১৯৪২ সালের এক শীতের বিকেল। পোল্যান্ডের ছোট্ট শহরটি যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, নিস্তব্ধতার মধ্যে যেন ভয়ঙ্কর কিছু ঘটতে চলেছে। এই নিস্তব্ধতার মধ্যেই বারো বছরের মেয়েটি, মিরিয়াম, তার জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বাইরের তুষারপাতের দৃশ্য দেখতে তার খুব ভালো লাগত, কিন্তু আজকের এই সাদা বরফ যেন তাকে শীতলতার থেকে বেশি ভয়ের এক অনুভূতি দিচ্ছিল। শহরজুড়ে নাৎসি বাহিনীর ভয়াবহ উপস্থিতি আরও বেড়ে চলেছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন বাড়িতে হানা দিচ্ছে তারা, পরিবারের লোকদের নিয়ে যাচ্ছে। আজ সকালেও পাশের বাড়ির লেভিন পরিবারকে ধরে নিয়ে গেছে—মিরিয়ামের খুব প্রিয় বন্ধু এভাকে। মিরিয়ামের মন শূন্য হয়ে গেছে।
মিরিয়াম তখনো বুঝতে পারেনি ঠিক কী ঘটতে চলেছে। তার বাবা মা অনেক দিন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তাদের ইহুদি পরিচয়ের জন্য সবসময় ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। মিরিয়ামের বাবা আইজাক একদিন বলেছিলেন, “আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।” কিন্তু যাবার জায়গা কোথায়? পোল্যান্ডের প্রতিটি কোণায় নাৎসিরা ঘুরছে, ইহুদিদের জন্য কোথাও নিরাপত্তা নেই। এই আতঙ্কিত পরিবেশে, মিরিয়ামের মন চুপচাপ ছিল না। তার ছোট ভাই, ইয়াকভ, মাত্র ছয় বছরের, ছোট্ট ছেলেটি পৃথিবীর এই ভয়াবহতার কিছুই বোঝে না। সে প্রতিদিন মিরিয়ামের কাছে এসে খেলে, তাদের পুরনো দিনের খেলার কথা মনে করে। কিন্তু মিরিয়াম জানে, আজকের এই পৃথিবী আর আগের মতো নেই।
সেদিন গভীর রাত। মিরিয়ামের পরিবার তখন ঘুমাচ্ছে। ঘরের আলো নিভে গেছে, কিন্তু বাইরে রাতের অন্ধকারের মধ্যে এক অদ্ভুত আওয়াজ শোনা যায়। একটা ভারী বুটের শব্দ, কিছু মানুষের চিৎকার। মিরিয়ামের ঘুম ভেঙে যায়। সে বুঝতে পারে কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে। হঠাৎ দরজায় প্রচণ্ড শব্দে ধাক্কা দেওয়া হয়। মিরিয়ামের বাবা তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতে যায়, কিন্তু তখনই নাৎসি সৈন্যরা ঢুকে পড়ে। তাদের কণ্ঠে ঠান্ডা আদেশ, “সবার হাত উপরে তোলো! বাইরে এসো!”
মিরিয়ামের মা, রেবেকা, ভয়ে কাঁপছিলেন। তিনি মিরিয়াম ও ইয়াকভকে আঁকড়ে ধরেন। সৈন্যরা তাদের কোনো কথা শোনার সুযোগ দেয় না। মিরিয়ামের বাবা-মাকে তৎক্ষণাৎ টেনে নিয়ে যায়। তাদের হাতে কোনো কাগজপত্র, কোনো পরিচয়পত্র নেই। মিরিয়াম চিৎকার করতে চায়, কিন্তু তার গলা থেকে কোনো শব্দ বেরোয় না। শুধু তার চোখের সামনে তার বাবা-মাকে দেখতে পায়, যাদের তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এই ভয়াবহ দৃশ্য তাকে স্তব্ধ করে দেয়।
ইয়াকভ তার ছোট হাত দিয়ে মিরিয়ামের হাত আঁকড়ে ধরে। কিন্তু হঠাৎ সে যেন ভয়ে পালিয়ে যায়, তার ছোট্ট দেহটি কোথায় যেন হারিয়ে যায় অন্ধকারের মধ্যে। মিরিয়াম ভয় পেয়ে যায়, তার ভাইকে খুঁজতে ছুটতে শুরু করে, কিন্তু ততক্ষণে নাৎসিরা তার বাড়ি পুরোপুরি তছনছ করে দিচ্ছে। বাইরে থেকে গাড়ির শব্দ শোনা যায়, যেন তারা শহরের প্রতিটি ইহুদি বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে।
এই ভয়াবহ সময়ে মিরিয়াম বুঝতে পারে যে তাকে পালাতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার আশেপাশের সবকিছু যেন ভয়াবহ অন্ধকারে ঢাকা পড়েছে। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে একটানা দৌড়াতে থাকে। তার বুক ধড়ফড় করছে, শরীরের প্রতিটি শিরা যেন কাঁপছে। তবে তার মন তাকে বলে, তাকে বাঁচতে হবে। সে জানে না কাকে বিশ্বাস করবে, কোথায় আশ্রয় নেবে। কিন্তু তার মনে একটাই কথা—পালাও, যত দূর পারো।
অনেকক্ষণ পরে, মিরিয়াম এক অচেনা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। তার শরীরের শক্তি ফুরিয়ে গেছে, হাঁপিয়ে পড়েছে। সে বসে পড়ে, কান্না করতে চায় কিন্তু কান্না তার আসে না। তার মন শূন্য হয়ে গেছে। হঠাৎ তার সামনে দাঁড়িয়ে এক বয়স্ক মহিলা, হেলেনা। তার চোখে মমতা, মুখে শান্তির আভা। হেলেনা তার দিকে এগিয়ে আসে, কিছু বলে না, শুধু মিরিয়ামকে তার বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায়।
