রচনা - সুরজিৎ রায় || গল্পপাঠে - শুভদীপ বসু
বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
সকালবেলা ছিল ধূসর ও শীতল, অরুণ কলকাতার ভীড়ে হাঁটছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্ধকার ছায়া ধীরে ধীরে শহরের প্রতিটি কোণে বিরাজমান ছিল। বাতাসে অতীতের বেদনার সুর যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল; যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি, ক্ষুধার কষ্ট আর আত্মাদের প্রানের মর্যাদা একত্রে মিলেমিশে আজকের এই শহরকে তৈরি করেছে। অরুণ, এক তরুণ বীর, যিনি যুদ্ধের ভয়াবহ বাস্তবতার মাঝে মানবতার মায়া খুঁজছিল, তাঁর হৃদয়ে এক অদৃশ্য শপথ বেঁধে নিয়েছিলেন – যুদ্ধের মাঝে ভালোবাসা, সাহস ও সত্যের দ্যুতি ধরে রাখতে।
অরুণের ছোটবেলার স্মৃতিতে মায়ের গল্প, বাবার ত্যাগ আর গ্রাম বাংলার নিরব নীরবতা সবসময় রাঙিয়ে উঠতো। তবে কলকাতায় এসে যুদ্ধের উত্তাপে, সে নিজেকে এক নতুন বাস্তবতার মাঝে খুঁজে পেয়েছিল। শহরের নকশাতে ব্রিটিশ রেলপথ, ফাঁকা রাস্তা আর আকাশে উড়োজাহাজের গর্জন যেন অতীতের এক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। এই কষ্টে ভরা পরিবেশে, অরুণের চোখে একটি মৃদু আলো জ্বলে উঠল যখন সে প্রথমবারের মতো মালয়িকা নামে এক নারীর সাথে দেখা করল। মালয়িকা হাসপাতালে নার্স হিসেবে কাজ করতেন। তাঁর কোমল হাসি ও নিরলস সহানুভূতি অরুণকে মনে করিয়ে দিয়েছিল যে মানবতার মাঝে ভালোবাসা আর যত্নের শক্তি অপরাজেয়।
মালয়িকার সাথে অরুণের পরিচিতি শুরু হয় এক অস্থির রাতে, যখন কলকাতার এক প্রান্তে হাওয়া ও বৃষ্টির স্নিগ্ধতায় যুদ্ধের আওয়াজ কমে গিয়ে ছিল। হাসপাতালে হাসপাতালে হাসপাতালে ক্ষতিপীড়া পেয়েছিলেন শহরের মানুষ। সেই রাতে, অরুণ যেন নিজের অন্তরের গভীরে লুকানো অজানা অনুভূতির সমাহারকে মালয়িকার দয়ালু চোখে দেখতে পায়। যুদ্ধের নির্জনে বেদনায়, তাদের দুইজন যেন এক অপরকে খুঁজে পেয়েছিল – এক তরুণ যিনি নিজের দেশের জন্য জীবনের সবকিছু ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছেন, আর এক নারী যিনি প্রাণের অঙ্গীকারে ভরা হৃদয়ে আশার আলো জ্বালাচ্ছিলেন।
তবে এই শান্তির মুহূর্ত ছিল অস্থায়ী। অরুণ যখন নিজেকে সশস্ত্র দলে নিয়োজিত করল, তখন সে বুঝতে পারল যে যুদ্ধ শুধু বাহ্যিক সংঘর্ষ নয়; এ হলো মানব হৃদয়ের অন্ধকার ও আলোয় লড়াই। শহরের এক গোপন কক্ষে, স্বাধীনতা আন্দোলনের গুপ্তচরদের সাথে মিলিত হয়ে, অরুণ যুদ্ধের পেছনের সত্য আর ষড়যন্ত্রের দাপট ছাড়ানোর লক্ষ্যে এক গোপন অভিযান শুরু করে। এই অভিযান ছিল শুধু শত্রুকে পরাস্ত করার জন্যই নয়, বরং নিজ নিজ হৃদয়ে লুকানো দুঃখ, পাপ আর ভুল বোঝাবুঝির ভার তুলে ফেলার এক সংগ্রাম।
অরুণের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল তাঁর শৈশবের বন্ধু সুরেন্দ্র, যিনি এখন এক নিস্তব্ধ গুপ্তচর হিসেবে দেশের সুরক্ষায় নিয়োজিত। সুরেন্দ্রের চোখে ছিল এক অদম্য আত্মবিশ্বাস, কিন্তু তাঁর মনে ছিল অতীতের এক গভীর আঘাত – এক পরিবার হারানোর বেদনাকে আঁকড়ে রেখে, সে আজ যুদ্ধের মাঠে নিজের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছে। দুইজনের মাঝে ছিল এক গভীর বন্ধুত্ব, যা যুদ্ধের ভগ্নিজগতে একমাত্র আশার আলো হয়ে উজ্জ্বল হচ্ছিল।
