পশ্চিমবঙ্গের এক সবুজ পাহাড়ঘেরা ছোট্ট গ্রাম, ফুলবাড়ি। এখানে বাতাসে ফুলের মিষ্টি গন্ধ মিশে থাকে, আর পাখির কূজন সকালবেলাকে সুরভিত করে তোলে। এই গ্রামেই বাস করত এক কৌতূহলী ছেলে, নাম তার কৃষ্ণ। কৃষ্ণের বয়স মাত্র দশ, তবে তার চোখে সর্বদা মুগ্ধতার ঝিলিক। গ্রামবাসী তাকে ভালোবেসে ডাকত “কৃষ্ণ দা”। কারণ তার মন ছিল সবার চাইতে আলাদা। সে সব সময় ভাবত, তার এই ছোট্ট গ্রাম ছাড়িয়ে আরও অনেক কিছু রয়েছে যা সে জানে না।
কৃষ্ণ প্রতিদিন নতুন কিছু খুঁজে পেতে গ্রামের চারপাশে ঘুরে বেড়াত। তার সঙ্গী ছিল গ্রামের চঞ্চল কুকুরছানা, ঝাঁকু। ঝাঁকু ও কৃষ্ণের বন্ধুত্ব যেন আকাশের নীল আর সাদা মেঘের মতো নিবিড়। একদিন সকালে, কৃষ্ণ বনের ধারে একা দাঁড়িয়ে রইল। এই বন ছিল গ্রামবাসীর কাছে রহস্যে ঘেরা; কেউ বনের গভীরে যেতে সাহস করত না। কিন্তু কৃষ্ণের মন কৌতূহলে টগবগ করছিল। সে ঝাঁকুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আজ আমরা বনের গভীরে যাব, ঝাঁকু। দেখি তো, কী আছে সেখানে।”
ঝাঁকু প্রথমে কিঞ্চিত ঘাবড়ে গেলেও কৃষ্ণের কণ্ঠে সাহস পেল। দুজনে বনের ভিতর প্রবেশ করল। পাখির ডাক আর পাতার মর্মর শব্দ তাদের পথ নির্দেশ করছিল। চারপাশে বড় বড় গাছ, যেগুলো বয়সের ভারে ন্যুব্জ, তাদের ডালপালা দিয়ে যেন পথ রোধ করে রেখেছিল। কৃষ্ণ আর ঝাঁকু গভীরে এগিয়ে যেতে থাকল।
অবশেষে তারা এসে পড়ল এক অদ্ভুত জায়গায়। জায়গাটা এতটাই মায়াবী যে, সূর্যের আলো সেখানে এক অন্যরকম সোনালি ছটায় নেমে আসছিল। ফুলগুলো ছিল নীল, বেগুনি আর সোনালি রঙে রঙিন। ঝাঁকু হালকা গম্ভীর গলায় ঘেউ ঘেউ করে উঠল। কৃষ্ণ অবাক চোখে চারপাশ দেখল। ঠিক সেই সময় তার নজরে পড়ল, উপত্যকার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল প্রাচীন বৃক্ষ। তার গায়ে অদ্ভুত সব খোদাই করা ছবি। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল সেই বৃক্ষের গায়ে খোদাই করা ছোট্ট দরজা।
কৌতূহলে কৃষ্ণের মন যেন আর দম মানছিল না। সে কাছে গিয়ে হাত দিয়ে দরজাটির উপর স্পর্শ করল। দরজাটি মৃদু শব্দে খোলা শুরু হল। ঝাঁকু প্রথমে ভয় পেলেও কৃষ্ণ তাকে সান্ত্বনা দিল।
“আয়, ঝাঁকু, দেখি তো ভিতরে কী আছে,” কৃষ্ণ বলল, আর দরজাটি খুলে ভিতরে ঢুকে পড়ল।
ভিতরে ঢুকতেই চারপাশে এক অদ্ভুত আলো ছড়িয়ে পড়ল। এটা যেন কোনো জাদুর জগৎ! দূরে একটা জলধারা বয়ে যাচ্ছে, আর সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সুরের মিষ্টতা যেন বাতাসে মিশে ছিল। হঠাৎ কৃষ্ণ শুনতে পেল, “তোমার স্বাগতম, কৃষ্ণ।”
কৃষ্ণ অবাক হয়ে চারপাশে তাকাল। “কে বলল?” সে প্রশ্ন করল।
তখনই সে দেখতে পেল এক বুদ্ধিমান চেহারার বুড়ো পেঁচা, যার নাম সেজ। সেজ কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। “আমি সেজ। এই জগতে তোমার আগমন বহুদিন পর ঘটল, কৃষ্ণ। তোমার সাহায্য দরকার আমাদের।”
কৃষ্ণ অবাক হয়ে সেজের কথা শুনল। সেজ বলতে লাগল, “এই মায়াবী জগৎ একসময় হাসি-খুশিতে ভরা ছিল। কিন্তু কালিমা নামের এক দুষ্ট জাদুকরী আমাদের সুখ কেড়ে নিয়েছে। এখন সবাই দুঃখে ভুগছে। আমাদের আনন্দ ফেরত পাওয়ার জন্য তোমার সাহস ও ভালোবাসার প্রয়োজন।”
কৃষ্ণ বুঝল, তার সামনে বড় একটি কাজ অপেক্ষা করছে। তবে তার হৃদয়ে কোনো ভয় ছিল না, শুধু উত্তেজনার ঢেউ। সে জানত, এই নতুন অভিযানে সে ঝাঁকুকে নিয়ে অজানা পথে পা বাড়িয়েছে।
