কলকাতার বুকে, পুরোনো বাড়ির ছাদে বসে আছি, ঊর্ধ্বশ্বাসে। চারপাশে গঙ্গার কোलाহল, আর তার উপরে ঝলমলে চাঁদ। আজ পূর্ণিমা, আকাশটা যেন এক টুকরো সাদা কাপড়ের উপর রূপোর জল ঢাল। কিন্তু, আমার মনটা কোন রকম শান্তিতে নেই। একটু আগে, মা আমার হাত ধরে এই ছাদে এনে বসিয়েছেন। চোখে জল, কিন্তু কথা বলছেন না। আমি জানি, কী হয়েছে। খবর এসেছে, জাহাঙ্গীর আর ফিরছে না। পাকিস্তানে যাওয়ার পর, আর কোনো খোঁজ নেই তার।
জাহাঙ্গীর ছিল আমার শৈশবসখা। পাশের বাড়ির ছেলে। সেই ছোটবেলায় গাছের ডালে চড়া, পুকুরে সাঁতার, সব একসাথে করতাম। বয়স বাড়ার সাথে সাথে, বন্ধুত্বটা প্রেমে রূপ নিয়েছিল। কিন্তু, এই দেশভাগের ঝড়ে সব উড়িয়ে গেল। হিন্দু-মুসলমান, দুই ধর্মের মাঝে টানাটানি। শেষমেশ, জাহাঙ্গীর তার পরিবারের সাথে পাকিস্তান চলে গেল। যেতে রাজি ছিলাম না আমি। কিন্তু, বাবা তখন জেলে। মা একা, কোথা যেতাম?
এখন জানি, সে আর ফিরবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। এই চাঁদের আলোয়, কত স্বপ্ন দেখেছি আমরা দু’জনে! কত রাত কাটিয়েছি তার সাথে গল্প করে! আর এখন, শুধু একটা বিশাল শূন্যতা।
মা আমার কাছে এসে বসলেন। হাতটা আমার হাতের মধ্যে নিলেন। “শান্তি কর, মায়ের মণি,” বললেন, কিন্তু গলা ভারী। আমি কিছু বলতে পারলাম না। কী বলব? জীবন এতটা নিষ্ঠুর হবে, ভাবিনি কোনোদিন।
কয়েকটা দিন কাটলো এমনি করেই। মা কাঁদতেন, আর আমি স্তব্ধ হয়ে থাকতাম। একদিন, খবর এলো দাদুর কাছ থেকে। সে লিখেছে, কলকাতার কাছেই একটা ছোট্ট গ্রামে থাকতে পারি আমরা। সেখানে একটা জমি আছে আমাদের, কিন্তু কেউ দেখভাল করেনি বছরের পর বছর। দাদু লিখেছে, সে জমিটা ঠিক করে দেবে, আর আমরা চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারব।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - প্রতিদ্বন্দ্বী: মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প - প্রতিদ্বন্দ্বী, সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত জীবন যুদ্ধের দুই যোদ্ধার একদিনের জীবন সংগ্রামের ঘটনা। সম্পুর্ন্য বাংলা অনুপ্রেরণামূলক ছোট গল্পটি পড়ুন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মা-কে খবরটা শোনালাম। প্রথমে কিছুটা দ্বিধা ছিল, কিন্তু শেষমেশ রাজি হলেন। আমরা কলকাতা ছেড়ে চলে গেলাম।
গ্রামের জীবন অনেকটাই আলাদা ছিল। শহুরের কোলাহল নেই, শুধু পাখির ডাক আর গাছের সোঁসোঁ শব্দ। কিন্তু, নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়াটা কঠিন হলো। মা আগে কখনো কাজ করেননি। কিন্তু, এখন তাকেও মাঠে নেমে কাজ করতে হচ্ছে। আমিও শিখছি, জমি চাষ করতে। কাজটা মোটেই সহজ ছিল না। রোদে পুড়ে, মাটি কামড়ে কাজ করতে শরীরটা ব্যথা হয়ে উঠত। কিন্তু, জীবনটা চালাতে হবে তো! ধীরে ধীরে শিখে গেলাম। প্রথমে লাঙ্গল চালানোটাও কঠিন লাগত, কিন্তু পরে অভ্যাস হয়ে গেল। মাও আস্তে আস্তে মানিয়ে নিলেন গ্রামের জীবন।