একদিন অরুণকে পাওয়া যায় একটি গুপ্ত বার্তা – একটি উচ্চমানের ব্রিটিশ অফিসারের কাছ থেকে, যে মূলত শত্রুর গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। এই বার্তায়, ব্রিটিশ অফিসার জনাব স্ট্যানফোর্ড তার সন্দেহের কথা প্রকাশ করছিলেন, যে কেউ কেউ দেশের ভেতরে গুপ্তচরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। অরুণের মনে উথলে উঠল দ্বন্দ্বের অনুভূতি – তাঁকে দেশের সেবায় নিবেদিত হতে হবে, কিন্তু সেই সঙ্গে মালয়িকার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসার স্মৃতি, যিনি তাঁর জীবনের এক অমর প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।
মালয়িকা, যিনি নিজেও অনেক কষ্ট ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে আসছেন, অরুণের এই দ্বন্দ্ব বুঝতে পেরেছিলেন। হাসপাতালে রাতের অন্ধকারে, যখন আহত সৈন্যদের যত্ন নেওয়ার ব্যস্ততায় মালয়িকার চোখে এক শান্ত নিরবতা, প্রেমের এক গভীর অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল। তিনি অরুণকে বারবার বলতেন, “জীবনের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ হলো নিজের ভেতরের ভয় ও দ্বিধার সাথে লড়াই করা।” এই শব্দগুলো অরুণের মনে এক নতুন দিশা জাগিয়ে তুলল।
একদিন, অরুণ এবং সুরেন্দ্র একটি গোপন মিটিংয়ে অংশ নিলেন, যেখানে জানা গেল যে শত্রুর গুপ্তচরবৃত্তি শুধু বাহ্যিক নয়; এদের মাঝে এমন এক ব্যক্তি আছেন, যিনি দেশের শত্রু হয়ে উঠেছেন এবং নিজ পরিবারের মধ্যেও বিভেদ সৃষ্টির কাজ করছেন। সেই গুপ্তচর ছিলেন এক প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব, যার নাম ছিল মিস্টার গিলমো, যিনি নিজেকে দেশের স্বার্থে কাজ করেন বলে দাবি করতেন, কিন্তু বাস্তবে তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য যুদ্ধের পরিস্থিতিকে কাজে লাগাচ্ছিলেন। অরুণ তখন বুঝতে পারল, যে এই যুদ্ধ শুধু বিদেশী শত্রুর বিরুদ্ধে নয়, বরং নিজেদের মধ্যেই এক গোপন শত্রু লুকিয়ে আছে।
ওই রাতেই অরুণের মনে এক অদ্ভুত জাগরণ হয়েছিল। তিনি মালয়িকার প্রতি তাঁর ভালোবাসা, দেশের প্রতি তাঁর অটল বিশ্বাস আর নিজের অতীতের স্মৃতির সাথে মিলেমিশে এক নতুন সংগ্রামের শুরুর সূচনা দেখলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত ছিল স্পষ্ট – সত্যকে উদঘাটন করতে হবে, দেশের মানুষকে একত্রিত করতে হবে, যাতে কেউই মিস্টার গিলমোর মত বিশ্বাসঘাতকতা ও দৌর্লভ্যের শিকার না হয়।
অতপর, অরুণ ও সুরেন্দ্র নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী মিস্টার গিলমোর কার্যালয়ে প্রবেশ করে, যেখানে তাঁরা জানতে পারেন, মিস্টার গিলমো শুধু গুপ্তচরবৃত্তির নেতা নন; তাঁর মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক গহীন ব্যক্তিগত ব্যথা, এক প্রান্তহীন হতাশা। সে এক সময় একজন আদর্শবাদী যুবক ছিল, যে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখত, কিন্তু যুদ্ধের চাপে ও ব্যক্তিগত ক্ষতির কারণে সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। অরুণ সেই সত্যটি জানার পর, মিস্টার গিলমোর প্রতি সহানুভূতি অনুভব করলেও, সে বুঝতে পারল যে দেশের জন্য ওই লোকের বিশ্বাসঘাতকতা আর দুর্নীতি মেনে নেওয়া যাবে না।
মালয়িকা, যিনি এখন নিজের কর্মক্ষেত্রে দিন রাত ব্যস্ত ছিলেন, সংবাদপত্রের গল্পগুলো থেকে জানতে পারেন যে, কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ এখনও সেই ভয়াবহ যুদ্ধের বাস্তবতা ও হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হচ্ছেন। তাঁর চোখে কষ্টের অশ্রু ঝরে পড়েছিল, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁর মুখে এক অদম্য দৃঢ়তা জাগ্রত হয়েছিল। মালয়িকা অরুণকে বার্তা পাঠালেন, “তুমি যদি সত্যের পথে থাকো, তবে ভুলবে না – প্রতিটি প্রাণে ভালোবাসা আছে, প্রতিটি মানুষের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অদম্য সাহস।” এই বার্তা অরুণের মনে এক নতুন জ্বলজ্বলে আশার দীপ জ্বালিয়ে দিল।
