সন্ধ্যার আলো ধীরে ধীরে নিভে আসছে, আর সেই সাথে থালিয়ার হৃদয়ের অস্থিরতাও যেন ক্রমশ বাড়ছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরের ম্লান আলো চোখে পড়ছিল, আর মনে হচ্ছিল যেন অদূর ভবিষ্যতের কোনো সংকেত। ঘরের ভেতর ছড়িয়ে থাকা অগোছালো থালাবাসন, খাবারের টেবিলে পড়ে থাকা গতকালকের কাগজ, সব কিছুই একরকম নিস্তব্ধতার মধ্যে ঢাকা। কিন্তু থালিয়ার মনের ভেতর একেবারে তোলপাড়। এ যেন নিত্যদিনের সঙ্গী।
সে জানে, আজ রাতটা স্বাভাবিক হবে না। ইংল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ চলছে, আর তার স্বামী মার্ক—যাকে সে একসময় খুব ভালোবেসেছিল—ফুটবলের কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন মানুষে পরিণত হয়। টিভির সামনে বসে থাকা মার্কের রাগ আজ আবার বেড়ে উঠবে, যদি ইংল্যান্ড ভালো না খেলে। আর সেই রাগের শিকার হতে হবে তাকে এবং তার ছোট মেয়ে গাব্বিকে। এই ভয় তাকে প্রতিদিন একটু একটু করে গ্রাস করছে।
থালিয়া একসময় মার্ককে ভালোবাসতো। তারা যখন প্রথম দেখা করে, মার্ক ছিল মজার, প্রাণবন্ত একজন মানুষ। তার চোখে ছিল জীবনকে উপভোগ করার এক অদ্ভুত আগ্রহ, যা থালিয়াকে তার প্রতি আকর্ষিত করেছিল। তাদের প্রথম দিনগুলো ছিল স্বপ্নের মতো—সিনেমা দেখা, রেস্টুরেন্টে খাওয়া, একে অপরের হাত ধরে হাঁটা। কিন্তু বিয়ের পর থেকে, সবকিছু বদলে যেতে থাকে। প্রথমদিকে, ফুটবল নিয়ে মার্কের উত্তেজনা শুধু উত্তেজনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল, কিন্তু পরে তা ক্রমেই রাগ আর হতাশায় পরিণত হতে থাকে। ইংল্যান্ডের হার যেন তার জীবনের সবকিছু শেষ করে দেয়। আর সেই হতাশার চাপ এসে পড়ে থালিয়ার ওপর।
আজকের দিনটা আলাদা নয়। গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়, ঘামে ভেজা শরীর নিয়ে কাজ শেষ করে সে ঘরে ফিরে আসে। ছোট্ট গাব্বি পড়ার টেবিলে বসে, মুখে চিন্তিত ভাব। মেয়েটাও যে এই ভয়ের পরিবেশে বড় হচ্ছে, সেটা থালিয়া ভালো করেই জানে। কিন্তু কিছুই করার নেই, গাব্বির নিরাপত্তার জন্য এই ভয়ংকর সম্পর্ককে সে মেনে নিয়েছে।
রান্নাঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে থালিয়া ধীরে ধীরে চিন্তা করতে থাকে তার নিজের জীবন নিয়ে। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব যেন তার একার উপর এসে পড়েছে। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্বপ্নগুলো অনেক দিন আগেই হারিয়ে গেছে। নার্সের চাকরি থেকে যে সামান্য আয় আসে, তাতে কোনোমতে সংসার চলে, কিন্তু বকেয়া বিলগুলো প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। ফুটবলের খেলোয়াড়রা কোটি কোটি টাকা আয় করছে, আর সে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করার জন্য সংগ্রাম করছে। এই বৈপরীত্য তাকে আরও অবসাদগ্রস্ত করে তুলছে।
কিছুক্ষণ রান্না করার পর, সে টিভির দিকে চোখ রাখে। মার্ক গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাচ দেখছে। তার মুখের রেখাগুলো শক্ত হয়ে গেছে, যেন যেকোনো মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। থালিয়া এই অবস্থাটা খুব ভালো চেনে। ইংল্যান্ড যদি হেরে যায়, মার্কের রাগ আর হতাশা পুরো ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়বে।
“গাব্বি, খাবার খেয়ে নিয়েছিস তো?” থালিয়া মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে।
গাব্বি আস্তে করে মাথা নাড়ে। তার চোখের কোণে ভয় আর দুশ্চিন্তা স্পষ্ট। এই বাচ্চাটার ওপরও তো প্রতিদিন এই মানসিক অত্যাচারের প্রভাব পড়ছে। থালিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, সে কিছু একটা করবেই, তবে ঠিক কখন, কীভাবে, সেটা সে এখনও জানে না।
ম্যাচের উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। থালিয়া রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। বাইরের বাতাসও যেন আজ থমথমে। তার বুকের ধুকপুকানি বাড়ছে, যেন যেকোনো মুহূর্তে কিছু একটা ঘটে যাবে। সে মার্কের দিকে তাকায়। তার চোখে লালসা আর ক্রোধের ছায়া। এই মানুষটাকে সে আর চিনতে পারে না। এই মানুষটার সাথে একসময় সে নিজের জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখেছিল? কীভাবে এত দ্রুত সবকিছু বদলে গেল?
