পলাশী ময়দানের ধূলিমিশ্রিত বাতাসে মৃত্যু ঘোড়ার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। দুপুরের রোদ তীব্র হলেও যুদ্ধক্ষেত্রে যেন শীতকালের প্রবল হিমায়ন। দু’পক্ষের সৈন্যরা রক্তের নদীতে ভেসে যাচ্ছিল। সেই রক্তাক্ত সমুদ্রের মাঝেই দুজন যোদ্ধা একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল। একজনের পিঠে লাল সিংহের প্রতীক, অপরজনের বুকে নীল কমল।
লাল সিংহের নাম রণবীর। বীরত্বের স্বরূপ তার ধারালো খড়গ। কিন্তু এই মুহূর্তে খড়গ তার হাত থেকে ফসকে পড়েছে। বুকে গভীর একটা জখম। ধীরে ধীরে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। পাশের একটি পুরনো বটগাছ ধরে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেও পায়ের জোর ক্ষীণ হয়ে আসছে।
নীল কমলের অবস্থাও একই রকম। তার হাতেও আর তীর নেই। বুক ফেঁটা গভীর একটা জখম। সেও একটি পলাশ গাছ ধরে নিজেকে টেনে নিয়েছে। দুজনেই একে অপরকে চিনে। চেনে তাদের শত্রুতা, চেনে তাদের বীরত্ব। কিন্তু এই মুহূর্তে তাদের মধ্যে কোনও শত্রুতা নেই, শুধুই অস্তিত্বের এক তীব্র আকাক্ষা।
রণবীরের মনে হঠাৎ একটা ভাব আসে। মৃত্যু এসে গেছে, তার আগে কিছু একটা রেখে যেতে হবে। কলম-কাগজ নেই, তবুও কবিতা লিখতে ইচ্ছে করছে। সে চোখ বুঁজে, মনে মনে কবিতা গুণতে শুরু করে।
“লাল রক্তের দাগ, নীল আকাশের ছায়া, মৃত্যু এসে ধরেছে, আমার প্রাণের সাথে খেলা। পলাশীর ময়দান, সাক্ষী হবে আমার বিদায়ের, অসমাপ্ত কবিতা, হবে আমার শেষ উপহার।”
এমন সময় নীল কমলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “কবিতা বলতে পারো? মৃত্যুর সময় কবিতা? আচ্ছা, শুনি।”
রণবীর অবাক হয়ে তাকায়। এই মুহূর্তেও তার কটূক্তি? তবুও শুরু করে, “শুনছেন…”
নীল কমল কান পাতে। কিন্তু কথা শেষ হতে না হতেই বলে ওঠে, “এ কী কবিতা! ছন্দ নেই, ভাবনা নেই। শুধুই মৃত্যুর ভার।”
রণবীরের মুখে হাসি ফোটে। মৃত্যুর সময়ও এই মানুষটির কবিতা নিয়েই মাথা ব্যথা!
“ঠিক আছে, শুনুন আরেকটি,” বলে সে আবার শুরু করে…
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - ভবিষ্যতের ছায়া: কল্পবিজ্ঞান গল্প এক বাড়িতে লুকিয়ে থাকা রহস্যের গল্প। অন্ধকার শক্তি, ভবিষ্যৎবাণী, এবং এক যুদ্ধের কাহিনী। বাংলা ছোট গল্পে এই রোমাঞ্চকর যাত্রায় যোগ দিন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
রণবীরের দ্বিতীয় কবিতা শুরু হল, “পলাশীর রণভূমি, মৃত্যুর খেলাঘর, দুই যোদ্ধার সংগ্রাম, শেষ পর্যন্ত হার। লাল রক্ত, নীল আকাশ, মিশে গেছে একাকার, জীবনের পালা শেষ, মৃত্যুর পথে ধার।”
নীল কমল আবারও কটাক্ষ করে, “এইবার ছন্দটা ঠিক হয়েছে, কিন্তু ভাবনা তো ওই তো! মৃত্যুকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছে। কিছু নতুনতা দেখাও।”
রণবীর হেসে ফেলল। এই মানুষটির কবিতা নিয়ে আগ্রহ দেখে সে আশ্চর্য হচ্ছিল। মৃত্যুর সামনেও তার মনে কবিতার প্রতি এত ভালোবাসা!
“ঠিক আছে, শুনুন,” বলে সে আবার শুরু করে, “চাঁদ উঠল আকাশে, তার আলো পড়ল আমাদের গায়ে, মৃত্যু এসেছে কাছে, কিন্তু মনটা হয়েছে শান্ত। জীবনের যুদ্ধ শেষ, হারলাম আমি, তবুও মনে শান্তি, চাঁদের আলোয় ভাসি।”
নীল কমলের মুখে প্রথমবারের মতো একটা নরম ভাব দেখা গেল। “এই কবিতাটা ভালো হয়েছে। চাঁদের সাথে মৃত্যুর মেলানো, ভালো ধারণা।”
রণবীরের মনে আশা জাগল। হয়তো সে সঠিক পথে এগোচ্ছে। সে আবারও শুরু করল, “জীবন যুদ্ধের মাঠ, মৃত্যু শান্তির ঘর, প্রতিটি মুহূর্ত, একটি নতুন স্বর। আমরা দুজন শত্রু, কিন্তু কবিতায় মিল, মৃত্যুর আগুনে পুড়ে, হয়ে উঠলাম শীতল।”
নীল কমল গভীর নিঃশ্বাস নিল। “এবার তো সত্যিই ভালো হয়েছে। মৃত্যুকে এভাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম।”
রণবীরের মনে একটা আশ্চর্য অনুভূতি হল। শত্রু হলেও এই মানুষটির সাথে তার একাত্মতা হচ্ছে। মৃত্যুর ছায়ায় দাঁড়িয়েও তারা কবিতার জগতে হারিয়ে যাচ্ছে।
দুজনেরই শ্বাস ক্রমশ ধীর হয়ে আসছিল। কিন্তু কবিতার আলাপ চলছিল। তারা যেন ভুলে গিয়েছিল মৃত্যুকে, হারিয়ে গিয়েছিল কবিতার জগতে।
রণবীরের শেষ শক্তি নিয়ে শুরু হল তার শেষ কবিতা, “জীবন নদী বয়ে গেল, মৃত্যু সাগরে মিলল, স্মৃতির তরঙ্গে ভাসি, হৃদয় শান্ত হয়ে গেল। তুমি আমার শত্রু, কিন্তু কবিতার সহযাত্রী, এই মুহূর্তে আমি শান্ত, তোমার হাত ধরে চলি।”
কথা শেষ হতে না হতেই রণবীরের মাথা নিচু হয়ে গেল। নীল কমলের চোখে জল এসে গেল। সে রণবীরের হাত ধরে, তার কবিতা শেষ করল, “তুমি চলে গেলেও, তোমার কবিতা থাকবে, আমার হৃদয়ে জ্বলবে, স্মৃতির আলো হবে।”
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - রক্তিনী বাড়ির রহস্য: রক্তিনী বাড়ির ভয়াবহ রহস্য! এক মেয়ের জীবন এবং একটি শাপগ্রস্ত বাড়ির কাহিনী। বাংলা ভাষায় লেখা এই ভূতের গল্প আপনাকে ভয়ানকভাবে নাড়িয়ে দেবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
নীল কমলেরও শ্বাস ধীরে ধীরে থেমে এল। দুই যোদ্ধা, দুই কবি, একই আকাশে উড়ে গেল। পলাশীর ময়দানে শুধুই তাদের রক্তের দাগ আর অসমাপ্ত কবিতার স্মৃতি রয়ে গেল।
পলাশীর যুদ্ধের কয়েক বছর পর, একজন ভ্রমণকারী কবি পলাশীর ময়দানে এলেন। তার নাম ছিল রাজেন্দ্র। কবিতার সন্ধানে ভারতবর্ষ ঘুরে বেড়ানোই তার একমাত্র লক্ষ্য। পলাশী ময়দানের কথা শুনে তিনি আকৃষ্ট হয়ে এসেছিলেন।
ময়দানের এক কোণে বসে তিনি কবিতা লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু যতই লিখলেন, ততই মনে পড়তে লাগল কোনও অসমাপ্ত কবিতার ছন্দ। সেই ছন্দটি তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কৌতূহল বশত তিনি ময়দান ঘুরতে শুরু করলেন।
হঠাৎ তার নজর গেল দুটি গাছের উপর। একটি বটগাছ, অন্যটি পলাশ। গাছগুলোর গায়ে কিছু অদ্ভুত চিহ্ন দেখতে পেলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন, গাছের ছালে কোনও এক অজানা ভাষায় কিছু লেখা আছে। বেশ খানিক সময় ধরে সেই লেখা পড়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বুঝতে পারলেন না।
তিনি একটি ছালের টুকরো নিয়ে গেলেন। একজন পণ্ডিতের কাছে গিয়ে দেখালেন। পণ্ডিত অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, এটি প্রাচীন বাংলা ভাষায় লেখা কবিতা। আর এই কবিতা অনেক পুরনো, সম্ভবত পলাশীর যুদ্ধের সময়কার।
রাজেন্দ্র আবারও পলাশীর ময়দানে গেলেন। সেখানে বসে দিনের পর দিন কাজ করতে লাগলেন। ধীরে ধীরে সেই অসমাপ্ত কবিতাগুলোকে সাজিয়ে তুললেন। দুটি আলাদা কণ্ঠস্বরের কবিতা, কিন্তু একই ছন্দ, একই ভাবনা।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - অন্ধকার ঘর: রহস্য, রোমাঞ্চ, প্রেম, এবং প্রতিশোধের মিশ্রণ। একটি বাংলা ছোট গল্প যা আপনাকে চমকে দেবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
কয়েক মাস পর রাজেন্দ্র কলকাতায় ফিরলেন। তার হাতে ছিল একটি পুরো কবিতাগ্রন্থ। দুই যোদ্ধার কবিতা, যাদের নাম জানা যায়নি, কিন্তু যাদের কবিতা অমর হয়ে গিয়েছিল।
কবিতাগ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পর তা সারা দেশে সাড়া ফেলল। মানুষ মুগ্ধ হল দুই যোদ্ধার কবিতার প্রতি। কেউ কেউ বলল, এটিই বাংলা কবিতার সূচনা।
পলাশীর ময়দানে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হল। একটিতে লাল সিংহ, অন্যটিতে নীল কমল। তাদের নাম না জানা গেলেও, তাদের কবিতা সবার মনে জায়গা করে নিল।
এভাবেই দুই শত্রু যোদ্ধার রক্তাক্ত যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উঠে এল কবিতার সুগন্ধি। মৃত্যু জয় করে বাঁচল কবিতা। আর পলাশীর ময়দান, যা একসময় রক্তের দাগে ভরা ছিল, হয়ে উঠল কবিতার তীর্থস্থান।