“আমি সাহায্য করব,” কৃষ্ণ বলল, চোখে ঝিলিক নিয়ে।
সেজ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। “তাহলে চলো, কৃষ্ণ, তোমার যাত্রা শুরু হোক। তোমাকে রাজার হারানো আনন্দের কণাগুলি সংগ্রহ করতে হবে, যা আমাদের মুক্তির চাবিকাঠি।”
কৃষ্ণের সামনে খুলে গেল এক নতুন পথ, যা তাকে এক অবিস্মরণীয় অভিযানের দিকে নিয়ে যাবে। এবং এভাবেই তার জীবনের সবচেয়ে বড় রূপকথার অধ্যায় শুরু হল।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - ভয়ঙ্কর গোপনীয়তা: "ভয়ঙ্কর গোপনীয়তা" একটি চিত্তাকর্ষক রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অদ্ভুত ঘটনার মাঝ দিয়ে নায়ক থমাস এভেলিনের আত্মাকে মুক্তি দিতে লড়াই করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মায়াবী জগতে প্রথম দেখা
দরজাটি খুলে ভিতরে ঢুকতেই কৃষ্ণ যেন এক আশ্চর্য জগতে পৌঁছে গেল। তার চারপাশে যেন রূপকথার মতো দৃশ্য। গাছের পাতা সোনালি রঙের, ফুলগুলো চমৎকার সব রঙে ঝলমল করছে। আশেপাশে ছোট ছোট ফড়িংয়ের মতো অদ্ভুত প্রাণী উড়ে বেড়াচ্ছে, আর তাদের ডানার ঝাপটায় যেন সুরের মিষ্টি ঝংকার। এমন এক মায়াবী পরিবেশে কৃষ্ণের মন আনন্দে ভরে উঠল, তবে কিছুটা কৌতূহলও ছিল তার চোখে।
ঝাঁকু কৃষ্ণের পাশে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে চারপাশ দেখছিল। হঠাৎই একটা মৃদু ফিসফিসের শব্দ শুনতে পেল তারা। কৃষ্ণ তাকিয়ে দেখল, এক বৃদ্ধ পেঁচা ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে। পেঁচাটির গায়ে সাদা পালকের ছাপ, চোখদুটো গভীর এবং বিজ্ঞের মতো। পেঁচাটি সামনে এসে মৃদু হেসে বলল, “স্বাগতম, কৃষ্ণ। আমি সেজ, এই মায়াবী জগতের অভিভাবক।”
কৃষ্ণ অবাক হয়ে বলল, “তুমি আমার নাম জানো কেমন করে?”
সেজ মৃদু হেসে বলল, “এই জগতের মাটি, গাছ, আর বাতাস সবাই জানে যে আজ এক বিশেষ অতিথি এসেছে। তোমার কৌতূহল আর সাহসই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। কিন্তু তোমার আসার কারণও বড় গুরুত্বপূর্ণ।”
কৃষ্ণ কিছুটা অবাক হয়ে সেজের দিকে তাকাল। “কারণ? এখানে আসার জন্য তো আমি কেবল কৌতূহলী হয়েছিলাম,” সে বলল।
সেজ তার ডানা মেলে হাওয়ায় ঝাপটা মেরে বলল, “তোমার কৌতূহলই তোমাকে এখানে এনেছে। তবে শোনো, এই জগত একসময় ছিল হাসি-খুশিতে ভরা। সব প্রাণী, গাছপালা, এমনকি বাতাসও হাসত। কিন্তু একদিন এক দুষ্ট জাদুকরী, কালিমা, আমাদের সুখ চুরি করে নিয়ে যায়। সবাই এখন দুঃখে ডুবে আছে, এবং সেই দুঃখের ভারে এই জগত ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে।”
কৃষ্ণের মনে একঝটকা লাগল। “আমি কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” সে জিজ্ঞাসা করল।
সেজ তার বড় বড় চোখদুটো মেলে বলল, “তোমার সাহস এবং মনুষ্যত্বই আমাদের আশা। এই অভিশাপ ভাঙতে হলে, তোমাকে এই জগতের হারানো আনন্দের টুকরোগুলি খুঁজে বের করতে হবে। সেগুলি লুকিয়ে আছে বিভিন্ন স্থানে, আর পথটা সহজ নয়। প্রতিটি আনন্দের টুকরো সংগ্রহ করার জন্য তোমাকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ পার করতে হবে।”
এই কথা শুনে কৃষ্ণের চোখে একধরনের আলোর ঝিলিক দেখা দিল। “আমি সাহায্য করব, সেজ। আমাকে বলো, প্রথমে কোথায় যেতে হবে?”
