আগে কখনো দেখিনি। আমার মনে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। হয়তো আমি সফল হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু ফিরিয়ে এনেছিলাম এক ভিন্ন ব্যক্তিকে।
শীতল স্রোতটা আমার মেরুদণ্ড ধরে ধরে মাথায় উঠে গেল। অবিশ্বাসের চোখে তাকিয়ে থাকা সেই ব্যক্তিটির হাত বাড়িয়ে দিলাম। ধীরে ধীরে সে উঠে দাঁড়াল। আমার চেনা মানুষটার চেহারাটা তারই ছিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টি, শরীরের ভঙ্গি, সবকিছুই একটু আলাদা।
“আপনি কে?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কণ্ঠটা কাঁপছে।
“আমি কে? তুমি কি আমাকে চিনতে পারছ না, সায়না?” সে আমার নাম জানে! কীভাবে? আমি কি আসলেই ভুল কোনো ব্যক্তিকে ফিরিয়ে এনেছি?
“না, চিনতে পারছি না।” আমি স্বীকার করলাম। “কিন্তু আপনি কীভাবে আমার নাম জানেন?”
“আমি তোমার বন্ধু।” সে বলল, কিন্তু তার কথায় কোনো আন্তরিকতা ছিল না।
আমি জানতাম, আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। এই লোকটা ঠিক আমার চেনা মানুষটা নাও হতে পারে। কিন্তু কে সে, আর কীভাবে অতীতে চলে গিয়েছিল, সেটা বের করতে হবে।
“আচ্ছা,” আমি বললাম, “আপনি যদি আমার বন্ধু হন, তাহলে অবশ্যই জানবেন আমি কে।”
সে কিছু না বলে আমার দিকে চেয়ে রইল। তার চোখে একধরণের অস্বস্তি ফুটে উঠল। “আমি…” সে থামল। “আমি…”
“আপনি কিছু মনে করবেন না,” আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম। “আপনি হয়তো একটা দুর্ঘটনায় পড়েছেন। মনে করতে পারছেন না।”
সে মাথা নাড়ল। “না, কোনো দুর্ঘটনা হয়নি।”
“তাহলে?”
“আমি…” সে আবার থামল। তার মুখের একপাশে একটা পেশী টান পড়ল। “আমাকে কিছুটা সময় দিন। হয়তো সব মনে পড়বে।”
আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম। এই অজানা লোকটাকে কি আমি ছেড়ে দেব? না কি সাহায্য করব? কিন্তু কীভাবে সাহায্য করব?
এর মধ্যে সে জিজ্ঞাসা করল, “আমরা কোথায় আছি?”
“আমার ল্যাবে।” আমি উত্তর দিলাম।
“ল্যাব?” সে ঘুরে ল্যাবের দিকে তাকাল, চোখে অবাক চাহনি। “এটা কী জায়গা?”
আমি নিজের গবেষণা, অতীতস্ফূর্তী যন্ত্রের কথা, কিছুই তাকে বলতে পারি না। এখনো জানি না সে কে, কোন দলের লোক। হয়তো সবটা জানলেই অতীতে যা ঘটেছে, তার আরো কিছুটা খুঁজে বের করতে পারব।
“এটা গুরুত্বপূর্ণ না,” আমি বললাম। “আপনি এখন একটু বিশ্রাম নিন।”
আমি একটা চেয়ার দেখিয়ে দিলাম। সে চুপ করে বসল।
আমি ল্যাবের এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। মাথাটা ছেঁকে গিয়েছিল। কী করা উচিত, বুঝতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় প্রফেসর সেনের কথা মনে পড়ে গেল আবার। তিনি বলতেন, “বিজ্ঞানের পথ কঠিন, কিন্তু আশা হারানো যাবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতে সমাধান খুঁজতে হবে।” হ্যাঁ, ঠিকই। আশা হারানো যাবে না। আমি এই সমস্যাও সমাধান করব। কিন্তু কিভাবে? অতীতস্ফূর্তী যন্ত্র সম্পর্কে এই লোকটাকে কিছু না জানানোই নিরাপদ। তাহলে কিছু গোঁ ধরে ধরেই তথ্য আঁটকাতে হবে। প্রথমে, তার পরিচয় জানতে হবে।
আমি তার কাছে ফিরে গিয়ে বললাম, “আপনি যখন মনে পড়বেন, তখন আমাকে জানাবেন। আর একটা জিনিস, আপনার নামটা কি?”
