মা চলে যাওয়ার পর, বাবার পুরনো কম্পিউটারটা আমার হয়ে যায়। পাসওয়ার্ডটা ভুলে যাওয়ায়, সেটা চালু করা যাচ্ছিল না। শোকের সাগরে ডুবে থাকা অবস্থায়, সেই কম্পিউটারটা খুলতে পারব না বলে একটা অদ্ভুত কষ্টও লাগছিল। কিন্তু একদিন দাদু এসে জোর করে একটা পাসওয়ার্ড দিয়ে চেষ্টা করলেন। অবিশ্বাস্য! কম্পিউটারটা চালু হয়ে গেল!
কম্পিউটার খুলে আমি অবাক হয়ে গেলাম। একটা ফোল্ডার ছিল, নাম দেওয়া “লিলির স্বপ্ন”। ফোল্ডারটা খুলতেই চোখে পড়ল অজস্র ছবি আর চিঠিপত্র। ছবিতে আমি, বাবা, মা – সবাই ছিলাম। চিঠিগুলো পড়তে শুরু করলাম। একটা চিঠিতে ছিল আমার প্রথম নাচের অনুষ্ঠানের বর্ণনা। বাবা কেমন করে সেদিন আমার প্রতিটি ছুটোছুটি লক্ষ্য করেছিলেন, সেই সব লেখা ছিল সেখানে। আরেকটা চিঠিতে ছিল আমার স্কুলের প্রথম দিনের কথা। বাবা কীভাবে সেদিন স্কুলের গেটের বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, কিন্তু আমার সঙ্গীদের দেখে লুকিয়ে গিয়েছিলেন, সেটাও লেখা ছিল।
চিঠিগুলো পড়তে পড়তে আমার মনে হচ্ছিল যেন বাবা আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি হয়তো কোনওদিন আমার প্রশংসা করতেন না, কিন্তু আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। তিনি আমাকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু হয়তো প্রকাশ করতে জানতেন না।
বাংলা ছোট গল্প - একাকী ভীড়ের গল্প : এই বাংলা ছোট গল্পটি একাকীত্বের চিত্র তুলে ধরে। ভবিষ্যতে সন্তানের অসমর্থতা আর নিজেদের দুঃখের সাথে লড়াই করে বয়স্ক দম্পতির গল্প। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
এই ছবি আর চিঠিগুলি নিয়ে আমি যেন হঠাৎ বাবাকে নতুন করে চিনতে শুরু করলাম। বাবা যে কোনওদিন শিল্পী ছিলেন, সেটাও জানতে পারলাম এই কম্পিউটার থেকেই। তিনি প্রকৃতির ছবি আঁকতেন, ছোট ছোট কবিতা লিখতেন। এই সব কিছুই তিনি গোপন রেখেছিলেন। হয়তো নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসের অভাব, অথবা সমাজের ভীতি তাকে থামিয়ে রেখেছিল।
এই অসাধারণ আবিষ্কার আমার হৃদয়কে পূর্ণ করতে শুরু করল। বাবার ভালোবাসা, তার শিল্পী মন, সবকিছুই যেন নতুন করে জীবিত হয়ে উঠল। কিন্তু এই আনন্দের সঙ্গে জেগে উঠল একটা ব্যাথার স্রোতও। বাবা কেন এই সব লুকিয়ে রাখলেন? কেন আমাদের জানালেন না?
এই প্রশ্ন নিয়েই দাদুর কাছে গেলাম। দাদু হাসলেন। বললেন, “তোর বাবা একটু নিঃশব্দ মানুষ ছিলেন। কিন্তু নিঃশব্দতা যে ভালোবাসার অভাব নয়, সেটাই তুমি এখন বুঝতে পারছ।”
দাদুর কথা আমার মনে গাঁথা হয়ে গেল। বাবার নিঃশব্দ ভালোবাসা আমার মনে গাঁথা হয়ে গেল। কিন্তু তার গোপন শিল্পী মনটা জাগিয়ে দিল আমার নিজের স্বপ্নকে। ছোটবেলায় আমারও ছবি আঁকা, গান গাওয়া, নাচ শেখার মতো অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ঠিক কিভাবে জানি না, কবে যে সেগুলো কোথা হারিয়ে গেল! বাবার এই আবিষ্কার যেন আবার সেই স্বপ্নগুলোকে জাগিয়ে দিল। মনে হল, বাবার গোপন ইচ্ছের মতো, হয়তো আমিও কোনও একটা শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি।
কিন্তু স্বপ্ন আবার জাগলেও, পথটা সহজ ছিল না। বছরের পর বছর লেখাপড়া আর দায়িত্বের বোঝা আমাকে শিল্পের জগৎ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দিয়েছিল। আঁকা কিভাবে, গান গাওয়া কিভাবে, কিছুই আর মনে ছিল না। উপরন্তু, মনে জাগলো আত্মবিশ্বাসের অভাব। বাবা যদি নিজের শিল্পকে গোপন রাখতে পারেন, তাহলে আমিও কি পারব না? এই সব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - মৃত্যুপুরীর বিদ্রোহ : এই ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্পে 16শ শতাব্দীর বাংলার দাসদের বিদ্রোহের কাহিনী বলা হয়েছে। মুঘল সাম্রাজ্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন রাজা শ্যামল নামক একজন দাস। এই বাংলা ছোট গল্পে ঐতিহাসিক ঘটনা, কাল্পনিক চরিত্র এবং রোমাঞ্চকর কাহিনীর মিশেল রয়েছে। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