সেজ মৃদু হাসল। “তোমার সাহস আমাকে ভরসা দিচ্ছে, কৃষ্ণ। প্রথমে তোমাকে যেতে হবে ‘রহস্যের বন’—সেখানে একদল দুষ্টু পরী থাকে, যারা রীতিমতো ধাঁধা দিয়ে তোমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। কিন্তু মনে রেখো, তুমি যদি সত্যি মন থেকে বিশ্বাস করো, তবে সব বাধা তুমি পেরিয়ে যেতে পারবে।”
কৃষ্ণ মাথা নাড়ল। সে জানত, এই অভিযানে ঝাঁকু তার সঙ্গী হবে। ঝাঁকু প্রায়ই তার কণ্ঠে সান্ত্বনার সুর ফুটিয়ে তুলত।
“চল, ঝাঁকু,” কৃষ্ণ বলল। “আমাদের অনেক কাজ বাকি।”
তারা ধীরে ধীরে মায়াবী বনের গভীরে পা বাড়াল। গাছের পাতায় সোনালি আলো মৃদু কম্পিত হচ্ছিল, যেন এই অভিযানের সাক্ষী হচ্ছিল বন। পথটা কখনও কাঁটাময়, কখনও মসৃণ। দূর থেকে পাখির ডাক আর ঝর্ণার শব্দে যেন এক আশ্চর্য সুর বেজে উঠছিল।
হঠাৎ, একটা মৃদু হাসির শব্দ শুনে কৃষ্ণ থেমে গেল। “কে ওখানে?” সে প্রশ্ন করল। ঝাঁকু সতর্ক হয়ে দাঁড়াল।
তখনই পাতার আড়াল থেকে এক ছোট্ট পরী বেরিয়ে এল। তার ডানায় রূপোলি আলো চিকচিক করছিল। পরীটা মিষ্টি গলায় বলল, “তোমরা রহস্যের বন পেরিয়ে যেতে চাও? আগে আমাদের ধাঁধা সমাধান করো।”
কৃষ্ণের মন ভরে উঠল নতুন উত্তেজনায়। সে জানত, এই ধাঁধাগুলি সমাধান করে এগোতে পারলেই তার গন্তব্যের আরও কাছে পৌঁছাতে পারবে।
বন্ধুত্বের পাঠ
কৃষ্ণ সেজের নির্দেশনা মেনে রহস্যের বনের পথে যাত্রা শুরু করল। ঘন সবুজ গাছপালার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে তার কানে আসছিল বিভিন্ন প্রাণীর কণ্ঠস্বর। ঝিঁঝি পোকার মৃদু ডাক আর পাতার মর্মরধ্বনি যেন এক সুরময় মিউজিকের মতো শোনা যাচ্ছিল। ঝাঁকু পাশে উড়ে উড়ে কখনও কৃষ্ণের কাঁধে বসে, কখনও তার চারপাশে ঘুরছিল।
বনের ভিতরে ঢোকার কিছুক্ষণ পরেই কৃষ্ণের সামনে এসে দাঁড়াল একদল খেয়ালী পরী। তাদের ডানার ঝিলিক ছিল রূপোলি, আর চোখে ছিল এক ধরনের দুষ্টু মিষ্টি চাহনি। প্রধান পরীটি সামনের দিকে এগিয়ে এসে বলল, “আমরা শুনেছি তুমি এই বনের রহস্য খুঁজতে এসেছো। তবে সহজে যেতে দিতে পারব না। তোমাকে আমাদের ধাঁধার উত্তর দিতে হবে।”
কৃষ্ণ হেসে বলল, “তোমরা ধাঁধা দিতে চাও? ঠিক আছে, বলো কী ধাঁধা।”
প্রধান পরীটি মিষ্টি গলায় বলল, “আমার প্রথম ধাঁধা শুনো:
আমার না আছে চোখ, না আছে মুখ,
তবু আমি দেখাই পথ সব দিকে—বুক।
আমি কে?”
কৃষ্ণ কিছুক্ষণ চিন্তা করল। সেজ মৃদু হাসল, যেন ইশারায় বলল, ‘তোমার মনের কথা শুনো’। কৃষ্ণ হঠাৎ বুঝতে পারল, উত্তরটি বাতাস। সে বলল, “উত্তর হলো বাতাস।”
পরীর মুখে হাসি ফুটল। “সত্যিই, তুমি ঠিকই বলেছো। কিন্তু এবার আরও কঠিন ধাঁধা। শুনো:
দুটি পায়ে হাঁটি না আমি, তবু ছুটে চলি,
জলে আছি আমি, আবার বৃষ্টির পরে ঝরি।
আমার নাম কী?”
কৃষ্ণ কিছুটা অবাক হয়ে ভাবতে লাগল। ঝাঁকু তার ছোট্ট পাখির কণ্ঠে বলল, “মনে পড়ে, নদীর শব্দ কেমন ছিল?”
