১৯৩৯ সালের এক গ্রীষ্মের দিন। পোল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রামে ১৪ বছরের কিশোরী হান্না একান্ত নিবিড় সুখে পরিবারসহ বাস করছিল। তার জীবন ছিল যেন পল্লীগ্রামের নির্ভেজাল প্রকৃতির মতোই নির্মল ও শান্ত। গ্রামের মেঠোপথ ধরে ছুটে বেড়ানো, আর পাকা শস্যক্ষেত্রের মাঝে দৌড়ে বেড়ানো ছিল তার নিত্যসঙ্গী। গমের ক্ষেত আর সূর্যমুখীর সমারোহে ভরা ছিল এই ছোট্ট গ্রাম, যেখানে এক টুকরো শান্তির চাদর বিছানো ছিল প্রতিটি প্রান্তে।
হান্নার পিতা-মাতা ছিলেন এক সাধারণ কৃষক। প্রতিদিন সকালের আলো ফুটলেই তারা শস্যক্ষেতে কাজে বেরিয়ে পড়তেন, আর দিনের শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘরে ফিরতেন। তাদের ঘরটি ছিল মাটির তৈরি, ছোট্ট জানালাগুলো থেকে ভেতরে সূর্যের আলো এসে পড়ত। হান্না তাদের একমাত্র সন্তান। পিতামাতার দৃষ্টি ছিল সবসময় তার ওপর নিবদ্ধ, যেন পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা এই ছোট্ট মেয়েটির মধ্যেই সঞ্চিত।
হান্না ছিল তার পিতামাতার আদরের ধন। তার সবচেয়ে প্রিয় সময় ছিল সন্ধ্যায়, যখন তাদের সবার একসঙ্গে বসার সময় হতো। মায়ের তৈরি গরম রুটি আর সুপের ঘ্রাণে ঘর ভরে উঠত, আর তাদের একসঙ্গে খাবার সময়ের গল্পগুলো হয়ে উঠত বিশেষ। হান্নার বাবা খুব ভালো গল্প বলতেন। তিনি যুদ্ধের গল্প বলতেন, বলতেন কিভাবে পূর্বপুরুষেরা এই ভূমিকে রক্ষা করেছিলেন শত্রুদের আক্রমণ থেকে। সেইসব গল্প শুনে ছোট্ট হান্নার মনে হত, তার পরিবার পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষদের মধ্যে একজন।
গ্রামের মানুষজনও ছিল খুব আন্তরিক। প্রত্যেকেই একজন অন্যজনকে চেনে, এবং সুখ-দুঃখের সঙ্গী। প্রতিটি উৎসবে গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়ে উদযাপন করত। হান্নার বন্ধুরা ছিল গ্রামেই, আর তারা একসঙ্গে খেলাধুলা করত, মেঠো পথ ধরে দৌড়ে বেড়াত, আর ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে খুঁজতো। প্রতিদিনের এসব খুশির মুহূর্তগুলোই ছিল হান্নার কাছে অমূল্য। তবে হান্না শুধু গ্রামের মেয়ে নয়; তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল ছিল পৃথিবীকে জানার, যা তার চোখে এক আলাদা উজ্জ্বলতা নিয়ে আসত।
কিন্তু সেই স্বাভাবিক জীবনে এক অশুভ ছায়া ধীরে ধীরে নেমে আসতে শুরু করল। গ্রামের বাইরে থেকে খবর আসছিল যে যুদ্ধের সুর এখন আর দূরে নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষম গর্জন পোল্যান্ডের প্রান্তে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। সবার মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কা বিরাজ করছিল। বাজারে মানুষের কণ্ঠস্বর আগের মতো উচ্ছল ছিল না, বরং ভয় আর কৌতূহলের মিশ্রণ ছিল সেখানে।
হান্নার বাবা-মাও এই অস্থিরতার মধ্যে চিন্তিত ছিলেন। তাদের মনে একটা অজানা আশঙ্কা বাসা বাঁধছিল, কিন্তু তারা সেটা হান্নার সামনে কখনো প্রকাশ করেননি। হান্নার মা তাকে রাত্রে আদর করে ঘুম পাড়ানোর সময় বারবার মৃদুস্বরে বলতেন, “আমার মেয়েটি থাকবে নিরাপদে। তোমার জন্যই আমাদের সমস্ত শক্তি।”
একদিন হঠাৎ গ্রামে রটে গেল, হিটলারের বাহিনী কাছাকাছি শহরগুলোয় প্রবেশ করছে। ভয়ে কাঁপতে থাকা গ্রামের মানুষজন দ্রুত ঘরে ফিরতে শুরু করল, বাজার শূন্য হয়ে পড়ল। হান্না তার পিতার মুখে এক ধরনের উদ্বেগ দেখতে পেল, যা সে আগে কখনো দেখেনি। এক সন্ধ্যায় তার পিতা-মাতা অনেকটা সাঁতরে-সাঁতরে গ্রামের প্রান্তে গেলেন। সেখান থেকে হান্না দেখল, তারা একে অপরের দিকে চেয়ে থাকলেন, যেন মনের সব কথাই বুঝে নিতে পারলেন এক নিমেষে।
এই পর্বের শেষে, এক অন্ধকারময় রাত নেমে এল। দূর থেকে কিছু কণ্ঠস্বর শুনতে পেল হান্না। সে তার মায়ের আঁচল ধরে লুকিয়ে রইল। তাদের ছোট্ট ঘরের জানালা দিয়ে আলো এসে পড়ছিল, আর সেই আলোতে হান্না এক নতুন অজানা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে রইল। বাইরে থেকে ভেসে আসা সৈন্যদের গর্জনে তার মন কেঁপে উঠল, কিন্তু সে জানত, এই শান্তির জীবন হয়তো আর থাকবে না।