একদিন, মাঠে কাজ করছিলাম, এমন সময় একটা ছেলে দেখা গেল। বয়স আমার কাছাকাছিই। হাতে লাঙ্গল নিয়ে মাঠের এক কোণে কাজ করছিল। কাছে এসে নিজের পরিচয় দিল সে। নাম সোম। পাশের গ্রামের ছেলে, মাঝেমধ্যে এই মাঠে কাজ করতে আসে। দেখে মনে হলো বেশ লাজুক ছেলে। কিন্তু, কাজটা বেশ ভালো পারত।
সেদিনের পর, মাঝেমধ্যে দেখা হতো সোমের সাথে। একসাথে কাজ করতে করতে গল্প হতো। সে আমাকে গ্রামের নানা কিছু বলতো, আর আমি তাকে শহুরের কথা বলতাম। ধীরে ধীরে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো আমাদের মধ্যে। সোম আমাকে অনেক কিছু শেখালো – কীভাবে ফসল ফলাতে হয়, গাছ লাগাতে হয়। আমিও তাকে শেখালাম কয়েকটা বাঙালি রান্না।
একটা বিকেলে, মাঠে কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিলাম, এমন সময় সোম আমার পাশে এলো। একটু থেমে থেমে বললো, “আজ্ঞে, আপনি কি আমার সাথে…” সে কথাটা শেষ করতে পারল না। থমকে গেল। বুঝলাম, কিছু বলতে চায়। আমি হেসে বললাম, “কী বলতে চাও, সোম?”
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - শেষ জমিদারের মেয়ে: ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প: এক জমিদার কন্যার গল্প, যে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর নিজের পায়ে দাঁড়ায় এবং গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
সে একটু লজ্জা দিয়ে বললো, “আপনি কি…পুজোয় আমার বাড়িতে আসবেন?”
আমার একটু অবাক লাগলো। কিন্তু, তার সাদাসিধে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কোনো খারাপ ইচ্ছা নেই তার। তাই বললাম, “ঠিক আছে, আসব।”
পুজোর আগে সোম এসে মা-কে জানালো, আমাকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করার কথা। মা একটু দ্বিধায় পড়লেন। কিন্তু, সোমের পরিবারের সুনাম শুনেছেন গ্রামের অন্যান্য কাছের মানুষের কাছ থেকে। তাই রাজি হলেন।
পুজোর দিনে, সোমের বাড়িতে গিয়ে দেখি, একটা ছোট্ট, কিন্তু পরিষ্কার বাড়ি। সোমের বাবা-মা, দুই বোন, সবাই আমাকে সাদরে বরণ করলেন। পুজোর প্রসাদ খেলাম, গল্প গল্প করলাম। সারাদিনটা বেশ ভালো কাটলো।
ফিরতি পথে সোমের সাথে হাঁটছিলাম। চাঁদের আলোয় সারা গ্রামটা ঝকমকাচ্ছে। হঠাৎ, সোম বললো, “আজ্ঞে, আপনি জানেন…” সে কথাটা শেষ করতে পারল না আবার। হাসি আমার চাপা দিতে পারলাম না।
“কী জানি না, সোম?”
