কলকাতার বুকে, ট্রামের ঝম ঝম শব্দ আর চায়ের দোকানের আড্ডায় জমজমাট ⸺ এই শহরেই বাস করি আমি, রূপসা। পেশা – ইভেন্ট প্ল্যানার। প্রতিটা অনুষ্ঠানকে সাজিয়ে তোলা, মানুষের আনন্দকে আরও জমকালো করে দেওয়া ⸺ এটাই আমার কাজ। কিন্তু এই চাকরির চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর লাগে এখন আমার নতুন জায়গায়। ‘হৃদয়মিলন’ নামের এক পাত্র পাত্রী সন্ধানের এজেন্সি।
এখানে এসে প্রথমেই দেখা হলো অভিজিৎ-এর সাথে। সহজ সরল, ঝটপটে ছেলে। এখন আমার সহকর্মী, আর নতুন বন্ধু। এই এজেন্সিতে আসা প্রত্যেকটা মানুষের গল্প শোনা, তাদের জীবনের সঙ্গী খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা ⸺ এই কাজটা কখনো একঘেয়ে লাগেনি। কারণ, প্রেমের গল্প তো কখনো এক রকম হয় না! প্রত্যেকটা জুটি, প্রত্যেকটা খোঁজা একেবারে আলাদা।
অভিজিৎ-এর সাথে কাজ করতে করতেই একটা গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। অফিসের পরে চায়ের দোকানে আড্ডা, রাস্তাঘাটে হাঁটতে হাঁটতে একে অপরের স্বপ্ন, আশা, ভাঙা প্রেমের গল্প শেয়ার করা ⸺ এইসব মুহূর্তগুলোতেই একটা মনের গভীরতা তৈরি হলো আমাদের মধ্যে।
একদিন আমাদের কাছে এলো এক অদ্ভুত ক্লায়েন্ট এর রিকোয়েস্ট। মুখ দেখানোর কোনো ইচ্ছে নেই, পরিচয় গোপন রাখতেই চান। শুধু একটা ডিম্যাণ্ড ⸺ তার জীবনের সঙ্গীকে খুঁজে দিতে হবে আমাদের।
অভিজিৎ আর আমি চমকে গেলাম। এতদিন ধরে কত মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, কত জীবনের গল্প শোনা গেছে; কিন্তু এমন ক্লায়েন্টের কথা কখনো শোনা যায়নি। কিন্তু, চ্যালেঞ্জটা মন্দ লাগলো না। আমরা রাজি হয়ে গেলাম।
কিন্তু কিভাবে খুঁজবো আমরা এই রহস্যময় মানুষের স্বপ্নের মানুষটাকে? একদিন, অফিস থেকে বেরোনোর সময় হঠাৎ করেই মাথায় এল, ক্লায়েন্টের কাছ থেকে আমরা যে তথ্য পেয়েছি, তার মধ্যে একটা ছোট্ট জিনিস; যা আমরা খেয়াল করিনি। সে জানিয়েছিল, সে প্রতি সন্ধে একটা নির্দিষ্ট পার্কে গিয়ে বসে। হয়তো সেখানেই কোনো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
পরের দিন সন্ধেবেলায়, সেই পার্কে গিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আমরা। একটা বৃক্ষের তলায় বসে আছে একজন মধ্যবয়সী মহিলা। চোখে এক অদ্ভুত বিষাদ। বেশ কিছুক্ষণ পরে, একজন বৃদ্ধ মানুষ এসে তার পাশে বসলেন। দুজনেই চুপচাপ বসে রইলেন। কোনো কথাবার্তা হচ্ছিলনা তাদের মধ্যে। কিন্তু, তবুও একটা গভীর বন্ধন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। হয়তো বহু বছরের সঙ্গ, না হয় হারিয়ে যাওয়া প্রেমের ছায়া। আমরা দু’জন দূর থেকেই তাদের দেখছিলাম। বৃদ্ধ মানুষটি মহিলার হাতে একটা পুরানো খাতা ধরিয়ে দিলেন। খাতাটা খুলে মহিলা যখন পড়তে শুরু করলেন, তখন তার চোখে জল দেখা গেল।
অভিজিৎ আমার দিকে চাইলো, চোখে একটা প্রশ্ন। আমিও তার চোখের ভাষা বুঝলাম। আমরা দু’জনেই বুঝতে পারছিলাম, এই খাতার মধ্যেই রয়েছে হয়তো আমাদের খোঁজা, সেই রহস্যময় ক্লায়েন্ট-এর গল্প। কিন্তু, কিভাবে সেই খাতাটা আমরা হাতে পাবো?