হেলেনার বাড়ি ছোট, সাধারণ কিন্তু সেখানে একধরনের উষ্ণতা রয়েছে। মিরিয়াম জানে না, এই মহিলাকে বিশ্বাস করা উচিত কিনা, কিন্তু তার অন্য কোনো উপায় নেই। হেলেনা তাকে কিছু বলার আগে গরম এক বাটি স্যুপ এনে দেয়। “খাও, তোমার দরকার,” সে বলে। মিরিয়াম চুপচাপ স্যুপ খেতে থাকে। হেলেনা তার পাশে বসে, মৃদু হেসে বলে, “তুমি ভয় পেও না, তুমি এখানে নিরাপদ আছো। আমার নাম হেলেনা, আমি তোমাকে সাহায্য করব।”
মিরিয়াম জানে না তার পরিবার কোথায়, সে জানে না তার বাবা-মা আর কখনো ফিরে আসবে কিনা। তার ভাইয়ের খোঁজও সে পায়নি। তবে হেলেনার মমতায় মিরিয়াম একটু শান্তি পায়। তার মন তাকে বলে, হয়তো এই মহিলাই তাকে রক্ষা করতে পারবে।
কিন্তু যুদ্ধের এই সময়ে কোনো আশ্রয়ই নিরাপদ নয়। হেলেনা ও মিরিয়াম জানে, যে কোনো মুহূর্তে তাদের লুকিয়ে থাকা জায়গাটি ফাঁস হতে পারে। নাৎসি বাহিনী তাদের সন্ধানে আসবে। মিরিয়ামের জীবনের এই কঠিন সময়ের শুরু মাত্র। তার সামনে রয়েছে আরও ভয়ংকর পথ, যেখানে তাকে সাহসের সাথে বাঁচতে হবে।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - মেশিনের মনুষ্যত্ব: "মেশিনের মনুষ্যত্ব" একটি কল্পবিজ্ঞান গল্প যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মানবিক অনুভূতির সেতুবন্ধন নিয়ে অনুসন্ধান করা হয়। এই বাংলা ছোট গল্পে প্রযুক্তি ও অস্তিত্বের জটিল দ্বন্দ্বকে তুলে ধরা হয়েছে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
অজানা দেশে অজানা আশ্রয়
মিরিয়াম জেগে উঠল। বাইরে মৃদু আলো ফুটে উঠেছে, শীতের সকালে সূর্যের কিরণ বরফের উপর পড়ে চকচক করছে। হেলেনার ছোট্ট কুটিরের ভেতর এক অদ্ভুত উষ্ণতা রয়েছে, যা বাইরে পৃথিবীর নিষ্ঠুরতা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। মিরিয়ামের মন এখনো অশান্ত, কিন্তু গতকালের আতঙ্ক ও ক্লান্তি তাকে একরকমভাবে অবশ করে রেখেছে। চোখ মেলে সে কুটিরের চারপাশে তাকায়—ছোট, মাটির দেওয়ালের ঘর, দেয়ালে কয়েকটি পুরোনো ছবি ঝুলছে, এক কোণে একটি কাঠের চৌকি। সবকিছুই খুব সাধারণ, কিন্তু তাতে একধরনের শান্তির ছোঁয়া আছে।
হঠাৎ মৃদু পায়ের শব্দ শুনে মিরিয়াম চমকে ওঠে। দরজার সামনে হেলেনা দাঁড়িয়ে, তার হাতে এক বাটি গরম স্যুপ। “ঘুম ভাঙলো? তুমি কিছু খেয়ে নাও,” হেলেনা মৃদু হেসে বলে। মিরিয়াম ধীরে ধীরে স্যুপের বাটি হাতে নেয়, তার শরীরে এখনো দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু হেলেনার মমতা যেন তাকে একটু একটু করে শান্ত করছে।
“তুমি কোথা থেকে এসেছো, মেয়েটি?” হেলেনা আস্তে আস্তে জানতে চায়। মিরিয়াম এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। কী বলবে সে? তার পরিচয় নিয়ে কথা বলতে তার ভয় লাগে। যদি হেলেনা তাকে পোল্যান্ডের নাৎসি সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়? কিন্তু হেলেনার চোখে এমন কিছু আছে, যা তাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। অনেকটা দ্বিধা নিয়ে মিরিয়াম বলে, “আমার নাম মিরিয়াম। আমি পোল্যান্ড থেকে পালিয়ে এসেছি। আমার মা-বাবাকে ধরে নিয়ে গেছে, আমার ছোট ভাইও হারিয়ে গেছে।”
হেলেনা চুপ করে শোনে। তারপর সে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “তুমি একা নও, মেয়েটি। আমিও এই যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুভব করেছি। অনেক মানুষ এই যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি কীভাবে একা লাগতে পারে, যখন চারপাশের সবাই হারিয়ে যায়।”
মিরিয়ামের ভেতরে কিছু ভেঙে পড়ে। এতদিন সে যন্ত্রণার সাথে একা লড়াই করে এসেছে, কাউকে কিছু বলার সাহস পায়নি। কিন্তু হেলেনার মমতার মধ্যে সে যেন এক ধরনের আশ্রয় খুঁজে পায়। তার চোখের কোণে জল গড়িয়ে পড়ে। “আমি জানি না আমার পরিবার বেঁচে আছে কিনা,” সে অস্পষ্ট কণ্ঠে বলে। “আমি জানি না তারা কোথায়, আমি কীভাবে তাদের খুঁজে পাব।”
হেলেনা চুপ করে থাকে, তারপর ধীরে ধীরে মিরিয়ামের হাত ধরে বলে, “কখনো আশা ছাড়ো না, মেয়েটি। এই সময়গুলো কঠিন, কিন্তু আমাদের লড়াই করে যেতে হবে। আমরা যারা বেঁচে আছি, তাদের জন্য এই লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।”
হেলেনার কথা মিরিয়ামের মনকে খানিকটা শান্ত করে। তার মনে পড়ে, কীভাবে তার বাবা মা তাকে বলেছিলেন শক্ত থাকতে, কখনো হাল ছেড়ে না দিতে। হয়তো কোথাও তারা এখনো বেঁচে আছে, হয়তো কোথাও ইয়াকভও আছে, কোনো দয়ালু মানুষের সাহায্যে। এই আশাটুকুই তাকে টিকিয়ে রাখছে।
দিনগুলো কাটতে থাকে। মিরিয়াম হেলেনার কুটিরে থেকে তার নতুন জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে থাকে। গ্রামের মানুষজন তাদের খুব একটা চেনে না, আর হেলেনাও তাদের সাথে বেশি মেশে না। সে তার নিজের মতো করে থাকে, মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে আসে। মিরিয়াম বুঝতে পারে, হেলেনা একসময় শহরের মেয়ে ছিল, কিন্তু যুদ্ধ তাকে এই নির্জন গ্রামে এনে ফেলেছে।
একদিন সন্ধ্যায়, যখন কুটিরে শীতের হাওয়া ঢুকে পড়ছে, হেলেনা তার জীবনের গল্প বলতে শুরু করে। “আমারও একসময় পরিবার ছিল,” সে বলে। “আমার স্বামী, পিটার, এক সাহসী মানুষ ছিলেন। তিনি নাৎসি বাহিনীর বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করতেন। একদিন তারা তাকে ধরে নিয়ে গেল, আর তার পর থেকে আমি তার কোনো খোঁজ পাইনি।”
হেলেনার চোখে কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। মিরিয়াম ধীরে ধীরে হেলেনার কাছে যায়, তার হাত ধরে। “তুমি কষ্ট পেয়েছো,” মিরিয়াম আস্তে আস্তে বলে। “কিন্তু তুমি এখনো শক্ত হয়ে আছো।”
হেলেনা হেসে ফেলে। “শক্ত হতে হয়, মেয়েটি। এই যুদ্ধ আমাদের সবার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিচ্ছে, কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। আমি জানি, পিটার হয়তো বেঁচে নেই, কিন্তু তার আদর্শ আমার ভেতরে বেঁচে আছে।”
মিরিয়াম হেলেনার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এই মহিলাটি কেবল একজন আশ্রয়দাতা নয়, সে একজন যোদ্ধা। তার ভেতরে এক অসীম শক্তি আছে, যা তাকে কঠিন পরিস্থিতিতেও বেঁচে থাকতে শিখিয়েছে। মিরিয়ামের মনে হয়, হয়তো তাকেও এই শক্তিটুকু খুঁজে বের করতে হবে।
কিছুদিন পরে, গ্রামে এক নতুন ধরনের আলোচনা শুরু হয়। হেলেনা কুটিরে ফিরে এসে বলে, “আমরা এখানেও আর নিরাপদ নই। নাৎসি বাহিনী এখানে আসতে পারে। তারা শরণার্থীদের খুঁজছে, আর আমরা খুব বেশি দিন লুকিয়ে থাকতে পারব না।”
মিরিয়ামের মন আবার অশান্ত হয়ে ওঠে। এতদিনের শান্তির আশ্রয় এখন আর নিরাপদ নয়। তারা কী করবে? কোথায় যাবে? হেলেনা তাকে বলে, “আমরা আরও গভীর বনে যেতে পারি। সেখানে কিছু লোক আছে যারা আমাদের সাহায্য করতে পারবে।”
মিরিয়াম দ্বিধাগ্রস্ত হয়। আবার নতুন জায়গায় যেতে হবে? আবার পালাতে হবে? কিন্তু তার অন্য কোনো উপায় নেই। সে হেলেনার দিকে তাকায়, তার চোখে দৃঢ়তার ছাপ দেখে। “আমি তোমার সাথে যাব,” মিরিয়াম বলে।
হেলেনা মাথা নাড়ে। “তুমি ভয় পেও না, মেয়েটি। আমরা ঠিক পথ খুঁজে নেব।”
সেই রাতেই তারা কুটির ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, অন্ধকারে বনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের পায়ের নিচে মাটি নরম, বাতাস ঠান্ডা, চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। তারা দ্রুত চলতে থাকে, যেন কোনো অজানা শক্তি তাদের তাড়া করছে।
মিরিয়াম বুঝতে পারে, তাদের এই যাত্রা সহজ হবে না। কিন্তু তার মনে একধরনের অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে। হয়তো এই যুদ্ধ তার থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু তাকে এখনো জীবনের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রতিদিনের লড়াই
মিরিয়ামের জীবন যেন প্রতিদিন নতুন কোনো দুঃস্বপ্নে প্রবেশ করে। হেলেনার ছোট্ট ঘরটিতে আশ্রয় পাওয়ার পর থেকে তার মন কিছুটা স্থির হলেও, বাইরের পৃথিবীটা যেন ঠিক তেমনই ভয়ানক রয়ে গেছে। প্রতিদিন সকালে মিরিয়াম জানলার ধারে বসে গ্রামের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। নাৎসিদের কোনো পেট্রোল দল আসছে কি না, আশেপাশের কেউ সন্দেহজনকভাবে তাকাচ্ছে কি না—এই সমস্ত ভাবনা তাকে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দেয় না। হেলেনা যেন এইসব কিছু এড়িয়ে চলতে অভ্যস্ত। তার একটাই লক্ষ্য—মিরিয়ামকে নিরাপদে রাখা।
একদিন সকালে হেলেনা যখন বাইরে থেকে খাবার সংগ্রহ করে ফিরছিল, মিরিয়াম তাকে জিজ্ঞাসা করল, “তুমি কি কখনও ভাবোনি, এভাবে কতদিন চলবে?”
হেলেনা এক মুহূর্ত থেমে মৃদু হাসল। “ভাবা অবশ্যই উচিত, কিন্তু আমরা যদি ভাবতেই থাকি, তাহলে বাঁচব কখন?”