“আপনি…আপনি আমার কাছে…” সোম থেমে গেল, চোখ দুটো নীচের দিকে ফেলে রাখল।
আমি একটু ইতস্ততা করলাম। জাহাঙ্গীরের কথা মনে এলো। কিন্তু, এই গ্রামের জীবনে, সোমের সরলতা আর সাহায্যের কথাও মনে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, “সোম, জাহাঙ্গীর ছিল আমার শৈশবের বন্ধু। কিন্তু…” আমি থেমে গেলাম।
সোম মাথাটা তুলে আমার দিকে তাকালো। “কিন্তু, এখন সে নেই।” কথাটা শেষ করল সে আমার জন্য।
আমি মাথা নাড়লাম। “না, সে নেই। কিন্তু, আমার মনটা এখনো একটু…”
“আমি বুঝি,” সোম মাঝখানে ঢুকে পড়ল। “আপনার মনটা এখনো জাহাঙ্গীরের কাছেই আছে। কিন্তু, আমি…” সে একটু থামলো, “আমি আপনার পাশে থাকতে চাই। আপনার দুঃখে-সুখে।”
আমি চুপ করে রইলাম। সোমের কথাগুলো আমার মনে একটা ঢেউ খেলালো। এতদিন পর, কেউ একজন আমার পাশে থাকতে চায়, সেটা ভাবতেই অদ্ভুত লাগছিল।
চাঁদের আলোয় সোমের মুখটা দেখতে পারছিলাম। তার চোখে একটা আগ্রহ, একটা আশা ঝলমল করছিল। আমি জানতাম, এই মুহূর্তে আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একটা ঠান্ডা বাতাস এসে আমার গালে লাগল। চারপাশের গ্রামটা নিশ্চুপ। আমার মনে জাহাঙ্গীরের স্মৃতি আর সোমের সরল মুখখানা দুটোই ঘুরপাক খেলো। শেষমেশ, একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বললাম, “সোম, আমি একটু সময় চাই।” কথাটা বেরিয়ে যাওয়ার পরে মনে মনে নিজেকেই একটু ধমক লাগলো। সময়টা ঠিক কী নিয়ে চাই, নিজেরই বোধহয় জানা নেই। জাহাঙ্গীরের স্মৃতি এখনো মনকে আঁকড়ে ধরে আছে, কিন্তু সোমের সততা আর সাহায্য অস্বীকার করার মতোও না।
পরের কয়েকটা দিন বেশ ঘোলাটে কাটলো। সোমের সঙ্গে দেখা হলেও, আগের মতো হাসি-গল্প থাকলো না। মাঝেমধ্যে চোখে চোখ পড়লে, সোমের মুখে একটা হতাশা দেখতে পেতাম, আর আমার বুকে একটা অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়তো।
একদিন, সন্ধ্যাবেলা গোবধনে দুধ দোঁহন করছিলাম, এমন সময় মা এসে পাশে দাঁড়ালেন। চুপ করেই একটু সময় থাকলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে রে, মায়ের মণি? কয়েকদিন ধরে একটু ছেমছামে আছিস।”
মায়ের কথায় চোখ দুটো ভিজে এলো। সবটা ঠিক সেভাবে বলা কঠিন হলেও, সোমের কথা আর আমার দ্বিধা মা’কে জানালাম। মা চুপ করে শুনলেন, তারপর হাতটা আমার মাথায় দিয়ে বললেন, “মনটা কী বলছে, সেটাই শোন। জাহাঙ্গীরের স্মৃতি তো রয়েই যাবে, কিন্তু জীবনটা থেমে থাকবে না। সোম ভালো ছেলে, তোকে সুখে রাখবে। আর একটা জিনিস, সময় নিয়ে ভুল করিস না, মায়ের মণি।”
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - স্বপ্নের রূপে ঝঙ্কার: শিউলি, এক গ্রামের মেয়ে, তার অসাধারণ গানের প্রতিভা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে। কিন্তু খ্যাতির পথে তাকে অতিক্রম করতে হয় অনেক বাধা। এই অনুপ্রেরণামূলক গল্পে দেখুন কীভাবে সে তার স্বপ্ন পূরণ করে এবং সকলের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মা’র কথাগুলো আমার মনে একটা আলো জ্বালিয়ে দিল। হ্যাঁ, জাহাঙ্গীরের স্মৃতি সবসময়ই থাকবে, কিন্তু জীবনটা তো চলতেই থাকবে। আমি সোমকে আর একটা সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