পরের কয়েকদিন ধরে, আমরা প্রতিদিন সন্ধ্যে সেই পার্কে যেতাম। সেই মহিলা আর বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখতাম। একদিন, যখন বৃদ্ধ মানুষটি চলে যাচ্ছিলেন, তখন অভিজিৎ তার কাছে গিয়ে কথা বললো। বুঝিয়ে বললো আমাদের পরিচয়, আর আমরা কেন তাদের উনাকে এতদিন ধরে ফলো করছি।
প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও, শেষ পর্যন্ত সব শুনলেন বৃদ্ধ মানুষটি। আমাদের কথা শুনে, একটু চিন্তা করে বললেন, “আপনারা হয়তো ঠিক জায়গায় এসেছেন। কিন্তু, এই খাতাটা দেওয়া সম্ভব নয়। এটা আমার মেয়ে, রিয়া। আর এই খাতায় লেখা আছে তার জীবনের সবচেয়ে বড়ো দুঃখের গল্প।”
আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। রহস্যময় ক্লায়েন্ট আর এই মহিলার মধ্যে যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে, সেটা এবার পরিষ্কার হয়ে গেল। কিন্তু, রিয়ার দুঃখের গল্পের সাথে আমাদের ক্লায়েন্টের কী সম্পর্ক, সেটা এখনো রহস্যই রয়ে গেল।
বৃদ্ধ মানুষটির কথা শুনে আমাদের রহস্য আরও জটিল হয়ে গেল। রহস্যময় ক্লায়েন্ট আর এই মহিলার মধ্যে যে সম্পর্ক আছে, সেটা জানতে পারলাম ঠিকই, কিন্তু রিয়ার গল্পের সাথে আমাদের কাজের কি সম্পর্ক, সেটা এখনো অস্পষ্ট।
অভিজিৎ বৃদ্ধ মানুষটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী এমন দুঃখ রয়েছে এই খাতায়, যেটা আমাদের কাজে লাগতে পারে?”
বৃদ্ধ মানুষটি একটু দূরে তাকালেন। তার চোখ ছলছল করছিল। “এই খাতায় লেখা রয়েছে রিয়া আর আকাশের প্রেমের গল্প। ছোটবেলা থেকেই একসাথে বড়ো হয়েছে তারা। কিন্তু, পরিবারের বাঁধা আর সমাজের চাপে আলাদা হয়ে গেছে দু’জনে।”
এই কথা শুনে আমার বুকটা এমনি যেন কেঁপে উঠলো। প্রেমের গল্প আর বিচ্ছেদ, মানুষের জীবনে এই দুটো জিনিসই তো সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয়। হয়তো এই বিচ্ছেদই হলো আমাদের রহস্যময় ক্লায়েন্টের গল্পের মূল।
“আপনার মেয়ে কি এখনো আকাশকে ভালোবাসেন?” – জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
বৃদ্ধ মানুষটি মাথা নীচু করে বললেন, “এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু রিয়া এখনো আকাশের কথা ভুলে উঠতে পারেনি। প্রতিদিন সন্ধ্যে এই পার্কে আসে, যেখানে একসময় দু’জনে দেখা করতো।”
এখন আমাদের কাজটা সহজ হয়ে গেল। রিয়ার সাথে দেখা করে, তার গল্প আর আকাশের সাথে তার সম্পর্কের বিস্তারিত জানতে হবে। কিন্তু, কিভাবে রিয়াকে মন খুলে কথা বলানো যায়, সেটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।
অভিজিৎ একটা প্ল্যান নিয়ে এলো। পরেরদিন, আমরা রিয়া যখন পার্কে আসবে, তার ঠিক আগে গিয়ে বসলাম।
