অধ্যায় ১: মধুমতির তীরে
১৯৪৬ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত এখনও শাঁজের দাগের মতো বাংলায় বিদ্যমান। গ্রামীণ জীবনে অশান্তির ছোঁয়া লেগেছে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির শঙ্কা জাগানো জল্পনা গাঁয়ে গাঁয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। রায়বাড়ির বিশাল আঙিনায় এক অস্বস্তিকর চাপ বিরাজ করছে।
মনোময়ী রায়, রায় পরিবারের একমাত্র কন্যা, দুঃখভারাক্রান্ত চোখে বাড়ির চারপাশের পরিবর্তন দেখছিলেন। একসময় জমিদার বাড়িতে যে কোলাহল, সেই জমজমাট জীবন এখন স্তব্ধ। চাকর-বাকরদের সংখ্যা কমে গেছে, আগের জৌলুস আর নেই। মাকে ডেকে পাশে বসালেন মনোময়ী।
“মা, এই জমিদারিটা কি আর থাকবে না?” – তার কণ্ঠে শঙ্কার ছায়া।
রানী রায়, স্নেহের স্পর্শে মেয়ের মাথা সহলাতে সহলাতে বললেন, “কী জানি, মনোময়ী। এতদিনের প্রথা, রাতারাতি কী করে বদলে যাবে? তবে ಊরে গুঞ্জন আছে ঠিকই।”
মনোময়ী চিন্তাভারাক্রান্ত হলেন। জমিদারি চলে গেলে তাদের কি হবে? ঐশ্বর্যের মাঝে বড় হয়ে ওঠা মনোময়ী এখন ভবিষ্যতের অন্ধকার দেখছিলেন।
এমন সময় বাড়ির বাইরে একটা গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। মনোময়ী উঁকি দিয়ে দেখলেন, একটা পুরনো অ্যাম্বাসাডর গাড়ি রায়বাড়ির সামনে এসে থেমেছে। গাড়ি থেকে নামলেন দেবপ্রসাদ চৌধুরী, ঢাকা থেকে আসা এক উকিল। মনোময়ীর বাবার বন্ধু ছিলেন তিনি।
অধ্যায় ২: বিবাহের প্রস্তাব
দেবপ্রসাদ চৌধুরী রায়বাড়িতে এসেছিলেন মনোময়ীর বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে। তার ছেলে, সূর্যপ্রসাদ, কলকাতায় পড়াশোনা করছেন এবং একজন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার পথে এগিয়ে চলেছেন। দেবপ্রসাদ মনে করেন, এই বিবাহ মনোময়ী এবং সূর্যপ্রসাদের দু’জনের জীবনেই সুখ বয়ে আনবে।
মনোময়ী প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় পড়লেন। সূর্যপ্রসাদকে তিনি চেনেন না। কিন্তু পরিস্থিতি এমন যে, তিনি জানতেন, এই সম্পর্ক তাদের পরিবারের জন্য লাভজনক হতে পারে। রানী রায়ও মেয়ের সাথে একমত হলেন।
দেবপ্রসাদ চলে যাওয়ার পর, মনোময়ী নিজের কামরায় গিয়ে বসলেন। তিনি সূর্যপ্রসাদ সম্পর্কে আরও জানতে চাইছিলেন। কিন্তু কাছে কোনো তথ্য ছিল না। মনে মনে একটা অস্থিরতা বাসা বাঁধল মনোময়ীর মনে। অচেনা এক ছেলের সাথে বিবাহের কথা ভাবতেই তার বুকে এক অজানা আশঙ্কা জাগল।
কয়েকদিন পরে দেবপ্রসাদ চিঠি পাঠিয়ে জানালেন যে, তার ছেলে সূর্যপ্রসাদ কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় আসছেন। মনোময়ীকে দেখা করার ইচ্ছাপ্রকাশ করলেন তিনি। এই খবরে একটু স্বস্তি পেলেন মনোময়ী। অন্ততঃ ছেলেটিকে দেখে, কথা বলে তার সম্পর্কে একটা ধারণা তো গড়তে পারবেন।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - স্বপ্নের রূপে ঝঙ্কার: শিউলি, এক গ্রামের মেয়ে, তার অসাধারণ গানের প্রতিভা দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করে। কিন্তু খ্যাতির পথে তাকে অতিক্রম করতে হয় অনেক বাধা। এই অনুপ্রেরণামূলক গল্পে দেখুন কীভাবে সে তার স্বপ্ন পূরণ করে এবং সকলের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৩: মধুমতির সাক্ষী