ছোটদের রূপকথার গল্প - ক্লারার রাজ্য: "ক্লারার রাজ্য" একটি মায়াবী রূপকথার গল্প যেখানে ক্লারা ও প্রাণীরা একসাথে তৈরি করে বন্ধুত্বের রাজ্য। ছোটদের গল্পে জাদু, বন্ধুত্ব, ও ভালোবাসার স্পর্শে গড়ে ওঠা এক অনবদ্য রূপকথার দুনিয়া। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অন্ধকারের আগমন
হান্নার জীবনের এক নির্মল অধ্যায় যেন সেই রাতেই চিরতরে শেষ হয়ে গেল। সন্ধ্যা পার হয়ে গভীর রাত। বনের ধারে, পোল্যান্ডের ছোট্ট গ্রামের আকাশ তখন কালো মেঘে ঢাকা। দূরে ঝলমলে শহরের আলো, কিন্তু সেই আলো যেন আর হান্নার জীবনে কোনো উষ্ণতা আনবে না। বাড়ির ভিতর মৃদু আলোতে বাবা-মা বিছানার পাশে বসে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, মুখে চিন্তার গভীর ছাপ। “হিটলারের বাহিনী আরও কাছে আসছে,” কাঁপা কণ্ঠে বললেন হান্নার বাবা।
হঠাৎ করেই বাইরে শোনা গেল থমথমে বুটের শব্দ। গোটা পরিবেশ যেন এক ঝাঁকের আশঙ্কায় ভরে উঠল। কাঁপতে কাঁপতে মা একেবারে হান্নাকে কাছে টেনে ধরলেন। “তুমি কিছুতেই ভয় পাবে না, হান্না,” মৃদু কণ্ঠে বললেন তিনি, কিন্তু সেই কণ্ঠে লুকিয়ে ছিল আতঙ্ক। হান্না কিছু বোঝার আগেই বাইরে দরজায় শোনা গেল জোর ধাক্কা।
হান্না চোখে মুখে ভীতির চিহ্ন ফুটে উঠল। বাবা দ্রুত এক নির্দেশ দিলেন, “তুমি মায়ের সাথে পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাও। আমি সৈন্যদের সামলাচ্ছি।” মা সঙ্গে সঙ্গে হান্নার হাত ধরে তাকে নিয়ে দরজার দিকে দৌড়াতে লাগলেন। বাড়ির বাইরের অন্ধকার তাদের আড়াল করছিল, কিন্তু সেই অন্ধকার ছিল আরেক বিপদের সঙ্কেত।
দূরে শোনা যাচ্ছিল গাড়ির ইঞ্জিনের গর্জন আর সৈন্যদের গলা। একসময় মা হান্নাকে বনের দিকে নিয়ে চললেন। কিন্তু ভাগ্যের এক নির্মম পরিহাসে তাদের সঙ্গেই ঘটল দুর্ঘটনা। মায়ের হাত থেকে হঠাৎ করে আলগা হয়ে গেল হান্না, সে পড়ে গেল পিছনের দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই সে দেখতে পেল, মা ভয়াবহ আতঙ্কে তাকিয়ে আছেন তার দিকে, কিন্তু সময় ছিল না, বিপদ এতটাই কাছাকাছি যে মা তাড়াতাড়ি দৌড়াতে লাগলেন আর অন্ধকারে মিলিয়ে গেলেন।
বন যেন নিঃশব্দ, কিন্তু সেই নিঃশব্দতার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল এক অদৃশ্য সন্ত্রাস। হান্নার মনের মধ্যে ছেঁকে ধরেছিল ভয় আর অসহায়ত্ব। চারপাশে কোনো পরিচিত মুখ নেই, কোনো সান্ত্বনা নেই। ধীরে ধীরে হাঁপাতে হাঁপাতে বনভূমির গভীরে প্রবেশ করল সে। গাছপালা, পাতার গন্ধ, মাটির সোঁদা গন্ধ – সবই যেন এক অপরিচিত রূপ ধারণ করেছিল।
বনের ভিতরে পা রাখার সাথে সাথেই শোনা গেল বুনো কুকুরের গর্জন আর দূরের বন্দুকের শব্দ। হান্না জানত না কোথায় যাবে, শুধু একটা চিন্তা মনের মধ্যে জেগে উঠল, “বেঁচে থাকতে হবে, কিছুতেই ভেঙে পড়া যাবে না।” বনের গভীরে গিয়ে সে একটা গাছের তলায় বসল, আশেপাশের পাতায় তার ছোট ছোট হাতের ছাপ পড়ছিল। রাতের শীতল বাতাস গায়ে লাগছিল, কিন্তু তার চোখে তখন শুধুই অতীতের সেই সুখের স্মৃতি ভেসে উঠছিল।
হান্না সেই রাতের অন্ধকারে প্রথমবার একাকী, এবং একান্তভাবে বুঝতে পারল যে, শৈশবের সেই দিনগুলি যেন কোনো অলীক কল্পনার মতোই মিলিয়ে গেছে। তার স্মৃতিতে ভেসে উঠছিল মা-বাবার মুখ, তাদের হাসি, গল্পের মুহূর্তগুলো। কিন্তু সেই সব কিছু এখনই কোনোভাবে তাকে ফিরে পেতে সাহায্য করবে না।
সেই রাতটি ছিল হান্নার জীবনের প্রথম পরীক্ষা। ভোরের আলো ফোটার আগে পর্যন্ত হান্না সেখানে, গাছের ছায়ায়, নিজেকে লুকিয়ে রাখল। মাথার মধ্যে ঘুরছিল বাবা-মার কণ্ঠস্বর, তারা যে তাকে নিয়ে কি পরিকল্পনা করেছিল, সে কি আবার তাদের দেখতে পাবে?