পরের দিন, মাঠে কাজ করছিলাম, এমন সময় সোম এসে হাজির। আগের মতো হাসি না থাকলেও, তার চোখে একটা আশা ঝিলমিল করছিল।
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম, “সোম, আমি…” এবার কথাটা থামলাম না। “আমি তোমার পাশে থাকতে চাই। তোমার সঙ্গে জীবনটা কাটাতে চাই।”
সোমের মুখখানা আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আমার হাতটা ধরে বললো, “আমি জানতাম, আপনি একদিন…” আমি হেসে তাকে থামিয়ে দিলাম।
চাঁদের আলোয় সেদিন আমরা দু’জনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। জাহাঙ্গীরের স্মৃতি আর সোমের সঙ্গ, দুটোই আমার জীবনের অংশ। একদিকে অতীতের প্রেম, অন্যদিকে হয়তো ভবিষ্যতের সুখ। আমি জানতাম না, জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সোমের হাত ধরে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হলো। চাঁদের আলোয় ঢাকা গ্রামের পথে আমরা দু’জনে পাশাপ
চাঁদের আলোয় ঢাকা গ্রামের পথ ধরে আমরা দু’জনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকলাম। সোমের হাতটা আমার হাতে জড়িয়ে ছিল, একটা নতুন নিশ্চিন্ততা এনে দিল সেটা। হয়তো আমার ভুল হয়েছে, হয়তো জাহাঙ্গীরের স্মৃতি চিরকাল আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকবে, কিন্তু সোমের সঙ্গে থাকতেও একটা শান্তি আছে। জীবনের এই চড়াই-উৎরাই পথে একটা সঙ্গী পাওয়াটা কিছু কম নয়।
কয়েকটা মাস পর, সোমের বাড়িতে বিয়েটা হলো। খুব জাঁকজমক নয়, তবে গ্রামের রীতি মেনেই সাজানো হলো সব। মা ভীষণ খুশি ছিলেন। সোমের পরিবারও আমাকে আপন করে নিল।
জীবনটা সহজ হয়ে গেল না, কিন্তু আগের চেয়ে সহনীয় হয়েছিল। সোমের সঙ্গে মাঠে কাজ করতে আরও মজা লাগতো। একসাথে লাঙ্গল চালাতাম, ফসল কাটতাম, গাছপালা লাগাতাম। মাঝেমধ্যে ঝগড়া হতো, কিন্তু শেষমেশ হাসিই হতো জয়ী।
কয়েক বছর পর, আমাদের একটা ছেলেমেয়ে হলো। সোম ছেলেকে রাজা আর মেয়েকে লক্ষ্মী নাম দিল। সন্তানদের হাসি আর কান্না, সারা বাড়ি ভরে যেত। মাঝেমধ্যে, রাতে চাঁদের আলোয় সোমের সাথে ছাদে বসে আমরা পুরনো কথা বলতাম। জাহাঙ্গীরের কথাও ওঠে মাঝেমধ্যে, কিন্তু কোনো দুঃখ ছিল না এবার। শুধু একটা স্বীকৃতি, যে জীবনের প্রতিটা অধ্যায়েরই একটা অর্থ আছে।
এখন, বছরের পর বছর কেটে গেছে। সোম আর আমি বুড়ো হয়ে গেছি। ছেলেমেয়ে বড় হয়ে নিজের জীবনে চলে গেছে। মাঝেমধ্যে, সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে, চাঁদের আলোয় ঢাকা গ্রামের পথটা দেখি। কত কিছু ঘটে গেছে এত বছরে! কিন্তু, একটা জিনিস বদ হয়নি – সোমের হাতটা এখনো আমার হাতে জড়িয়ে থাকে। আর সেই হাতে ধরেই, আমরা এগিয়ে গেছি, একসাথে।