শর্মিষ্ঠা যেন নিজের জীবনকে নতুন করে শুরু করার জন্য সমস্ত কিছু প্রস্তুত করে ফেলেছিল। একটি দীর্ঘ সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর সে কলকাতার প্রান্তের এক প্রাচীন বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। বাড়িটা বছরের পর বছর নির্জন পড়ে রয়েছে, সেইজন্যেই হয়তো ভাড়া পেতে এতটা সময় লাগল। বাড়ির চারপাশে পুরনো গাছপালা আর মোসুমের পাথরে মোড়া পথ। বিকেলের শেষ আলোয় বাড়িটাকে দেখতে যেন আরও বেশি ভয়ানক লাগে। শর্মিষ্ঠা তার ব্যাগ গুছিয়ে ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে, কিন্তু দরজা পার করতেই একটা শীতল হাওয়া তার শরীরকে ঘিরে ফেলে। যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তার অপেক্ষায় ছিল।
এই বাড়ির ইতিহাস নিয়ে স্থানীয় লোকজনের মধ্যে নানা গুজব প্রচলিত ছিল। এ বাড়িতে নাকি বহু বছর আগে এক রহস্যময়ী মহিলা থাকতেন, নাম ছিল রজতশ্রী। চিত্রশিল্পী হিসেবে খ্যাতি ছিল রজতশ্রীর, কিন্তু এক ঝড়ো রাতে তিনি আচমকাই নিখোঁজ হয়ে যান। তারপর থেকে কেউ তাকে আর দেখেনি। বাড়ির স্থানীয় লোকজন বলে, রাতের বেলা এই বাড়ি থেকে ফিসফিস আওয়াজ, কান্নার শব্দ শোনা যায়। শর্মিষ্ঠা এসব গুজবে মোটেও বিশ্বাস করত না। তার মনে হয়েছিল, এ বাড়িতে সে নিজের একাকীত্ব কাটিয়ে ওঠার একটা নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারবে। কিন্তু তার ধারণা যে কতটা ভুল ছিল, তা সে বুঝতে শুরু করে প্রথম রাতেই।
রাতের খাবার শেষ করে শর্মিষ্ঠা ঘরের মেঝেতে এক কাপড় বিছিয়ে বসে, কিন্তু মনে তার কোনো অস্বস্তি। মনে হয় যেন দেওয়ালের ছায়াগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে, অদৃশ্য কেউ যেন তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। বাতাসেও যেন একধরনের শীতলতা ভেসে আসছে। খানিকটা ক্লান্ত হয়ে শর্মিষ্ঠা যখন শুতে গেল, তখনই শুরু হল অদ্ভুত ঘটনা।
রাতের মধ্যভাগে হঠাৎ করেই কানে ফিসফিস আওয়াজ ভেসে আসে। শব্দটা যেন খুব কাছ থেকেই আসছে, যেন কেউ তার পাশেই বসে কানে কানে কিছু বলছে। ঘুম ভেঙে গেলে সে দেখে চারদিক নিঃসঙ্গ। বাড়ির জানালা দিয়ে হাওয়া আসছে, কিন্তু তা এতটাই ঠান্ডা যেন বরফের মতো চিমটি কাটে। হঠাৎ করেই দেওয়ালের ছায়াগুলো যেন আরো গাঢ় হয়ে ওঠে, আর সেখানে কি যেন একটা মুখ দেখার মতো অনুভূতি হয়।
শর্মিষ্ঠা ভয়ে গুটিয়ে যায়, কিন্তু তবুও নিজের মনে শক্তি ধরে রেখে জানালাটা বন্ধ করতে যায়। জানালার পাশে পৌঁছেই তার নজরে পড়ে একটি চিত্রকর্ম—পুরনো, বিবর্ণ, কিন্তু মুখটা বড়ই পরিচিত। এ মুখটা সেই রজতশ্রীর হতে পারে। শর্মিষ্ঠার মনে পড়ে স্থানীয় লোকেরা বলেছিল, রজতশ্রী নাকি নিজের শেষ চিত্রকর্মটা এই বাড়িতেই রেখে গেছেন। সেই ছবির দিকে তাকাতেই তার মনে এক অদ্ভুত শীতল অনুভূতি জন্ম নেয়, আর মনে হয় যেন ছবিটার চোখ থেকে তার দিকে একটা হতাশাজনক কষ্ট ভেসে আসছে।
এরপর থেকে শর্মিষ্ঠার জীবনে একের পর এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে। দিনের বেলায় সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করে, কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই ঘরের পরিবেশ পালটে যায়। প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে বারান্দা পর্যন্ত এক অদ্ভুত হাওয়া বইতে শুরু করে, যেন কোনো প্রাচীন আত্মা এই বাতাসে ভাসমান। শর্মিষ্ঠা রাতে ঘুমাতে চায়, কিন্তু ফিসফিস আওয়াজ, ছায়ার খেলা, আর অদৃশ্য ঠান্ডা স্পর্শ তাকে বারবার ব্যাকুল করে তোলে।