ভোরের আলো ফুটতেই, হান্না নিজের ইচ্ছাশক্তিকে জাগিয়ে তুলল। একা বেঁচে থাকার ইচ্ছা যেন তার মনে একধরনের সাহস এনে দিল। বন থেকে বের হয়ে কোথাও একটা আশ্রয় খুঁজতে হবে। ঠিক তখনই মনে পড়ল তার বাবার কথা, “যুদ্ধ সবকিছু কেড়ে নেয়, কিন্তু সাহস ধরে রাখতে হবে।”
সেই সাহসই তাকে অচেনা পথে চালিত করল।
নতুন আশ্রয়
বনের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ সময় হাঁটতে হাঁটতে হান্না অবশেষে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। পায়ের নিচের মাটি, আকাশের নিচের খোলা বাতাস এবং চারপাশের গাছের পাতাগুলি যেন তার ভয়ানক অভিজ্ঞতার স্মৃতি বহন করছিল। গভীর রাতে হঠাৎ দূরে কোথাও একটি আলো দেখল সে। দিশেহারা মনের মধ্যে একটুকরো আশা জাগল, হয়তো কোথাও কিছু নিরাপদ আশ্রয় পেতে পারে। আর একটু এগিয়ে দেখল ছোট্ট একটি বাড়ি, চারপাশে মাটির দেয়াল আর সামনের উঠোনে কয়েকটি মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে।
বাড়িটির সামনে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে ছিলেন, পরনে মাটির রঙের পোশাক, মুখে সাদাটে দাড়ি। তিনি লাঠি ভর দিয়ে উঠোনের মাটি খুঁড়ছিলেন। হান্না একটু থেমে দেখল, তিনি নিশ্চয়ই এই বাড়ির মালিক। সাহস করে সে তার দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু ভয়ে ঠোঁট কাঁপছিল তার। বৃদ্ধটি তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলেন, যেন তার আগমনের অপেক্ষাতেই ছিলেন।
“তুমি কি সাহায্যের জন্য এসেছো, মেয়ে?” শান্ত স্বরে বললেন বৃদ্ধ, যার নাম মিস্টার কোয়ালস্কি।
হান্না তার ভয়ের কথা আর মন থেকে সরাতে পারছিল না, তাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নীচু করে বলল, “আমার নাম হান্না। আমার পরিবার থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। আপনিই কি আমাকে কিছুদিন আশ্রয় দিতে পারেন?”
মিস্টার কোয়ালস্কি একটি ছোট্ট হাসি দিলেন, যার মধ্যে ছিল সহানুভূতির স্পর্শ। “অবশ্যই পারি, মেয়ে,” বললেন তিনি। “আমাদের বাড়ি বড় না, কিন্তু যা আছে, তার মধ্যে তোমারও একটুকরো আশ্রয় মিলবে।”
মিস্টার কোয়ালস্কির এই কথাগুলো যেন হান্নার মনে এক ধরনের শান্তি এনে দিল। বহুদিন পর যেন সে কোনো নিরাপত্তার অনুভূতি পেল। কোয়ালস্কি তাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন, যেখানে ছোট্ট একটি রান্নাঘর, মাটির দেওয়াল, কাঠের খাট এবং কয়েকটি পুরোনো আসবাবপত্র ছিল।
কিছুক্ষণ পর কোয়ালস্কির কন্যা আনা সেখানে এলো। আনার বয়স প্রায় হান্নার সমান হবে, কিন্তু তার চোখে-মুখে ছিল প্রচণ্ড দৃঢ়তা আর অভিজ্ঞতার ছাপ। আনার চোখে ভেসে উঠল সহানুভূতির অভিব্যক্তি। সে এসে হান্নার হাত ধরে তার পাশে বসলো এবং বলল, “তুমি নিশ্চয়ই অনেক কষ্টের মধ্য দিয়ে এসেছো, কিন্তু তুমি এখানে নিরাপদে আছো।”
হান্নার চোখে জল চলে এলো, এই প্রথমবার তার মনে হলো কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে। আনা যেন তার একান্ত আত্মীয়ের মতো লাগছিল, যাকে সে দীর্ঘদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।
কোয়ালস্কির পরিবারে থাকতে শুরু করল হান্না, তাদের ছোট্ট বাড়িতে ধীরে ধীরে এক ধরনের সান্ত্বনা খুঁজে পেল সে। দিনে দিনে সে খামারের কাজে অভ্যস্ত হয়ে উঠল, মুরগি ও গরুর খাওয়া, খেতের কাজ – সবকিছুতেই আনার সাহায্য করতে লাগল। আনার সঙ্গে কাজ করতে করতে তাদের মধ্যে এক গভীর বন্ধন গড়ে উঠল। আনা তার বন্ধুত্বপূর্ণ এবং মৃদু ব্যবহারের মাধ্যমে হান্নাকে জীবনের নতুন মানে বোঝাতে থাকল।
একদিন বিকেলে, যখন সূর্যের আলো খেতের উপর দিয়ে সোনালী আভা তৈরি করছিল, আনা তাকে বসল আড়াল করে, নিজের জীবনের কাহিনী বলতে শুরু করল। আনার কথাগুলো হান্নাকে আরও প্রেরণা দিল। “যুদ্ধ আমাদের থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে,” বলল আনা, “কিন্তু আশা এবং একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া আমরা বাঁচতে পারব না। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে লড়াই করতে হয়, তা যে পরিস্থিতিতেই হোক।”