রিয়া এসে খাতাটা খুলে পড়তে শুরু করল। সেই মুহূর্তে, অভিজিৎ তার কাছে গিয়ে আস্তে করে বলল, “আপনার গল্পটা খুব সুন্দর।”
রিয়া চমকে উঠল। আমাদের দেখে একটু সঙ্কোচিত হল। আমরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে, রিয়ার বাবার কাছ থেকে সব শোনা গেছে জানালাম।
রিয়া প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও, শেষ পর্যন্ত খুলে বলতে শুরু করল তার গল্প। আকাশের সাথে তার প্রথম দেখা, প্রেমের জন্ম, পরিবারের বাঁধা আর বিচ্ছেদ – সবকিছুই খুলে বলল।
রিয়া জানাল, এত বছর কেটে গেছে, কিন্তু আকাশকে এখনো ভুলতে পারেননি। তার কাছে শুধু একটা ইচ্ছে – আকাশকে আর একবার দেখা করার। কিন্তু, এত বছরে তার কোনো খোঁজই নেই।
রিয়ার কথা শুনে আমাদের মনে একটা আশার আলো জ্বলে উঠলো। হয়তো আমরা আকাশকে খুঁজে পেতে পারি। রিয়ার কাছ থেকে আকাশের সম্পর্কে যতটুকু তথ্য জানা যায়, সব লিখে নেওয়া হলো। তার পুরনো বাড়ির ঠিকানা, স্কুল-কলেজের নাম, এমনকি আকাশের পছন্দের জায়গাগুলোও লিখে রাখলাম।
পরের কয়েকদিন ধরে, অফিসের পরে আমরা শুধুই আকাশকে খুঁজে বের করার কাজে জুড়ে গেলাম। ইন্টারনেট ঘাঁটা, পুরনো বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ, এমনকি আকাশের স্কুল-কলেজেও গিয়ে খোঁজ নেওয়া।
কিন্তু, কোনো ঠিক সূত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। হাল ছেড়ে দেওয়ার মুহূর্তেই, অভিজিৎ-এর এক কলিজ বন্ধু ফোন করলো। জানালো, সে আকাশকে দেখেছে দক্ষিণ কলকাতার একটা ছোট্ট ক্যাফেতে।
আমরা দু’জনেই উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়লাম। পরের দিনই, সেই ক্যাফেতে গিয়ে ঢুকলাম। ভিড়ের মধ্যে চোখ বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম আকাশকে। হঠাৎ, একটা টেবিলে বসা একজনকে দেখে চমকে উঠলাম। সেই ছেলেটির চোখে-মুখে ছিল আকাশের ছায়া।
অভিজিৎ আমার দিকে চাইলো, চোখে একটা প্রশ্ন। আমি মাথা দিয়ে সায় দিলাম। সাহস করে সেই টেবিলে গিয়ে ছেলেটির কাছে গেলাম। তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। ছেলেটি একটু অবাক হয়ে বললো, “আকাশ।”
মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ আন্দাজ করতে পারলাম। এতদিনের খোঁজা পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু, এখন কিভাবে রিয়া আর আকাশের দেখা করাব, সেটা ভাবিয়ে তুললো।
অভিজিৎ এগিয়ে এসে সব খুলে বললো। রিয়া আর তার গল্প, এত বছরের বিচ্ছেদ আর দেখা করার ইচ্ছে।
আকাশের চোখে অবাকের ছাপ। সে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর, এক গভীর শ্বাস নিয়ে বললো, “আমি রিয়ার সাথে দেখা করব।”