“নদী!” কৃষ্ণ জোরে বলল। পরীরা একসাথে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। প্রধান পরীটি বলল, “ঠিক বলেছো, কৃষ্ণ। এবার তুমি পারো আমাদের বন পেরিয়ে যেতে।”
কৃষ্ণ পরীদের সাথে কথা বলে বুঝতে পারল, তারা আসলে মন্দ ছিল না। শুধু নতুন বন্ধুর খোঁজে থাকত আর খেলা পছন্দ করত। কৃষ্ণের মধ্যে এক ধরনের ভালোবাসা আর সহানুভূতি জন্মাল এই ছোট্ট পরীদের জন্য। সে বলল, “তোমরা খুব মজার। আমি আনন্দের কণা সংগ্রহ করছি, তোমরা কি আমার সাহায্য করতে পারবে?”
পরীরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ ফিসফিস করে কথা বলল। তারপর প্রধান পরী বলল, “আমাদের একটা ছোট্ট কাজ করলেই আমরা তোমাকে আনন্দের প্রথম কণা দেবো। আমাদের বন্ধু গুঁটু, যে এক ছোট্ট মৌমাছি, হারিয়ে গেছে। তাকে খুঁজে এনে দাও।”
কৃষ্ণ রাজি হয়ে চারদিকে খুঁজতে বের হল। ঝাঁকু তার সঙ্গী হয়ে চারদিক খুঁজছিল। অবশেষে তারা একটা ছোট্ট ফুলের গাছের তলায় গুঁটুকে কাঁদতে দেখল। কৃষ্ণ এগিয়ে গিয়ে বলল, “গুঁটু, তুমি এখানে কেন?”
গুঁটু কেঁদে বলল, “আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। বাড়ি ফিরে যেতে চাই।”
কৃষ্ণ তার হাত বাড়িয়ে দিল। “চলো, আমি তোমাকে তোমার বন্ধুদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাই।”
গুঁটু খুশিতে ভরে গেল। পরীদের কাছে ফিরে আসার পর, প্রধান পরীটি খুশি হয়ে বলল, “তোমার এই সহানুভূতি আর বন্ধুত্বের জন্য, আমরা তোমাকে আনন্দের প্রথম কণা উপহার দিচ্ছি।”
একটি ছোট্ট সোনালি আলোর বল কৃষ্ণের সামনে ভেসে উঠল। কৃষ্ণ অবাক হয়ে দেখল, আলোর বলটি মৃদু সুরে গুনগুন করছে। সেজ এসে বলল, “তুমি প্রথম কণা সংগ্রহ করতে পেরেছো, কৃষ্ণ। তোমার বন্ধুত্ব আর সহানুভূতি তোমাকে আরও পথ দেখাবে।”
কৃষ্ণ হাসল। সে জানত, এ যাত্রা সহজ নয়, কিন্তু নতুন বন্ধুরা এবং তার সাহস তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
ছোটদের রূপকথার গল্প - কুকিজের খুশি: "কুকিজের খুশি" – ছোটদের রূপকথার গল্প যেখানে ছোট্ট লীলা তার হৃদয় দিয়ে কুকিজ বানিয়ে অনাথ শিশুদের মুখে হাসি ফোটায়। ছোটদের গল্প যা ভালোবাসা ও আনন্দ ছড়িয়ে দেয় প্রতিটি পৃষ্ঠায়। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
ছায়ার বন
কৃষ্ণ আর সেজের যাত্রা ধীরে ধীরে গভীরতর হয়ে উঠল। তারা এবার এসে পৌঁছল এক বিশাল কালো বনের সামনে, যেটাকে গ্রামের লোকেরা “ছায়ার বন” নামে চিনত। এই বনে প্রবেশ করার সাহস খুব কম মানুষই করত, কারণ বনের ছায়াগুলি যেন জীবন্ত ছিল, নীরবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকত। পাখিদের কণ্ঠস্বরও এই বনে ঢুকে কেমন যেন থেমে যেত, আর বাতাসও কেমন ভারী লাগত।
কৃষ্ণের মনে একটু ভয় জাগল, কিন্তু সেজ তার পাশে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে বলল, “কৃষ্ণ, মনে রেখো, এই বন কালিমার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সৃষ্টি। তবে তোমার সাহস আর ভালোবাসা, আর তোমার বন্ধুদের প্রতি সহানুভূতিই তোমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।”
কৃষ্ণ গভীর শ্বাস নিল। “আমি পারব সেজ, আমি জানি।”
বনের মধ্যে ঢুকতেই কৃষ্ণ টের পেল, অন্ধকার যেন তাকে ঘিরে আসছে। ছায়াগুলি কেমন যেন সরে সরে পথের চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু ছায়া তার দিকে হাত বাড়িয়ে ছিল, আবার কিছু দূর থেকে কটমট করে তাকাচ্ছিল। হঠাৎ সে শুনতে পেল, পাতার মধ্যে থেকে কেমন একটা মৃদু ‘মিউ মিউ’ আওয়াজ আসছে।
কৃষ্ণ থমকে দাঁড়াল। সেজ সতর্ক হয়ে বলল, “দেখে শোনো, এই বনে যেকোনো কিছুই হতে পারে।”
