কলকাতার রাতে, গগনবিহারী গুপ্ত – বিখ্যাত বিজ্ঞান কথাসাহিত্যিক – তার বারান্দায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়েছিলেন। শহরের আলোকঝলকানির মাঝেও চাঁদ তার মৃদু আলোয় পৃথিবীকে আলোকিত করে রয়েছে। কিন্তু আজ রাতে কোন এক অজান কারণে চাঁদের আলো কেমন যেন ম্লান লাগছিল। ঠিক যেন কোন এক অদৃশ্য পর্দা চাঁদের সৌন্দর্যকে ঢেকে দিয়েছে। হঠাৎ দূরের আকাশে একটি নীল আলোর ঝলক দেখা গেল। অবাক হয়ে গেলেন গগনবিহারী। আলোটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকল এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পুরো আকাশ নীল আলোয় ছেয়ে গেল। চারপাশে চিৎকার শুরু হয়ে গেল। লোকজন রাস্তায় বেরিয়ে এসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল।
আলোটা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি বিশাল আকাশযান দু’পাশে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল। যেন দুইটি ধাতব চোখ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে আছে। এই আকাশযানগুলো আগে কখনো দেখা যায়নি। মসৃণ ধাতু দিয়ে তৈরি, নীল আলোয় জ্বলজ্বল করছে।
গগনবিহারী জানতেন এটা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। তিনি দ্রুতগতিতে লেখার টেবিলে গিয়ে তার কম্পিউটার চালু করলেন। নিউজ চ্যানেলগুলোতে শুধু এই ঘটনারই খবর। কেউ জানে না কোথাকার এই আকাশযান, কী কারণে এরা এসেছে। চারপাশে একটা চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়ে গেল।
কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল। আকাশযানগুলো নিঃশব্দে ভাসমান অবস্থায় রইল। হঠাৎ, দুটি আকাশযানের মাঝখানে আবার নীল আলোর সৃষ্টি হল। আলোটা এতটা তীব্র ছিল যে, কিছুক্ষণের জন্য চোখ খোলাই যাচ্ছিল না। তারপর আলোটা কমতে শুরু করল এবং আকাশযান দুটি ধীরে ধীরে একে অপরের কাছে এগিয়ে আসল। ঠিক যখন দুটি আকাশযান মিলিত হওয়ার মুখে তখনই একটি প্রচণ্ড শব্দ হল। শব্দটা এতটা জোরে লাগল যে, কলকাতার কাঁচের জানালার কয়েকটি ভেঙে গেল।
কিন্তু কিছুই ঘটল না। শব্দটা থেমে গেল এবং দুটি আকাশযান একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে গেল। যেন দুটি জলের ফোঁটা মিশে গেল। কিছুক্ষণ পর, আকাশযান দুটি ভাঙতে শুরু করল। কিন্তু ধ্বংসাবেশ নয়, বরং তার থেকে একটি নতুন আকাশযানের আবির্ভাব হচ্ছিল।
এই নতুন আকাশযানটা আগের দুটির থেকেও বিশাল।
নিঃশব্দে চেয়ে থাকলেন গগনবিহারী। তার মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। এই অচেনা আকাশযান কোথাকার? এরা কারা, আর কী চায়?
এর মধ্যেই নিউজ চ্যানেলে একটা চাঞ্চল্যকর খবর প্রচার হতে শুরু করল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা একত্রে কাজ করে এই নতুন আকাশযান থেকে একটি বার্তা ডিকোড করতে সক্ষম হয়েছেন। বার্তাটা ছিল একটি মানব চেহারার ছবি এবং তার নিচে কিছু অজানা অক্ষরে লেখা কিছু লাইন।
কয়েকদিনের মধ্যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ভাষাবিজ্ঞানীরা মিলে সেই অজানা অক্ষরগুলো পড়তে সক্ষম হলেন। বার্তায় লেখা ছিল, “আমরা শান্তিতে এসেছি। আমরা জ্ঞান বিনিময় করতে চাই।”
এই বার্তা পৃথিবীতে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি করল। অনেকে আশঙ্কায় ভুগলেন, কেউ আবার উচ্ছ্বসিত হলেন। কিন্তু সবার মনের মধ্যে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল – এই অতিমনুষ্য প্রযুক্তি সম্পন্ন জাতির সাথে আমরা কিভাবে যোগাযোগ করব?
এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে জাতিসংঘের একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হল। কমিটির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, ভাষাবিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ, এমনকি কিছু বিখ্যাত লেখকও। গগনবিহারীর বিজ্ঞান কথাসাহিত্যে কল্পনার জগতের সাথে যোগাযোগের অভিজ্ঞতার জন্য তাকেও এই কমিটিতে রাখা হল।
কমিটির বহু বৈঠকের পর, সিদ্ধান্ত হল যে, মানব সভ্যতার সারকথা নিয়ে একটি বার্তা সেই নতুন আকাশযানে পাঠানো হবে। এই বার্তায় মানব ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, সবকিছুরই একটা সংক্ষিপ্ত রূপ থাকবে। এটা ছিল এক অভূতপূর্ব চেষ্টা। মানব সভ্যতার প্রথম আন্তঃবিশ্ব যোগাযোগের সূচনা।
কয়েক মাস পর, নতুন আকাশযান থেকে আবার একটি বার্তা এলো। এবারের বার্তাটা ছিল আগের চেয়েও জটিল। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মস্তিষ্করা মিলে কয়েক সপ্তাহ ধরে এই বার্তা ডিকোড করার চেষ্টা চালালেন। অবশেষে, সাফল্য এলো।
বার্তায় লেখা ছিল, “আমরা আপনাদের বার্তা পেয়েছি। আমরা অভিভূত। আপনাদের সঙ্গীত, শিল্পকলা, বিজ্ঞান – সবকিছুই আমাদের মুগ্ধ করেছে। আমরা আপনাদের সাথে আরও গভীরভাবে জ্ঞান বিনিময় করতে চাই।”
এই বার্তাটা পৃথিবীতে একটা মহোৎসব-এর সৃষ্টি করল। মানুষ্য সভ্যতা এখন আর একা নেই। কিন্তু উৎসবের এই আনন্দ বেশি দিন স্থায়ী হলো না। কয়েক সপ্তাহ পর, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল। প্রথমে ছোটখাটো ঘটনা, যেমন – ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি অকারণে বিকল হয়ে যাওয়া, বিদ্যুৎ বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া। কিন্তু ধীরে ধীরে সমস্যা আরও জটিল হতে থাকল। বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। বিমান এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রগুলোতে সমস্যা দেখা দিল। পৃথিবী যেন একটা ডিজিটাল অন্ধকারে ঢেকে গেল।
আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। বিশেষজ্ঞরা মত দিলেন, এটা কোন সাধারণ ঘটনা নয়। এটা নিশ্চিতভাবেই সেই অতিমনুষ্য সভ্যতার কাজ। কিন্তু তারা কেন এমনটা করছে, তা কেউ বুঝতে পারছিল না। জাতিসংঘের কমিটি দ্রুতগতিতে বৈঠক ডাকল। কিন্তু এইবার কেউ কোন সমাধান খুঁজে পেল না।
এই সময় গগনবিহারী নিজের বাসায় বসে চিন্তায় মগ্ন ছিলেন। হঠাৎ তার মনে পড়ল সেই নতুন আকাশযান থেকে পাঠানো প্রথম বার্তা – “আমরা শান্তিতে এসেছি। আমরা জ্ঞান বিনিময় করতে চাই।” কিন্তু এখন তাদের কাজ তো শান্তির কাজ বলে মনে হচ্ছে না।
এই রহস্যের সমাধান খুঁজতে গিয়ে গগনবিহারীর মনে একটা তত্ত্বের জন্ম হল। তিনি মনে করলেন, সম্ভবত আমাদের পাঠানো বার্তায় কোনো কিছু ভুল বুঝিয়েছে অতিমনুষ্য জাতি। হয়তো আমাদের সংস্কৃতির কোনো অংশ তাদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছেছে। এই তত্ত্ব নিয়ে গগনবিহারী কমিটির সামনে উপস্থিত হলেন।