পরের সপ্তাহে, সেই পুরনো পার্কেই আবার দেখা হলো তাদের। রিয়া আর আকাশ। এত বছর পর, দু’টি পরিচিত চোখের মুখোমুখি দেখা। দু’জনের চোখেই জল। কোনো কথা ছাড়াই অনেক কথার আদান-প্রদান হলো সেদিন।
আমরা দু’জনে দূর থেকে দেখছিলাম। মনে মনে খুশি হচ্ছিলাম। হয়তো তাদের গল্পের শেষটা সুখেরই হবে।
কয়েকদিন পর, রিয়া আমাদের অফিসে এলো। হাতে ছিল একটা খাম। খুলে দেখি, রিয়ার আর আকাশের ছবি। দু’জনেই হাসছিল। রিয়া জানালো, আকাশ এখন বিবাহিত। কিন্তু, তার স্ত্রী মারা গেছেন কিছুদিন আগে। ছেলেমেয়ে নেই। রিয়া আর আকাশের দেখা হওয়ার পর, দু’জনেই বুঝতে পারলো, মনের কোণে এত বছর পরেও সেই ভালোবাসা একটুও কমেনি। কিন্তু, পরিস্থিতি এমন যে, আবার একসাথে থাকা সম্ভব নয়।
আমরা রিয়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলাম। হয়তো ভাগ্যে তাদের জীবনে পূর্ণ সুখ লেখা ছিল না। তবে, এত বছর পর একে অপরকে খুঁজে পাওয়া, এটাও কম কি!
রিয়া আমাদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে গেল। খামের মধ্যে রাখা ছবিটা আমরা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
এই গল্পটা আমাদের কাছেও একটা গভীর শিক্ষা দিয়ে গেল। প্রথম প্রেমের জায়গাটা সবসময়ই মনে এক কোণে থেকে যায়। কিন্তু, জীবন সব সময় ইচ্ছামতো চলে না।
কয়েকদিন পর, অফিসে কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই অভিজিৎ আমার দিকে চাইলো। তার চোখে একটা নতুন আশা দেখলাম। হয়তো সেই আশাটাই আমার মনের মধ্যেও জাগিয়ে দিল।
এই অফিস, এই কাজের মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন নতুন মানুষের গল্প শুনি, তাদের জীবনের সঙ্গী খুঁজে দেওয়ার চেষ্টা করি। কখনো সফল হই, কখনো বা হতাশ হই। কিন্তু, এই গল্পগুলো আমাদের নিজেদের জীবনের গল্পকেও একটু একটু করে সাজিয়ে তোলে। হয়তো আমার গল্পের নায়কও কোনো রহস্যময় ক্লায়েন্টের রূপে, অথবা হারিয়ে যাওয়া প্রেমের খোঁজে আসা এক অপরিচিত মানুষের চেহারায় আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। কে জানে?
অভিজিৎ আমার হাতটা ধরলো। চোখে একটা হাসি। সেই হাসিটা যেন আমার মনের কথাগুলোকেই বলে দিল। হয়তো আমাদেরও খুঁজে পাওয়ার সময় এসেছে। এই ব্যস্ত শহরের কোনো এক কোণায়, হয়তো আমাদের দু’জনেরও কোনো অসমাপ্ত প্রেমের গল্প রয়েছে, অথবা ঠিক এখনই শুরু হওয়ার অপেক্ষায় থাকা একটা নতুন প্রেমের গান। হৃদয়মিলনের এই অফিসেরই কোনো ফাইলে, হয়তো আমাদের দু’জনের ভাগ্য লুকিয়ে আছে।
আমরা দু’জনেই জানালায় চেয়ে রইলাম। কলকাতার আকাশে সন্ধ্যার আলো ছড়িয়ে পড়ছে। শহরের গমগমে শব্দ, আর সন্ধেবেলায় ফেরিওয়ালাদের ডাক মিশে এক অদ্ভুত সুর তৈরি করছে। এই শহরের কোনো এক গলিতে, হয়তো আমাদের গল্পেরও শুরু হবে আজ।