“ইংল্যান্ড যদি আজ হারে…” থালিয়া মনে মনে বলে ওঠে, কিন্তু বাক্যটা শেষ করতে পারে না। তার ভেতর থেকে শীতল একটা শিহরণ বয়ে যায়। গাব্বিকে একবার দেখে নিলো সে। মেয়েটার ঘুমানোর সময় হয়ে এসেছে।
হঠাৎ টিভি থেকে এক গর্জন ভেসে আসে—”গোল!”। থালিয়ার শরীর ঝিম ঝিম করতে থাকে। তার মনে হলো, এখনই কিছু করতে হবে। তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে, কিন্তু সে নিজেকে স্থির রাখে। রান্নাঘরের কোণে থাকা একটা ছোট স্যুটকেস সে টেনে বের করে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নিজের আর গাব্বির জন্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে গুছিয়ে রেখেছে সে। তার মনের মধ্যে একটাই চিন্তা—আজকের রাতেই তাকে পালাতে হবে।
মার্ক এখনও টিভির দিকে তাকিয়ে আছে, তার রাগ এখনও প্রশমিত হয়নি। থালিয়া চুপচাপ গাব্বির ঘরে ঢোকে। মেয়েটা তখনো পড়ার টেবিলে বসে, তার মুখে স্পষ্ট দুশ্চিন্তার ছাপ। থালিয়া আস্তে করে গাব্বির কাঁধে হাত রাখে, “গাব্বি, আমাদের যেতে হবে। এখনই।”
গাব্বি মায়ের চোখে ভয় দেখে চুপচাপ থাকে। সে কোনো প্রশ্ন করে না। মায়ের মুখের অস্থিরতা তাকে বোঝাতে দেরি হয় না যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে।
তারা দু’জন খুব সাবধানে স্যুটকেসটা নিয়ে দরজার দিকে এগোয়। বাইরে রাতের অন্ধকারে তাদের অপেক্ষা করছে এক অজানা ভবিষ্যৎ। থালিয়া জানে, এই পথে অনেক বাধা আছে, কিন্তু সে আর এই ঘরবন্দী জীবনে থাকতে চায় না। সে চায় তার মেয়ে একটা স্বাভাবিক, নিরাপদ জীবন যাপন করুক।
দরজার বাইরে পা বাড়ানোর মুহূর্তে থালিয়া শেষবারের মতো ঘুরে তাকায়। এই বাড়ির প্রতিটা দেয়াল তার জন্য এক একটা বন্দিশালা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর সেই দেয়ালের মধ্যে বন্দী হয়ে সে একদিন একেবারে মরে যাবে, যদি আজ রাতে সে না পালায়।
তাদের প্রথম পদক্ষেপটিই যেন মুক্তির শুরু। কিন্তু ভবিষ্যতের অজানা পথে হাঁটতে হলে তাকে আরও শক্ত হতে হবে।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - মুক্তির পথে প্রেম: ১৯৪৩ সালের ভারতীয় মুক্তির আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত এই ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্পে বিজয় ও সুফিয়ার প্রেম এবং সংগ্রামের কাহিনী উঠে এসেছে। বাংলা ছোট গল্পের এই অধ্যায়ে, সাহসী অভিযান ও বিপদের মধ্যে ভালোবাসা ও দেশপ্রেমের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে তাদের জীবন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
ম্যাচের উত্তেজনা
রাতের বাতাসে এক ধরনের ভারী উত্তেজনা ভাসছে। শহরের প্রতিটা কোণে কোণে যেন সেই উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, ইংল্যান্ড বনাম ক্রোয়েশিয়া—এক ম্যাচ, যা কেবল খেলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যেন একটা যুদ্ধ, একটা আশা আর স্বপ্নের লড়াই। কিন্তু থালিয়ার জীবনে এই ম্যাচ শুধুমাত্র একটা খেলা নয়, এটা তার জীবনের আরেকটি ভয়ংকর রাতের সূচনা।
ঘরে ফিরে এসে সে একবারও বিশ্রাম নিতে পারেনি। গাব্বির পড়াশোনার ব্যবস্থা করা, রান্নাবান্না, ঘর গোছানো—সব কাজের মধ্যেই ডুবে ছিল সে। রান্নাঘরে কাজ করতে করতে তার মন এক মুহূর্তের জন্যও শান্ত হয়নি। আজ রাতের ম্যাচ যে কী ভয়াবহ কিছু বয়ে আনতে চলেছে, সে তা জানে। মার্ক যখন টিভির সামনে বসে, তার চোখে সেই পরিচিত উন্মাদনা স্পষ্ট।
মার্কের ফুটবলের প্রতি উন্মাদনা এক ধরনের আসক্তি। সে চেয়েছিল একসময় নিজেও ফুটবলার হবে। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম ছিল। সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই ফুটবল তার জীবনের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে দাঁড়িয়েছে। খেলোয়াড়দের প্রতি তার একটা উদ্ভাসিত ভালোবাসা থাকলেও, ম্যাচে ইংল্যান্ডের কোনো ভুল হলে, তার সেই ভালোবাসা ভয়ংকর ঘৃণায় পরিণত হয়। এবং সেই ঘৃণা সব সময় থালিয়া আর গাব্বির ওপরই গিয়ে পড়ে।
রান্নাঘরের টেবিলে পড়ে থাকা বকেয়া বিলগুলো তার নজর এড়ায় না। লাইট বিল, পানির বিল, মুদিখানার দোকানের বাকি—সব মিলিয়ে দিন দিন যেন ঋণের ভার বাড়ছে। নার্সের কাজ করে যা আয় হয়, তাতে কোনো রকমে চলে, কিন্তু কোনোদিনই যথেষ্ট মনে হয় না। মার্কেরও কোনো স্থায়ী কাজ নেই। ফুটবলের প্রতি তার উন্মাদনা ছাড়া সে জীবনে কোনো স্থিরতা খুঁজে পায় না।
টিভি থেকে ভেসে আসা উত্তেজিত ধারাভাষ্যের শব্দ থালিয়াকে মুহূর্তের জন্য থামিয়ে দেয়। ম্যাচ শুরু হয়ে গেছে। ঘরের বাতাসের ভার আরও ঘনীভূত হতে থাকে। মার্কের চোখ এখন টিভির স্ক্রিনে আটকে আছে, তার শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরা টানটান।
গাব্বি মায়ের পাশে এসে দাঁড়ায়। তার চোখে এক ধরনের উদ্বেগ। মায়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে, যেন এই মুহূর্তে সে তার মায়ের কাছাকাছি থাকতে চায়। “মা, আজ রাতটা আবার খারাপ হবে?” গাব্বির সরল প্রশ্ন শুনে থালিয়ার বুক কেঁপে ওঠে।
সে মেয়ের মাথায় আলতো করে হাত বোলায়, “না, মা। সব ঠিক হবে। আমরা ঠিকঠাক থাকবো।” কিন্তু নিজের কথায় বিশ্বাস আসে না থালিয়ার।
মার্কের এক একটা প্রতিক্রিয়া তাকে সজাগ করে তোলে। যতবার ইংল্যান্ড আক্রমণাত্মকভাবে খেলছে, ততবার সে উত্তেজিত হচ্ছে। তার মুখে ক্রমশ ধীর রাগের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। থালিয়া কিছুটা দূর থেকে তাকে দেখছিল, যেন এক বিপর্যয়ের অপেক্ষা।
“গোল! ইংল্যান্ড গোল দিয়েছে!” ধারাভাষ্যকারের উত্তেজিত কণ্ঠ থালিয়ার মনেও একটা ধাক্কা দেয়। সে জানে, এই মুহূর্তটা সাময়িক শান্তি এনে দেবে। মার্ক খুশি হবে, আর হয়তো কিছুটা সময়ের জন্য ঘরের পরিবেশ স্বাভাবিক থাকবে।
কিন্তু শান্তিটা দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ পরেই ক্রোয়েশিয়ার পাল্টা আক্রমণ শুরু হলো। ক্রমাগত চাপ বাড়তে থাকে, আর মার্কের মুখে রাগের রেশ স্পষ্ট হতে থাকে। যখনই ক্রোয়েশিয়া বল ধরে রাখে, মার্কের মুঠি শক্ত হতে থাকে।
থালিয়া দ্রুত রান্নার কাজ সেরে ফেলল। সে জানে, যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ কিছু ঘটতে পারে। রান্নাঘরের জানালাটা খুলে সে বাইরে তাকালো। বাইরে শূন্যতা, কিন্তু সেই শূন্যতাতেও মুক্তির একটা ইঙ্গিত রয়েছে। এই চার দেওয়ালের বন্দী জীবন থেকে পালানোর স্বপ্ন প্রতিনিয়ত তার মনকে দগ্ধ করছে। কিন্তু সে কীভাবে পালাবে? কোথায় যাবে? গাব্বির কথা ভেবে তার মন আরও ভারী হয়ে যায়।
মার্কের উত্তেজনা ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। টিভির দিকে তাকিয়ে সে হাতের মুঠি শক্ত করে। হঠাৎ করে, ক্রোয়েশিয়ার এক খেলোয়াড়ের পা থেকে বল বেরিয়ে গোলপোস্টের দিকে ছুটে গেল। “না!” মার্কের গর্জন যেন ঘরের সবকিছু কাঁপিয়ে দেয়।
“ক্রোয়েশিয়া গোল!”