কয়েকদিন পর সূর্যপ্রসাদ রায় চৌধুরী কলকাতায় পৌঁছান। দেবপ্রসাদ তাকে মধুমতি নদীর তীরে একটি ডাক বাংলোতে রায় চৌধুরীর সাথে থাকার ব্যবস্থা করেন। সূর্যপ্রসাদ সুদর্শন ছিলেন এবং আত্মবিশ্বাসী মেজাজের। মনোময়ীকে দেখে তার মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল।
তারা দু’জনে মধুমতির তীরে ঘুরতে বেরলেন। সূর্যপ্রসাদ কলকাতার জীবনের গল্প, তার ব্যবসার কথা, আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা মনোময়ীকে জানালেন। মনোমmয়ী মনোযোগ সহকারে শুনলেন। সূর্যপ্রসাদ শিক্ষিত ও সফল, এটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু তার মনের গভীরে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – এই আত্মবিশ্বাসী ছেলেটি কি তাকে বুঝতে পারবেন?
সূর্যপ্রসাদও মনোময়ীকে দেখে মুগ্ধ হলেন। তার সৌন্দর্যের পাশাপাশি, মনোময়ীর মিষ্টি স্বভাব এবং শিক্ষিত মন তার মন জয় করে নিল।
সূর্যপ্রসাদ ফিরে যাওয়ার পর, দেবপ্রসাদ আবার রায়বাড়িতে এলেন। বিবাহের আলোচনা এগিয়ে গেল। মনোময়ী আর সূর্যপ্রসাদের সম্মতি থাকলে, কয়েক মাসের মধ্যেই বিবাহের আয়োজন করা হবে – এমনটাই ঠিক হল।
অধ্যায় ৪: নতুন জীবন
মাস কয়েক পরে, মনোময়ী সূর্যপ্রসাদ চৌধুরীকে বিবাহ করলেন। কলকাতায় এক আধুনিক বাড়িতে নতুন সংসার শুরু হল তাদের। মনোময়ী গ্রামের জীবন ছেড়ে শহরে এসে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলেন ঠিকই। কিন্তু সূর্যপ্রসাদের সাহচর্য এবং ভালোবাসায় সেই অস্বস্তি কয়েকটা দিনের মধ্যেই দূর হয়ে গেল।
সূর্যপ্রসাদ ব্যবসায়ে সফল হচ্ছিলেন। তার আধুনিক চিন্তাধারা মনোময়ীকেও প্রভাবিত করল। মনোময়ী ছেলেমানুষের মতো উৎসাহ নিয়ে নতুন জীবনকে গ্রহণ করতে শুরু করলেন। কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনেও ঢুকতে লাগলেন। কিন্তু মাঝেমধ্যে গ্রামের পুরনো বাড়ি, মা, আর মধুমতি নদীর স্মৃতি তার মনে আঁচ কাটতো।
একদিন সন্ধ্যায়, খাবার টেবিলে বসে মনোময়ী বললেন, “সূর্য, মা একটু অসুস্থ। আমার একবার গিয়ে দেখা দরকার।”
সূর্যপ্রসাদ মৃদু হেসে বললেন, “অবশ্যই যাও, মনোময়ী। কালকে আমি তোমাকে দাদুবাড়িতে পৌঁছে দেব।”
পরের দিন সকালে তারা ট্রেনে রওনা হলেন। গ্রামে ফিরে মনোময়ী দেখলেন, রায়বাড়ির আগের জৌলুস আর নেই। কয়েকজন চাকর ছাড়া বাড়িটা অনেকটা ফাঁকা লাগছিল। রানী রায় মেয়েকে দেখে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন।
মনোময়ী মা’র সাথে কয়েকদিন কাটালেন। এর মধ্যে গ্রামের পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হল। তারা জানালেন যে, জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। রায়বাড়ির জমি এখন সরকারের অধীনে চলে গেছে। এই খবরে মনোময়ীর মন খারাপ হয়ে গেল।
অধ্যায় ৫: অনিশ্চয়তা
কয়েকদিন পরে, সূর্যপ্রসাদ মনোময়ীকে নিয়ে ফিরলেন কলকাতায়। কিন্তু ফিরে এসে মনোময়ী দেখলেন সূর্যপ্রসাদের আচরণে একটা পরিবর্তন এসেছে। তিনি আর আগের মতো খোলামেলা কথা বলছেন না। অনেক সময় চিন্তিত দেখা যাচ্ছে তাকে।
একদিন সন্ধ্যায় সাহস করে মনোময়ী জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে, সূর্য? কেন এত চিন্তিত?”
সূর্যপ্রসাদ একটু দ্বিধার পরে বললেন, “ব্যবসায়ে একটু সমস্যা হয়েছে, মনোময়ী।”
মনোময়ী আরও জানতে চাইলেন, কিন্তু সূর্যপ্রসাদ তেমন কিছুই বলতে রাজি হলেন না। এই অবস্থায় মনোময়ীর মনে একটা অশান্তি জাগল। কী সমস্যা হয়েছে সূর্যপ্রসাদের ব্যবসায়, তা জানতে না পেরে মন খারাপ হল তার।
এর কয়েকদিন পরে একদিন সকালে সূর্যপ্রসাদ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন। দুপুরে ফিরলেন না, রাতেও ফিরলেন না। মনোময়ী চিন্তায় পড়ে গেলেন। সারারাত ঘুম আসল না তার। সকালে বাড়ির কাজের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু কেউ সূর্যপ্রসাদকে কোথায় দেখেছে, সে খবর দিতে পারল না। মনোময়ী আর স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি সূর্যপ্রসাদের বন্ধুদের বাড়িতে খোঁজ নিলেন, কিন্তু কোথাও কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।
দুশ্চিন্তায় দিন কেটে গেল। অবশেষে তিন দিন পরে একটা চিঠি এলো সূর্যপ্রসাদের। চিঠিতে লেখা ছিল, ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণে তাকে কিছুদিনের জন্য শহর ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে। কবে ফিরবেন, সে সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না।
চিঠি পড়ে মনোময়ীর চোখে জল এলো। তিনি বুঝতে পারলেন, সূর্যপ্রসাদ সমস্যায় পড়েছেন। কিন্তু ঠিক কি সমস্যা, সেটা না জানায় তার মনে একটা সন্দে জাগল। এই অবস্থায় কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারলেন না মনোময়ী।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - সবুজ স্বপ্ন: কল্পবিজ্ঞান গল্প: পারমাণবিক যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে রিয়া নামক এক যুবতী পৃথিবীকে পুনরুদ্ধারের আশা খুঁজে পায়। বাংকারে লুকিয়ে থাকা জ্ঞানের সাহায্যে সে লড়াই শুরু করে নতুন সবুজের জন্য। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৬: নিজের পায়ে দাঁড়ানো
দিন যতো যায়, মনোময়ীর মনে সন্দে আরও গাঢ় হতে থাকে। সূর্যপ্রসাদ আর কোনো চিঠি দিলেন না, ফোনও করলেন না। একদিন সূর্যপ্রসাদের বন্ধুদের একজন মনোময়ীকে জানালেন, শোনা যাচ্ছে সূর্যপ্রসাদ কোনো বড়ো কেলেঙ্কারি করে পলায়ন হয়েছে। এই খবরে মনোময়ীর মাথাটা যেন ঘুরে গেল।
কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেওয়ার মতো মানুষ ছিলেন না মনোময়ী। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াবার। তিনি তার মায়ের সাথে কথা বলে ঠিক করলেন যে, শহরে ফিরে যাবেন।
মনোময়ী তার বাবার জমিদারি হারিয়ে যাওয়া জমি থেকে কিছু আয়ের ব্যবস্থা করলেন। এছাড়াও তিনি বাড়িতে টিউশনি শুরু করলেন। কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু মনোময়ী নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন।
অধ্যায় ৭: অতীতের স্মৃতি