মিরিয়াম চুপ করে রইল। তার মনে হলো, হেলেনা যেন সমস্ত কিছু জানে। সে জানে কিভাবে এই কঠিন সময়ের মধ্যে আশা ধরে রাখতে হয়। মিরিয়ামও চেষ্টা করে, কিন্তু যখন তার মনে পড়ে তার বাবা-মা ও ভাইয়ের কথা, তখন সমস্ত আশা ধুয়ে যায়।
এদিকে, গ্রামে নাৎসিদের উপস্থিতি দিন দিন বাড়তে থাকে। হেলেনা প্রায়ই মিরিয়ামকে সতর্ক করে দেয়, “তুমি খুব সাবধানে থেকো। কেউ জানতে পারলে, আমাদের দু’জনের জন্যই মুশকিল হয়ে যাবে।”
গ্রামের মানুষদের অনেকেই হেলেনার প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছিল। মিরিয়ামকে তারা কখনওই পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি, কারণ তার চেহারাতেই যেন ধরা পড়ে গেছে যে সে এক বহিরাগত, আর এই সময়ে বহিরাগত মানেই বিপদ। এমনকি কয়েকজন হেলেনার কাছে গিয়ে স্পষ্ট করেই জানিয়েছিল, “তুমি যদি ওকে নিজের ঘরে রাখো, তাহলে আমাদের গ্রামটাও ঝুঁকিতে পড়বে।”
তবুও, হেলেনা দমে যায়নি। সে মিরিয়ামের জন্য খাবার জোগাড় করত, তাকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিত, এবং প্রতিদিন তাকে মনে করিয়ে দিত যে এই কঠিন সময়েও বাঁচার জন্য কিছু না কিছু খুঁজে পেতে হয়।
মিরিয়ামের দিনগুলো অতীতের স্মৃতির মাঝে বিভোর হয়ে কাটতে থাকে। তার মনে পড়ে তার বাবা-মার কথা। বাবা ছিলেন এক সাধারণ ব্যবসায়ী, কিন্তু তাদের জীবনে সুখ ছিল। ভাইয়ের সঙ্গে খুনসুটি, মায়ের আদর—এইসব স্মৃতি যেন একেকটা টুকরো টুকরো স্বপ্ন হয়ে তাকে ঘিরে ধরে। কিন্তু বাস্তবতা এতটাই নির্মম যে, এইসব স্মৃতি আর কখনও ফিরে আসবে না।
“তুমি কি এখনও তোমার পরিবারকে খুঁজে পাবে বলে মনে করো?” হেলেনা একদিন মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, যখন তারা একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিল।
মিরিয়াম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি জানি না। কিন্তু আমি ভাবি, যদি তাদের খুঁজেও পাই, তারা কি আর আগের মতো থাকবে? যুদ্ধ মানুষকে পরিবর্তন করে দেয়।”
হেলেনা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, “হয়তো না, কিন্তু তাও খোঁজার চেষ্টা করাটা আমাদের কর্তব্য। যদি আমরা বাঁচি, তাদের খুঁজে পাওয়ার একটা সুযোগ তো থাকবেই।”
যদিও গ্রামের অনেকেই তাদের সাহায্য করতে চায়নি, তবুও দু’একজন নীরবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল। গ্রামের এক বৃদ্ধ কৃষক, যিনি হেলেনার পুরনো পরিচিত, মাঝে মাঝে তাদের জন্য শাকসবজি ও দুধ এনে দিতেন। সে জানত যে মিরিয়াম ইহুদি, তবুও সে বলত, “আমাদের নিজেদের মানুষকে সাহায্য করতে হবে। এই যুদ্ধ তো আমাদেরও।”
এইসব সামান্য সাহায্যই যেন তাদের বেঁচে থাকার আশাকে ধরে রেখেছিল। কিন্তু প্রতিদিনই হেলেনা ও মিরিয়াম বুঝতে পারছিল, সময় ফুরিয়ে আসছে। নাৎসিদের উপস্থিতি আরও কঠোর হতে চলেছে, আর গ্রামেও মিরিয়ামের অবস্থান নিয়ে গুঞ্জন বাড়ছে।
একদিন সন্ধ্যায়, মিরিয়াম ও হেলেনা দু’জনেই কাজ শেষ করে বসেছিল, তখনই গ্রামের এক কিশোর ছুটে এসে খবর দিল, “তোমাদের সাবধান থাকতে হবে। কিছু লোক আজ বিকেলে গ্রামের বাইরে মিটিং করেছে। তারা বলেছে, কাল নাৎসিরা পুরো গ্রাম খুঁজবে। তারা কাউকে ছাড়বে না।”
মিরিয়ামের শরীরের রক্ত যেন জমে গেল। “তাহলে কি আমাকে এখান থেকে পালাতে হবে?”
হেলেনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “হ্যাঁ, হয়তো তোমাকে পালাতে হবে। কিন্তু আমরা কোথায় যাবো?”
এ কথা শুনে মিরিয়ামের চোখে জল এসে গেল। এতদিন ধরে যে জায়গাটা তার জন্য আশ্রয় ছিল, সেটা ছেড়ে এখন কোথায় যাবে সে? হেলেনা তখনই একটা সংকল্প নিয়ে ফেলল। “তুমি আমার সঙ্গে চলো। আমরা অন্য গ্রামে পালিয়ে যাব। এখান থেকে দূরে, এমন জায়গায় যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পাবে না।”
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - আত্মার মুক্তি: এক ভুতের গল্পে সোহিনী আত্মার মুক্তির সন্ধানে অন্ধকার শক্তির সাথে লড়াই করে। এই বাংলা ছোট গল্পটি ভয়ের ছায়া এবং সাহসিকতার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
বন্ধুত্বের বন্ধন
শীতের রাতটা যেন আরও তীব্র হয়ে উঠছিল। হেলেনা ও মিরিয়াম তাদের অল্প ক’টি জিনিসপত্র গুছিয়ে রওনা দেয়। বাইরের গাঢ় অন্ধকার তাদের চারপাশে একটা চাপা অশুভতা এনে দিয়েছে। মিরিয়ামের বুক ধড়ফড় করতে লাগল—একটা অজানা আশঙ্কা যেন তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সে জানত, যেকোনো মুহূর্তে নাৎসিদের দলের সামনে পড়লে তাদের বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না। তবে হেলেনার অবিচল চাহনি, দৃঢ় মনোভাব তাকে খানিকটা সাহস যোগাল।
“হেলেনা,” মিরিয়াম মৃদু কণ্ঠে বলল, “তুমি কীভাবে এতটা শান্ত থাকতে পারো? আমার তো মনে হচ্ছে আমরা যেকোনো সময় ধরা পড়ে যাব।”
হেলেনা মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ চলল, তারপর মৃদু হাসল। “আমরা যদি এখন ভেঙে পড়ি, তাহলে আর বাঁচার কোনো সুযোগই থাকবে না। ভয়কে পাশে রেখেও আমাদের চলতে হবে, মিরিয়াম। এটিই জীবনের নিয়ম।”
মিরিয়াম চুপ করে রইল। তার মনে পড়ল হেলেনার কথা—যে মেয়েটা নিজের জীবন দিয়ে লড়াই করছে তার জন্য, এক অনাত্মীয়কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। হেলেনা যেন এক অবিচল সাহসিকতার প্রতীক, যে সবকিছুর উপরে বন্ধুত্বকে স্থান দিয়েছে। এতদিনের এই লড়াইয়ের মধ্যে তাদের বন্ধুত্ব যে কতটা গভীর হয়ে উঠেছে, তা মিরিয়াম আজ হঠাৎই অনুভব করতে পারল।
হেলেনা আর মিরিয়ামের মধ্যে এই সম্পর্ক একেবারেই স্বাভাবিক ছিল না। মিরিয়াম যখন প্রথম হেলেনার কাছে আসে, সে জানত না, এই অচেনা মেয়েটার সঙ্গে তার জীবনের এমন অদ্ভুত বাঁধনে জড়িয়ে পড়বে। ভাষা, সংস্কৃতি, এমনকি জীবনের উদ্দেশ্য—সবকিছুই আলাদা ছিল। কিন্তু যুদ্ধের এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তাদেরকে এক করে দিয়েছে। একে অপরের পাশে দাঁড়িয়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছে।
মিরিয়ামের চোখে হেলেনা যেন এক আশ্রয়ের মতো। সে শুধু সাহায্য করেই থেমে থাকেনি, বরং মিরিয়ামের মানসিক বলকে বাড়িয়ে তুলেছে। সে মিরিয়ামকে শিখিয়েছে কীভাবে প্রতিদিন একটু একটু করে শক্ত হয়ে ওঠা যায়। কীভাবে ভয়কে পাশ কাটিয়ে বাঁচা যায়। মিরিয়াম যতই হেলেনাকে দেখত, ততই তার ভেতরে সাহসিকতার বীজ গজাতে শুরু করত।
“তুমি আমার মায়ের মতো,” একদিন মিরিয়াম ফিসফিস করে বলেছিল। তখন হেলেনা এক মুহূর্ত চুপ করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। তারপর মৃদু হাসল, “আমরা কেউই কারোর মা নই, মিরিয়াম। কিন্তু বন্ধুত্ব কখনও কখনও রক্তের সম্পর্কের থেকেও গভীর হয়ে যায়।”
তারা গ্রামের পেছনের দিকে একটা নির্জন পথ ধরে চলতে থাকে। হেলেনার এই রুটটা ভালোই চেনা, কারণ আগে সে একবার এই পথ দিয়ে অন্য একজনকেও পালাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু এবার পরিস্থিতি অনেক বেশি বিপজ্জনক। গ্রামের মানুষদের অনেকেই হয়তো এখন তাদের সন্দেহ করছে। কিন্তু তাদের কোনো বিকল্প নেই। এই জায়গায় আর এক মুহূর্তও থাকা মানে নাৎসিদের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি।
“তুমি কি কখনও ভেবেছিলে, আমরা এভাবে পালাব?” মিরিয়াম চুপ করে হেলেনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“এখনকার সময়ে সবকিছুই অনিশ্চিত। আজ যা ভাবছ, কাল তা বদলে যেতে পারে। আমাদের শুধু এগিয়ে যেতে হবে, মিরিয়াম,” হেলেনা কঠিন কণ্ঠে বলল।
তারা ধীরে ধীরে পথ চলতে থাকে। চারপাশের নিস্তব্ধতা ভাঙছে না, কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপের শব্দ যেন হাড়ের ভেতর দিয়ে গিয়ে কাঁপিয়ে দিচ্ছে মিরিয়ামের মনকে। সে জানত, তাদের হাতে আর খুব বেশি সময় নেই। তারা যদি ধরা পড়ে যায়, তাহলে তাদের জীবন শেষ।
হেলেনার অবিচলতা মিরিয়ামকে প্রতিনিয়ত অবাক করত। সে কিভাবে এতটা নির্ভীক থাকতে পারে? কিভাবে সে দিনের পর দিন তার পরিবার হারিয়ে ফেলে, তবুও এমনভাবে লড়াই চালিয়ে যেতে পারে? মিরিয়ামের এইসব প্রশ্নের উত্তর ছিল না। কিন্তু সে বুঝতে পারছিল যে, এই যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের নয়, মনোবলেরও। আর হেলেনার মনোবল তাকে আশ্চর্যভাবে ধরে রেখেছে।
“তুমি কি কখনও ভেঙে পড়ো না?” মিরিয়াম জিজ্ঞেস করল, যখন তারা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিচ্ছিল।
“সবাই ভেঙে পড়ে, মিরিয়াম। কিন্তু সবকিছু সত্ত্বেও যদি আবার দাঁড়াতে পারো, তবেই তুমি সত্যিকারের শক্তিশালী।” হেলেনা মাটির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল, যেন সে নিজেকে মনে করাচ্ছে।
রাতটা ক্রমশ গভীর হতে থাকল। মিরিয়াম ও হেলেনা গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে, কিন্তু পথের শেষে তাদের সামনে আরও নতুন বাধা অপেক্ষা করছে। সামনে একটা নদী, যা পেরোতে হলে তাদের আরও শক্তি ও সাহসের প্রয়োজন।
“আমরা কি পারব?” মিরিয়াম জিজ্ঞেস করল, তার কণ্ঠে অনিশ্চয়তার ছাপ স্পষ্ট।
হেলেনা নদীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আমরা পারব। আমরা এ পর্যন্ত এসেছি, আর একটু দূর যেতে হবে।”
এই কয়েকটি কথায় মিরিয়ামের মনে যেন নতুন এক আশার আলো জ্বলে উঠল। তারা পথ চলতে শুরু করল। নদীর ধারে পৌঁছে তারা একটা ছোট্ট নৌকা দেখতে পেল, যা হেলেনা আগেই ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, পেছন থেকে কয়েকজনের কণ্ঠস্বর শোনা গেল।
পেছনে নাৎসিদের দলের সদস্যরা ধীরে ধীরে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। মিরিয়াম ও হেলেনা দ্রুত নৌকায় উঠল। হেলেনা নৌকা চালাতে শুরু করল, আর মিরিয়াম প্রার্থনা করতে লাগল। নদীর অন্য পাড়ে পৌঁছনোর আগেই যদি তারা ধরা পড়ে, তাহলে তাদের বাঁচার আর কোনো উপায় থাকবে না।
কণ্ঠস্বরগুলো ক্রমশ আরও কাছে আসছে। মিরিয়াম নিঃশ্বাস নিতে পারছে না ঠিক মতো। তারা কি বাঁচতে পারবে? নাকি এইখানেই শেষ হয়ে যাবে তাদের জীবনযুদ্ধ?
বিপদের ছায়া
যুদ্ধের শেষ সময় আসন্ন, এবং ক্রমশ অন্ধকারের ছায়া তাদের চারপাশে ঘনিয়ে আসছে। চারিদিকে নিঃশব্দে মৃত্যুর ছায়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেন অদৃশ্য শত্রুদের আগমনকে জানান দিচ্ছে। হেলেনা আর মিরিয়ামের জন্য প্রতিটি দিন আর রাত হয়ে উঠেছে অজানা ভয়ের আখ্যান। নাৎসিদের নজরদারি এখন আরও কঠোর, এবং শহরের গলিতে গলিতে ছড়িয়ে পড়েছে একধরনের অস্বস্তি। প্রতিটি গুঞ্জন, প্রতিটি শব্দের আড়ালে যেন কোনো গোপন ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা লুকিয়ে রয়েছে।
হেলেনা আর মিরিয়ামের গোপন আশ্রয়স্থল দিনদিন আরও অসুরক্ষিত হয়ে পড়ছে। যেদিন তারা প্রথম এখানে লুকিয়েছিল, সেদিন তারা ভাবতেও পারেনি এই জায়গাটি একদিন তাদের মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হতে পারে। ঘরের দরজা-জানালা সবই বন্ধ, কিন্তু বাইরে নাৎসি বাহিনীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে তারা। প্রতিটি রাত তাদের জন্য হয়ে উঠছে নতুন দুশ্চিন্তা আর আতঙ্কের স্রোত।
একদিন সন্ধ্যায় হেলেনা শুনতে পায় যে, তাদের লুকানোর জায়গার খবর ফাঁস হয়ে গেছে। মিরিয়াম তখনও তার ছোট্ট মোমবাতির আলোয় একটা পুরানো ডায়েরি পড়ছে। ডায়েরির পাতা থেকে শব্দের আর্তনাদ উঠছে—ভবিষ্যতের জন্য লেখা একটি কাহিনি, যেখানে বেঁচে থাকার আর কোনো নিশ্চয়তা নেই।
“মিরিয়াম, আমাদের এখনই পালাতে হবে,” হেলেনা শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল। মিরিয়ামের হাত থেকে ডায়েরি পড়ে গেল। এক মুহূর্তের জন্য তাদের চোখে চোখ পড়ল, যেন তারা দুজনেই বুঝতে পারল কী অপেক্ষা করছে সামনে।
কিন্তু পালানোর রাস্তাটা সহজ নয়। চারপাশের প্রতিটি পথ নজরদারিতে ভরা। হেলেনা জানে না কোন পথে গেলে তারা নিরাপদে পৌঁছাতে পারবে। তবু তাদের কোনো বিকল্প নেই। রাতের অন্ধকারে, তারা দুজনেই চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল, পা টিপে টিপে শহরের এক অজানা গলি ধরে হাঁটতে শুরু করল।
আকাশে তখন মেঘের স্তূপ জমছে, যেন প্রকৃতি তাদের সংকটের প্রতিচ্ছবি। বাতাসে ভারী নিরবতা, শুধু মাঝে মাঝে কুকুরের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। হেলেনার হাত শক্ত করে ধরে আছে মিরিয়াম, যেন যেকোনো মুহূর্তে এই বন্ধন ভেঙে গেলে সবকিছু শেষ হয়ে যাবে।
“কোথায় যাচ্ছি আমরা, হেলেনা?” মিরিয়ামের কণ্ঠে ভয়ের কম্পন।
“আমার জানা নেই। কিন্তু এখান থেকে যতটা সম্ভব দূরে যেতে হবে,” হেলেনা বলল।
হঠাৎ দূরে একটা চিৎকার শোনা গেল। তাদের রক্ত জমে গেল সেই শব্দে। নাৎসি বাহিনী হয়তো খুব কাছাকাছি। পায়ের শব্দগুলোও শোনা যাচ্ছে, যেন তাদের খুব কাছ থেকে কেউ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।
তারা দুজনেই একটা পুরানো বাড়ির পেছনে লুকিয়ে পড়ল। বাড়িটি প্রায় ভেঙে পড়েছে, কিন্তু অন্ধকারে সেটা তাদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয় হতে পারে। ভিতরে ঢুকে তারা শ্বাস ফেলল, যেন কিছু সময়ের জন্য নিরাপদ। কিন্তু এই নিরাপত্তা দীর্ঘস্থায়ী নয়, তারা জানে।
বাড়ির ভিতরে অদ্ভুত এক সুনসান নীরবতা। ধুলোবালিতে ঢাকা চেয়ার আর টেবিলগুলো যেন তাদের কষ্টের চিহ্ন বহন করছে। সময় এখানে থেমে গেছে, কিন্তু তাদের জন্য সময় আর নেই।
মিরিয়াম বলল, “আমরা কি এখান থেকে বাঁচতে পারব?”
“আমরা বাঁচতেই হবে, মিরিয়াম,” হেলেনা দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল, যদিও নিজের মনেও সাড়া পাচ্ছিল না।
কিন্তু তখনই, দরজার বাইরে আবারও পায়ের শব্দ শোনা গেল। নাৎসি বাহিনী হয়তো তাদের উপস্থিতি আঁচ করতে পেরেছে। হেলেনা দ্রুত একটা ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। তাদের অবস্থা খারাপ। আশেপাশে কোনো গোপন পথ নেই, আর নাৎসিরা ক্রমেই কাছে আসছে।
“আমাদের এখান থেকে বেরোতে হবে,” হেলেনা চুপিচুপি বলল, মিরিয়ামের দিকে তাকিয়ে। মিরিয়াম মাথা নাড়ল। ভয়ের ছাপ তার চোখে স্পষ্ট, কিন্তু সে হেলেনার উপর পুরোপুরি নির্ভর করছে।
তারা দুজনেই দরজার কাছাকাছি এসে দাঁড়াল। বাইরে তখন যুদ্ধের শ্বাসরুদ্ধকর আয়োজন চলছে।
কিন্তু ঠিক তখনই, একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে যায়, আর একদল নাৎসি সেনা তাদের সামনে দাঁড়িয়ে যায়। হেলেনা আর মিরিয়ামের শরীর জমে গেল ভয়ে। সব কিছু যেন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।
কিন্তু হেলেনা তখনও ছেড়ে দিতে রাজি নয়। সে দ্রুত এক মুহূর্তের ফাঁকে মিরিয়ামের হাত ধরে ছুটে চলে অন্য একটা দরজা দিয়ে বাইরে। নাৎসিরা পিছু নেয়, গুলি ছোড়ে, কিন্তু অন্ধকারের মধ্যে তারা কোনো রকমে পালাতে সক্ষম হয়।
তারা একটা পুরানো ঝর্ণার পাশে এসে দাঁড়ায়। শ্বাস নিতে পারছে না, দেহের প্রতিটি পেশিতে ক্লান্তি। কিন্তু সময় নেই। নাৎসিরা তাদের সন্ধানে বেরিয়েছে, আর তাদেরকে বাঁচাতে হলে নতুন কোনো পথ খুঁজতে হবে।
“আমাদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই,” মিরিয়াম কাঁদতে কাঁদতে বলে।
“আছে,” হেলেনা বলল, তার মুখে দৃঢ়তার ছাপ। “আমাদের সব শেষ হয়ে যায়নি। আমাদের সামনে একটা সুযোগ আছে।”
“কীসের সুযোগ?” মিরিয়াম প্রশ্ন করে।
“আমি জানি একটা জায়গা,” হেলেনা বলল, তার চোখে অদ্ভুত এক জ্যোতি। “সেখানে গেলে আমরা নিরাপদে থাকতে পারব, কিন্তু খুব সতর্ক হতে হবে।”
তারা দুজনেই আবারও হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু এই যাত্রা সহজ নয়, কারণ তাদের প্রতি মুহূর্তেই বাঁচার জন্য লড়তে হবে।
কঠিন সিদ্ধান্ত
বিপদের ছায়া তাদের চারপাশে ক্রমশ গাঢ় হয়ে আসছিল। মিরিয়াম এবং হেলেনা যখন তাদের লুকানোর জায়গায় বসে ছিল, তখন মনে হচ্ছিল, যেন তারা একেবারে অন্ধকারের মধ্যে চাপা পড়ে যাচ্ছে। নাৎসিরা তাদের অনুসরণ করছে, এবং তাদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা প্রতিদিন বাড়ছিল। একদিন হঠাৎই হেলেনা জানাল, “আমাদের আলাদা হতে হবে।”
মিরিয়ামের চোখে হতাশার ছাপ পড়ল। “কেন? আমি তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব? আমরা যদি একসঙ্গে থাকি, তাহলে আমরা লুকিয়ে থাকতে পারব,” সে বলল।
হেলেনার মুখে দৃঢ়তা ছিল। “না, মিরিয়াম। যদি তারা আমাদের দুজনকে একসঙ্গে ধরে ফেলে, তাহলে আমাদের বাঁচার সম্ভাবনা শূন্য হয়ে যাবে। তুমি জানো, তারা কতটা নির্মম। তোমার বাঁচার জন্য, তোমার আলাদা হতে হবে।”
মিরিয়াম নিজেকে দোষী মনে করছিল। “কিন্তু আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে পারি না। তুমি আমার সব কিছু।”
“এটাই সত্যি। কিন্তু আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মনে রেখো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।” হেলেনার চোখে জল ছিল, কিন্তু তার কথা দৃঢ় ছিল।
মিরিয়াম বুঝতে পারছিল, হেলেনার কথা সঠিক। শেষ পর্যন্ত, তারা দুজনেই জানতো যে, যুদ্ধের এই অন্ধকারে তাদের বেঁচে থাকার জন্য কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শেষ পর্যন্ত, মিরিয়ামকে বিদায় জানাতে গিয়ে হেলেনার চোখে জল এসে গেল। “একদিন দেখা হবে,” সে বলল, “আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।”
মিরিয়ামের হৃদয় ভেঙে যাচ্ছিল। “আমি তোমাকে ভুলব না,” সে বলল, “অবশ্যই একদিন তোমাকে খুঁজে পাব।”
দুজনেই আলাদা পথে বের হলো। মিরিয়াম জানতো, তার যাত্রা খুব কঠিন হবে, কিন্তু হেলেনার সাহস তাকে শক্তি দিচ্ছিল। প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছানোর জন্য প্রেরণা জোগাচ্ছিল। প্রতিটি ঘর, প্রতিটি গলি তাকে মনে করাচ্ছিল তার প্রিয়জনদের কথা।
একদিন, যখন মিরিয়াম একটি জনাকীর্ণ বাজারে প্রবেশ করলো, তখন সে অনুভব করলো যে, জীবন আবারও ফিরে আসছে। মানুষজনের কথা, হাসি, আর ব্যবসার তাড়াহুড়িতে তাকে মনে হলো যেন এক নতুন আশা জাগছে। কিন্তু সেখানেও বিপদের ছায়া ছিল। কিছু লোকের মুখের ভাষা, কিছু কিছু চাউনি তার মনে আস্থা জাগাতে পারছিল না। সে জানতো, যেখানে যাই, নাৎসিদের নজর সর্বদা তার দিকে।