এই খবরটা শুনে মার্কের রাগ যেন আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরিত হয়। সে টেবিল থেকে রিমোটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। টিভির সামনে দাঁড়িয়ে সে চিৎকার করতে থাকে, “সবাই ফালতু! এদের দিয়ে কিছু হবে না!”
থালিয়া বুঝতে পারে, সময় এসেছে। আরও অপেক্ষা করা মানে বিপদের দিকে এগিয়ে যাওয়া। সে চুপচাপ গাব্বির হাত ধরে, মেয়েটাকে ইশারা করে স্যুটকেসটা নিয়ে আসতে।
গাব্বি কিছু বলতে চায়, কিন্তু থালিয়ার চোখে ভয় দেখে চুপ করে যায়। মেয়েটা দ্রুত স্যুটকেস নিয়ে আসে।
“মা, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” গাব্বির কণ্ঠে উদ্বেগ স্পষ্ট।
থালিয়া মেয়ের হাত ধরে আস্তে করে বলে, “আমরা আজ রাতে পালাবো, মা। এখান থেকে অনেক দূরে, যেখানে কোনো ভয় থাকবে না।”
মার্কের রাগ তখনও শান্ত হয়নি। সে টিভির দিকে তাকিয়ে গালাগালি করতে থাকে। থালিয়া এই মুহূর্তটা কাজে লাগাতে চায়। সে জানে, আজ যদি পালাতে না পারে, তাহলে হয়তো কখনোই পারবে না।
তারা আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোয়। কিন্তু হঠাৎ মার্ক পেছনে ঘুরে তাকায়। তার চোখে ক্রোধের আগুন জ্বলছে। “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” তার গর্জন ঘরের ভেতর প্রতিধ্বনি তোলে।
থালিয়া কোনো উত্তর দেয় না। সে মেয়ের হাত ধরে দরজার দিকে আরও এক ধাপ এগোয়।
মার্ক তাদের দিকে এগিয়ে আসে, চোখে স্পষ্ট হিংস্রতা। “থামো! তোমরা কোথাও যেতে পারবে না!”
থালিয়া এই মুহূর্তে অনুভব করে, তাদের জন্য লড়াই করার সময় এসে গেছে। সে জানে, এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তাকে সমস্ত শক্তি একত্র করতে হবে।
ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা
রাতের ঘন অন্ধকারে টিভির পর্দা থেকে ভেসে আসা আলোয় ঘরটা যেন এক ভয়ংকর মঞ্চে রূপ নিচ্ছে। টিভির স্ক্রিনে ফুটবল ম্যাচের উত্তেজনা ধীরে ধীরে জমে উঠছে, কিন্তু থালিয়ার জন্য সেই উত্তেজনা অনেক বেশি বাস্তবিক। তার বুকের ভেতর ধুকধুকানি যেন বেড়ে চলেছে। বাইরে থেকে সবার জন্য এটা একটা খেলা হতে পারে, কিন্তু থালিয়ার জন্য এটা তার জীবন-মৃত্যুর লড়াই।
ম্যাচের প্রথমার্ধ শুরু হয়ে গেছে, এবং ইতিমধ্যেই কয়েকটা সুযোগ হাতছাড়া করেছে ইংল্যান্ড। থালিয়া রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে চুপচাপ টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। ফুটবলের প্রতিটা আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ যেন তার নিজের জীবনের প্রতিফলন। তার মনে পড়ে যায়, কতবার ইংল্যান্ডের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের হারের পর মার্ক তার ওপর ক্রোধ প্রকাশ করেছে।
মার্কের চোখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, তার ভেতরে ক্রমশ একটা বিস্ফোরণ তৈরি হচ্ছে। টিভির দিকে তাকিয়ে সে একদৃষ্টিতে দেখছে, হাতে মুঠো করা একটা গ্লাসে বিয়ার। থালিয়া জানে, এই ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত তাদের পরিবারের শান্তির ওপরে নির্ভর করছে। প্রতিবারই মার্ক খেলা দেখার সময় যেন অন্য মানুষ হয়ে যায়। ম্যাচের প্রতিটা ফলাফল তার মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর সেই মেজাজের শিকার হয় থালিয়া আর গাব্বি।
ম্যাচের প্রথমার্ধ যত এগিয়ে চলছে, থালিয়ার ভেতরে এক অদ্ভুত আশঙ্কা জমতে থাকে। ইংল্যান্ড বারবার সুযোগ হাতছাড়া করছে, আর সঙ্গে সঙ্গে মার্কের অস্থিরতা বাড়ছে। সে চিৎকার করে খেলোয়াড়দের দিকে গালাগালি ছুঁড়ে দিচ্ছে, যেন তারা তার ব্যক্তিগত সেনা, যাদেরকে তার হুকুম মানতে হবে। টিভির স্ক্রিনে ফুটবল খেলা চললেও, থালিয়া মনে মনে অন্য একটা খেলা খেলে যাচ্ছে—মার্কের রাগের প্রভাব থেকে কীভাবে পালানো যায়।
রান্নাঘরের ফাঁক থেকে তার মনের এক কোনায় একটা পরিকল্পনা গড়ে উঠছে। কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করা অতটা সহজ নয়। তাকে সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।
“গোল করো!” মার্ক চিৎকার করে উঠল, যখন ইংল্যান্ড এক আক্রমণে এগিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে বল বারে লেগে ফিরে আসে। থালিয়ার শরীরে একটা স্নায়বিক টান অনুভব করে। তার মনে হচ্ছে, এই মুহূর্তে সময়টা যেন থেমে আছে, আর তার ভেতরকার ভয় যেন ধীরে ধীরে বাড়ছে।
গাব্বি তাদের শোবার ঘরে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু থালিয়া জানে, আজকের রাতটা কীভাবে কাটবে সেটা একমাত্র ইংল্যান্ডের ভাগ্যের ওপর নির্ভর করছে। সে একটা ক্লান্ত নিঃশ্বাস ছাড়ে। প্রতিদিনই তাকে এমন চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
মার্ক এখন আরও বেশি বিয়ার পান করছে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরা যেন টানটান হয়ে আছে। যখন ক্রোয়েশিয়া বল ধরে রাখে, তখন তার মুখের ওপর একটা অন্ধকার ছায়া নেমে আসে। হঠাৎ করেই ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের প্রতি তার রাগ প্রকাশ পায়। টিভির দিকে তাকিয়ে সে গালি দিতে দিতে বলে, “এত টাকা পায় আর গোলটা দিতে পারে না!”
থালিয়া রান্নাঘরে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে, ইংল্যান্ডের খারাপ পারফরম্যান্স মানে তার জন্য আরও এক বিপর্যয়। তার বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সে একটা মুক্তির ইঙ্গিত খুঁজতে চেষ্টা করে, কিন্তু বাইরে অন্ধকারের গভীরে কোনো আশার আলো নেই।
মার্কের রাগ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যেমনটা সে প্রত্যেকবার খারাপ ম্যাচের সময় করে। থালিয়া জানে, এই মুহূর্তে ম্যাচের ফলাফল নির্ধারণ করবে আজকের রাতের পরিস্থিতি। সে আর অপেক্ষা করতে পারে না। তার মনে পড়ছে গাব্বির ভয়ভরা মুখ, তার ছোট্ট হাত মায়ের হাত চেপে ধরেছিল সেদিন, যখন শেষবার ইংল্যান্ড হেরেছিল। সেই রাতে, মার্কের ক্রোধ তাদের ছোট্ট ঘরটাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছিল।
“তুমি কী করছ?” হঠাৎ মার্কের গর্জন থালিয়াকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনে। সে বুঝতে পারে, সে রান্নাঘরের কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার উপস্থিতি মার্কের চোখে পড়েছে। মার্ক রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে বলল, “কিছু বলছ না কেন? তুমি কি বোবা হয়ে গেছ?”
