কোলকাতার বুকে ঠাসাঠাসি ঝড়ের মধ্যে ঐশী এসেছিল নতুন করে নিজেকে খুঁজতে। মায়ের অকস্মাৎ চলে যাওয়ার শোক এখনো বুকে জ্বালাপোড়া, কাঁচের মতো মনটা যে কোনো মুহুর্তে ভেঙে পড়ার উপক্রম। এই বিশাল শহরে একটা ছোট্ট বইয়ের দোকানে কাজ নেওয়াটাই ছিল তার একমাত্র ভরসা। ‘পুরানো কথা’ নামের সেই দোকানটা ঐশীকে এক অদ্ভুত শান্তি দিয়েছিল। কাঠের আলমারিতে সাজানো হাজারো গল্পের মাঝে হারিয়ে যেতে পারত সে, নিজের গল্পকে একটু দূরে রেখে।
একদিন দোকানে ঢুকে পড়লেন অগ্নি। গায়ের রং একটু গম্ভীর, চোখে এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা। হাতে নিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’। ঐশী যখন বইটা খুঁজে দিলেন, অগ্নি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি পড়েছেন?”
ঐশী একটু অবাক হলেন। সাধারণত কেউ কাস্টমারদের পড়াশোনা নিয়ে প্রশ্ন করে না। কিন্তু, অগ্নির চোখের আন্তরিকতাটা তাকে কথা বলতে বাধ্য করল। “হ্যাঁ, পড়েছি। অনেক আগে।”
“কী মনে হয়েছিল?” অগ্নি আরো একটু কাছে এসে দাঁড়ালেন।
এই রকম কাছাকাছি আসাটা ঐশীর কাছে অস্বস্তিকর মনে হল। কিন্তু, অগ্নির গলায় একটা আন্তরিক কৌতূহল ছিল, যা তাকে আর কথা না বলতে বাধা দিল। তারা দু’জনেই ‘চোখের বালি’ নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। একটা সময় দেখলেন, বেশ কিছুক্ষণ পার হয়ে গেছে।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - স্মৃতির তালা খুলে : মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প: "স্মৃতির তাল খুলে" শোকের অন্ধকারে মেয়ে খুঁজে পেল বাবার গোপন শিল্পী মন ও নিজের হারিয়ে ফেলা স্বপ্ন। এই গল্পে আছে: স্বপ্ন পুনরুদ্ধার, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি, সৃজনশীলতার আহ্বান, পরিবারের ভালোবাসা, জীবনের নতুন শুরু আজই পড়ুন! সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অগ্নি বইটা কিনে নিয়ে বের হওয়ার আগে ঐশীকে বললেন, “আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগল। আবার আসব নিশ্চয়ই।”
ঐশীর মনটা একটু হালকা লাগল। অগ্নির সাথে কথা বলার মধ্যে একটা অন্যরকম স্বস্তি ছিল। তারপর থেকে প্রায়ই আসত অগ্নি। নতুন বই নিয়ে আসতেন, পুরোনো বই নিয়ে আলোচনা করতেন। ঐশীর মায়ের কথাও একদিন বলে ফেললেন তিনি। মায়ের জন্য বুকে জমা কষ্টটা প্রথমবারের মতো কারো কাছে খুলে বলতে পারলেন। অগ্নি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপর কোনো মন্তব্য না করে ঐশীর হাতটা ধরলেন। সেই ধরায় কোনো রোমান্টিক টান ছিল না, বরং একটা নিঃশব্দ সান্ত্বনা ছিল।
এইভাবেই তাদের বন্ধুত্ব গড়িয়ে গেল। ঐশীর অজান্তেই অগ্নি তার জীবনের একটা অংশ হয়ে গেলেন। বইয়ের কথায়, গল্পের আলোচনায়, চায়ের কাপে, আড্ডায় – সব জায়গায় ছিল অগ্নির উপস্থিতি।
কিন্তু, একটা গভীর দুঃখের ছায়াও ছিল অগ্নির জীবনে। ঐশী জানতে পারলেন, অগ্নি পেশায় একজন সাংবাদিক, যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাগুলো থেকে প্রতিবেদন করেন। মৃত্যুকে সহচর করে চলা এই জীবনটা ঐশীকে ভীষণ চিন্তিত করত। অগ্নির চোখের গভীরে সেই সব যুদ্ধক্ষেত্রের ছায়া ফুটে উঠত মাঝেমধ্যে। ঐশীর মনে হতো, অগ্নির মনটা একটা অশান্ত সমুদ্রের মতো, যেখানে ঢেউ খেলে বেড়ায় কষ্টের জল।
বাংলা ছোট গল্প - একাকী ভীড়ের গল্প : এই বাংলা ছোট গল্পটি একাকীত্বের চিত্র তুলে ধরে। ভবিষ্যতে সন্তানের অসমর্থতা আর নিজেদের দুঃখের সাথে লড়াই করে বয়স্ক দম্পতির গল্প। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একদিন অগ্নি এলেন, চোখ দুটি রক্তা লাল। “আমার একটা বন্ধু…” – শুরু করলেন তিনি, কিন্তু গলা ভরে উঠল কান্নায়। ঐশী তাকে জড়িয়ে ধরলেন, কোনো কথা না বলে। অগ্নি তার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ফেললেন। সেদিন ঐশী বুঝলেন, অগ্নির প্রয়োজন শুধু একজন বন্ধু নয়, প্রয়োজন একটা আশ্রয়ের, একটা নিরাপদ কোণের, যেখানে সে নিজের কষ্টগুলো খুলে রাখতে পারবেন। আর ঐশীও বুঝতে পারলেন, অগ্নির প্রতি তার মনে একটা গভীর অনুভূতি জন্ম নিয়েছে।
কিন্তু, নিজের মনের কথাই স্বীকার করতে পারছিলেন না ঐশী। মায়ের মৃত্যুর শোক এখনো কাটেনি, অগ্নির ঝুঁকিপূর্ণ জীবনটাও তাকে দুশ্চিন্তায় ফেলে। একদিন সাহস করে অগ্নিকে তার মনের কথা বললেন ঐশী। “আমি জানি না, কী হচ্ছে আমার সাথে। কিন্তু, তোমাকে দেখতে না পাওয়ার ভয়টা…”
অগ্নি তার কথা শেষ না হতেই ঐশীর গালে হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। তার মুখের একপাশে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল। “আমিও, ঐশী। তোমাকে হারানোর ভয়টা আমারও রয়েছে। কিন্তু, আমার কাজটাই আমার জীবন।”
ঐশীর চোখে জল এলো। সে জানত অগ্নি মিথ্যা বলছেন না। কিন্তু, ভালোবাসা কি কিছু নিশ্চয়তার সাথে বাঁধা? ঐশী নিজের মনেই প্রশ্ন করলেন।
এরপর কয়েকটা দিন অস্বস্তি নেমে এলো তাদের সম্পর্কে। দু’জনেই চুপচাপ থাকতেন, বইয়ের কথায় মনোযোগ দিতে পারতেন না। একদিন দোকান বন্ধ করে দেওয়ার পরে ঐশীকে আটকালেন অগ্নি।
“ঐশী,” একটানা নিঃশ্বাসে বললেন, “আমি ছেড়ে চলে যেতে পারব না। তোমাকে ছেড়ে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু, আমার কাজটাও আমি ছেড়ে দিতে পারি না।”
ঐশী চুপ করে থাকলেন।
“একটা সমঝোতা করতে পারি কি?” অগ্নি একটু এগিয়ে এলেন। “যখনই সম্ভব, ফিরে আসব। তোমার কাছে।”
ঐশী তাকালেন অগ্নির চোখের দিকে। সেখানে দেখলেন এক অসম্ভব দ্বন্দ্বের ছায়া। ভালোবাসার টান ও পেশার দায়িত্ব, দুটোই টানছে তাকে। জানত ঐশী, এই সিদ্ধান্ত সহজ নয়। কিন্তু, সেও তো আর নিজের মনের টানকে অস্বীকার করতে পারবে না।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে ঐশী বলল, “ঠিক আছে, অগ্নি। কিন্তু, প্রতিবার ফিরে এসে আমাকে সব খুলে বলবে। যুদ্ধের মাঠের গল্প, তোমার ভয়, তোমার কষ্ট – সব। আমি শুনব।”
অগ্নির মুখে ফুটে উঠল একটা স্বস্তির হাসি। সে ঐশীকে জড়িয়ে ধরল। “থ্যাংক ইউ, ঐশী। তুমি আমার সব।”
এরপরের দিনগুলো কেটে গেল এক অদ্ভুত সুখের ছোঁয়ায়। অগ্নি যখন থাকতেন, তখন দোকানের পরে ছাদে বসে তারা গল্প করতেন। ঐশী শুনতো দূর দেশের গল্প, যুদ্ধের বীভৎসতা, মানুষের দুঃখ আর সাহসের কথা। অগ্নি শুনতো ঐশীর ছেলেবেলার গল্প, তার লেখালেখার স্বপ্ন। দু’জনের জীবন যেন দুই মেরু, কিন্তু ভালোবাসা সেতু হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদের মাঝে।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - মৃত্যুপুরীর বিদ্রোহ : এই ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্পে 16শ শতাব্দীর বাংলার দাসদের বিদ্রোহের কাহিনী বলা হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন রাজা শ্যামল নামক একজন দাস। এই বাংলা ছোট গল্পে ঐতিহাসিক ঘটনা, কাল্পনিক চরিত্র এবং রোমাঞ্চকর কাহিনীর মিশেল রয়েছে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
কিন্তু, সুখ সবসময় স্থায়ী হয় না। একদিন খবর এলো, অগ্নি যে এলাকায় রিপোর্ট করছেন, সেখানে তীব্র গোলাগুলি চলছে। দিনের পর দিন কোনো খবর নেই। ঐশী ছটফট করে উঠলেন। ঘুম আসে না, খাবার খেতে পারেন না। অবশেষে এক সকালে ফোন করলেন অগ্নি। কণ্ঠটা ভাঙা, কিন্তু একটা স্বস্তি ছিল তার গলায়।
“ঐশী, আমি ঠিক আছি।”
ঐশী আর কিছু বলতে পারলেন না। ফোনের ওপাশে শুধু তার কান্নার শব্দই ভেসে এল।
এরপর আরো অনেকবার এমন অপেক্ষার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে ঐশীকে। কিন্তু, প্রতিবারই অগ্নি ফিরে এসেছেন। আর ফিরে এসে ঐশীর কাছে খুলে বলেছেন সব – যুদ্ধের বর্বরতা, মানুষের হাহাকার, নিজের মৃত্যুভয়। আর ঐশী শুনেছেন, সান্ত্বনা দিয়েছেন। ভালোবাসা আর বিশ্বাসের এই বন্ধনেই টিকে ছিল তাদের সম্পর্ক।
একদিন ঝড়ের রাতে, অগ্নি ফিরলেন একটা চিঠি নিয়ে। ঐশী চিঠিটা খুলে পড়লেন। অগ্নি লিখেছেন, সে এবার আর যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় যাচ্ছেন না। একটা নতুন পথ বেছে নিয়েছে সে, ঐশীর কাছে থাকার পথ। চিঠিটা শেষ করে ঐশী তাকালেন অগ্নির দিকে। অগ্নির চোখে ছিল এক অপার স্নেহের ঝিলিক।
ঐশী জানত, তাদের এই ভালোবাসা কোনো সাধারণ প্রেমের গল্প নয়। এটা ছিল দুই মেরু বিপরীত জীবনের মিলন, নিরাপত্তা ও ঝুঁকির মাঝে এক অবিমিশ্র বন্ধন। অগ্নি যুদ্ধের মাঠ থেকে ফিরে এলে ঐশী তাকে আগলে ধরতেন, যেন আর কখনো ছেড়ে যেতে না দিতে পারা যায়। আর অগ্নি ঐশীর চোখে দেখতেন শান্তির আশ্রয়, সেই নিরাপত্তা যেটা তাকে আবার নতুন করে বাঁচার শক্তি দিত।
একদিন সকালে ঐশী অগ্নিকে দেখালেন তার লেখা একটি গল্প। সেই গল্পে ছিল যুদ্ধের ক্ষত, মানুষের துঃখ, কিন্তু ছিল আরো কিছু। ছিল মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েও মানবিকতার জয়, ছিল ভালোবাসার অদম্য শক্তি। অগ্নি গল্পটা পড়ে মুগ্ধ হয়ে গেলেন।
“এই গল্পটা তো আমার গল্প, ঐশী!” অগ্নি চমকে গিয়ে বললেন।
ঐশী হাসলেন। “হ্যাঁ, কিন্তু এটা তোমার দেখা যুদ্ধের গল্প নয়। এটা সেই যুদ্ধের গল্প, যেখানে ভালোবাসা জেগে ওঠে, আশা জন্ম নেয়।”
অগ্নি ঐশীর হাত ধরলেন। “তুমি ঠিক বলেছো।”
ঐশীর লেখা সেই গল্পটা ছাপা হলো এক বিখ্যাত পত্রিকায়। আর ঐশী হয়ে উঠলেন একজন জনপ্রিয় লেখিকা। তবে তার লেখায় সবসময়ই ফুটে উঠতো অগ্নির অভিজ্ঞতা, যুদ্ধের বাস্তব চিত্র, আর তার পাশে থাকা সেই অবিচল ভালোবাসার গল্প।
এইভাবেই কেটে গেল বছরের পর বছর। ঐশী লিখলেন, অগ্নি লিখলেন তার ক্যামেরার চোখে দেখা গল্প। তাদের জীবন ছিল দুই ধারার মতো, কিন্তু মাঝখানে সেতুবন্ধনে বাঁধা। ঝড় আসত, সূর্য উঁকি দিত, কিন্তু তাদের ভালোবাসা সবসময়ই টিকে থাকল, অটুট ও অবিশ্বাস্য।