কমিটির সদস্যরা গগনবিহারীর তত্ত্ব শুনে কিছুটা আশাবাদী হলেন। তারা মনে করলেন, চেষ্টা করে দেখা যায়। তারা আবার একটি বার্তা প্রস্তুত করলেন। এই বার্তায় পৃথিবীর ইতিহাসের কিছু বিভ্রান্তিকর ঘটনা, যুদ্ধ, ধ্বংস, এগুলো আরও বিশদভাবে বর্ণনা করা হল। সাথে সাথে মানব জাতির সৃজনশীলতা, সহযোগিতার কথাও তুলে ধরা হল।
এই নতুন বার্তাটি সেই নতুন আকাশযানে পাঠানো হল। দিন যায়, মাস যায়, কোনো সাড়া নেই। পৃথিবীর মানুষের উদ্বেগ আরও বেড়ে গেল।
কিন্তু হঠাৎ একদিন, আকাশ জুড়ে আলোর ঝলক দেখা গেল। ঠিক আগের মতোই। নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে গেল গোটা পৃথিবীর। তারপর আলো কমে গেল এবং নতুন আকাশযানটি আবার আগের আকারে ফিরে গেল।
এরপর বিশ্বব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ ফিরে এল। নিঃশ্বাস ফিরে এল গোটা পৃথিবীর। কিন্তু আশঙ্কা একেবারে মুছে যায়নি। কী ঘটেছিল, কেন এমনটা করা হল, সেই রহস্যের উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। কয়েক ঘণ্টা পর, জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীরা একত্রিত হলেন নতুন আকাশযান থেকে পাঠানো বার্তা ডিকোড করার জন্য।
দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর, অবশেষে সাফল্য এলো। বার্তায় লেখা ছিল, “আমরা আপনাদের নতুন বার্তা পেয়েছি। আমরা বুঝতে পেরেছি যে, আমরা আপনাদের সংস্কৃতির কিছু অংশ ভুল ব্যাখ্যা করেছি। আপনারা শুধু ধ্বংস আর যুদ্ধই নন, আপনারা সৃজনশীল, সহযোগিতাপূর্ণ একটি জাতি। আমরা আমাদের ভুলের জন্য ক্ষমা চাই। আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে চাই। আমরা আপনাদের গ্রহে শান্তিতে অবতরণ হতে চাই।”
এই বার্তা পৃথিবীতে একটা আনন্দধ্বনি তুলল। মানুষের চোখে জল এলো। হাজার হাজার বছরের একাকীত্বের পর, অবশেষে মহাকাশে আমাদের সঙ্গী পাওয়া গেল। কিন্তু আবারো প্রশ্ন জাগল মনে। কোথায় অবতরণ করবে এই অতিমনুষ্য জাতি? কে এই প্রতিনিধিরা?
কয়েক সপ্তাহ পর, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নিরপেক্ষ এলাকা হিসেবে নির্বাচিত হল ভারতের থার মরুভূমি। বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধি এবং বিজ্ঞানীরা সেখানে জমা হলেন। অবশেষে, নির্ধারিত দিনে আকাশে আবার সেই নীল আলোর ঝলক দেখা গেল। আলো কমতেই একটি বিশাল আকাশযান থার মরুভূমির বালির উপর নেমে এলো।
আকাশযানের দরজা খুলল। কিন্তু কেউ বের হল না। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর, আকাশযানের ভিতর থেকে একটি আলোকনির্গমন হল। আলোটা ধীরে ধীরে মানবাকৃতি ধারণ করল। কিন্তু সেটা একেবারে মানুষের মতো ছিল না। লম্বা শরীর, বড় বড় চোখ। তবে তার চোখে ছিল বুদ্ধিমত্তার ঝলক।
আলোকমানবটি বিশ্বের নেতাদের উদ্দেশ্যে কথা বলল, “আমি শান্তিতে এসেছি। আমি আপনাদের সাথে জ্ঞান বিনিময় করতে চাই।”
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটা ছিল এক অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। মহাকাশের রহস্য কিছুটা উন্মোচিত হল। এখন মানুষ আর একা নেই। এখন আমাদের সামনে নতুন জ্ঞানের, নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলা।