ঊষাশ্রী এখনো নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ছেলেবেলা থেকে লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্নটা বুকে জড়িয়ে কতদূর এসেছে সে! শিলিগুড়ির জলপাই রঙের আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মনে হলো, এই শহরটা যেন মন্ত্র ঝাড়ছে তার ওপর। মায়ের হাতটা ধরে সে ঘুরে দাঁড়ালো। মা, যে সবসময় তার স্বপ্নের পাশে দাঁড়িয়েছিল, চোখে অভিমান আর আশঙ্কা মিশিয়ে তাকিয়ে ছিল।
ঊষাশ্রী এসেছে লেখালেখার প্রতিযোগিতায় জেতা লেখক তরুণ সেনের সঙ্গে দেখা করতে। এই সুযোগটাই তাকে লেখিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দিতে পারে। কিন্তু ভাবটা যেন সত্যি হচ্ছেনা। এই বিশাল শহরে, অচেন মানুষের মাঝে, তার স্বপ্ন কতটা টিকবে? তার মতো কতজন আসে, আবার হতাশ হয়ে ফিরে যায়? মনের মধ্যে একটা শীতল হাওয়া লেগেছে, স্বপ্নের আগুন নেভে যাচ্ছে না কি?
ঠিক সেই সময় হঠাৎ একটা ছেলের ছেলেমানুষের গলা শোনা গেল, “এই যে মিস, আপনারা কি হারিয়ে গেছেন?”
ঊষাশ্রী চমকে তাকাল। সামনে এক ফুটফঁাট্ট ছেলে দাঁড়িয়ে। কাঁধে ঝুলছে একটা ছোট্ট ব্যাগ। চোখ দুটো খুবই সজীব, যেন সারাক্ষণ হাসি খেলা করে। সে আরো বললো, “এত দুঃখী মুখ করে কী দাঁড়িয়ে আছেন? শিলিগুড়িতে থাকতে হলে প্রথমেই হাসি শেখা লাগে!”
ঊষাশশ্রী একটু হাসলো, “আমি হারিয়ে যাইনি। তবে একটু…”
“চিন্তায়?” ছেলেটা শেষ করে দিল, “এই শহরে চিন্তা নিয়ে ঢোকা চলবে না। চলুন, আমি আপনাদের একটা চায়ের দোকানে নিয়ে যাই। এখানে চায়ের সঙ্গে স্বপ্নের গল্প ভালো করে বলা যায়।”
বাংলা ছোট গল্প - চাঁদের আলোয় পাগলামি: চাঁদের আলোয় বিচ্ছেদ ও নতুন সূচনার গল্প! দেশভাগের জেরে স্বপ্ন হারানো নায়িকা নতুন জীবন খুঁজে পায় গ্রামের সাদাসিধা ছেলের সাথে। এক পুরনো প্রেমের স্মৃতি আর নতুন বন্ধনের টানাকষিতে জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সংগ্রাম। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
ছেলেটার সরলতায় ঊষাশ্রীর চিন্তা কেমন যেন কমে গেল। মায়ের দিকে তাকালো সে। মা একটু দ্বিধা করলেন, তারপর মাথা নাড়লেন সম্মতি জানিয়ে।
ছেলেটা তাদের নিয়ে গেল একটা ছোট্ট, পরিষ্কার চায়ের দোকানে। চায়ের গন্ধে মনটা একটু হালকা লাগলো ঊষাশ্রীর। ছেলেটা নিজের নাম জানালো, অভি। সে এখানে একটা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে কাজ করে। ঊষাশ্রী তাকে লেখিকা হওয়ার স্বপ্নের কথা বললো, তরুণ সেনের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাওয়ার কথাটাও।
অভি মন দিয়ে শোনলো তার কথা। তারপর বললো, “জানেন, স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গেলে অনেক বাঁধা আসবে। মানুষজন হাসি ঠাট্টা করবে, নিরুৎসাহিত করবে। কিন্তু আপনি থেমে যাবেন না। কারণ, আপনার স্বপ্ন আপনারই।”
অভি আরো বলল, “আর দেখুন, এই শহরে লেখালেখা খুবই কঠিন। কিন্তু আপনি লিখতে থাকুন। ছোট ছোট লেখা কাগজপত্রে জমা দিন। প্রতিযোগিতায় অংশ নিন, হারলে মন খারাপ করবেন না, শেখা নেবেন।”
ঊষাশ্রীর চোখ জ্বলজ্বলিয়ে উঠলো। হ্যাঁ, ঠিক তো! স্বপ্নটা বড় হতে পারে, কিন্তু শুরুটা তো ছোট থেকেই হবে। অভি চলে যাওয়ার পর তার সঙ্গে আরও কথা বলতে ইচ্ছে হলো ঊষাশ্রীর। কিন্তু সে নিজের কাজে চলে গেল।
তরুণ সেনের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি খুবই বড় মাপের লেখক। ঊষাশ্রীর লেখা পড়ে উনি কয়েকটা পরামর্শ দিলেন। তার লেখায় আরও গভীরতা লাগবে, চরিত্রগুলোকে আরও বেশি জীবন্ত করে তুলতে হবে। এই পরামর্শ নিয়েই ঊষাশ্রী লেখা শুরু করলো। সে লিখতো ছোট ছোট গল্প, কবিতা। এলাকার বাঙালি কমিউনিটির একটা পত্রিকায় তার লেখা বের হলো। আর একটা ছোট প্রতিযোগিতায় তার গল্প দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলো। প্রথমে হয়নি ঠিকই, কিন্তু ছোট ছোট সাফল্যে ঊষাশ্রী উৎসাহিত হলো।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - প্রতিদ্বন্দ্বী: মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প - প্রতিদ্বন্দ্বী, সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত জীবন যুদ্ধের দুই যোদ্ধার একদিনের জীবন সংগ্রামের ঘটনা। সম্পুর্ন্য বাংলা অনুপ্রেরণামূলক ছোট গল্পটি পড়ুন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
কিন্তু সবসময় সহজ ছিল না। কখনও কখনও লেখার আইডিয়া আসতো না। কখনও লিখে ফেলা লেখা নিজেরই ভালো লাগতো না। মন খারাপ হয়ে যেতো। ঠিক সেই সময় মাকে ডেকে বলতো, “মা, আর লিখতে পারছি না।”
মা তখন বলতেন, “ঊষাশ্রী, মনে রেখো, স্বপ্নের পথে বাঁধা আসবেই। কিন্তু ঝড়ের পরেই তো সূর্য দেখা দেয়। একটু ধৈর্য ধরো, লেখা আবার আসবে।”
মায়ের কথাগুলো ঊষাশ্রীকে সাহায্য করতো। সে আবার লেখা শুরু করতো। লিখতে না পারলেও পড়াশোনা করতো। বিভিন্ন লেখকের লেখা পড়তো, নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করতো।
একদিন ঊষাশ্রী একটা ক্যাফেতে বসে চা খাচ্ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়লো পাশের টেবিলে বসা এক বয়স্কা মহিলার ওপর। মহিলাটি একটা খাতায় কিছু লিখছিলেন। কখনও কখনও থামছিলেন, চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবছিলেন। ঊষাশ্রীর মনে হলো, মহিলাটি হয়তো লেখিকা। সাহস করে ঊষাশ্রী তার কাছে গিয়ে কথা বললো।
মহিলাটির নাম ছিল শিপ্রা সেন। তিনি নিজেও একজন লেখিকা ছিলেন, তবে খুব একটা পরিচিত নাম নন। ঊষাশ্রী তাকে নিজের লেখালেখির কথা বললো, তার স্বপ্নের কথা। শিপ্রা মন দিয়ে শোনলেন, তারপর বললেন, “লেখালেখি
লেখালেখি চালিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু শুধু নিজের গল্প লেখাই যথেষ্ট নয়। চারপাশের মানুষকে দেখো, তাদের গল্প শোনো। রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রামে, ক্যাফেতে – সব জায়গায় নজর রাখো। মানুষের আনন্দ, দুঃখ, স্বপ্ন – সবকিছুই তোমার লেখায় জীবন্ত হয়ে উঠতে পারে।”
ঊষাশ্রী মুগ্ধ হয়ে শিপ্রার কথা শুনছিল। শিপ্রা আরও বললেন, “আমি তোমাকে আমার লেখক বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। তারা তোমাকে আরও সাহায্য করতে পারবেন।”
ঊষাশ্রীর আনন্দ আর ধরে না। এই শহরে এসে তার যে এত সাহায্য পাওয়া যাবে, সে ভাবেনি। শিপ্রার সাহায্যে ঊষাশ্রী আরও কিছু লেখকের সাথে পরিচিত হলো। তাদের কাছ থেকে লেখালেখা নিয়ে নানা টিপস শিখলো। একসঙ্গে আড্ডা দিতো, একে অপরের লেখা নিয়ে আলোচনা করতো। এই লেখকদের ছোট্ট গ্রুপটা ঊষাশ্রীকে অনেকটা সম্বল দিলো।
কয়েকটা বছর অবিরাম লেখালেখার পর ঊষাশ্রীর জীবনে একটা বড়ো পরিবর্তন এলো। একটা নামী প্রকাশনা সংস্থা তার উপন্যাস ছাপানোর জন্য চুক্তি করলো। উপন্যাসটা বের হতেই तहলকা মিথ্যা গেল। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়লো ঊষাশ্রীর নাম। সমালোচকরাও তার লেখার প্রশংসা করলেন।