এমন সময়, আমার জীবনে এলো রিয়া। রিয়া আমার অফিসের নতুন সহকর্মী। রিয়ার সাথে আলাপ হওয়ার পর, জানতে পারলাম সে ছোটবেলা থেকেই গিটার বাজায়। একদিন অফিসের পর, রিয়াকে আমার বাবার কথা, আর তার গোপন শিল্পের কথা বললাম। রিয়া মন দিয়ে শুনল, তারপর হঠাৎ বলল, “তুমি জানো, স্বপ্নগুলো কখনও মরে না। সেগুলো হয়তো ঘুমিয়ে থাকে, কিন্তু একটু খোঁজ নেওয়া দরকার।”
রিয়ার কথা আমার মনে গভীর দাগ ছাড়ল। সেই সপ্তাহান্তেই, আমি রিয়ার সঙ্গে গেলাম একটা মিউজিক স্টোরে। একটি সহজ গিটার কিনলাম। রিয়া আমাকে প্রাথমিক কিছু সুর শেখাল। প্রথম কয়েকটা দিন তো কিছুই বুঝলাম না। কিন্তু হার মানলাম না। রাতের বেলা, নিঃশব্দে, একটু একটু করে সুর গুলো আয়ত্ত করতে শুরু করলাম।
কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই, কিছু সহজ গান বাজাতে পারছিলাম। গান বাজানোর সময় একটা অদ্ভুত আনন্দ লাগছিল। মনে হচ্ছিল, যেন মনের মধ্যে একটা দরজা খুলে গেছে। ঠিক যেন বাবা আমার পাশে বসে আছেন, আমার গান শুনছেন।
এই আনন্দ আরো বাড়ল যখন রিয়া জানালো সে তার এলাকায় একটা ছোট গানের প্রতিযোগিতা হচ্ছে। রিয়া আমাকে বলল, “এই প্রতিযোগিতা-তে তুমিও অংশ নিতে পারো।”
প্রথমে আমার ভীষণ ভয় লাগছিল। কিন্তু রিয়া আমাকে সাহস জোগাল। সে বলল, “এটা প্রতিযোগিতা না, একটা উৎসব। তুমি তোমার স্বপ্নের সাথে আবার যোগ দিয়েছ, সেটাই আসল কথা।”
রিয়ার কথা আমার মনে গাঁথা হয়ে গেল। প্রতিযোগিতা-তে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক সহজ ছিল না। কিন্তু রিয়ার উৎসাহ আর নিজের মধ্যে জাগানো সেই সুরের আহবান, দুটো মিলে আমাকে এগিয়ে যেতে বলল।
প্রতিযোগিতা-এর দিনটা এলো। মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার হাত-পা কাঁপছিল। অবাক হওয়ার মতো অনেক খুদে খুদে ছেলেমেয়ে, বয়স্ক মানুষ – সবাই অংশ নিচ্ছিল। তাদের গান শুনতে শুনতে মনে হল, হয়তো আমার ঠিক এই প্রতিযোগিতা-তে অংশ নেওয়া উচিত হয়নি। কিন্তু রিয়া এসে আমার কাধে হাত রেখে বলল, “তুমি দারুণ গান গাও। মনে রেখো, এটা তোমার বাবার সাথে একটা সম্পর্ক খুঁজে পাওয়ার মতো একটা সুযোগ।”
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - অসমাপ্ত যাত্রা : মহাকাশের রহস্য ও দুঃসাহসিক যাত্রায় ভরা বাংলা কল্পবিজ্ঞান ছোট গল্প - 'অবন্তী ও সোম' মধুচন্দ্রিমার সময় মহাকাশযান ধ্বংসের পর অবন্তী ও সোম জিওন গ্রহে আশ্রয় পায়। ত্রিক্ষণদর্শীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে পৃথিবী ও জিওনকে রক্ষা করে তারা। সম্পূর্ণ বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
রিয়ার কথা আমাকে স্থির হতে সাহায্য করল। আমার পালা এলো। গিটার হাতে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে, আমি যে গানটা প্র্যাকটিস করেছিলাম, সেটা গাইতে শুরু করলাম। গান গাইতে গাইতে মনে হল, বাবা যেন আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমার গলায় কাঁপুনি ছিল, তবু গানটা শেষ করতে পারলাম।
প্রতিযোগিতা-তে জেতা হয়নি ঠিকই, কিন্তু মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গাওয়ার অভিজ্ঞতাটা ছিল অবিশ্বাস্য! যেন মনের একটা বড় জয় হয়ে গেল।
এই প্রযোগিতার পর, গান গাওয়ার অভ্যাস আর থেমে থাকল না। রিয়ার সাহায্যে আরো কিছু গান শেখা শুরু করলাম। মাঝে মাঝে বাবার লেখা কবিতাগুলোকেও সুর দিয়ে গান করতাম। মনে হত, বাবা আমার গান শুনে খুশি হচ্ছেন।
একদিন, রাতের বেলা গান গাইছি, এমন সময় দাদু এসে বললেন, “লিলি, তোর গানে একটা আলাদা ভাব আছে।” দাদুর কথা শুনে আমার চোখ ভিজে গেল। মনে হল, বাবা হয়তো আমার গানের মধ্যেই লুকিয়ে আছেন।
আমি জানি না, ভবিষ্যতে আমি কোনো গানের তারকা হব কিনা। কিন্তু একটা জিনিস জানি – বাবার গোপন শিল্পী মন আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। আমার নিজের স্বপ্নকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। বাবার প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো গভীর হয়েছে। এখন আমি জানি, ভালোবাসা কখনও সত্যিই মরে না, সেটা রূপ বদলে ফিরে আসে, অন্যরকমভাবে।