একদিন, টিউশনি শেষ করে ফিরছিলেন মনোময়ী। হঠাৎ তার চোখে পড়ল একটা পরিচিত মুখ। সে ছিল সূর্যপ্রসাদের বন্ধু, যিনি আগে তাকে জানিয়েছিলেন সূর্যপ্রসাদ সম্পর্কে।
মনোময়ী তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কি সূর্যপ্রসাদ সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“কিছু জানি,” সেই ব্যক্তিটি একটু দ্বিধার পরে বললেন, “কিন্তু ঠিক কি বলব, বুঝতে পারছি না।”
“আমাকে সব জানাতে হবে,” দৃঢ়কণ্ঠে বললেন মনোময়ী। “আমি সত্যি জানতে চাই, সূর্য কী করেছেন, কোথায় আছেন এখন।”
অবশেষে সেই ব্যক্তিটি সব খুলে বললেন। সূর্যপ্রসাদ কোনো বড়ো ব্যবসায়ী ছিলেন না। তিনি জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির গুঞ্জন শোনা মাত্রই মিথ্যা পরিচয় দিয়ে মনোময়ীকে বিবাহ করেছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল রায় পরিবারের অর্থ।
মনোময়ীর মাথাটা যেন ঘুরে গেল। তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন ভালোবাসার জীবনের, কিন্তু এই নির্মম সত্য তাকে ধাক্কা দিল। এতদিন ধরে যে মানুষকে তিনি ভালোবাসতে শুরু করেছিলেন, সে সবই ছিল প্রতারণা।
মনোময়ী বাড়ি ফিরলেন। মা তার মুখের অবস্থা দেখেই সব বুঝে গেলেন। মা-মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। এই কষ্টের মধ্যেও মনোময়ী মা’র সান্ত্বনা পেয়ে একটু স্বস্তি বোধ করলেন।
অধ্যায় ৮: নতুন সূর্যোদয়
কয়েকদিন কেটে গেল। মনোময়ী নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। তিনি জানতেন, সূর্যপ্রসাদকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না। তিনি মা’র সাথে শহরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। কষ্ট ছিল, কিন্তু আত্মসম্মানবোধ জাগিয়ে তিনি নতুন করে জীবন শুরু করতে চাইলেন।
মনোময়ী টিউশনি আরও বাড়িয়ে দিলেন। তাছাড়া, গৃহস্থীয় জিনিসপত্র তৈরি করে বিক্রি করা শুরু করলেন। রানী রায়ও তার মেয়েকে সাহায্য করতে লাগলেন। এই ছোটো ব্যবসা ধীরে ধীরে লাভজনক হয়ে উঠল।
একদিন, বাজারে থাকাকালীন মনোময়ী দেখা করলেন একজন সাংবাদিকের সাথে। সেই সাংবাদিক জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির ফলে প্রভাবিত মানুষদের জীবন নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র বানাচ্ছিলেন। মনোময়ীর গল্প তাকে মুগ্ধ করল। তিনি মনোময়ীর সাক্ষাৎকার নিলেন এবং তার জীবনের অভিজ্ঞতা প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরলেন।
প্রামাণ্যচিত্রটি মুক্তি পেয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলল। মনোময়ী হয়ে উঠলেন অনেকের অনুপ্রেরণা। জীবনের প্রতারণার পরেও হাল না ছেড়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর লড়াই করা মনোময়ীর গল্প শহরবাসীকে স্পর্শ করল। অনেক নারী এগিয়ে এলেন তাকে সাহায্য করার জন্য।