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর মৃদু স্বরে বলল, “আমার নাম আকাশ।”
আকাশ! সেই নামটা আমার চেনা লাগল। কিন্তু কোথায় শুনেছি, মনে পড়ছে না। আমি কম্পিউটারে ঢুকে প্রফেসর সেনের লেখা নথিগুলো ঘাঁটতে শুরু করলাম। হয়তো কোনো ঐতিহাসিক তথ্যের মধ্যে এই নামটা আছে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম নথিগুলো পড়ে। অবশেষে, একটা পুরোনো ডায়েরির পাতায় চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা ছিল, “আজ আকাশ নামের এক অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলো। সে…”
আমি পড়তে থাকলাম। অবাক হয়ে গেলাম। এই আকাশ, যে অতীতে চলে গিয়েছিল, সে এক বিখ্যাত সময়-অপরাধী! সে ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে গিয়ে ইতিহাস পরিবর্তন করার চেষ্টা করত।
আমার রক্ত শীতল হয়ে গেল। আমি এমন এক ভয়ঙ্কর লোককে ফিরিয়ে এনে ফেলেছি! এখন কী করা উচিত?
হঠাৎ, আমার চোখ পড়ল প্রফেসর সেনের আর একটি লেখায়। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, “যদি কোনো ভুল করে অবাঞ্ছিত ব্যক্তি অতীতে চলে যায়, তাহলে তাকে আবার ফেরত পাঠানোর জন্য একটি বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এই পদ্ধতি খুবই জটিল এবং ঝুঁকিপূর্ণ।”
এই ছিল একমাত্র সমাধান! আমি সেই বিশেষ পদ্ধতিটা আবার পড়তে শুরু করলাম। এটা ছিল অতীতস্ফূর্তী যন্ত্রের সাথে আর একটি যন্ত্র যুক্ত করার প্রক্রিয়া। সেই যন্ত্রটি অতীতে পাঠানো ব্যক্তির স্মৃতি উদ্ধার করতে সাহায্য করবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এই যন্ত্রটি তৈরি করার জন্য আমার অনেক সময় লাগবে। আর আকাশের কাছে আমার গোপনীয়তা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে।
আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তাকে এখানে আটকে রাখতে হবে। কিন্তু কীভাবে? আমার মনে একটা চিন্তা এলো।
আমি আকাশের কাছে গিয়ে বললাম, “আকাশ, আপনার এই দুর্ঘটনায় কিছুটা মেমরি লস হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আপনাকে একটা স্মৃতি উদ্ধারের টেস্ট করতে হবে। ঠিক হয়ে গেলে, আপনি নিজের বাড়ি ফিরে যেতে পারবেন।”
আকাশ একটা চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকাল। সন্দেহের চোখে সে জিজ্ঞাসা করল, “কী ধরনের টেস্ট?”
আমি নিজের সেরা অভিনয় কাজে লাগিয়ে বললাম, “এটা খুবই সহজ। আমরা আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব। আপনার অতীতের স্মৃতি ফিরে এলেই আপনি বাড়ি যেতে পারবেন।”
আকাশ কিছুটা সময় চুপ করে থাকল। তারপর সে মাথা নাড়ল। “না, আমার কোনো টেস্ট দিতে ইচ্ছে নেই। আমি এখনই বাড়ি যেতে চাই।”
আমি জানতাম, সে যেতে চাইবে না। তাই, আমার পরের পদক্ষেপটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম। ল্যাবের কোণে একটা বিশেষ ডিভাইস ছিল, যা অস্থায়ভাবে চলাফেরা বন্ধ করে দেয়। আমি দ্রুত সেই ডিভাইসটা সক্রিয় করে দিলাম।
আকাশ চমকে উঠল। সে উঠে দাঁড়াতে চাইল কিন্তু পারল না। চারপাশটা ঘুরতে লাগলো তার চোখ।
“কী করছো তুমি?” সে চিৎকার করে উঠল। কিন্তু তার চিৎকারের কোনো সাড়া পেলাম না।
“আপনাকে একটু থামতে হবে, আকাশ,” আমি উত্তর দিলাম, চেষ্টা করে যতটা সম্ভব শান্ত থাকার। “আপনার স্মৃতি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি আপনাকে এখানে রাখতে বাধ্য হচ্ছি।”