এই ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে শর্মিষ্ঠা একধরনের গভীর সংযোগ অনুভব করতে থাকে বাড়ির সাথে। যেন বাড়ির প্রতিটি কর্ণার, প্রতিটি দেওয়াল তার কাছে কিছু বলতে চাইছে। একটা গভীর রহস্য তার মনে জন্ম নেয়—রজতশ্রীর নিখোঁজ হওয়ার কারণ কী ছিল? তার মতো এক চিত্রশিল্পী হঠাৎ করে উধাও হয়ে গেল কেন? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে শর্মিষ্ঠা নিজের জীবনের সাথেও অদ্ভুতভাবে মিল খুঁজে পায়।
তবুও, শর্মিষ্ঠা তার মনে জোর ধরে রেখেছিল। সে ঠিক করে, এই বাড়ির অতীত তাকে ভয় দেখাতে পারবে না। কিন্তু সে জানত না, এই বাড়ির দেয়ালগুলোর ভেতর যে আঁধার লুকিয়ে রয়েছে, তা এতটাই গভীর যে তার প্রভাব একদিন তার জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আনবে।
ছোটদের রূপকথার গল্প - জাদুময় আকাশ: "জাদুময় আকাশ" একটি মনোমুগ্ধকর ছোটদের গল্প। লিলির তারাদের জগতে ভ্রমণ ও ভালো কাজের মাধ্যমে জীবনকে আলোকিত করার রূপকথার গল্প ছোটদের কল্পনায় জাদুর ছোঁয়া নিয়ে আসবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আঁধারের ছোঁয়া
শর্মিষ্ঠার এই পুরনো বাড়িতে আসার প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে। সন্ধ্যে নামলে বাড়ির প্রতিটি কোণ কেমন যেন অন্ধকারে ঢেকে যায়। দিনের বেলায় মনে হয়, বাড়িটা বেশ শান্ত আর নিঃস্তব্ধ। কিন্তু সন্ধ্যে নামলেই বাতাসে যেন অন্যরকম একটা অনুভূতি ভেসে আসে। যেন বাড়িটার অদৃশ্য দেয়ালগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে, প্রতিটা ছায়া যেন তাকে কিছু বলতে চাইছে।
এক সন্ধ্যায় শর্মিষ্ঠা বসার ঘরে বসে নিজের পুরনো ডায়েরি পড়ছিল। হঠাৎ করে যেন সে অনুভব করল, একটা ঠান্ডা বাতাস তার ঘাড় বেয়ে নেমে আসছে। শীতে কেঁপে উঠল সে, মনে হলো যেন কারো হাত তার কাঁধে রাখা। কিন্তু পেছনে তাকিয়ে সে কাউকে দেখতে পেল না। শুধুই সেই গভীর, ভারী নীরবতা। তার মনে হলো, কেউ তার কাছে আছে, খুব কাছে, কিন্তু দেখাতে চাইছে না।
সেদিন রাতেই প্রথমবারের মতো শর্মিষ্ঠা বাড়ির একটি দেওয়ালের ছায়ায় অদ্ভুত কিছু দেখতে পেল। লিভিং রুমের দেওয়ালে এক গভীর কালো ছায়া সরে গেল। সেই ছায়া যেন একটা মানুষের মুখের আকার নিচ্ছে। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই সে বুঝতে পারল, মুখটা নারীর। চোখে অদ্ভুত একটা শূন্যতা, ঠোঁটের কোণায় যেন এক গভীর কষ্টের ছাপ। মুহূর্তের মধ্যেই ছায়াটা মিশে গেল দেয়ালের মধ্যে, কিন্তু সেই চোখের শূন্যতা শর্মিষ্ঠার মনে গভীর ছাপ রেখে গেল।
রাত বাড়তে থাকলে শর্মিষ্ঠার ভেতরের ভয় বেড়ে উঠতে লাগল। বালিশে মাথা রাখতেই মনে হলো, একদম কানের কাছে কেউ কিছু ফিসফিস করছে। শব্দগুলো পরিষ্কার নয়, কিন্তু এতটাই স্পষ্ট যে শর্মিষ্ঠার নিঃশ্বাস থেমে যাওয়ার উপক্রম হয়। শব্দটা যেন তার নাম নিচ্ছে, খুব আস্তে করে।
সে জানত, এই বাড়িতে কিছু একটা অস্বাভাবিক ঘটছে। কিন্তু তার ভয় ও কৌতূহল দুটোই তাকে এই বাড়ি ছেড়ে যেতে দিচ্ছিল না। ভাবল, হয়তো কোনো কারণ আছে, হয়তো এই বাড়ির ইতিহাসের মধ্যে কিছু আছে যা তাকে জানতে হবে। বাড়িটা শুধু বাড়ি নয়, তার মনে হচ্ছিল বাড়িটার ভেতর একটা জীবন্ত সত্তা আছে, একটা অতীত যা নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে।
পরের দিন সে স্থানীয় এক দোকানদারের কাছ থেকে কিছু জানতে চেষ্টা করল। দোকানদার বলল, “ম্যাডাম, এই বাড়িটায় যেই এসেছে, তার কোনো শান্তি থাকে না। অনেকেই এখানে এসে অদ্ভুত ঘটনা দেখতে পেয়েছে। আপনারও উচিত বাড়িটা ছেড়ে চলে যাওয়া।”