কিন্তু কৃষ্ণের কৌতূহল তাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গেল। একটা ঝোপের আড়াল থেকে সে দেখতে পেল, একটা ছোট্ট, সাদা বিড়ালছানা ভয়ে কাঁপছে। বিড়ালছানাটির চোখে জল, আর তার ছোট্ট শরীরটা কাঁপছে ভয়ে। কৃষ্ণের হৃদয় দ্রব হয়ে গেল। সে ধীরে ধীরে বিড়ালছানার দিকে হাত বাড়াল। “আয়, ছোট্ট বন্ধুটি। আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
বিড়ালছানাটি প্রথমে পিছু হটতে চাইল, কিন্তু কৃষ্ণের মিষ্টি কণ্ঠ শুনে সে ধীরে ধীরে শান্ত হল। কৃষ্ণ বিড়ালছানাটিকে তার হাতে তুলে নিল। ঠিক সেই মুহূর্তে ছায়াগুলির মধ্যে একটা মৃদু আলো দেখা দিল। সেজ মৃদু হেসে বলল, “তোমার ভালোবাসাই এ বনের ভয়কে কাটিয়ে দিয়েছে, কৃষ্ণ। এগিয়ে চলো।”
অন্ধকার ধীরে ধীরে পাতলা হয়ে গেল, আর বনের গাঢ় ছায়াগুলি ম্লান হয়ে পড়ল। আশেপাশের বাতাসে একটা নরম, উষ্ণ আলো জ্বলে উঠল, আর সেই আলো যেন বনের গাছগুলিকে নতুন জীবন দিল। পাখিরা আবার ডাকতে শুরু করল, আর গাছের ডালগুলির মধ্যে ছোট ছোট ফুল ফুটে উঠল।
বিড়ালছানাটি কৃষ্ণের বুকে মাথা ঠেকিয়ে আনন্দে মিউ মিউ করল, আর তার ছোট্ট লেজটা নাচতে লাগল। কৃষ্ণ বুঝল, এই বন্ধুত্ব আর ভালোবাসা শুধু তাকে নয়, আশেপাশের সবাইকেই শক্তি দিচ্ছে।
বনের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর সময়, সেজ বলল, “এই ছায়ার বনের শেষে আছে কালিমার দুর্গের পথ। এবার শুরু হবে সবচেয়ে কঠিন পর্ব।”
কৃষ্ণ গভীর শ্বাস নিয়ে সামনের দিকে তাকাল। বিড়ালছানাটি তার পিঠের পাশে চুপ করে বসে রইল, যেন তার নতুন সঙ্গীর সঙ্গে এগিয়ে চলার প্রতিজ্ঞা করছে।
আনন্দের কণা সংগ্রহ
কৃষ্ণ গভীর শ্বাস নিয়ে তার হাতের মধ্যে থাকা ছোট্ট জ্বলজ্বলে রত্নটিকে দেখল। এই রত্নটি তার সংগ্রহ করা প্রতিটি আনন্দের কণার থেকে তৈরি হয়েছে। প্রতিটি কণার মধ্যে ছিল বন্ধুত্ব, সাহস আর ভালোবাসার গল্প, যা সে তার যাত্রার পথে অর্জন করেছে। রত্নটি এমন আলো ছড়াচ্ছিল, যেন তা রাতের অন্ধকারকে মুছে দিয়ে চারপাশে এক উষ্ণ আলো জ্বেলে দিচ্ছে।
সেজ তার পাখনার পালকগুলো ঠিকঠাক করতে করতে বলল, “তুমি এখন প্রস্তুত, কৃষ্ণ। এই রত্নের শক্তি কালিমার অভিশাপ ভাঙার চাবিকাঠি। এখন আমাদের কালিমার দুর্গে যেতে হবে।”
দূরে কালিমার দুর্গের ধূসর মেঘাচ্ছন্ন আকাশ আর তীক্ষ্ণ মিনারগুলো দেখা যাচ্ছিল। দুর্গের চারদিকে ঘন কালো ঝড়ো মেঘ ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আর মাঝে মাঝে বাজ পড়ার মতো শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু কৃষ্ণের মন ভয় নয়, বরং উত্তেজনা আর আশা দিয়ে ভরে উঠেছিল।
“আমরা কীভাবে যাব, সেজ?” কৃষ্ণ প্রশ্ন করল, রত্নটি শক্ত করে ধরে।
“আমাদের পথ দেখাবে তোমার সাহস আর এই রত্নের আলো,” সেজ বলল। সে এক মৃদু সুরে মন্ত্র পড়তে শুরু করল, আর হঠাৎই তাদের চারপাশে হাওয়ার গতি বাড়ল। রত্নটির আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর তাদের চারপাশে আলোয় মোড়া একটি পথ তৈরি হল।
“এই পথই আমাদের সরাসরি কালিমার দুর্গে নিয়ে যাবে,” সেজ বলল। “তবে মনে রেখো, এই পথে আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারি। সাহস হারিয়ো না।”
কৃষ্ণ একটুও দ্বিধা না করে সামনে এগোল। তার পাশে বিড়ালছানাটি খুটখুটে চোখে সব কিছু দেখছিল, আর মাঝে মাঝে তার লেজ নাড়ছিল।
পথে এগোতে গিয়ে তারা দেখতে পেল এক বিশাল জলপ্রপাত, যার জল কালো আর ঘন ছিল, যেন গভীর অন্ধকার থেকে উঠে আসছে। জলপ্রপাতের সামনে একটি পাথরের মূর্তি দাঁড়িয়ে ছিল, যার চোখে ছিল লাল জ্বলজ্বলে আলো। কৃষ্ণ বুঝল, এটি তাদের পথের প্রথম চ্যালেঞ্জ।
মূর্তিটি গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তোমরা যদি সত্যি এই পথ পার হতে চাও, তবে প্রমাণ করতে হবে যে তোমাদের মধ্যে সাহস আছে।”
কৃষ্ণ কিছুক্ষণ মূর্তিটির চোখে তাকিয়ে রইল। তারপর সে বলল, “আমরা সাহস আর ভালোবাসার শক্তিতে বিশ্বাস করি। আমরা একে অপরকে সাহায্য করি এবং পাশে থাকি। এটাই আমাদের সত্যিকারের শক্তি।”
মূর্তিটি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে তার লাল চোখের আলো ফিকে হয়ে গেল। জলপ্রপাতের জল হালকা হয়ে গেল, আর তারা সেই জল পার হয়ে এগিয়ে গেল।
পথে আরও অনেক অদ্ভুত প্রাণী আর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হল কৃষ্ণ। কখনো এক দুষ্ট বাদুড়ের দল তাকে ভয় দেখাতে চেষ্টা করল, আবার কখনো ছায়ারা পথ আটকাল। কিন্তু প্রতিবারই কৃষ্ণ তার সাহস, বুদ্ধি আর তার সাথে থাকা বন্ধুর সাহায্যে সেই বাধা অতিক্রম করল।
প্রতিটি বাধা পেরিয়ে রত্নটি আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। তার আলোয় কালিমার অভিশপ্ত অন্ধকার ক্রমেই দূর হয়ে যাচ্ছিল। সেজ প্রশংসায় বলল, “তুমি অসাধারণ, কৃষ্ণ। এই আলোর শক্তি আমাদের সঠিক পথ দেখাচ্ছে।”
যতই তারা দুর্গের কাছে এগোতে লাগল, ততই আশেপাশের প্রকৃতি যেন ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগল। পাখিরা তাদের সুরে গান ধরল, গাছের পাতাগুলো সজীব হয়ে উঠল।
একটি বিশেষ মুহূর্তে কৃষ্ণ দাঁড়িয়ে দূরের দুর্গের দিকে তাকাল। কালিমার দুর্গ অন্ধকার আর ভয়ের প্রতীক হলেও, কৃষ্ণ জানত, তার ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর সংগ্রহ করা আনন্দের কণা দিয়ে সে এই অভিশাপকে চিরতরে দূর করতে পারবে।
“চল, সেজ। এবার কালিমার মুখোমুখি হওয়ার সময় এসেছে,” কৃষ্ণ দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - ভালবাসার পুনর্জন্ম: "ভালবাসার পুনর্জন্ম" একটি রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে মায়া ও ঋষির সম্পর্ক নতুন করে গড়ে ওঠে, এবং দেব নতুন জীবনের পথে পা বাড়ান। অনুভূতি ও ক্ষমতার কাহিনী। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
কালিমার মোকাবিলা
কালিমার দুর্গের সামনে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণ গভীর শ্বাস নিল। দুর্গটি বিশাল এবং মেঘে ঢাকা অন্ধকারে যেন হারিয়ে গিয়েছিল। দুর্গের প্রতিটি কোণ থেকে কালো ছায়া বেরিয়ে আসছিল, তাদের হিংস্র চোখে ছিল ভয়ানক ঝলকানি। বিড়ালছানাটি কৃষ্ণের পায়ে গা ঘষে মিউ মিউ করে সান্ত্বনা দিতে লাগল, আর সেজ তার পাখা মেলে প্রস্তুত থাকল।
“এবারই সত্যিকারের পরীক্ষা, কৃষ্ণ,” সেজ মৃদুস্বরে বলল। “তোমার সাহস, ভালোবাসা আর সংগৃহীত আনন্দের শক্তি দিয়েই কালিমার অভিশাপ ভাঙতে হবে।”
কৃষ্ণ ধীরে ধীরে দুর্গের দরজা ঠেলে খুলল। দরজার কড়া শব্দ চারপাশের নীরবতা ভেঙে দিল। ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডা হাওয়া তার মুখে আঘাত করল। গা ছমছম করা অন্ধকারে চারদিকে কেবল ছায়ারা নড়াচড়া করছিল। তাদের নীরব গর্জন আর অশুভ চোখের জ্বলজ্বলে আলো দেখে অন্য কেউ হলে হয়তো ভয়ে জমে যেত, কিন্তু কৃষ্ণ ভয় পেল না। তার হৃদয়ে ছিল সেজের মন্ত্রমুগ্ধ সুর আর সেই রত্নের জ্বলজ্বলে আলো।
কালিমা হঠাৎই তার সামনে আবির্ভূত হল। সে এক উচ্চদেহী কালো ছায়ামূর্তি, যার চোখে ছিল আগুনের শিখার মতো তীব্রতা। কালিমা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “কে আমার ঘুম ভাঙালো? কে আমার রাজত্বে আনন্দের আলো আনতে চায়?”