হান্না তখন আনার হাত ধরে বলল, “তুমি আমার জীবনে যেমন আশ্রয় দিয়েছো, তেমনই আমার জীবনের প্রেরণা হয়েছো। আমি চিরকাল তোমার এই বন্ধনকে মনে রাখব।”
এই সময়ে তাদের জীবনে আসে নতুন এক চ্যালেঞ্জ। গ্রামের প্রান্তে থাকা এক সৈন্য দল গুজব শুনে আসে যে কোয়ালস্কির বাড়িতে শরণার্থী লুকিয়ে আছে।
অধ্যায়টি এখানেই শেষ হয়, কিন্তু সৈন্যদের এই অনুসন্ধান ভবিষ্যতে কী বিপদের সৃষ্টি করবে, সেই রহস্য নিয়ে শুরু হবে চতুর্থ অধ্যায়।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - আত্মার অপেক্ষা: "আত্মার অপেক্ষা" - একটি রহস্যে মোড়া ভুতের গল্প। বাংলার প্রাচীন বাড়ির ভৌতিক ঘটনার আবহে লেখা এই বাংলা ছোট গল্পটি পাঠককে ভয় ও উত্তেজনার এক নতুন স্তরে নিয়ে যাবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
বন্ধুত্বের জোর
যুদ্ধের নৃশংসতার মাঝে, দিনগুলো যেন আরও কঠিন হয়ে উঠছিল। বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত ছিল একটা অমূল্য উপহার, আর সেই উপহারের ভাগীদার ছিল দুই বন্ধু—হান্না আর আনা। খামারের কাজ, রান্নাবান্না, পশুপালন—প্রতিদিনের ছোট ছোট কাজের মধ্যে যেন তারা একে অপরের সঙ্গ খুঁজে পেত। যুদ্ধের কারণে তাদের জীবনের সকল সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেওয়া প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হান্না এখন আনার কাছে শুধু একজন আশ্রিত নয়, বরং তার বোনের মতোই হয়ে উঠেছিল।
সকালের সূর্যের আলো যখন খামারের সবুজ গাছের পাতার ফাঁকে পড়ত, তখন তারা একসঙ্গে কাজ করতে শুরু করত। মুরগির খাঁচা থেকে ডিম সংগ্রহ করা, বাগানে জল দেওয়া কিংবা ফসলের যত্ন নেওয়া—এই কাজগুলো তাদের দুজনের একসঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলোকে মজবুত করে তুলত। কিন্তু তাদের এই স্বাভাবিক জীবনের ছায়ার আড়ালে ছিল এক ভয়ের ছাপ, যে কোনো সময় তাদের লুকিয়ে থাকার রহস্য ফাঁস হতে পারে।
একদিন সন্ধ্যাবেলা, যখন চারপাশে ধীরে ধীরে আঁধার ঘনিয়ে আসছিল, আনা ছোট্ট একটি আগুন জ্বালিয়ে বসেছিল উঠোনে। পাশে বসে হান্না তার গল্প শুনছিল। আনার চোখে যেন গভীর কোনো স্মৃতির ছায়া ছিল। সে বলল, “তুমি জানো, হান্না, আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন যুদ্ধের কথা আমি কখনোই ভাবিনি। আমরা সবাই ভেবেছিলাম যে শান্তি চিরদিন থাকবে। কিন্তু এখন দেখি এই পৃথিবীতে শান্তি যেন একটা বিলাসিতা। মনে হয় যেন প্রতিদিনের অস্তিত্বও একটা যুদ্ধ।“
হান্না চুপ করে শুনছিল, তার চোখের কোণ দিয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। “আমিও জানি এই যন্ত্রণা। প্রতিদিনের এই লড়াই আমাদের সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। কিন্তু তোমার পাশে থাকায় এই জীবনটা সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে।”
আনা হেসে তার কাঁধে হাত রাখল। “তুমি আমারও বাঁচার কারণ, হান্না। আমি যদি কোনোদিন কাউকে বোনের মতো মনে করে থাকি, তবে তা তুমি।“
তাদের বন্ধুত্ব যেন যুদ্ধের এই ভয়ংকর সময়েও এক ধরনের সাহসের প্রতীক হয়ে উঠছিল। তারা একে অপরের সঙ্গে আস্থা আর সাহস ভাগাভাগি করে নিচ্ছিল, যেন পৃথিবীর সকল অন্ধকারকে একসঙ্গে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়।
একদিন রাতে, যখন তারা বাড়ির ভেতরে একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করছিল, হঠাৎ বাইরে থেকে হুড়মুড় করে দরজার শব্দ শুনতে পেল। আনার বাবা, মিস্টার কোয়ালস্কি, দ্রুত উঠে দরজা খুললেন। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল দুইজন সৈনিক, মুখে রূঢ়তার ছাপ। তারা জিজ্ঞেস করতে লাগল, “এই বাড়িতে কি কেউ লুকিয়ে আছে?”