কিন্তু শর্মিষ্ঠা কিছুতেই যেতে চাইছিল না। তার মনে হচ্ছিল, তার এখানে থাকার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।
সেই রাতেই সে আবারও সেই ছায়াগুলোর উপস্থিতি অনুভব করল। এবার সেই কালো ছায়াটা স্পষ্টভাবে তার পাশে এসে দাঁড়াল। তার সামনে যেন একটা ধোঁয়ায় মোড়া অবয়ব, সেই নারীর মুখ, সেই শূন্য চোখ। শর্মিষ্ঠা কেঁপে উঠল, কিন্তু সে তার চোখ সরাল না। এবার ছায়ার মুখ থেকে আস্তে আস্তে শব্দ ভেসে আসতে লাগল।
“আমাকে মুক্তি দাও…”
শর্মিষ্ঠার শরীর শীতল হয়ে গেল। সে জানত না কীভাবে এই ছায়াকে মুক্তি দেবে, কীভাবে এই রহস্যময় অতীতের সাথে নিজের সম্পর্ক খুঁজে পাবে। তার মনে হলো, রজতশ্রীর হারিয়ে যাওয়ার সাথে এই বাড়ির কোনো গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে।
রজতশ্রীর স্মৃতিচারণা
একদিন সকালে, শর্মিষ্ঠা বাড়ির পুরনো দোতলার ঘরগুলো ঘুরে দেখতে দেখতে একটি কাঠের ভারী আলমারি আবিষ্কার করে। আলমারিটি বেশ পুরনো আর প্রায় ভেঙে যাওয়ার মতো অবস্থা। আলমারির সামনে এসে তার মনে হলো, ভেতরে কোনো রহস্য লুকিয়ে আছে, কোনো অতীতের টুকরো যা বাড়ির কাহিনীকে আরও বেশি গাঢ় করবে। ধুলো জমা হাতলটি ধরে খুলতেই সে দেখল, ভেতরে একগুচ্ছ হলুদ হয়ে যাওয়া চিঠি বাঁধা আছে ময়লা সাদা সুতো দিয়ে। প্রতিটি চিঠি অনেকদিনের পুরনো, যেন অতীতের অনেক অনুভূতি, কষ্ট আর আনন্দের সাক্ষী।
শর্মিষ্ঠা চিঠিগুলো খুলে পড়তে শুরু করল। চিঠিগুলো লিখেছে রজতশ্রী, একজন স্বপ্নময়ী যুবতী, যে ছিল একজন প্রতিভাধর চিত্রশিল্পী। চিঠির প্রতিটি লাইনে রজতশ্রীর এক গভীর প্রেম, ব্যথা আর তীব্র আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠেছে। প্রতিটি শব্দ যেন জীবন্ত, প্রতিটি বাক্য যেন কোনো গভীর অভিমানের সাক্ষ্য বহন করে। চিঠির মধ্যে লেখা ছিল এক যুবকের প্রতি তার ভালোবাসা, কিন্তু সেই প্রেমে পূর্ণতা আসেনি। তার প্রিয় মানুষটি তাকে ছেড়ে চলে যায়, আর তারপর থেকেই রজতশ্রীর জীবন বদলে যায়।
শর্মিষ্ঠা চিঠিগুলো পড়তে পড়তে বুঝতে পারে, রজতশ্রী ছিল অতি সংবেদনশীল এবং সৃজনশীল। তার আঁকা ছবিগুলো যেন তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্টের আভাস দেয়। সে কোনো এক ঝড়ের রাতে এই বাড়িতেই অদৃশ্য হয়ে যায়। কেউ জানে না, রজতশ্রীর সাথে ঠিক কী ঘটেছিল। সেই রাতে বজ্রপাতের গর্জন আর তার শেষ আর্তনাদ যেন এই বাড়ির দেয়ালগুলোর মধ্যেই আটকে গেছে।
চিঠির শেষের দিকে শর্মিষ্ঠা একটি আঁকা স্কেচ খুঁজে পায়—রজতশ্রীর এক আঁকা নিজস্ব প্রতিকৃতি। মুখের হাসি দেখে বোঝা যায় সে এক সময় হাসিখুশি মেয়েটি ছিল, কিন্তু চোখে কোথাও যেন গভীর শূন্যতা লুকিয়ে আছে। সেই চোখে শর্মিষ্ঠা নিজের চোখের প্রতিফলন খুঁজে পায়, যেন রজতশ্রীর কষ্ট আর তার নিজের কষ্ট একসূত্রে বাঁধা।
রাতে শর্মিষ্ঠা সেই ছবির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়। হঠাৎ করে আলোর মাঝে সে রজতশ্রীর অবয়ব দেখতে পায়। রজতশ্রীর মুখে গভীর ব্যথার ছাপ, তার হাত তুলে যেন শর্মিষ্ঠাকে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু শব্দগুলো শর্মিষ্ঠার কাছে পৌঁছায় না। সে স্থির হয়ে বসে থাকে, ঠান্ডায় তার শরীর কাঁপছে।
“আমাকে মুক্তি দাও…” শর্মিষ্ঠার কানে খুব আস্তে করে এই শব্দগুলো ভেসে আসে, যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে আছে। কিন্তু এই মুক্তির জন্য রজতশ্রী কী চায়, সে তা বুঝতে পারে না। তার মনে হয়, রজতশ্রীর আত্মা কোথাও আটকানো আছে, এবং এই পুরনো বাড়িই তার বন্দীশালা। তার মনে গভীর কৌতূহল জন্মায়—কীভাবে সে রজতশ্রীকে মুক্তি দিতে পারে? এই রহস্যের সমাধান কি তারই হাতে?
এই ভাবনায় শর্মিষ্ঠা ঘুমোতে যায়, কিন্তু ঘুম তার চোখে আসে না। বারবার মনে হয়, রাতের আঁধারে সেই কালো ছায়াগুলো ঘরের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভোরের দিকে হঠাৎ এক বিকট শব্দে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে দেখে, আলমারির দরজাটা খুলে হাওয়ায় দুলছে। যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে ডাকছে, আবারও সেই চিঠিগুলোর দিকে তাকানোর জন্য।
এখন শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারে, এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সহজ উপায় নেই। রজতশ্রীর অতীতের রহস্য তারই সমাধান করতে হবে। মনে গভীর এক ভয় ও উত্তেজনার অনুভূতি নিয়ে সে সিদ্ধান্ত নেয়, সে রজতশ্রীর অতীতের টুকরোগুলো একত্রিত করে সত্যটা উদঘাটন করবেই।
আত্নার কন্ঠস্বর
রাতের গভীরতা বাড়ছে, ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় দুটো ছুঁই ছুঁই। চারদিকে নিস্তব্ধতা, কেবল মাঝে মাঝে বাতাসে গাছের পাতাগুলোর ক্ষীণ সরসর শব্দ। শর্মিষ্ঠা নিজের ছোট্ট আঁকার ঘরটায় বসে আছে, টেবিলের উপরে এলোমেলোভাবে ছড়ানো ক্যানভাস আর তুলি। তার চোখের পাতায় ঘুম নেই। তার মন পড়ে রয়েছে রজতশ্রীর চিঠিগুলোর মধ্যে, যেগুলো একদিন আগে সেই পুরনো আলমারির ভেতর খুঁজে পেয়েছিল। কৌতূহল আর ভয়ের মধ্যে এক অদ্ভুত মিশ্রণ নিয়ে সে চিঠিগুলোর প্রতিটি শব্দ পড়েছে, মনে হয়েছে যেন রজতশ্রীর কান্নার শব্দগুলো সেই লাইনের মধ্য দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
শর্মিষ্ঠা তুলি নিয়ে অচেতনভাবে রজতশ্রীর প্রতিকৃতির একটা ছবি আঁকতে শুরু করে। তার চোখের সামনে যেন ভেসে ওঠে সেই মেয়েটির বিষন্ন মুখ, দুচোখের গভীরে জমে থাকা শূন্যতা। ঠিক তখনই হঠাৎ একটা ঠান্ডা অনুভূতি তার শরীর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সে আঁতকে ওঠে। কেমন যেন অনুভব করে, কেউ ঠিক তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। বুকটা ধকধক করতে থাকে তার। সে একটু সাহস সঞ্চয় করে পেছন ফিরে তাকায়। কিন্তু কিছুই নেই, কেবল হালকা একটা ঠান্ডা বাতাস ঘরের জানলাগুলোয় থেমে থেমে হাওয়ায় ভাসছে।
মনের মধ্যে অস্বস্তি নিয়ে শর্মিষ্ঠা আবার ছবির দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে আনে। হঠাৎ করেই তার কানে যেন খুব আস্তে ফিসফিস শব্দ ভেসে আসে, “আমার কথা শোনো…” শীতল আতঙ্ক তাকে ঘিরে ধরে। সে ছবির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, যেন রজতশ্রীর আত্মা ছবির মধ্যেই বন্দী হয়ে আছে, এবং সেই বন্দীত্বের ব্যথা আর কষ্ট সে অনুভব করছে। তার হাত কাঁপতে থাকে, তবুও সে তুলি নামিয়ে রাখতে পারে না। এক সময় সে আবিষ্কার করে, ক্যানভাসে রজতশ্রীর ছবির দুচোখ থেকে যেন রক্ত ঝরছে, প্রতিটি রঙের আঁচড় যেন বাস্তবতার সীমা ছাড়িয়ে অতিপ্রাকৃত রূপ নিয়েছে।
এই অনুভূতি থেকে বের হতে না পেরে শর্মিষ্ঠা ধীরে ধীরে বুঝতে পারে, রজতশ্রীর আত্মা এই বাড়ির মধ্যেই আটকে আছে এবং তার কোনো দুঃখ, কোনো অব্যক্ত কষ্ট তাকে এভাবে বন্দী করে রেখেছে। শর্মিষ্ঠার মনে হয়, রজতশ্রীর কষ্টগুলো কেবল এই ছবির মধ্যেই প্রকাশ পেতে চায় না, বরং তার মাধ্যমে মুক্তি খুঁজছে।
শর্মিষ্ঠা উঠে দাঁড়ায় এবং প্রতিটি জানালা বন্ধ করে দিতে চায়। কিন্তু ঠিক তখনই একটি দরজা বন্ধ হয়ে গিয়ে ঠাস করে আওয়াজ হয়। সে ভয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে, তার চোখের সামনে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে কারো ছায়া ঘুরে বেড়ায়। সেই ছায়া ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, এবং শর্মিষ্ঠার বুক ধুকপুক করে ওঠে। তার মুখ দিয়ে শব্দ বেরোতে চায় না।
“তুমি আমাকে মুক্তি দেবে না?” সেই একই ফিসফিস কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসে আসে। শর্মিষ্ঠা এবারও কাউকে দেখতে পায় না, তবে শব্দটা যেন তার মনের গভীরে গেঁথে যায়।
সে হঠাৎ করে চিৎকার করে বলে ওঠে, “কে তুমি? তুমি কী চাও?”
কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর আর কোনো উত্তর দেয় না। কেবল বাতাসের ভেতর দিয়ে হালকা একটা গন্ধ তার নাকে আসে, গন্ধটা যেন পুড়ে যাওয়া কাঠের মতো, আর সেই সাথে একটা মিষ্টি আতরের গন্ধ। তার মনটা অজান্তেই চলে যায় সেই চিঠির কথায়, যেখানে রজতশ্রীর প্রিয় মানুষ তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। শর্মিষ্ঠা ভাবতে শুরু করে, কী এমন ঘটনা ঘটেছিল সেই রাতে যার জন্য রজতশ্রীর আত্মা আজও শান্তি পায়নি?
রাতের নির্জনতা আবার তাকে গভীর শূন্যতায় গ্রাস করে। তার মনে হয়, রজতশ্রী তার সাহায্য চায়, তার দুঃখের গল্পটা শোনাতে চায়। শর্মিষ্ঠা যেন দেখতে পায় সেই আঁধারে রজতশ্রীর মুখ, তার চোখে জমে থাকা কান্নার প্রতিফলন। সে সিদ্ধান্ত নেয়, কিছুতেই এই রহস্য তার হাতে ফসকে যেতে দেবে না। এই বাড়ির প্রতিটি কোণ ঘুরে, প্রতিটি আসবাবপত্রের ছায়া ছুঁয়ে সে খুঁজে বের করবে রজতশ্রীর সত্য।
পরদিন সকালে উঠে শর্মিষ্ঠা আলমারির কাছে ফিরে যায়, চিঠিগুলোর মধ্যে আবারও তথ্য খুঁজতে থাকে। সে জানতে চায়, কোথায় সেই প্রেমিকের বাড়ি, কোথায় সেই জায়গা যেখানে রজতশ্রীর মন ভেঙে গিয়েছিল। সে ভাবে, হয়তো সেই জায়গাগুলোই রজতশ্রীর আত্মার শান্তির পথে প্রথম পদক্ষেপ।
একটা মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে শর্মিষ্ঠা ঠিক করে, আজ রাতেই সে আবার সেই ঘরে ফিরে আসবে, যদি দরকার হয় ছবির ভেতর লুকিয়ে থাকা প্রতিটি কথাও সে বের করে আনবে। তার মনে হয়, এই পথ তাকে কোথাও নিয়ে যাবে, হয়তো সত্যের মুখোমুখি করবে।
তবে, ভেতরে একটা অজানা ভয় তাকে গ্রাস করে—কেননা সে জানে না, এই সত্যের মূল্য কী হতে পারে।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - প্রেমের অভিশাপ: "প্রেমের অভিশাপ" একটি রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প যেখানে শিখা তার মায়ের অতীতের গোপনীয়তা ও একটি দুষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। রহস্য ও উত্তেজনা অপেক্ষা করছে! সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
গোপন কক্ষ
বাইরে তুমুল ঝড় চলছে, বৃষ্টির ফোঁটা আর ঝড়ের আওয়াজে পুরো বাড়িটা যেন কেঁপে উঠছে। শর্মিষ্ঠা নিজের ঘরে বসে চুপচাপ শুনছে সেই ঝড়ের আওয়াজ। কয়েক রাত ধরে তার ঘুম নেই; রজতশ্রীর গল্পটা যেন তাকে অদৃশ্য এক জালে জড়িয়ে ফেলেছে। একাধিকবার মনে হয়েছে, সব কিছু ছেড়ে চলে যায়। কিন্তু কোথাও যেন একটা অদৃশ্য টান তাকে এই বাড়িতে আটকে রেখেছে।
ঝড়ের রাতটা তার মনে ভীষণ অস্থিরতা তৈরি করে। তার মন বলছে, আজ রাতেই যেন কিছু একটা ঘটবে। তাই সাহস করে সে উঠে পড়ে, হাতে একটা টর্চ আর ব্যাগ নিয়ে চিলেকোঠার দিকে পা বাড়ায়। চিলেকোঠা সবসময়ই তার কাছে একটা ভয়ের জায়গা মনে হতো। বিশেষ করে সেই পুরোনো কাঠের সিঁড়িগুলো, যেগুলো ভাঙাচোরা আর মচমচ আওয়াজ করে। তবু, আজ তার মনে হচ্ছে, এই ঝড়ের রাতে তাকে এখানে কিছু একটা আবিষ্কার করতে হবে।
ধীরে ধীরে চিলেকোঠায় উঠে, তার টর্চের আলোয় ঘরটা পরীক্ষা করতে শুরু করে। সবকিছু যেন স্তব্ধ। এমন সময় একটা দরজার আকারের মতো কিছু চোখে পড়ে। টর্চের আলোয় আরও ভালো করে দেখতে পায়, এটা আসলেই একটা পুরোনো কাঠের দরজা। কিন্তু দরজাটা এতদিন তার চোখে পড়েনি কেন? নাকি, দরজাটা তার জন্যই অপেক্ষা করছিল?
শর্মিষ্ঠা হাত বাড়িয়ে দরজাটা ঠেলে খোলে। একটা ঘন কালো অন্ধকার তাকে গ্রাস করতে আসে, কিন্তু সে নির্ভয়ে টর্চের আলোতে সেই অন্ধকারের ভিতর ঢুকে পড়ে। একটা ছোট্ট ঘর, যেন সময়ের সাথে থেমে রয়েছে। টেবিলে ছড়ানো ক্যানভাস, অসমাপ্ত চিত্রকর্ম, পুরনো জামাকাপড় আর ব্যক্তিগত কিছু জিনিসপত্র। ঘরের আবহাওয়ায় একটা ভীষণ বিষণ্ণতা, যেন কারো দীর্ঘশ্বাস এখনো এখানে আটকে রয়েছে।
একটার পর একটা ছবি দেখতে থাকে সে। ছবিগুলোর মধ্যে একটাতে একজন যুবকের মুখ। রজতশ্রীর ছবির পাশে সেই যুবকের মুখটা যেন স্থিরভাবে তাকিয়ে আছে। শর্মিষ্ঠা ছবির দিকে ভালো করে তাকায়। রজতশ্রীর দুচোখে ব্যথার ছাপ, আর সেই যুবকের মুখেও যেন এক অজানা রহস্যের ছায়া। মনে হয়, এই যুবকই হয়তো রজতশ্রীর জীবনে ছিল, যার কারণে আজ সে এই চিরকালের জন্য বন্দী হয়ে আছে।
বুকের ধুকপুকানি বাড়তে থাকে শর্মিষ্ঠার। মনে হয়, যেন কেউ তার খুব কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই সে এক অদ্ভুত শীতলতা অনুভব করে। যেন তার শরীরের মধ্যে হাড় পর্যন্ত সেই ঠান্ডাটা পৌঁছে যায়। সে টর্চের আলো দিয়ে ঘরটা ভালো করে দেখতে থাকে। তখনই সে টেবিলের উপর একটা ছোট ডায়েরি দেখতে পায়। ডায়েরিটা ধরার জন্য হাত বাড়ায়, কিন্তু তখনই বাতাসে সেই চেনা ফিসফিস আওয়াজ শুনতে পায়, “আমার কথা শোনো…”
শর্মিষ্ঠা চমকে ওঠে। কিন্তু এবার সে পিছিয়ে আসে না। বরং ডায়েরিটা হাতে তুলে নিয়ে পাতা উল্টাতে শুরু করে। ডায়েরির পাতায় পাতায় রজতশ্রীর জীবনের টুকরো টুকরো গল্প লেখা। প্রতিটি লাইনে তার একাকীত্ব, প্রতারণার কষ্ট আর মনের গভীরে জমে থাকা কান্নার প্রতিচ্ছবি।
একটা পাতায় লেখা ছিল, “প্রিয় মানুষটা আমায় ছেড়ে গেল, আমাকে প্রতারিত করল। আমার মনের গভীরতায় জমে থাকা এই কান্নার প্রতিধ্বনি কেউ শুনতে পাবে না।” শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারে, রজতশ্রীর প্রিয় মানুষটা হয়তো তাকে ঠকিয়েছিল, তাকে একাকী করে দিয়ে চলে গিয়েছিল।
আরেকটা পাতায় লেখা, “আমি এই ঘরেই অপেক্ষা করব, যেদিন কেউ আমার কান্না শুনতে আসবে।” শর্মিষ্ঠার ভেতর যেন শীতল একটা ভয় ছড়িয়ে পড়ে। সে বুঝতে পারে, এই ঘরেই রজতশ্রীর আত্মা আজও বন্দী। আর সেই আত্মা মুক্তি চায়।
ঠিক তখনই হঠাৎ করে একটা শব্দ হয়। ঘরের দরজাটা আচমকাই বন্ধ হয়ে যায়। শর্মিষ্ঠা ভয়ে জমে যায়, তার গলার কাছে কাঁপুনি ধরে আসে। অন্ধকারে সে টর্চের আলো ধরে রাখে, কিন্তু ঘরটা হঠাৎই যেন আরও গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে যায়। চোখের সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে।
হঠাৎ তার কানে আবার সেই কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “আমার কথা শোনো… আমায় মুক্তি দাও…” এই ভয়ানক ফিসফিস শব্দে তার গা শিউরে ওঠে। ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে, তবুও সে পিছিয়ে আসার বদলে কণ্ঠস্বরের দিকে মনোযোগ দেয়। কণ্ঠস্বর যেন তাকে ইশারা করছে, ডায়েরির শেষ পাতার দিকে।
শর্মিষ্ঠা ডায়েরির শেষ পাতায় পৌঁছায়, যেখানে লেখা রয়েছে, “যদি তুমি আমার কথা শুনতে চাও, তবে আমাকে সাহায্য করো। আমার প্রতারণার প্রতিশোধ নাও। তাকে খুঁজে বের করো, যিনি আমার জীবন ধ্বংস করে দিয়েছেন।” এই লাইনগুলো পড়ে শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারে, রজতশ্রী কেবল একজন প্রতারিত প্রেমিকা নন; তার মৃত্যুর পেছনে গভীর কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র, কোনো অন্ধকার সত্য তাকে এই চিরকালের জন্য বন্ধী করে রেখেছে।
ঘরের ভেতর একের পর এক শীতল হাওয়া বইতে থাকে, আর সেই সাথে ঝড়ের আওয়াজে যেন রজতশ্রীর কান্নার প্রতিধ্বনি শুনতে পায় শর্মিষ্ঠা। তার মনে হয়, এই রহস্য উদ্ঘাটন না করা পর্যন্ত এই অশান্ত আত্মা শান্তি পাবে না।
শর্মিষ্ঠা সিদ্ধান্ত নেয়, এই প্রতারণার গল্পের শেষটা জানতে হলে তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী, রজতশ্রীর জীবনের সেই প্রতারক মানুষটার খোঁজ নিতে হবে। হয়তো এটাই রজতশ্রীর আত্মাকে মুক্তি দিতে পারে।
তবে, তার মন আবারও একবার আশঙ্কায় ভরে যায়। সে জানে না, সামনে আর কী অপেক্ষা করছে। এই রহস্য তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সেই প্রশ্নের উত্তর অজানা।
শেষ প্রতিফলন
শর্মিষ্ঠা সেই ঘরটায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতা আর অদ্ভুত এক শীতলতা, যেন ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জমাট বাঁধা কান্না আর প্রতারণার কষ্টে আবদ্ধ। বাতাসে একটা অজানা শিহরণ বয়ে যাচ্ছে, তার অনুভব হয় যেন কোনো অদৃশ্য উপস্থিতি তাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। একবার ডায়েরির দিকে তাকায়, আরেকবার ঘরের দেওয়ালে থাকা অসমাপ্ত ছবি আর পুরোনো জিনিসপত্রের দিকে।
হঠাৎ ঘরের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। ভয়ের রেশ তার শরীরে শিরদাঁড়া বেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। অনুভব করতে পারে, তার একদম কাছেই রজতশ্রীর আত্মা উপস্থিত। যেন তার সমস্ত হতাশা, সমস্ত ক্ষোভ নিয়ে তার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে। শর্মিষ্ঠার চোখের সামনে ঘরের দেওয়ালে ছায়াগুলি যেন আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে। দেওয়ালের প্রতিটি ছায়া যেন রজতশ্রীর অতীতের কোন অন্ধকার ঘটনা বহন করে নিয়ে এসেছে। প্রতারণা, হারানোর ব্যথা আর রাগ যেন সেই ছায়ার মাধ্যমে তার চোখে ফুটে ওঠে।
এতদিন ধরে যে রহস্য তাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করছিল, সেই রহস্যের এক ধাপের কাছাকাছি পৌঁছে গেলেও আজ তার মন সন্দেহে ভরে উঠছে। সে বুঝতে পারে, রজতশ্রীর আত্মা শান্তি খুঁজছে—মুক্তি চাইছে।
শর্মিষ্ঠা এক পা পেছনের দিকে সরায়। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর তার কানে ধাক্কা দেয়, “আমাকে মুক্ত করো…” সে চমকে ওঠে। তবে এবার পিছু হটার বদলে কণ্ঠস্বরের উৎসের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তেই ঘরের দেওয়ালে একাধিক ছায়া তাকে ঘিরে ফেলে। মনে হচ্ছে, প্রতিটি ছায়া তার দিকে এগিয়ে আসছে, যেন তার কাছ থেকে কিছু দাবি করছে। শর্মিষ্ঠা পেছাতে পেছাতে দেওয়ালের গায়ে সেঁটে যায়। তার দুচোখে ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্র অনুভূতি।
“তুমি কি আমার কষ্ট বুঝতে পারছো?” কণ্ঠটা যেন গভীর আক্রোশে তার ভেতর ধ্বনিত হচ্ছে। শর্মিষ্ঠা ভয়ে গলায় কাঁপুনি ধরে গেলেও, সে শক্ত করে বলে, “হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি কীভাবে তোমায় মুক্ত করব? কীভাবে তোমার এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারব?”
ছায়াগুলি মুহূর্তের মধ্যে আবার নিস্তব্ধ হয়ে যায়। ঘরটা আবারও শীতল, কিন্তু এবার সেই শীতলতার মধ্যে একটা রহস্যের ইঙ্গিত। শর্মিষ্ঠা অনুভব করে, একটা অদ্ভুত শান্তি যেন তাকে ঘিরে রেখেছে। তার মনে হচ্ছে, রজতশ্রীর আত্মা তাকে কিছু বলতে চাইছে। ঘরের একপাশে রাখা একটা পুরোনো আয়না তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আয়নার প্রতিফলনে নিজের মুখের সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি মুখ দেখতে পায়, যে মুখটা সম্পূর্ণ অপরিচিত, কিন্তু সেই চোখের গভীরে এক ধরনের চেনা শূন্যতা।
“এই আয়নাটা…” শর্মিষ্ঠা নিজের কাছে বিড়বিড় করে। মনে পড়ে, এই আয়নাটা নাকি রজতশ্রীর একান্ত প্রিয় ছিল। তার ভেতর গভীর কিছু রহস্য লুকিয়ে ছিল, যা রজতশ্রীর মৃত্যুর পর থেকে আর কেউ জানে না।
আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শর্মিষ্ঠা। হঠাৎ আয়নায় নিজের প্রতিফলনের বদলে রজতশ্রীর মুখ স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে। তার চোখে আগুনের মতো আক্রোশ, কিন্তু সেই চোখে একটা অদ্ভুত অনুনয়ও ফুটে ওঠে। মনে হয়, রজতশ্রী তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। শর্মিষ্ঠা তার দৃষ্টি আয়নার দিকে নিবদ্ধ করে, গভীরভাবে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করেই আয়নায় দেখা যায় সেই মানুষটার প্রতিচ্ছবি—যে রজতশ্রীর প্রিয়জন ছিল, যিনি তাকে এই একাকীত্ব আর প্রতারণার জালে ফেলে গিয়েছিলেন।
শর্মিষ্ঠা ভেতর থেকে একটা শক্তি অনুভব করে। সে বলে, “তুমি আমাকে দেখাচ্ছো… তাকে খুঁজে বের করতে বলছো, তাই না? তোমার প্রতিশোধের ইচ্ছা এখনো মুছে যায়নি, তাই না?”
আয়নার প্রতিফলনে রজতশ্রীর মুখে একটু প্রশান্তির ছাপ পড়ে। শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারে, তাকে এই প্রতারণার গল্পের শেষ পর্যন্ত যেতে হবে। সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করতে হবে, যে রজতশ্রীর জীবনের সবকিছু ধ্বংস করেছিল।
এবার একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস নিয়ে শর্মিষ্ঠা বলে, “আমি তোমার কথায় সাড়া দেব, তোমার দুঃখের প্রতিফলন আমাকে পথ দেখাবে।”
বাইরে ঝড়ের আওয়াজ একটু একটু করে থেমে আসছে, কিন্তু ঘরের ভেতরের বাতাসে এখনও সেই প্রতিশোধের গন্ধ। শর্মিষ্ঠা জানে, তার সামনে আরও অনেক রহস্যের জট খুলতে বাকি আছে, অনেক অন্ধকারের পথ পাড়ি দিতে হবে। কিন্তু এবার তার মন স্থির। সে একবারও ভয় পায় না। এই রহস্য উদঘাটন না করলে সে নিজের শান্তি পাবে না।
ছোটদের রূপকথার গল্প - মায়াবী বনভূমি: "মায়াবী বনভূমি" - একটি আকর্ষণীয় ছোটদের গল্প যা রূপকথার গল্পের মতো জাদু ও শিক্ষার সমন্বয়ে ভরা। এলারার ভালোবাসা ও যত্নে জাগ্রত বনভূমি শিশুদের মনে আনন্দ ও বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মুক্তির আলো
শর্মিষ্ঠা গভীর রাতের নিস্তব্ধতায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। রজতশ্রীর আত্মা যেন তাকে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করতে বলছে, যেন সবকিছু বলার জন্য এই মুহূর্তটাই সবচেয়ে উপযুক্ত। আয়নার ভেতর থেকে প্রতিটি স্মৃতি, প্রতিটি কান্না, প্রতিটি ব্যথা ধীরে ধীরে ভেসে উঠছে। শর্মিষ্ঠার দুচোখে ভয়ের বদলে এবার একধরনের অদ্ভুত সাহস দেখা যায়, সে জানে, এই মুহূর্তে পিছু হটার সুযোগ নেই।
রজতশ্রীর দৃষ্টিতে সেই একই আবেগ—প্রিয়জনের হাত ধরে অনন্তকাল কাটানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা, যা আর কখনো পূর্ণ হবে না। শর্মিষ্ঠা আয়নার সামনে ঝুঁকে বলে, “তুমি মুক্তি চাইছো, তাই না? কিন্তু সেই মুক্তি পেতে হলে তোমার গল্প শেষ করতে হবে, তোমার অসমাপ্ত প্রতিশোধের ইচ্ছা পূর্ণ করতে হবে।”
হঠাৎই আয়নার গাঢ় ছায়ার ভেতর থেকে রজতশ্রীর প্রিয়জনের ছায়ামূর্তি ফুটে ওঠে, যাকে এতদিন ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। শর্মিষ্ঠার মনে অস্বস্তি জাগলেও, সে সেই চেহারা গভীরভাবে লক্ষ্য করে। তার মনে হচ্ছে, রজতশ্রীর দুঃখের প্রতিটা টুকরো ধীরে ধীরে তার দিকে ধেয়ে আসছে। কিন্তু শর্মিষ্ঠা জানে, সে পিছু হটার মেয়ে নয়।
রজতশ্রীর কন্ঠস্বর এবার স্পষ্ট শোনা যায়, “ও আমাকে প্রতারণা করেছিল, আমাকে একা ফেলে গিয়েছিল…আমি সেই বিশ্বাসঘাতকের শাস্তি চাই।”
শর্মিষ্ঠা হালকা গলায় বলে, “তোমার কষ্ট আমি বুঝেছি। কিন্তু প্রতিশোধে মুক্তি আসবে না। তোমার প্রিয়জনকে তুমি নিজেই ক্ষমা করে দাও। অন্যথায় এই ব্যথা তোমাকে আরও বেঁধে রাখবে।”
আয়নার প্রতিফলনে রজতশ্রীর চেহারায় এক মুহূর্তের জন্য প্রশান্তি দেখা যায়, কিন্তু পরক্ষণেই আবার সেই হতাশা ও বেদনার ছাপ ফিরে আসে। শর্মিষ্ঠা অনুভব করে, রজতশ্রীর আত্মা তখনও সংকীর্ণ প্রতিশোধের খাঁচায় আবদ্ধ।
তখনই শর্মিষ্ঠা নিজের বুক থেকে একটা পুরনো মাদুলি বের করে আয়নার সামনে ধরে। এই মাদুলিটা তার দিদিমা তাকে দিয়েছিল, বলেছিলেন, “যে কোনো বিপদে এই মাদুলিটা তোমায় রক্ষা করবে।” শর্মিষ্ঠা মৃদু গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করে, “মুক্তির জন্য যে শান্তির প্রয়োজন, তা তোমায় আমি দিতে পারি। রজতশ্রী, তোমার প্রতিশোধ পূরণে নয়, তোমার মনের শান্তিতেই মুক্তি আছে।”
মন্ত্রোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের ভেতরের বাতাসের স্রোত থেমে যায়। যেন রজতশ্রীর মনেও একটা পরিবর্তন আসছে। তার চোখে একটা নির্লিপ্ততা, একটা মমতার ছায়া। হঠাৎই তার ছায়ামূর্তি আলোকিত হয়ে উঠে বলে, “তুমি ঠিকই বলেছো। প্রতিশোধে মুক্তি নেই। শান্তি শুধু ভালোবাসাতেই মেলে। এই অভিশপ্ত ভালোবাসার ভার আমি আর বইতে চাই না।”
শর্মিষ্ঠা মাথা নত করে বলে, “তুমি ক্ষমা করো তাকে, আর এই পৃথিবী থেকে মুক্ত হয়ে চির শান্তিতে চলে যাও।”
এই কথাগুলো বলতেই, আয়নার ভেতর থেকে এক অদ্ভুত আলো বেরিয়ে আসে, ঘরটাকে এক মুহূর্তে আলোকিত করে তোলে। সেই আলো শর্মিষ্ঠার চারপাশে ঘুরপাক খেয়ে শেষে আয়নাটার ভেতরেই মিশে যায়। ঘরের প্রতিটি ছায়া যেন আলোর স্পর্শে ধুয়ে মুছে যায়। আর সেই মুহূর্তে রজতশ্রীর আত্মা ধীরে ধীরে আলোকময় শূন্যতায় মিলিয়ে যায়, যেন কোনো ভারমুক্ত পাখির মতো উড়ে যাচ্ছে।
শর্মিষ্ঠা বুঝতে পারে, রজতশ্রী অবশেষে শান্তি পেয়েছে। সেই যে ঘন কালো অন্ধকারে আবৃত বাড়িটা, আজ যেন একটা আলোর ঝলকানিতে ঘরের প্রতিটি কোণে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাড়ির হিমেল পরিবেশে এখন যেন একটা উষ্ণতা বিরাজ করছে, যেন রজতশ্রীর মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুরো বাড়িটাও মুক্তি পেল।
পরের দিন সকালে শর্মিষ্ঠা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তার চোখে ক্লান্তি থাকলেও মনে এক ধরনের প্রশান্তি। বাড়িটার দিকে একবার পেছন ফিরে তাকায়। রজতশ্রীর গল্পটা তার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হয়ে থাকবে। সে বুঝতে পারে, অতীতের সমস্ত দুঃখ আর প্রতারণার মধ্যে লুকিয়ে থাকে কিছু গোপন শিক্ষা, যা কখনো ক্ষমা করে, কখনো মুক্তি দেয়।
বাড়িটা এখন আর ভয়ের নয়; এটা হয়ে উঠেছে মুক্তির প্রতীক। শর্মিষ্ঠা এক ঝলক আলোর মাঝে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে। তারপর সে নিজের নতুন জীবনের পথে এগিয়ে যায়, যেখানে ভয় নেই, কেবল মুক্তির আলো।