একদিন ঊষাশ্রীকে একটা বড়ো বইমেলায় বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হলো। মঞ্চে দাঁড়িয়ে, হাজার হাজার মানুষের সামনে কথা বলতে গিয়ে ঊষাশ্রীর গলা কাঁপছিল। মনে পড়লো শিলিগুড়িতে আসার সেই প্রথম দিনটা। কতটা ভয় পেয়েছিল সে, কতটা হতাশ লাগছিল। কিন্তু সে ছেড়ে দেয়নি। অভি, মা, শিপ্রা আর তার লেখক বন্ধুদের পরামর্শ মেনে চলেছে। আজ সে এই জায়গায়।
ঊষাশ্রী গলা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলেন, “আমার স্বপ্ন ছিল লেখিকা হওয়া। আপনারাও যদি কোনো স্বপ্ন নিয়ে থাকেন, তাহলে তা ধরে রাখুন। বাঁধা আসবে, হতাশা আসবে। কিন্তু থেমে যাবেন না। চেষ্টা চালিয়ে যান। দেখবেন, একদিন আপনার স্বপ্নও সফল হবে।”
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - শেষ জমিদারের মেয়ে: ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প: এক জমিদার কন্যার গল্প, যে জমিদারি প্রথার বিলুপ্তির পর নিজের পায়ে দাঁড়ায় এবং গ্রামের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
ঊষাশ্রীর কথা শেষ হতেই তালি আর চিয়েরি গুঞ্জন উঠলো। মঞ্চের নিচে বসে থাকা অভি হাত নাচিয়ে ঊষাশ্রীকে অভিনন্দন জানাচ্ছিল। শিপ্রা আর তার লেখক বন্ধুরাও ছিলেন সেখানে। ঊষাশ্রীর চোখে জল এলো। লেখিকার পরিচয় পেয়ে অভি অবাক হয়ে গেল। সেই ছেলেমানুষ ছেলেটি এখন একজন স্বীকৃত নাট্যকার। দু’জনে আবেগঘন্ট মিলিত হলো। অভি বললো, “আমি তোমাকে চিনতেই পারিনি, ঊষাশ্রী! তোমার লেখা পড়ে মনে হয়েছিল, এই লেখিকা নিশ্চয়ই খুব স্বপ্নবীনা, আবেগী মানুষ।”
ঊষাশ্রী হাসলো, “স্বপ্ন থাকলেই তো লেখা আসে, না অভি? আর আবেগ ছাড়া কি লেখা হয়? তুমি তো সেদিন আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলে।”
এরপর দু’জনে তাদের এই কয়েক বছরের গল্প আদান-প্রদান করলো। ঊষাশ্রী শিপ্রার কাছে জানতে চাইলো, তাঁর লেখা কোথায় এখন। শিপ্রা হাসলেন, “এখনো ছোট ছোট পত্রিকায় লিখি। কিন্তু লেখা ছেড়ে দেয়নি। আর তোমার মতো নতুন লেখকদের দেখে খুবই আনন্দ লাগে।”
বইমেলার সেই আড্ডা ঊষাশ্রীর মনে গেথে রয়েছে। সেদিন তিনি শুধু নিজের গল্পই বলেননি, অন্য স্বপ্নবাজদেরও গল্প বলেছিলেন। তার কথা শুনে অনেকেই তাকে এসে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। কেউ বলেছিল, তার লেখা তাকে জীবনে হাল ধরতে সাহায্য করেছে। কেউ বলেছিল, তার লেখা তাকে স্বপ্ন দেখার শক্তি দিয়েছে।
ঊষাশ্রী বুঝতে পারলেন, লেখকের কাজ শুধু লেখা লিখে যাওয়াটাই নয়। তার লেখার মাধ্যমে সে মানুষের জীবনে একটা ছোট্ট, ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। এই চিন্তাই তাকে আরও লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়।
শিলিগুড়ির সেই ছোট্ট চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বইমেলার মঞ্চ পর্যন্ত ঊষাশ্রীর যাত্রা ছিল বাঁধা, সন্দেহ আর সাফল্যের মিশ্রণ। কিন্তু সে ছেড়ে দেয়নি। স্বপ্নের পিছনে ছুটেছে, চড়াইল ঝড়, উপভোগ করেছে রোদের আলো। আজ সে অন্য স্বপ্নবাজদের জন্য একটা উদাহরণ। তার গল্প বলে দেয়, স্বপ্ন যদি মনের গহীনে জ্বলে, আর চেষ্টা থাকে অবিরাম, তাহলে সফলতা একদিন অবশ্যই আসবে।