হান্না আর আনার মনের ভেতর ততক্ষণে আতঙ্ক কাজ করছিল। আনা তার হাত ধরে মৃদু ফিসফিস করে বলল, “ভয় পেও না, আমি তোমার পাশে আছি।” মিস্টার কোয়ালস্কি শান্তভাবে বললেন, “এই বাড়িতে শুধু আমার মেয়ে আর আমি আছি। আমরা নিরীহ কৃষক। কোনো শরণার্থী নেই এখানে।”
কিছুক্ষণ সৈনিকরা চারপাশ দেখে চলে গেল, কিন্তু হান্নার মনের মধ্যে ভয়ের শেকড় আরও গভীর হয়ে গেঁথে গেল। তাদের জীবনের শান্তি যেন এক মুহূর্তে ভেঙে পড়ল। তারা জানত, এই বিপদের মাঝে কোনো ভুল হলে তাদের সকলের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
তাদের জীবনের এই অস্থিরতা সত্ত্বেও হান্না ও আনা প্রতিদিন একসঙ্গে সময় কাটিয়ে নিজেদের মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করত। একদিন আনা একটি পুরনো বাঁশি নিয়ে এলো এবং সে বাজাতে শুরু করল। হান্না তার বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে বলল, “তুমি এত সুন্দর করে বাজাও, আগে কখনো শুনিনি।”
আনা হাসল এবং বলল, “এটাই তো আমার ছোটবেলার সঙ্গী ছিল, কিন্তু যুদ্ধের কারণে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে।“
হান্নার মনে হল, যেন সে এই বাঁশির সুরের মধ্যে নিজের হারিয়ে যাওয়া সুখের স্মৃতিগুলোকে খুঁজে পেতে পারে। সেই সন্ধ্যায় তারা দুজন একসঙ্গে গান গাইল, পুরোনো দিনের কথা বলল এবং নিজেদের স্বপ্নের কথা শেয়ার করল।
কিন্তু যুদ্ধের এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে তাদের এই ছোট্ট শান্তির মুহূর্তগুলোও যেন চিরদিনের জন্য টিকে থাকতে পারে না। আনা একদিন রাতের বেলা এসে হান্নাকে বলল, “তোমাকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া দরকার। সৈন্যরা আমাদের সন্দেহ করছে। আমাদের বন্ধুত্বের জন্যই তোমাকে বাঁচাতে হবে।”
এই কথার মধ্য দিয়ে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। হান্না কি আনার কাছ থেকে দূরে চলে যাবে, নাকি তারা একসঙ্গে লড়াই করবে? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গল্প এগোবে পঞ্চম অধ্যায়ে।
কঠিন সিদ্ধান্ত
যুদ্ধের ছায়া প্রতিদিন ঘন হয়ে আসছে। মিস্টার কোয়ালস্কি প্রতিটি দিন নতুন আতঙ্কে কাটাচ্ছেন, কারণ তারা জানেন, সৈন্যরা যেকোনো মুহূর্তে তাদের বাড়িতে হানা দিতে পারে। আনার মাধ্যমে শোনা খবরের সূত্র ধরে তিনি বুঝতে পারছেন, এই ছোট্ট শহরটি আর নিরাপদ নয়, বিশেষ করে হান্নার জন্য। আনা তাকে যতটা সম্ভব লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, কিন্তু যে কোনো সময় তাদের গোপন আস্তানা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। আর এই ঝুঁকির মুখে তিনি আর নীরব থাকতে পারলেন না।
এক সন্ধ্যায়, হান্না আর আনা উঠোনে বসে মৃদু আলোয় গল্প করছিল। মিস্টার কোয়ালস্কি তাদের কাছে এসে কাশতে কাশতে বললেন, “আমাদের কথা বলা দরকার।” তার গলায় একটা কঠিনতা আর চোখে এক অসম্ভব দুশ্চিন্তা স্পষ্ট। আনা ও হান্না চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু সময় নীরব থাকার পর তিনি বললেন, “হান্না, তোমাকে এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হবে। এই পরিস্থিতিতে এখানে থাকা আর নিরাপদ নয়।”
এই কথাগুলো শোনার পর হান্নার মনের মধ্যে যেন বজ্রাঘাত হলো। তার সারা শরীর অবশ হয়ে এলো। আনা দ্রুত বলল, “বাবা, আপনি কি বলছেন? আমরা তো এতদিন ধরে হান্নাকে লুকিয়ে রেখেছি। সে আমার পরিবার, তাকে আমি যেতে দেব না।”
মিস্টার কোয়ালস্কি আনার কাঁধে হাত রেখে শান্তভাবে বললেন, “বুঝতে চেষ্টা করো, মেয়ে। এই যুদ্ধ আমাদের কোনো দয়া দেখাবে না। হান্নাকে আমরা ভালোবাসি বলেই আমাদের উচিত তাকে রক্ষা করা। আমাদের নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে এখানে রাখাটা ভুল হবে। তাকে নিরাপদে অন্য কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করা দরকার।”
হান্নার চোখে জল চলে এলো। এই কয়েক মাসে আনা আর মিস্টার কোয়ালস্কি তার কাছে পরিবার হয়ে উঠেছিল। তাদের ছেড়ে চলে যাওয়া তার কাছে অসম্ভব মনে হচ্ছিল। সে বলল, “কিন্তু আমি কোথায় যাবো? আর তোমরা… তোমরা কি আমার জন্য বিপদে পড়বে না?”