আকাশ রাগে গর্জাতে লাগল। সে আমাকে হুমকি দিতে শুরু করল। কিন্তু আমি তার কথায় কান দিলাম না। আমি জানতাম, ইতিহাসের সাথে ছিনিমিনি খেলা করার পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে।
এরপরের কয়েকটা দিন খুবই কঠিন ছিল। আকাশের স্মৃতি উদ্ধারের টেস্ট নিতে শুরু করলাম। কিন্তু সে সবকিছুই অস্বীকার করতে থাকল। সে এমনকী আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টাও করল। কিন্তু ধীরে ধীরে, কৌশলে তার কাছ থেকে কিছু তথ্য আঁটকাতে সক্ষম হলাম।
শেষ পর্যন্ত, প্রফেসর সেনের লেখা অনুযায়ী, অতিরিক্ত যন্ত্রটি তৈরি করতে সক্ষম হলাম। যন্ত্রটি আকাশের মাথায় লাগানো হলো। যন্ত্রটি কাজ করতে শুরু করল। আকাশ চিৎকার করতে লাগল। তার চোখ দিয়ে জল চলছিল।
একটা সময় পরে, যন্ত্রটি বন্ধ করে দিলাম। আকাশ চুপ করে বসেছিল। তার চোখে এক অন্য দৃষ্টি।
“আমি সব মনে পড়ছি,” সে কাঁটা গলায় বলল। “আমি ভুল করেছি। আমি অতীত পরিবর্তন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, এর ফল ভয়াবহ হতে পারত।”
আমি তার কাছে গিয়ে বললাম, “আপনি যদি আন্তরিকভাবে অনুতাপ করেন, তাহলে আপনাকে সাহায্য করব।”
আকাশ আমার দিকে চোখ তুলে তাকাল। তার চোখে অবাক চাহনি। “কীভাবে?”
“আপনি আমাকে অতীতে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করবেন।”
আকাশ চমকে উঠল। “আবার অতীতে? কেন?”
“আপনি যে সময়কালে যেতে চেয়েছিলেন, সেই সময়কালে কোনো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা না করে, কেবল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন। সেই সময়ের মানুষের সাথে কোনো যোগাযোগ করবেন না।”
আকাশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সে গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “ঠিক আছে। আমি আপনাকে সাহায্য করব।”
আমি জানতাম, এটা বিশাল ঝুঁকি। কিন্তু আকাশের স্মৃতি উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় তার আন্তরিকতা দেখে আমার বিশ্বাস হয়েছিল, সে সত্যিই ভুল করেছে বুঝতে পেরেছে। দিন-রাত এক করে কাজ করলাম। অতীতস্ফূর্তী যন্ত্র আর নতুন তৈরি করা যন্ত্র দুটিকে একত্রিত করলাম। এবারের পদ্ধতিটা আরো জটিল ছিল। অবশেষে, সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। আমি আকাশকে যন্ত্রের সামনে বসলাম।
“আপনি প্রস্তুত?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
আকাশ মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ।”
আমি যন্ত্রটি সক্রিয় করলাম। ল্যাবটা ঝলকানি মুখর হয়ে উঠল। আকাশ চিৎকার করে উঠল। কিন্তু এবার তার চিৎকারের সঙ্গে মিশে গেল ভয়, অনুতাপ আর একটু আশা। কয়েক সেকেন্ড পরে সবকিছু থেমে গেল। ল্যাবটা নিস্তব্ধ। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। সফল হয়েছি কি না, জানি না।
কিন্তু হঠাৎ, শব্দটা হলো। কেউ যেন ল্যাবের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছিল। আমি দরজা খুলে দিলাম।
আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এবার তার চোখে এক অন্য রঙ। সে হাসল।
“আমি ফিরে এসেছি।” সে বলল। “আমি আর কোনো ভুল করব না।”
আমিও হাসলাম। হয়তো বিজ্ঞানের পথ কঠিন, কিন্তু আশা হারানো যায় না। এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, বিজ্ঞানের শক্তি যেমন অসাধারণ, তেমনি এর দায়িত্বও গুরুত্বপূর্ণ। অতীত পরিবর্তন করা নয়, বরং অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া, এটাই হলো সঠিক পথ।