কৃষ্ণ তার কণ্ঠ দৃঢ় রেখে বলল, “আমি, কৃষ্ণ। এই রত্নে আছে সেইসব সুখ আর আনন্দ যা তুমি চুরি করেছ!”
কালিমা ফিসফিস করে হেসে উঠল, যেন দুঃস্বপ্নের রাত্রিতে বাতাসে ভেসে আসা শীতল গর্জনের মতো। “তুমি কি ভেবেছ, এই ছোট্ট রত্নের শক্তি আমার মহাজাদুকে হারাতে পারবে?”
এরপর চারদিকের ছায়াগুলি সজীব হয়ে উঠল। তারা ঘিরে ধরল কৃষ্ণকে, তার চারদিকে ঘন অন্ধকারের এক দেয়াল তৈরি করল। সেজ দ্রুত ফিসফিস করে বলল, “কৃষ্ণ, নিজের হৃদয় থেকে আলোকে ডেকে নাও। রত্নের শক্তি ব্যবহার করো।”
কৃষ্ণ চোখ বন্ধ করল এবং মনে মনে তার যাত্রার প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণ করল—বন্ধুত্বপূর্ণ পরীদের সাথে ধাঁধার খেলা, ছোট্ট বিড়ালছানার উদ্ধার, এবং ছায়ার বনে সাহসের পরীক্ষার স্মৃতি। প্রতিটি স্মৃতি তার হৃদয়ে এক নতুন শক্তি জাগিয়ে তুলল।
সে রত্নটি উঁচু করে ধরে বলল, “এই রত্নে রয়েছে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব, আর সেই সুখের কণা যা কেউ কেড়ে নিতে পারে না। তোমার কালো জাদু এখন শেষ।”
রত্ন থেকে হঠাৎই প্রবল আলোর ঝলকানি ছড়িয়ে পড়ল। সেই আলো এতটাই উজ্জ্বল ছিল যে চারপাশের ছায়ারা আর কালিমা চোখ বন্ধ করতে বাধ্য হল। অন্ধকারের দেয়াল ভেঙে গিয়ে আলোর ঢেউ দুর্গের প্রতিটি কোণ ভাসিয়ে দিল।
কালিমা কেঁপে উঠল, তার ছায়ামূর্তি ক্ষীণ হতে শুরু করল। “না… এ কী হচ্ছে?” কালিমা আর্তনাদ করে উঠল, তার চোখ থেকে কালো অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে তার শক্তি লোপ পেয়ে গেল, আর সে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, যেন কোনো কাল্পনিক গল্পের এক ভয়াবহ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।
কৃষ্ণের চারপাশের ছায়া মিলিয়ে গেল, আর দুর্গের দেয়াল থেকে কালো অভিশাপ দূর হতে লাগল। দুর্গটি যেন নতুনভাবে জীবন ফিরে পেল। ফুলেরা ফুটে উঠল, জানালায় পাখিরা গান ধরল, আর চারপাশের প্রকৃতি আনন্দে ভরে উঠল।
“তুমি পেরেছ, কৃষ্ণ!” সেজ উল্লাসে বলল, তার ছোট পাখাগুলি আনন্দে ঝাপটাতে লাগল। বিড়ালছানাটিও খুশিতে মিউ মিউ করে নাচতে শুরু করল।
কৃষ্ণ তার শ্বাস সামলে চারপাশের পরিবর্তন দেখল। তার চোখে জল এসে গেল, কিন্তু সেটা আনন্দের জল। সে সেজকে বলল, “এখন আমরা সবাই মিলে শান্তি ও সুখ ফিরিয়ে আনতে পারব।”
তবে হঠাৎই, এক দূর থেকে মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “কৃষ্ণ, তোমার কাজ এখানেই শেষ নয়। তোমার সামনে আরও একটি গোপন সত্য অপেক্ষা করছে।”
কৃষ্ণ বিস্মিত হয়ে সেদিকে তাকাল। “কে?” তার মনের মধ্যে নতুন প্রশ্ন উঁকি দিল, আর তার অভিযানের এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল।
মুক্তির উৎসব
আলোর ঝলকানিতে কালিমার অভিশাপ ভেঙে যাওয়ার পর পুরো রাজ্য যেন নতুন জীবন ফিরে পেল। দুর্গের চারপাশে ফুল ফোটার আওয়াজ আর পাখির কলরব মিশে চারদিকে এক মধুর সুর সৃষ্টি করল। বৃক্ষেরা সবুজ আচ্ছাদনে ঢেকে গেল, ঝর্ণার জল স্ফটিকের মতো ঝলমল করে বয়ে চলল, আর শিশির বিন্দুর মতো আলো ঝিলমিল করতে লাগল। এমন দৃশ্য দেখে কৃষ্ণের চোখে আনন্দের অশ্রু জমল।
রাজ্যের মানুষজন যারা এতদিন কালিমার ভয়ে অন্ধকারে দিন কাটিয়েছিল, তারা একে একে দুর্গের দিকে এগিয়ে এল। তাদের মুখে ছিল বিস্ময়ের ছাপ এবং চোখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। বৃদ্ধ থেকে শিশু, সবাই আনন্দে হাততালি দিতে শুরু করল। “বাঁচাও কৃষ্ণ! আমাদের বীর!” তাদের কণ্ঠস্বর পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল ঘুরে ফিরে ধ্বনিত হতে লাগল।
সেজ তার ছোট্ট পাখা মেলে কৃষ্ণের কাঁধে বসল। “তুমি প্রমাণ করেছ, সত্যিকারের সাহস আর ভালোবাসা দিয়ে যে কেউ বড় কিছু করতে পারে,” সে বলল। তার চোখে গর্বের দৃষ্টি ছিল।
“আমি কিছুই করিনি একা,” কৃষ্ণ বিনম্রভাবে বলল। “তোমার সাহায্য আর ভালোবাসা ছাড়া আমি কখনোই সফল হতে পারতাম না।”
বিড়ালছানাটি আনন্দে লাফিয়ে উঠল এবং কৃষ্ণের পায়ে গা ঘষল। সেই ছোট্ট প্রাণীটির চোখে কৃতজ্ঞতার মৃদু আলো ছিল।
এরপর শুরু হল মুক্তির উৎসব। রাজ্যের কেন্দ্রীয় প্রাঙ্গণে বিশাল এক মেলার আয়োজন করা হল। চারদিকে লাল-নীল রঙের পতাকা উড়তে লাগল, ফুলের মালায় সাজানো হল বড় বড় বৃক্ষ। রাজ্যের বংশীধারীরা মিষ্টি সুর বাজাতে শুরু করল, আর তাদের সুরের সঙ্গে পাখিরা গলা মেলাল।
প্রাণীদের সাথে নিয়ে সেজ, কৃষ্ণকে এক কোলাহলময় নাচে টেনে নিল। বিড়ালছানাটি খুশিতে তার লেজ দুলিয়ে নাচতে শুরু করল। এমন এক দৃশ্য ছিল যা কখনোই ভুলবে না কৃষ্ণ। সে অনুভব করল, এই মুহূর্তে তার সমস্ত কষ্ট, দ্বিধা, ভয় – সবকিছুই সার্থক হয়েছে।
রাজ্যের রাজার পক্ষ থেকে এক বিশেষ পুরস্কার ঘোষণা করা হল। কৃষ্ণকে সোনার মুকুট আর রত্নখচিত তলোয়ার দিয়ে সম্মানিত করা হল। রাজা বললেন, “কৃষ্ণ, তোমার মতো সাহসী কেউ নেই। এই রাজ্য আজ তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।”
কৃষ্ণ নম্রতার সাথে সেই সম্মান গ্রহণ করল। তবে তার মন জানত, সে শুধুমাত্র নিজের জন্য নয়, সবকিছুর উপরে ভালোবাসা, বন্ধুত্ব আর সাহসের জন্যই আজ এই যাত্রা সম্পূর্ণ করতে পেরেছে।
উৎসবের শেষ পর্যায়ে সেজ কৃষ্ণকে বলল, “তুমি জানো, এই মাটির উপর তোমার পায়ের ছাপ আজীবন থেকে যাবে। কিন্তু তোমার ভিতরকার সেই দুঃসাহসিক মন আজীবন তোমাকে নতুন অভিযানে ডাক দেবে।”
কৃষ্ণ মৃদু হাসল। “আমি জানি, সেজ। আজকের এই যাত্রা কেবল শুরু। আমি জানি, ভবিষ্যতে আরও অনেক অভিযানে যেতে হবে, হয়তো আরও কঠিন, আরও রহস্যময়।”
সূর্য তখন অস্ত যাচ্ছে, আকাশে লাল-সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়ছে। সেই আলোয় কৃষ্ণের চোখে এক নতুন স্বপ্ন ফুটে উঠল।
সে নিজের গ্রামে ফিরে গেল, কিন্তু তার হৃদয় জানত, তার ভেতরের সেই আলো কখনোই নিভবে না।