আনা তার হাত ধরে শক্ত করে বলল, “হান্না, তুমি আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। তুমি থাকলে আমি সাহস পাই। কিন্তু বাবার কথায় হয়তো কিছুটা সত্যি আছে। আমাদের একবার ভেবে দেখতে হবে।”
তারা কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তাদের সবার মনের মধ্যে বিদায়ের এক অজানা যন্ত্রণা ফুটে উঠেছিল। শেষ পর্যন্ত মিস্টার কোয়ালস্কি বললেন, “আমার এক পুরনো বন্ধু রয়েছেন শহরের বাইরে একটি গ্রামে। তিনি সম্ভবত তোমাকে আশ্রয় দেবেন। সেখানে কিছুটা নিরাপদ থাকবে। এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে জানি না, কিন্তু এই কঠিন সময়ে আমাদের নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে।”
হান্না আনার হাত ধরে ফিসফিস করে বলল, “আমরা কি আবার একদিন দেখা করতে পারব, আনা? এই বিদায় কি চিরদিনের?”
আনা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরল, চোখে অশ্রু টলমল করছে। “আমাদের দেখা অবশ্যই হবে, হান্না। তুমি আমার প্রতিশ্রুতি রাখবে, ঠিক আছে? এই যুদ্ধ একদিন শেষ হবে, তখন আমরা আবার একত্রে হব।”
সেই রাতে বিদায়ের মুহূর্তটি যেন তাদের জীবনের এক কঠিনতম সময় হয়ে উঠল। আনা আর মিস্টার কোয়ালস্কি হান্নার জন্য কিছু খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র একত্রিত করে দিলেন। মিস্টার কোয়ালস্কির বন্ধুর ঠিকানাটি হাতে নিয়ে হান্না তাদের শেষবারের মতো বিদায় জানাতে উঠোনে এসে দাঁড়াল। আনা শক্ত করে তার হাত ধরে বলল, “মনে রেখো, তুমি আমার পরিবারের একজন। তুমি যেখানেই থাকো, আমি তোমাকে মনে রাখব।”
হান্না বিদায় নেওয়ার সময় তার চোখে ছিল নির্ভীকতা, কিন্তু মনে ছিল এক অপার কষ্ট। প্রতিটি পা ফেলার সাথে তার বুকের মধ্যে অসহ্য এক ব্যথা ফুটে উঠছিল। সে যখন শেষবারের মতো পেছন ফিরে দেখল, আনা তার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, চোখে অশ্রু।
রাতের অন্ধকারে হান্না একা পথ চলা শুরু করল, তার মন তোলপাড় করছে। এই যুদ্ধ তার জীবনকে ভিন্ন পথে চালিত করেছে, তাকে আলাদা করেছে তার প্রিয়জনদের থেকে। কিন্তু তার মনে ছিল আনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি—তারা আবার একদিন মিলিত হবে।
মুক্তির পথে
রাতের অন্ধকারে গভীর শ্বাস নিয়ে হান্না তার যাত্রা শুরু করল। আনার দেওয়া প্রতিশ্রুতি ও মিস্টার কোয়ালস্কির অনুপ্রেরণায় তার মনে এক অভূতপূর্ব সাহস জেগে উঠেছে। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, সে বিভিন্ন শহর ও গ্রাম অতিক্রম করতে থাকে। প্রতিটি পা ফেলার সময় তার মনে তীব্র একটা যন্ত্রণা আর আশার সংমিশ্রণ তৈরি হয়। প্রতিটি নতুন শহর ও গ্রামের মানুষের মধ্যে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখা যায়, যুদ্ধের কড়া শাসন তাদের চোখে-মুখে ছাপ ফেলেছে।
একটি ছোট্ট শহরে এসে সে একটি নিরাপদ জায়গায় রাত কাটানোর জন্য আশ্রয় চায়। কিছু গ্রামবাসী তাকে সাবধান করে দেয়, বলে, “এখানে থাকাটা খুব বিপজ্জনক। সৈন্যরা যেকোনো মুহূর্তে হানা দিতে পারে।” কিন্তু তার পায়ে হেঁটে যাওয়ার আর শক্তি নেই, তাই সে গ্রামের এক বৃদ্ধ মহিলার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বৃদ্ধা তাকে মৃদু সুরে বলে, “মা, তোমার চোখে সাহস আছে। এই পরিস্থিতিতে সাহস থাকা সহজ নয়।”
রাতের বেলা ঘুমানোর সময় বৃদ্ধা তাকে একটি ছোট্ট তাবিজ দেয়, বলে, “এটা আমার মায়ের দেওয়া ছিল। বলতেন, যুদ্ধে বেঁচে থাকতে হলে হৃদয়ে সাহস রাখতে হয়। তুমি এটা সঙ্গে রাখো।”
হান্না বৃদ্ধার কথা শুনে তার তাবিজটি হাতে ধরে মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। সেই মুহূর্তে তার মনের মধ্যে এক অজানা শক্তি ভরে যায়। সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এই যুদ্ধ তাকে টলাতে পারবে না।