থালিয়া কোনো উত্তর দেয় না। সে জানে, কথা বললে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। তার চোখে ভয়, কিন্তু সে সেটা লুকানোর চেষ্টা করে। এই মুহূর্তে তার মনে একটাই চিন্তা—তাদের পালাতে হবে। এই ক্রোধ থেকে, এই ভয়ের জীবন থেকে, তাদের একটা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে হবে।
ইতিমধ্যে ক্রোয়েশিয়া আক্রমণ চালিয়ে যায়। ম্যাচের প্রতিটা মিনিট যেন থালিয়ার জন্য যন্ত্রণা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গোল! ক্রোয়েশিয়া একটা গোল করে বসে, আর সেটা যেন সবকিছুর সমাপ্তি ঘোষণা করে। মার্কের শরীর থমকে যায়। সে টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে, তার মুখে ক্রমশ ঘনীভূত ক্রোধ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
“এটা কীভাবে সম্ভব?” মার্ক চিৎকার করে উঠল। সে উঠে দাঁড়িয়ে টেবিল থেকে গ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। থালিয়ার মন বলছে, আর সময় নেই। এই মুহূর্তে তাদের পালাতে হবে।
সে দ্রুত গাব্বির ঘরে যায়, তাকে জাগায়। “চলো মা, আমাদের যেতে হবে,” সে ফিসফিসিয়ে বলে।
গাব্বি ঘুমের মধ্যে ধাক্কা খেয়ে জেগে ওঠে। তার মায়ের মুখ দেখে সে কিছুটা ভয় পায়, কিন্তু কোনো প্রশ্ন না করে সে উঠে দাঁড়ায়।
মার্ক তখনও বসে গালাগালি করছে, কিন্তু থালিয়া জানে, এক মুহূর্তের জন্যও দেরি করা যাবে না। তারা দ্রুত স্যুটকেসটা টেনে নিয়ে দরজার দিকে এগোয়।
“তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” হঠাৎ মার্কের গর্জন থালিয়ার পিঠে ধাক্কা দিয়ে যায়। সে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পায়, মার্ক তাদের দিকে তেড়ে আসছে।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - নিউরাল ছায়া: একটি চমকপ্রদ কল্পবিজ্ঞান গল্প, যেখানে এলারা কুইন নামে এক তরুণ বিজ্ঞানী তার সৃষ্ট নিউরাল ইন্টারফেসের মাধ্যমে মনের অন্ধকার দিক আবিষ্কার করে। এই বাংলা ছোট গল্প প্রযুক্তির বিপজ্জনক সত্তা এবং মানবতার ভবিষ্যৎ নিয়ে এক উত্তেজনাপূর্ণ অনুসন্ধান। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অতীতের ছায়া
থালিয়া রান্নাঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে, আর হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জানালার কাচে ধাক্কা খাচ্ছে, যেন প্রতিটা শব্দ তাকে তার গভীর চিন্তায় ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মাথার ভেতরে আজকের রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিটি মুহূর্ত বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছে। মার্কের ক্রোধ, গাব্বির ভয়ভরা মুখ, আর সেই অসহ্য চাপ—সবকিছু যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খলে তাকে আটকে রেখেছে।
কিন্তু তার মনে পড়ে যায় আরও এক সময়ের কথা—একটা সময়, যখন সবকিছু এত ভয়ংকর ছিল না। সেই সময়টা ছিল ভালোবাসার, আশা আর স্বপ্নের।
মার্কের সাথে প্রথম দেখা হয়েছিল হাসপাতালের এক ছোট কফিশপে। থালিয়া তখন এক ক্লান্তিকর শিফটের পর এক কাপ কফি হাতে বসেছিল। মার্ক ছিল তখনও সেই হাসিখুশি, বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ। সে কফির দোকানে এসে থালিয়ার পাশে বসে তাকে কিছুক্ষণ দেখেছিল, তারপর মৃদু হাসিতে বলেছিল, “তুমি খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছ। কফি কি কাজ করছে?”
তাদের কথোপকথন সেখান থেকেই শুরু হয়েছিল। প্রথমে সাধারণ কিছু কথা, তারপর ধীরে ধীরে আরও গভীর আলোচনা। মার্ক ফুটবল নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত ছিল, আর থালিয়া তখনও বুঝতে পারেনি এই উত্তেজনা একদিন তাদের জীবনে ঝড়ের মতো আঘাত করবে। সে শুধু ভাবছিল, এই মানুষটা হয়তো তার জন্য একজন উপযুক্ত সঙ্গী হতে পারে—একজন, যে তার কঠিন জীবনের বোঝা ভাগ করে নিতে পারে।
তারা ধীরে ধীরে একে অপরের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। সেই সময়টা ছিল যেন এক স্বপ্নের মতো, যখন মার্ক তাকে প্রতিদিন হাসাতে চেষ্টা করত, তার জন্য ছোট ছোট উপহার আনত। তারা প্রায়ই হাঁটতে যেত, নতুন নতুন জায়গা ঘুরত, আর একে অপরের স্বপ্নগুলো নিয়ে আলোচনা করত।
কিন্তু সেই স্বপ্ন অচিরেই দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে শুরু করল। তাদের বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই মার্কের মধ্যে পরিবর্তন আসতে লাগল। ফুটবলের প্রতি তার আগ্রহ ছিল আগে থেকেই, কিন্তু সেটা একটা অস্বাভাবিক আসক্তিতে পরিণত হল। সে ম্যাচ মিস করত না, আর যখন ইংল্যান্ড হেরে যেত, তখন তার রাগ আর হতাশা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত।
প্রথমে এটা কেবল কয়েকটা চিৎকার, গালাগালি ছিল, যা থালিয়া সহ্য করতে পারত। কিন্তু ধীরে ধীরে মার্কের মদ্যপান শুরু হল, আর তার ক্রোধ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল।
থালিয়া কখনও ভাবেনি যে সে এমন একটা পরিবেশে আটকে পড়বে। সে ভাবত, বিয়ের পর তার জীবন আরও সুন্দর হবে, সুখের আলোয় ভরে উঠবে। কিন্তু আজ, সে সেই সুখের ছায়া থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে। এখন প্রতিটা দিন তার জন্য একটা যুদ্ধ।
গাব্বির স্নিগ্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে তার বুকটা হু হু করে ওঠে। মেয়েটা কি এমন পরিবেশে বড় হতে হবে? এই অস্থিরতা, এই ভয়—এ সবকিছুর মধ্যে তার জীবন কি থালিয়ার মতোই হয়ে যাবে? গাব্বি কি তার বাবার রাগের ভয়ে, তার মায়ের অক্ষমতায় আটকে থাকবে?