যুদ্ধের গর্জনে, যখন শহরের রাস্তাগুলোতে বোমার আওয়াজ ও আতঙ্ক বিরাজমান ছিল, তখন অরুণ এক মিশনে নিজেকে নিয়োজিত করলেন। তাঁর মিশন ছিল, শত্রুর গুপ্তচরের তথ্য সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামী দলের কাছে পৌঁছে দেওয়া। এই পথে তিনি নানা রকম বিপদের সম্মুখীন হলেন; কিছুকাল বন্দী হয়ে পড়লেন, আবার কিছুকাল নিজের সততা ও বীরত্বের ফলে শত্রুর চোখে প্রশংসিত হলেন। প্রতিটি বিপদে, মালয়িকা ও সুরেন্দ্রের ভালোবাসা ও সহানুভূতি যেন তাঁকে নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে দিতে সহায়তা করত।
কয়েক মাসের দুর্বিষহ সংগ্রামের পর, অরুণ অবশেষে শত্রুর গুপ্তচরবৃত্তির মূল ঠিকানা উন্মোচন করতে সক্ষম হলেন। তার সংগ্রামের ফলস্বরূপ, শহরের বিভিন্ন স্থানে থাকা স্বাধীনতা সংগ্রামী দল সমন্বয় সাধন করতে পারল এবং দেশের ভেতরের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে একটি সুসংগঠিত অভিযান শুরু হলো। সেই অভিযান ছিল এক অন্ধকারের মাঝেও আশা, মানবতার মাঝে ভালোবাসার পুনর্জাগরণ।
যুদ্ধের শেষ দিনগুলো আসতে আসতে, অরুণ অনুভব করলেন যে, যুদ্ধ শুধুমাত্র রক্তক্ষয় বা ধ্বংসাবশেষ নয়; এটা হলো মানব জীবনের এক অতীব জটিল নাটক, যেখানে ভালোবাসা, ত্যাগ, বিশ্বাসঘাতকতা ও অনিশ্চয়তার মিশেল জড়িয়ে থাকে। একদিকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান আর স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়, অন্যদিকে মানুষের মনে গভীর আঘাত ও বেদনার আঁধার ছিল। মালয়িকা ও অরুণের ভালোবাসা এই সব কষ্টের মাঝে এক অমর মধুর সুরের মতো জ্বলে উঠেছিল।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, যখন শান্তির রোদেলা সকালে কলকাতার রাস্তাগুলো আবারও জীবনের অম্লান সুরে গান গাইতে শুরু করল, তখন অরুণ নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, যুদ্ধের আঁধারে লুকিয়ে থাকা সত্য ও ভালোবাসা সবসময় মানবতার মাঝে বিদ্যমান – শুধু তা প্রকাশ পেতে ধৈর্য আর ত্যাগের প্রয়োজন। মিস্টার গিলমো, যিনি নিজেও একসময় দেশের স্বপ্ন দেখতেন, তাঁর পতনের মধ্য দিয়ে অরুণ শিখলেন – যে কোনো ক্ষতির মধ্যে যদি মানবিকতার চিংড়ি থাকে, তবে তা আবার উঠতে পারে।
শহরের এক কোণে, যেখানে অবশেষে শান্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল, অরুণ মালয়িকার হাত ধরে হাঁটলেন; তাদের চোখে ছিল অতীতের দুখের ছায়া, কিন্তু ভবিষ্যতের আশার দীপ জ্বলে উঠেছিল। যুদ্ধের করাল রাতে, যেখানে তাঁরা মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই একই রাতে তাদের ভালোবাসা, বন্ধুত্ব ও মানবতার প্রতি অটল বিশ্বাস নতুন করে জীবনের অর্থ দান করেছিল। এই সংগ্রাম, এই ভালোবাসার গল্প ছিল শুধুমাত্র যুদ্ধের সময়ের নয়; এটি ছিল প্রতিটি মানুষের জীবনের এক চিরন্তন পাঠ – যে সত্য ও ভালোবাসা কখনো মরে না।
এইভাবে, অরুণ ও মালয়িকার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত হয়ে উঠল এক অমর গল্প, যেখানে যুদ্ধের নিঃসঙ্গতা ও মানবিকতার অদম্য শক্তি একে অপরকে জড়িয়ে রাখে। কলকাতার ধূসর আকাশের নিচে, যেখানে একসময় বোমার আওয়াজ গুনগুন করত, এখন শুধু শান্তির সুর বাজতে শুরু করেছিল – একটি নতুন দিনের, একটি নতুন জীবনের শুরু। আর সেই জীবনের প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে, ছিল যুদ্ধের সেই অমর অভিজ্ঞতা, যেখানে ভালোবাসা, বিশ্বাস আর ত্যাগ একে অপরের সাথে মিশে, মানবতার ইতিহাসে এক চিরন্তন অধ্যায় হিসেবে রয়ে গেল।