সকাল হতেই সে বৃদ্ধাকে বিদায় জানিয়ে আবার যাত্রা শুরু করে। প্রতিটি শহর পার হওয়ার সাথে তার মনে এক নতুন সংকল্প জন্ম নেয়। যুদ্ধ তাকে বারবার থামাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু সে জানে, আনা ও মিস্টার কোয়ালস্কির জন্যই তাকে টিকে থাকতে হবে। প্রতিটি গ্রাম পেরোবার সময় সে নতুন মানুষদের মুখোমুখি হয়, তাদের থেকে নতুন নতুন গল্প শুনে। কিছু গল্প তাকে অনুপ্রাণিত করে, কিছু গল্প তার ভেতরের কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
একদিন বিকেলবেলা সে একটি গ্রামে পৌঁছায়, যেখানে যুদ্ধের আঘাতে সবকিছু প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বাড়িগুলো ভেঙে পড়েছে, আর রাস্তার ধারে বাচ্চারা ক্ষুধায় কাতর। হান্নার মনে হলো, তার নিজের যন্ত্রণার থেকেও এই মানুষগুলোর কষ্ট অনেক বেশি। সে কিছু খাবার নিয়ে বাচ্চাগুলোকে দেয়, আর তাদের চোখে আনন্দের ঝলক দেখে তার মন কিছুটা শান্তি পায়।
সেই রাতে সে গ্রামে একটি আশ্রয়ে রাত কাটায়, যেখানে আরও কিছু যাত্রী তার মতোই যুদ্ধের কারণে ঘর ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন তরুণ দম্পতি ছিল, যাদের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তরুণটি, নাম তার ইলিয়াস, তাকে বলে, “যুদ্ধ আমাদের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু আমাদের জীবনের আশা কেড়ে নিতে পারেনি। আমরা যদি একে অপরকে সাহায্য করি, তবে হয়তো এই অন্ধকার কেটে যাবে।”
হান্না ইলিয়াস ও তার স্ত্রীর কাছ থেকে সাহস পায় এবং তার যাত্রা এগিয়ে নিয়ে যেতে নতুন উদ্যম খুঁজে পায়। পরদিন ইলিয়াস তাদের সঙ্গে তাকে কিছু দূর এগিয়ে দিয়ে বিদায় জানায়, বলে, “মনে রেখো, তুমি কখনো একা নও। এই যুদ্ধের মধ্যে থেকেও আমরা সবাই একসাথে আছি।”
হান্নার যাত্রাপথে বিপদ আরও ঘনিয়ে আসে। কিছুদিন পর এক সন্ধ্যায় সে একদল সৈন্যের সম্মুখীন হয়, যারা গ্রামে তল্লাশি চালাচ্ছে। তারা হান্নাকে আটকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু সে কৌশলে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এই ঘটনাটি তাকে বুঝিয়ে দেয়, প্রতিটি মুহূর্ত তার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তারপর থেকে সে আরও বেশি সতর্ক হয়ে চলতে শুরু করে। এই সমস্ত ঝুঁকির মধ্যেও তার মনে আনার প্রতিশ্রুতি আর বৃদ্ধার দেওয়া তাবিজের শক্তি তাকে বারবার বাঁচিয়ে নিয়ে চলে।
অবশেষে সে একটি বড়ো শহরে পৌঁছায়, যেখানে গোপনে প্রতিরোধের কিছু দল সক্রিয়। সেখানে সে আরও কিছু বন্ধু খুঁজে পায়, যারা যুদ্ধের শিকার এবং একই সাথে তার মতোই সাহসী। তাদের মধ্যে একজন, যার নাম রুডলফ, হান্নার গল্প শুনে বলে, “তুমি যে এতদূর এসেছ, তার মানে তুমি সত্যিকারের সাহসী। এই যুদ্ধ আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। একদিন এই কালো মেঘ কেটে যাবে, কিন্তু আমরা যারা বেঁচে থাকব, তাদের মধ্যে এই সাহস আর সহনশীলতার স্মৃতি চিরদিন থাকবে।”
এই কথাগুলো শুনে হান্নার মনে আরও শক্তি আসে। সে প্রতিজ্ঞা করে, যত কঠিনই হোক না কেন, সে এই যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে। রুডলফ ও তার দল তাকে আরও নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং তাকে আশ্বাস দেয় যে সে একদিন তার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে পারবে।
ছোটদের রূপকথার গল্প - জাদুময় আকাশ: "জাদুময় আকাশ" একটি মনোমুগ্ধকর ছোটদের গল্প। লিলির তারাদের জগতে ভ্রমণ ও ভালো কাজের মাধ্যমে জীবনকে আলোকিত করার রূপকথার গল্প ছোটদের কল্পনায় জাদুর ছোঁয়া নিয়ে আসবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আলোর সন্ধানে