“না,” থালিয়া দৃঢ়ভাবে ফিসফিস করে বলে। সে জানে, কিছু একটা করতে হবে। এই পরিস্থিতি থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু কীভাবে? কোথায় যাবে? কার কাছে সাহায্য চাইবে?
তার পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার কথা মনে পড়ে, কিন্তু সে জানে, ওদের কাছে যাওয়াটা কোনো সমাধান হবে না। তার মা-বাবা, যদিও ভালো মানুষ, মার্কের ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে চাইবে না। তারা বরাবরই মনে করে এসেছে যে থালিয়াকেই সবকিছু মেনে নিতে হবে, পরিবার ধরে রাখতে হবে। তাদের সমাজে, একজন নারীর বিবাহিত জীবন মানেই হলো ত্যাগের জীবন। সেই ত্যাগ কতটা সহ্য করা সম্ভব, সেটা তারা কখনও ভাবেনি।
তার মন ফিরে যায় আরও অতীতে—তার নিজের শৈশবে। তার মা-ও এমন একটা পরিবেশে আটকে ছিলেন। থালিয়া সেই সময়ের কথা মনে করতে গিয়ে শিউরে ওঠে, যখন তার মা-বাবার ঝগড়া হত, আর মা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না করত। থালিয়া তখন প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে কখনও এমন জীবন বেছে নেবে না। কিন্তু বাস্তবতা যেন সেই পুরনো ইতিহাসকেই পুনরাবৃত্তি করছে।
একটা অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে থালিয়া অনুভব করল, সে আর এটা সহ্য করতে পারবে না। তার ভেতরকার শক্তি শেষ হয়ে আসছে। তার মনের ভেতর কোথাও একটা শব্দ শুনতে পেল—একটা কথা যা বারবার তাকে বলছে, “পালাও, থালিয়া। পালাও।”
গাব্বি তখন ঘুমোচ্ছে, তার ছোট্ট হাত মায়ের হাতের মুঠোয়। থালিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তার এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাকে একটা পথ খুঁজে নিতে হবে, যে পথ তাকে এবং গাব্বিকে মুক্তি এনে দেবে।
কিন্তু, কোথায় যাবে? কতদূর যেতে পারবে?
তার মাথার মধ্যে একটার পর একটা পরিকল্পনা ঘুরপাক খেতে থাকে। বাইরে অন্ধকার গভীর হয়েছে, আর বৃষ্টির ফোঁটাগুলো আরও তীব্র হয়েছে। এই বৃষ্টির মধ্যে পালানো কি সম্ভব?
সেই মুহূর্তে, থালিয়ার মনে পড়ে যায় তাদের পাশের শহরে থাকা তার কলেজের এক পুরোনো বান্ধবীর কথা। হয়তো সে সাহায্য করতে পারে।
হঠাৎ করেই তার সিদ্ধান্ত আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। বৃষ্টির মধ্যে, ভোরের আগে এই শহর থেকে পালানোই একমাত্র উপায়। সে স্যুটকেসটা টানতে শুরু করে, যেখানে সে আগে থেকেই কিছু দরকারি জিনিস গুছিয়ে রেখেছিল। ধীরে ধীরে, একটা নতুন শক্তি তার শরীরে ভর করতে শুরু করল।
মার্ক তখনও বিছানায় গড়িয়ে পড়েছে, ঘুমের ভেতর থেকে অস্পষ্ট আওয়াজ করছে। থালিয়া জানে, খুব দ্রুত তাকে সবকিছু সেরে ফেলতে হবে।
গাব্বিকে জাগিয়ে সে বলল, “আমাদের যেতে হবে, মা। চলো।”
গাব্বি অর্ধেক ঘুমের মধ্যে থাকলেও মায়ের নির্দেশে কিছু না বলেই উঠে দাঁড়াল। থালিয়া জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল, রাস্তা ফাঁকা।
তার মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরছে—সে কি পারবে? তারা কি সত্যিই পালাতে পারবে?
ম্যাচের নাটকীয় মোড়
থালিয়ার হৃদস্পন্দন ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। রান্নাঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে, সে প্রতিটি মুহূর্ত যেন লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে, কখন কোথা থেকে বজ্রপাতের মতো বিস্ফোরণ ঘটবে। টিভির পর্দায় ক্রোয়েশিয়া গোল করেছে, আর সেটাই যেন ছিল মার্কের মনের বিস্ফোরণের শেষ সূত্র। তিনি যে কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা সে আগেই জানত। প্রতিবার ইংল্যান্ডের পরাজয় মানে তার জন্য একটি নতুন দুঃস্বপ্নের শুরু। আজও তার ব্যতিক্রম হবে না।
মার্কের মুখে তিক্ত এক হাসি ফুটে উঠল। তার চোখগুলো যেন আগুনের শিখায় দাউ দাউ করে জ্বলছে। “এই বারও হারল,” ঠোঁট চেপে গর্জে উঠল সে। বালিশটা টিভির দিকে ছুঁড়ে মারল। থালিয়ার হাত-পা কাঁপতে শুরু করল, তার চোখের কোণে অশ্রুর ঝিলিক। রান্নাঘরের দরজার ফাঁক দিয়ে মার্কের প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে, সে নিজেকে সঙ্কুচিত করে ধরে রেখেছিল।
কিন্তু আজকের রাতে কিছু বদলেছে। তার মন বলছে—আর না। এতদিনে তার ভিতরে জমে থাকা সমস্ত আবেগ, হতাশা, ভয়, কষ্ট—সবকিছু এক হয়ে এক প্রবল সাহসের রূপ নিয়েছে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ এই কষ্টের চক্র ভাঙবে।
রান্নাঘরের কোণে রাখা সেই ছোট স্যুটকেসটা বের করে নিল থালিয়া। প্রায় কয়েকদিন ধরেই সে এটা গুছিয়ে রেখেছিল, নিজের আর গাব্বির কিছু দরকারি জিনিসপত্র নিয়ে। সে জানত এই দিনটা আসবে। কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল। এখন আর দেরি করার সময় নেই। গাব্বি তখন নিজের ঘরে গভীর ঘুমে মগ্ন। থালিয়া সাবধানে, যেন একটি চিলের মতো নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করল।
“গাব্বি, মা। ওঠো, আমাদের যেতে হবে।”
মেয়েটা প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। সে চোখ কচলাতে কচলাতে মায়ের দিকে তাকাল। থালিয়ার চোখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। তবে সেই ভয়ের নিচে ছিল একটা দৃঢ়তা, একটা প্রতিজ্ঞা। গাব্বি বুঝে গেল, আজ কিছু একটা আলাদা।
“মা, কী হয়েছে?”