এই সময়েই মনোময়ীর জীবনে আসল নতুন এক মুখ। সঞ্জয়, একজন সামাজিক কর্মী, মনোময়ীর গল্প শুনে তার সাথে যোগাযোগ করলেন। জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার একটা সংগঠন চালাচ্ছিলেন তিনি। মনোময়ীর অভিজ্ঞতা এবং সাহস দেখে তিনি মনোময়ীকে তাঁর সংগঠনে কাজ করার প্রস্তাব দিলেন।
মনোময়ী আগ্রহী হলেন। নিজের মতো আরও অনেককে সাহায্য করার সুযোগ এটি। তিনি সঞ্জয়ের সাথে কাজ শুরু করলেন। গ্রামে গিয়ে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের নতুন করে জীবন শুরু করতে সাহায্য করলেন। মহিলাদের ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার প্রশিক্ষণ দিলেন, কৃষিকাজের নতুন পদ্ধতি শেখালেন।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে মনোময়ী আর সঞ্জয়ের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। সময়ের সাথে সাথে এই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপ নিল। মনোময়ী সঞ্জয়ের কাছে নিজের অতীতের গল্প খুলে বললেন। সঞ্জয় তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং জানালেন যে, অতীতের ভুলের জন্য তিনি নিজেকে দোষ দিবেন না।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - আধাঁরের আলো: মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প: 'আধাঁরের আলো', এক তরুণী উদ্যোক্তার 'আধাঁরের আলো' চা এর দোকান, স্বপ্ন, চ্যালেঞ্জ, আর সফলতার অনুপ্রেরণামূলক গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অধ্যায় ৯: পূর্ণতা
কয়েক বছর পরে, মনোময়ী আর সঞ্জয়ের বিয়ে হল। তারা শহরেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। মনোময়ী তাঁর ছোটো ব্যবসা চালিয়ে গেলেন।
এখনও মাঝেমধ্যে মনোময়ীর মনে পড়ে সূর্যপ্রসাদের কথা। কিন্তু সেই কষ্ট এখন আর তাকে আঁকড়ে ধরে না। তিনি খুশি। তিনি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন, নিজের পরিবার গড়েছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা, তিনি অনেকের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন।
একদিন, একটা পুরনো খাতা ঘাটতে গিয়ে মনোময়ীর হাতে পড়ল সূর্যপ্রসাদের লেখা একটি চিঠি। চিঠিতে লেখা ছিল, সে মনোময়ীকে ভালোবাসেনি, কিন্তু পরিস্থিতি তাকে এই প্রতারণা করতে বাধ্য করেছিল।
চিঠি পড়ে মনোময়ী একটু থমকে গেলেন। কিন্তু তারপরই নিজের মনে মনে হাসলেন। সূর্যপ্রসাদের কথা আর তার জীবনে কোনো গুরুত্ব রাখে না। তিনি চিঠিটি সযত্নে রেখে দিলেন, অতীতের একটি স্মৃতি হিসেবে।
বছরের পর বছর কেটে গেল। মনোময়ী আর সঞ্জয়ের একটি সুন্দর সন্তান জন্ম নিল। সংসার জীবনে এলো আরও আনন্দ। মনোময়ী মাঝে মাঝে গ্রামের পুরনো বাড়িতে ফিরতেন। রানী রায় মেয়ে আর নাতিকে দেখে খুবই খুশি হতেন।
একবার গ্রামে থাকাকালীন মনোময়ী শুনলেন যে, ছেলেবেলার খেলার সাথী অপर्णাও ফিরেছে গ্রামে। অপর্ণা বিদেশে লেখাপড়া শেষ করে এখন গ্রামের উন্নয়নে কাজ করছে। মনোময়ী তার সাথে দেখা করলেন। দুই বন্ধুবী অতীতের স্মৃতি আলোচনা করলেন।