শেষবারের মতো যখন হান্না যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরটির দিকে তাকায়, তার মনে বিস্ময়ের সঙ্গে কিছুটা প্রশান্তিরও অনুভূতি হয়। সেই রাতের পরে তাকে আর কেউ অনুসরণ করেনি। রুডলফ ও তার বন্ধুরা তাকে সহায়তার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিল, তাদের প্রতিরোধের প্রচেষ্টায় শহরটিকে একটি নিরাপদ স্থানে পরিণত করার অঙ্গীকার ছিল। কিন্তু হান্না জানত, তার সামনে যে পথে সে হাঁটছে, তা শেষ পর্যন্ত তাকে তার নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
সকালবেলা হান্না উঠে রুডলফের দেয়া মানচিত্রটির দিকে তাকায়। এতে একটি গোপন পথের নির্দেশ ছিল, যা তাকে নিরাপদে সীমান্ত পেরিয়ে তার নিজের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। সেই মানচিত্রটি মুঠোয় নিয়ে সে যাত্রা শুরু করল। এই যাত্রার শেষ প্রান্তে তাকে যে অপেক্ষা করছে তা নিয়ে তার মনে উত্তেজনা ছিল, তবে সেই সঙ্গে একটু ভয়ও ছিল।
পাহাড়, বন আর নদী পেরিয়ে তার মনে ভেসে আসতে লাগল আনার কথা। আনার হাসি, তার ছোট ছোট স্মৃতিগুলো, আর সেই নির্ভীক চাহনি – সবই যেন তাকে সাহসী করে তুলল। সে ভাবতে লাগল, যুদ্ধে হয়তো অনেক কিছু হারিয়ে গেছে, কিন্তু আশাকে কেউ কখনো হারাতে পারে না।
যাত্রাপথে সে এক পরিত্যক্ত ছোট্ট গ্রামে পৌঁছায়, যেখানে একটি পুরানো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। তার মনে হয়, এই মন্দিরটি একসময় গ্রামবাসীদের উপাসনার স্থান ছিল, যেখানে মানুষ মন থেকে শান্তি খুঁজে পেত। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কিছু ফুল ফুটে রয়েছে। সেই মুহূর্তে হান্নার মনে আসে যে, ফুল যেমন ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও ফোটে, মানুষও তেমনি ধ্বংসের মাঝেও নতুন করে বাঁচতে শেখে।
সীমান্তে পৌঁছানো সহজ ছিল না। পথে পথে সৈন্যদের টহল, চেকপয়েন্ট আর কিছু সন্দেহপ্রবণ স্থানীয় লোকজন তার যাত্রাকে কঠিন করে তুলছিল। সে প্রতিবার চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিত, যেন সমস্ত ভয় আর দ্বিধা মুছে ফেলে শক্তি অর্জন করে। অবশেষে যখন সে সীমান্তের একেবারে কাছে পৌঁছায়, তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। সীমান্তের ওপারে তার নিজের দেশের মাটি। মাটির গন্ধে তার চোখে জল আসে। এতদিন ধরে সে এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করেছে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছিল না যে এই যাত্রার শেষ প্রান্তে সত্যিই সে দাঁড়িয়ে আছে।
যুদ্ধ অবশেষে শেষ হয়েছিল। হান্না বুঝতে পারে, সে একা নয়, তার মতো আরও অনেক মানুষ আছে যারা এই যুদ্ধের অন্ধকার সময়ে জীবনের নতুন আলোর খোঁজে ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর, শূন্য মাঠ, কষ্টে ভরা মানুষজনের ভিড়ে অনেকেই হারিয়ে গেছে, কিন্তু যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁদের প্রত্যেকের মধ্যে নতুন জীবনের শক্তি, সাহস আর অদম্য ইচ্ছা খুঁজে পাওয়া গেছে। তাদের চোখে মিশে ছিল কষ্টের ছাপ, কিন্তু তাদের হৃদয়ে ছিল এক অদ্ভুত শান্তি, যা শুধু যুদ্ধে টিকে থাকা মানুষরাই বুঝতে পারে।
তার নতুন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সে সেই প্রিয়জনদের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে রাখে। আনার মুখ, মিস্টার কোয়ালস্কির সাহসী চোখ, সেই বৃদ্ধার মায়াময় হাসি – তারা যেন তাকে শক্তি দেয়, প্রতিটি শ্বাসে তাকে প্রেরণা জোগায়।
হান্না অবশেষে নিজেকে বুঝতে পারে – জীবন কত কঠিনই হোক, প্রতিটি মুহূর্তেই কিছু না কিছু শেখায়। যে যুদ্ধে সে এতকিছু হারিয়েছে, সেই যুদ্ধই তাকে বেঁচে থাকার মানে বুঝিয়েছে, তাকে শিখিয়েছে যে অন্ধকারের পরেই আলোর দেখা মেলে।
শেষে, হান্না নতুনভাবে জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। যুদ্ধের সব তিক্ততা ভুলে সে তার দেশের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করে। যুদ্ধ তার জীবনের অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু সেই যুদ্ধই তাকে নতুন করে বাঁচার, ভালোবাসার এবং সেবার পথ দেখিয়েছে।