“শান্তভাবে ওঠো, মা। এখনই প্রশ্ন করো না। আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে।”
থালিয়া দ্রুত গাব্বিকে জড়িয়ে ধরল, তারপর স্যুটকেসের হাতল ধরে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। তখনও মার্ক টিভির সামনে বসে, টিভির পর্দায় ফুটবল খেলার আবেগ ধুয়ে মুছে গিয়ে আছে। তার চেহারায় এখন ক্রোধের ছাপ।
গেটের কাছাকাছি পৌঁছাতে না পৌঁছাতে হঠাৎ করেই টিভির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। থালিয়া মুহূর্তের জন্য থেমে গেল, দম বন্ধ করে অপেক্ষা করতে লাগল। তারপর পেছনে তাকিয়ে দেখল—মার্ক উঠে দাঁড়িয়েছে। সে চারপাশে তাকাচ্ছে, বুঝতে পারছে কিছু একটা ঘটছে।
“থালিয়া! তুমি কোথায়?” মার্কের গর্জন শোনা গেল ঘরজুড়ে।
থালিয়ার ভেতরে যেন এক বিশাল কম্পন বয়ে গেল। এই মুহূর্তটাই তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর। যদি সে ধরা পড়ে যায়, তাহলে কী হবে? কিন্তু আর পিছিয়ে যাওয়ার সময় নেই। সে গাব্বির হাত শক্ত করে ধরল, আর দরজাটা খুলে দিল। দ্রুততার সঙ্গে দুজনেই বাইরে বেরিয়ে গেল।
বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে। আকাশের মেঘ ঘন হয়ে এসেছে, আর তাদের পালানোর পথ যেন আরও অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। তবে থালিয়ার ভেতরের অন্ধকার এর চেয়েও গভীর ছিল, আর সেখান থেকে আজ সে মুক্তি পেতে চায়।
রাস্তাটা ছিল একেবারে ফাঁকা। গাড়ির হর্নের আওয়াজ দূর থেকে ভেসে আসছে। তারা দ্রুত পা চালিয়ে মূল রাস্তায় এসে দাঁড়াল। থালিয়া জানত, তাদের অনেকটা পথ অতিক্রম করতে হবে। সেই পুরোনো বান্ধবী, যার কথা আগের রাতে তার মনে পড়েছিল, তার বাড়ি এখান থেকে বেশ কিছুটা দূরে। সেখানে পৌঁছানোই এখন একমাত্র লক্ষ্য।
কিন্তু তখনই পিছন থেকে শোনা গেল একটা ভয়ানক চিৎকার—“থালিয়া! থামো!” মার্ক ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখে রাগের আগুন, আর শরীরের ভঙ্গিতে স্পষ্ট প্রতিশোধের ইঙ্গিত।
থালিয়া আর অপেক্ষা করল না। সে গাব্বির হাত শক্ত করে ধরে ছুটতে শুরু করল। রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, একটা ট্যাক্সি আসছে। ট্যাক্সিটাকে থামানোর জন্য সে চিৎকার করে উঠল, “দাদা, দাঁড়ান! দাঁড়ান!”
ট্যাক্সি থামল, আর তৎক্ষণাৎ তারা গাড়িতে উঠে পড়ল। “যত দ্রুত সম্ভব চালান, দয়া করে!” থালিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল।
ড্রাইভার কিছু না বলে গাড়ি চালাতে শুরু করল। পিছনে মার্কের চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। থালিয়া ট্যাক্সির জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখল, তাদের বাড়ি ধীরে ধীরে অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে।
গাড়ি চলতে চলতে থালিয়া নিজেকে কিছুটা হালকা অনুভব করল, তবে একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারল না। আজকের রাতটা যদিও তারা পার হয়ে গেছে, কিন্তু আগামীকাল কী হবে? কোথায় যাবে তারা? গাব্বি পাশে চুপচাপ বসে আছে, তার চোখে ভয়ের ছায়া।
থালিয়া তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “সব ঠিক হয়ে যাবে, মা। আমি আছি তোমার পাশে।”
গাব্বি চুপচাপ মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। মায়ের কণ্ঠে যেন নতুন এক শক্তি আর প্রতিজ্ঞা শোনা যাচ্ছে।
গাড়ি শহরের ভিতরে ঢুকে গেল, রাস্তার আলো ঝলমল করছে। থালিয়া তার বান্ধবীর ফোন নম্বর খুঁজে বের করে ডায়াল করল। ফোনের ওপার থেকে শোনা গেল একটা ক্লান্ত গলা, “হ্যালো?”
“মীরা, আমি থালিয়া। আমার তোমার সাহায্য দরকার। এখনই।”
“থালিয়া! তুমি এত রাতে? কী হয়েছে?”
“আমি পালিয়ে এসেছি। গাব্বি আমার সাথে আছে। আর ফিরে যাওয়ার উপায় নেই।”
ফোনের ওপারে কিছুক্ষণ নীরবতা, তারপর মীরার গলা শোনা গেল, “ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে চলে এসো। আমি আছি তোমাদের জন্য।”
থালিয়ার বুকের ভেতর এক বিশাল ভার নেমে গেল। আজকে সে শেষ পর্যন্ত একটুখানি আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু এই আশ্রয় কতটা নিরাপদ?
গাড়ি মীরার বাড়ির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলল। ভোরের আলো ফোটার আগে তাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাদের জীবনের পরবর্তী ধাপ কী হবে, সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব এখন পুরোপুরি থালিয়ার।
মুক্তির সন্ধানে
রাতের অন্ধকারে ট্যাক্সি চলতে থাকে, থালিয়া আর গাব্বি চুপচাপ গাড়ির ভিতরে বসে। বাতাসে একটা অদ্ভুত শীতলতা, থালিয়ার মনে হয় যেন শীতের ঠাণ্ডা হাওয়া নয়, বরং এক নতুন শুরুর পূর্বাভাস। ট্যাক্সির ভিতরে নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে, কেবল সামান্য গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
থালিয়ার মনের মধ্যে তোলপাড় চলছে। আজকের রাতের পর সে আর কখনোই নিজের পুরোনো জীবনে ফিরে যাবে না—এটা সে জানে। কিন্তু কীভাবে সে নতুন জীবন গড়বে, কীভাবে সে এবং তার মেয়ে এই ভয়ঙ্কর অতীতের হাত থেকে মুক্তি পাবে—এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
গাব্বি মায়ের কোলের ওপর মাথা রেখে আধো ঘুমে। ছোট্ট মেয়েটির মুখে এক ধরনের শান্তির ছাপ। তার এখনো সম্পূর্ণ বোঝার বয়স হয়নি, কী ধরনের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তারা যাচ্ছে। থালিয়া মাথায় হাত বুলিয়ে গাব্বির দিকে তাকিয়ে থাকল। তার বুকের গভীরে এক অদম্য সাহস বোধ করল।
মীরার বাড়ি কাছাকাছি। মীরা, সেই বান্ধবী, যার কাছে যাওয়ার আর কোনো বিকল্প ছিল না। মীরার সাথে তার বন্ধুত্ব অনেক পুরোনো। বহু বছর পরে আজ তাদের দেখা হতে যাচ্ছে। থালিয়া জানে, মীরা নিশ্চয়ই সাহায্য করবে, কিন্তু কতদিন? কতদিন ধরে তারা এভাবে পালিয়ে থাকতে পারবে?
ট্যাক্সি ধীরে ধীরে মীরার বাড়ির সামনে এসে থামল। পুরোনো একতলা বাড়ি, সামনের ছোট্ট বাগানটা এখনও আগের মতোই রয়েছে। থালিয়া দম নিল, গাড়ি থেকে নামার আগে মনে মনে সাহস সঞ্চয় করল। মীরা দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে, তার মুখে চিন্তার রেখা স্পষ্ট।
“থালিয়া!” মীরা তার দিকে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল। “তুমি ঠিক আছো তো?”
থালিয়া কিছু বলতে পারল না। গলা আটকে গেল। শুধু মাথা নাড়ল, চোখের কোনা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।
মীরা তাদের ভিতরে নিয়ে গেল। গাব্বি তখনো আধো ঘুমে। মীরা তাদের জন্য ঘরের ব্যবস্থা করল। ছোট্ট একটা ঘরে, একটুখানি বিছানা পাতা ছিল। গাব্বি তৎক্ষণাৎ বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু থালিয়ার মনে এখনও অশান্তির ঢেউ চলছে।
“এখন কী করবে?” মীরা জিজ্ঞাসা করল।
“আমি জানি না,” থালিয়া উত্তর দিল। “কিছুই জানি না। শুধু জানি যে আর কখনো সেই জায়গায় ফিরতে পারবো না। আমরা পালিয়ে এসেছি। কিন্তু ভবিষ্যতে কী হবে—আমার কোনো ধারণা নেই।”
মীরা গভীরভাবে তাকাল তার দিকে। “তুমি যা করেছো, সেটা সাহসী কাজ। কিন্তু তুমি জানো, মার্ক তোমাদের খুঁজে পেতে চেষ্টা করবে। তুমি কি আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছো?”
থালিয়া মাথা নাড়ল। “না, এখনো না। আমি জানি, এটা করতে হবে, কিন্তু কোথা থেকে শুরু করবো বুঝতে পারছি না।”
মীরা তার কাঁধে হাত রাখল। “তুমি এখানে নিরাপদে থাকতে পারো, যতদিন চাইবে। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তুমি একা নও। আমরা সবাই আছি তোমার পাশে।”
থালিয়া মাথা নাড়ল। এতদিনের ভয়, কষ্ট, আর সঙ্কোচের পর, আজ সে কিছুটা হালকা বোধ করল। কিন্তু জানত, আসল লড়াই এখনো শুরু হয়নি।
রাত গভীর হতে থাকল। ঘরের মধ্যে আলো-আঁধারির খেলা চলছে, বাইরের রাস্তায় মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ। ঘরের মধ্যে এই নিস্তব্ধতা থালিয়াকে আরাম দিলেও তার ভিতরে এক অদ্ভুত উদ্বেগ সৃষ্টি করছে। সে জানে, এই পালানোর মধ্য দিয়ে সব সমস্যার সমাধান হবে না। বরং এটিই হয়তো নতুন এক বিপদের সূচনা।
শুয়ে থাকা অবস্থায়, থালিয়ার মনে পুরোনো দিনের স্মৃতি ভেসে উঠতে থাকল। মার্কের সঙ্গে তার প্রথম দেখা, সেই দিনগুলোর কথা, যখন সবকিছু সুন্দর আর স্বপ্নময় ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হল, ফুটবল খেলা, তার আচ্ছন্নতা, মদ্যপান, আর তারপর হিংস্রতার শুরু। প্রথমে ছোট ছোট ঝগড়া, তারপর সেটা ক্রমেই মারাত্মক হয়ে উঠল। আর আজ, সেই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছে সে।
ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথে, থালিয়ার মনে একটা নতুন ভাবনা জন্ম নিল। সে এবার আর চুপচাপ থাকলে চলবে না। আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শুধু তার নিজের জন্য নয়—গাব্বির জন্যও।
মীরা ঘুম থেকে উঠে নাস্তার ব্যবস্থা করছিল। থালিয়া তার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। “মীরা, তুমি ঠিক বলেছো। আমাকে পুলিশের কাছে যেতে হবে। আর এই বিষয়ে কিছু করতে হবে।”
মীরার মুখে আশার আলো ফুটে উঠল। “এটাই ঠিক সিদ্ধান্ত। আমি তোমার সাথে আছি।”
বিকেলের দিকে, থালিয়া স্থানীয় থানায় গেল। সেখানে যাওয়ার সময় তার ভেতরটা ভয়ে কাঁপছিল। পুলিশ স্টেশনের সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে হল যেন সে আবার এক নতুন যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করছে। পুলিশ অফিসারদের সামনে বসে সব ঘটনা খুলে বলল।
অফিসাররা থালিয়ার কথা শুনে নোট নিল। একজন মহিলা পুলিশ কর্মকর্তা তার কাছে এসে সহানুভূতির সাথে বলল, “আমরা তোমার পাশে আছি। কিন্তু জানো তো, এটা সহজ হবে না। তোমার স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা হলে সে সহজে ছাড়বে না।”
“আমি জানি,” থালিয়া দৃঢ় কণ্ঠে বলল। “কিন্তু আমি আর ফিরে যাব না। এবার আমার লড়াই শুরু।”
অফিসাররা যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া শুরু করল। তবে থালিয়ার মনে একটাই চিন্তা—কীভাবে সে আর গাব্বি নিরাপদে থাকবে? মার্ক যখন জানতে পারবে, সে নিশ্চয়ই প্রতিশোধ নিতে চাইবে।
থালিয়া তখনই ঠিক করল, তাদের কোথাও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে হবে। একেবারে অন্য কোথাও, যেখানে মার্ক খুঁজে পাবে না। মীরা তাকে এক পরিচিত লোকের কথা বলল, যে দূরে একটা নিরাপদ আশ্রয়স্থল চালায়। সেখানেই তাদের যাওয়া উচিত।
রাত বাড়ছে। থালিয়া আর মীরা পরের পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা করছে। গাব্বি তখনো গভীর ঘুমে। থালিয়া জানে, আগামীকাল তাদের নতুন যাত্রা শুরু হবে—এক অজানা গন্তব্যে, এক নতুন জীবনের সন্ধানে।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - অতৃপ্ত আত্মার ডাইরি: মঞ্জরী ও সুমনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, পুরনো বাড়ির অশুভ শক্তি, ও ললিতার আত্মার মুক্তির জন্য তাদের সাহসিকতা, সবই এক মন্ত্রমুগ্ধকর ভুতের গল্পের মাধ্যমে। পাঠ করুন এবং ভয়াবহ রহস্যের জগতে প্রবেশ করুন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
নতুন সূচনা
রাতের আকাশে অল্প অল্প করে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসে মৃদু কাঁপছিল থালিয়ার গা, কিন্তু তার হৃদয় ছিল অদ্ভুতভাবে শান্ত। একটা দীর্ঘ, অন্ধকারময় অধ্যায় পেছনে ফেলে সে গাব্বির হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক নতুন দিনের প্রান্তে। সামনের রাস্তা দেখে মনে হচ্ছিল এ যেন এক নতুন জীবন শুরু করার পথে তার প্রথম পদক্ষেপ।
তারা মীরার পরিচিত সেই লোকের বাড়িতে এসে পৌঁছেছে, যা শহরের বাইরে এক নিরিবিলি জায়গায় অবস্থিত। বাড়িটা ছোট কিন্তু শান্ত। ছোট্ট বাগান আর সাদা রঙের একতলা বাড়িটা যেন এক স্বপ্নময় স্বর্গ। মীরার সেই বন্ধু, অজয়, তাদের খুব আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। তার মুখে শান্তির ছাপ, আর চোখে মমতার আভাস। এই বাড়িটাই তাদের জন্য আশ্রয়স্থল হবে কিছুদিনের জন্য।
গাব্বি মায়ের হাত ধরে ধীরে ধীরে ঘরের ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট ঘরটি তাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে—একটা ছোট বিছানা, কিছু প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, আর জানালা দিয়ে বাগানের সবুজের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়। গাব্বি মৃদু হাসল। তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “মা, আমরা এখানে থাকবো?”
থালিয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে একটা ক্লান্ত কিন্তু তৃপ্তির হাসি দিল। “হ্যাঁ, মা, আমরা এখানে কিছুদিন থাকবো। এখানে আমরা নিরাপদ।”
গাব্বির চোখে সেই নির্ভীকতা ফুটে উঠল, যা সে এতদিনে হারিয়ে ফেলেছিল। মনে হচ্ছিল, এই নতুন আশ্রয় তার ছোট্ট মনেও নতুন স্বপ্নের বীজ বপন করেছে। মেয়ের সেই শান্ত মুখ দেখে থালিয়ার বুকটা আবার হালকা হল। এতদিন ধরে সে যে ভয় আর আতঙ্কের মধ্যে বেঁচে ছিল, সেটা এক মুহূর্তের জন্য মিলিয়ে গেল।
রাতের সেই নিস্তব্ধতার বিপরীতে, আজকের সকালটা যেন একদম আলাদা। সূর্যের আলো ঘরের ভেতরে পড়ছে, আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ পুরো পরিবেশকে সজীব করে তুলেছে। থালিয়া জানে, তার লড়াই শেষ হয়নি। মার্ক যে কখনো তাকে ছেড়ে দেবে না, সেটা সে নিশ্চিতভাবে জানে। কিন্তু তবুও আজকের সকালটা তার জন্য এক অন্যরকম বোধ নিয়ে এসেছে। এতদিনের নিপীড়ন, নির্যাতন, আর যন্ত্রণার পর, আজ সে নিজেকে কিছুটা মুক্ত মনে করছে।
অজয় তাদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করেছে। সাধারণ কিছু খাবার—রুটি, ডিম, আর চা। কিন্তু এই সাধারণতায় এক ধরনের উষ্ণতা ছিল, যা থালিয়াকে তৃপ্ত করল। এতদিন পর যেন প্রথমবারের মতো সে কিছু খেতে পারছে শান্ত মনে।
“থালিয়া,” অজয় বলল, “তোমরা এখানে যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো। তোমাদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু আইনি প্রক্রিয়া বাকি আছে। তুমি কি প্রস্তুত?”
থালিয়া মাথা নাড়ল। “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। কিন্তু একটাই চিন্তা—মার্ক কী করবে? সে কি আমাদের খুঁজে বের করবে?”
অজয় মৃদু হেসে বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমরা সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। তোমার আইনগত লড়াই শুরু হয়েছে। পুলিশে তোমার রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে, আর তারা এখন থেকেই তদন্ত শুরু করবে। আর যদি সে তোমাদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করে, আমরা প্রস্তুত থাকব।”
থালিয়ার ভিতরে সাহসের একটা নতুন ঢেউ এল। এতদিন ধরে সে একা ছিল, ভয় ছিল প্রতিদিনের সঙ্গী। কিন্তু এখন সে বুঝতে পারছে, সে আর একা নয়। তার পাশে রয়েছে বন্ধু, সহকর্মী, আর এমন মানুষজন, যারা তাকে ভালোবাসে, সুরক্ষা দিতে প্রস্তুত।
সন্ধ্যাটা কেটে গেল মীরার সাথে কথা বলে। মীরা এসে তাদের দেখতে এল, এবং থালিয়ার মনে শান্তির একটা বড় অংশ ফিরিয়ে দিল। তারা দু’জন অনেকক্ষণ ধরে কথা বলল, জীবনের নানা ঘটনা আর স্মৃতি নিয়ে। মীরা তাকে আশ্বাস দিল, ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ যাই হোক না কেন, থালিয়া সবকিছু সামলাতে পারবে।
“তুমি এতদূর এসেছো, থালিয়া,” মীরা বলল। “তুমি যে সাহস দেখিয়েছো, সেটা সবাই করতে পারে না। আর আমি জানি, তুমি আর গাব্বি নিশ্চয়ই একদিন এই দুঃস্বপ্ন থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হবে। ততদিন পর্যন্ত তোমার লড়াই চলতে থাকবে, কিন্তু তুমি একাই নও।”
রাত বাড়ার সাথে সাথে থালিয়া বাগানের দিকে তাকিয়ে ভাবতে শুরু করল। তার সামনে এক অজানা ভবিষ্যৎ। সে জানে, এই মুক্তির পথ সহজ হবে না। একদিকে আইনগত প্রক্রিয়া, অন্যদিকে মার্কের প্রতিশোধপরায়ণ মনোভাব—সবকিছুই তাকে আবার অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু আজ তার মন একদম দৃঢ়। সে আর কখনো পুরোনো সেই অন্ধকারে ফিরে যাবে না।
ঘুমের আগে, থালিয়া গাব্বির পাশে শুয়ে তার ছোট্ট মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। মেয়েটা একটুও জানে না, কেমন করে তার মা তাকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করছে। কিন্তু একদিন সে জানবে, একদিন সে বুঝবে।
পরদিন সকালে, থালিয়া পুলিশের কাছে যোগাযোগ করল। পুলিশ অফিসার তাকে জানাল যে তদন্ত দ্রুত এগোচ্ছে। মার্ককে খুঁজে বের করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। অফিসাররা তাকে আশ্বাস দিল, “আপনারা নিরাপদ আছেন। কিন্তু সতর্ক থাকবেন।”
এই কথাগুলো থালিয়াকে কিছুটা স্বস্তি দিল। তবে তার মনে এখনো একটাই প্রশ্ন—মার্ক কি সত্যিই তাদের ছেড়ে দেবে? যদি সে আবার ফিরে আসে?
সন্ধ্যায়, মীরার সাহায্যে থালিয়া আর গাব্বি অজয়ের বাড়ির সামনের বাগানে কিছুক্ষণ হাঁটল। শান্ত পরিবেশ, নরম বাতাস, আর সবুজের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে থালিয়ার মনে হল, এটা তার নতুন জীবনের শুরু।
“মা,” গাব্বি মৃদুস্বরে বলল, “আমরা কি সবসময় এখানেই থাকবো?”
থালিয়া তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। “না, মা। আমরা সবসময় এখানে থাকবো না। কিন্তু আমরা কোথাও থাকবো, যেখানে তুমি আর আমি দু’জনেই নিরাপদে থাকবো। আর আমরা আর কখনোই সেই পুরোনো জীবনে ফিরে যাবো না।”
সেই মুহূর্তে থালিয়ার ভিতরে একটা অদম্য শক্তি অনুভূত হল। গাব্বির চোখে তাকিয়ে সে বুঝল, তার জন্য লড়াইটা শুধু নিজের জন্য নয়, তার মেয়ের ভবিষ্যতের জন্যও।
এটাই ছিল তার মুক্তির প্রথম পদক্ষেপ। সামনে আসবে আরও চ্যালেঞ্জ, কিন্তু এখন তার মধ্যে এমন একটা সাহস আর আত্মবিশ্বাস জন্মেছে, যা তাকে জীবনের যেকোনো পরিস্থিতির সামনে শক্তভাবে দাঁড়াতে সাহায্য করবে।