অপর্ণা জানালো যে, সে গ্রামের পুরনো জমিদার বাড়িগুলোকে ঐতিহ্যবাহী হোটেলে রূপান্তর করার একটা প্রকল্পনা নিয়ে এসেছে। এতে গ্রামের মানুষের রোজগার বাড়বে, পর্যটন বাড়বে। মনোময়ী এই প্রকল্পনায় খুবই আগ্রহী হলেন।
অধ্যায় ১০: নতুন স্বপ্ন
মনোময়ী সঞ্জয়ের সাথে আলোচনা করলেন অপর্ণার প্রকল্পনা নিয়ে। সঞ্জয়ও এই প্রকল্পনাকে সমর্থন করলেন। তারা অপর্ণার সাথে মিটিং করে ঠিক করলেন, মনোময়ীর পুরনো বাড়িই হবে এই প্রকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ।
মনোময়ী এবং সঞ্জয় তাদের সঞ্চয়ের কিছু অংশ দিয়ে বাড়িটি সংস্কার করার কাজ শুরু করলেন। গ্রামের কারিগরদের দিয়েই কাজটি করানো হল, যাতে স্থানীয় মানুষের রोजগার বাড়ে।
কয়েক মাসের পরিশ্রমের পর, মনোময়ীর পুরনো বাড়িটি ঐতিহ্যবাহী হোটেলে রূপান্তরিত হল। হোটেলটির উদ্বোধন করলেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
হোটেলটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠল। পর্যটকরা এসে ঐতিহ্যের স্বাদ নিলেন। গ্রামের মানুষেরা হোটেলে কাজ পেলেন।
মনোময়ী খুশি হলেন। তিনি চেয়েছিলেন নিজের পায়ে দাঁড়াতে, অন্যদের সাহায্য করতে। এখন তিনি সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন। তার বাবার জমিদারি না থাকলেও, তিনি নিজের পরিশ্রমে, সাহসে, আত্মবিশ্বাসে এক নতুন জমিদারি গড়েছেন। মধুমতির তীরে দাঁড়িয়ে মনোময়ী দূরের দিকে চেয়েছিলেন। হোটেলের সাফল্যে মন আনন্দে ভাসছিল। একসময় যে বাড়িটি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ সেই বাড়িতে আবার জীবন ফিরেছে। পর্যটকদের আনাগোনা, কর্মীদের চাঞ্চল্য – এই সবকিছুই মনোময়ীকে আনন্দ দিচ্ছিল।
হঠাৎ, পাশেই কারো স্বর শুনলেন তিনি। “কী সুন্দর লাগছে, না?”
মনোময়ী দেখলেন, সঞ্জয় তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখেও ছিল একই আনন্দ।
“হ্যাঁ,” মনোময়ী হাসলেন, “এই স্বপ্নটা পূরণ হলো। কিন্তু আরও অনেক কিছু করার আছে।”
“নিশ্চয়ই আছে,” সঞ্জয় বললেন, “আপনি তো আর থেমে থাকবেন না।”
মনোময়ী তার স্বামীর হাত ধরলেন। “ঠিক কথা। অপর্ণার সঙ্গে আরও কয়েকটা বাড়ি নিয়ে কাজ করা যাবে। গ্রামের আরও ছেলেমেয়েদের রোজগার-এর ব্যবস্থা করতে হবে।
এভাবেই মনোময়ী আর থামলেন না। তার সাহস আর আত্মবিশ্বাস অন্যদেরও অনুপ্রেরণা জোগাল। গ্রামে ঐতিহ্যবাহী হোটেলের পাশাপাশি গড়ে উঠলো হস্তশিল্পের দোকান, স্থানীয় ফলমূলের বাজার। পর্যটন বাড়লো, গ্রামের অর্থনীতি চাঙ্গা হলো।
কয়েক বছর পরে, এক জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত হলেন মনোময়ী। পুরস্কার বক্তৃতায় তিনি বললেন, “জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে, কিন্তু মানুষের মনের জমিদারি – সাহস, আত্মবিশ্বাস, স্বনির্ভরতা – এগুলো কখনো বিলুপ্ত হয় না।” মধুমতির তীরে দাঁড়িয়ে তিনি গর্বের সঙ্গে চারপাশে তাকালেন। এই গ্রাম, এই মানুষ, এই স্বপ্ন – এ সবই ছিল তার নতুন জমিদারি।