মিরিয়াম বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়া পরিবারের সদস্যদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু প্রতিটি মুখের মধ্যে তার মা-বাবার পরিচয় খুঁজে পেতে ভয় লাগছিল। প্রতিটি পরিচয় যেন তাকে আরও বেশি হতাশার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
একদিন, মিরিয়াম একটি পুরনো বন্ধুর দেখা পেল। বন্ধু বলল, “মিরিয়াম, তুমি কেমন আছো? তুমি জানো, এই অঞ্চলে সবকিছুই বদলে গেছে। আমাদের বাঁচার জন্য একে অপরকে সাহায্য করতে হবে।”
মিরিয়াম বলল, “আমি আমার পরিবারকে খুঁজে পাচ্ছি না। আমি জানি না তারা কোথায় আছে।”
বন্ধু মিরিয়ামকে কিছু তথ্য দিলো, কিছু পুরনো চিঠি এবং ডায়েরি, যা তার পরিবারের সদস্যদের চলাচল সম্পর্কে ধারণা দিত। “তুমি যদি তাদের খুঁজতে চাও, তাহলে এগুলো ব্যবহার করতে পারো,” সে বলল।
মিরিয়ামের মনোভাব পরিবর্তিত হতে লাগলো। সে জানতো, তাকে আরেকবার চেষ্টা করতে হবে। সে আরও বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞা নিয়ে তার যাত্রা শুরু করলো।
এখন তার মনে হেলেনার কথা ভাসছিল। হেলেনা যে বলেছিল, “যুদ্ধের এই অন্ধকারে তোমার শক্তি তোমার ভিতরেই আছে।” এই কথাগুলো তার মনে সাহস জোগাচ্ছিল। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে, সে আবার হেলেনার সঙ্গে দেখা করতে পারবে, সেই আশা বুকের মধ্যে লালন করছিল।
প্রতি রাতে, যখন মিরিয়াম একটি পুরনো গাছের নিচে শুয়ে পড়তো, তখন সে হেলেনার সঙ্গে দেখা করার স্বপ্ন দেখতো। মনে মনে ভাবতো, কিভাবে তারা আবার একত্রিত হবে। তাদের বন্ধুত্ব যে কত গভীর, সে অনুভব করতো।
অবশেষে, মিরিয়াম বুঝতে পারলো যে, একা থাকা মানে দুর্বল হওয়া নয়; বরং, একা থেকে সংগ্রাম করতে পারাটা অনেক বড় কথা। তাকে সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ তার জীবন জুড়ে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে।
সকাল বেলার রোদে যখন সে উঠে দাঁড়ালো, তখন সে প্রতিজ্ঞা করলো যে সে হেলেনার মতো একজন হবে—একজন যে ভালোবাসা আর সাহস দিয়ে অন্যদের রক্ষা করবে। তার মনে আস্থা জন্মালো, যে সে একদিন তার পরিবারকে খুঁজে পাবে।
এভাবে তার যাত্রা শুরু হলো, নতুন আশার দিকে। প্রতিটি পদক্ষেপে সে বুঝতে পারলো, যুদ্ধের ক্ষত তাকে ভিতর থেকে বদলে দিয়েছে, কিন্তু সে জানে যে হেলেনার শিক্ষা তাকে সারাজীবন এগিয়ে নিয়ে যাবে।
যুদ্ধের বিপদের মধ্যে, মিরিয়াম যখন তার পথে চলতে থাকলো, তখন সে উপলব্ধি করলো—যুদ্ধের সমাপ্তি হবে, কিন্তু তাদের বন্ধুত্বের কাহিনী কখনো শেষ হবে না।
শেষ পর্যন্ত, মিরিয়াম একটি নতুন ভোরের অপেক্ষায় ছিল, যেখানে সে তার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করবে।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - অমীমাংসিত রহস্য: অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একটি নতুন ভোর
মিরিয়াম একা দাঁড়িয়ে আছে শহরের ধ্বংসাবশেষে। যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু তার চারপাশের চিত্র যেন কোনো বিভীষিকা। ধ্বংসপ্রাপ্ত বিল্ডিং, রাস্তায় পড়ে থাকা ধুলো ও ধ্বংসস্তূপ, সবই প্রমাণ করে যে কতটা নির্মম ছিল এই লড়াই। কিন্তু এইসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মিরিয়ামের চোখে শুধু একটাই স্মৃতি ফুটে উঠছে—হেলেনা। সেই দৃঢ়, সাহসী নারী, যিনি সবসময় মিরিয়ামকে বাঁচানোর জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু মিরিয়ামের ভেতরে যুদ্ধের গর্জন এখনও থামেনি। হেলেনার কথা মনে হলেই তার বুকের মধ্যে এক ধরনের তীব্র শূন্যতা তৈরি হয়। হেলেনার শেষ বিদায়ের মুহূর্ত, তার সেই সাহসী মুখ আর ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া ছায়া—সবকিছু যেন আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। হেলেনা আর নেই, তবুও তার স্মৃতি মিরিয়ামের প্রতিটি পদক্ষেপে সাথে সাথে থাকে।
“আমি তোমার মতো হব, হেলেনা,” মিরিয়াম নিজেকে বলে। “তোমার সেই সাহস, সেই ভালোবাসা আমি সারা জীবন বয়ে নিয়ে যাব।”
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মিরিয়ামের পরিবারকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার বাবা-মা কোথায়, তারা বেঁচে আছে কিনা, সেসব উত্তর তার কাছে নেই। তবুও, একধরনের আশ্চর্য শান্তি তার মনে এসেছে। যুদ্ধের ক্ষত তাকে ভিতর থেকে বদলে দিয়েছে, কিন্তু সেই বদল তাকে দুর্বল করেনি, বরং আরও শক্তিশালী করেছে। মিরিয়াম আজ নতুন এক নারী।
যুদ্ধের পর শহরে শান্তি আসতে শুরু করেছে, কিন্তু সেই শান্তি যেন ক্ষণিকের। প্রতিটি মানুষ, যারা বেঁচে আছে, তারা সবাই নিজের ক্ষত নিয়ে বেঁচে রয়েছে। শহরের প্রতিটি কোণায় সেই স্মৃতি জেগে আছে—যুদ্ধের তাণ্ডব, ভয়, আর তারপরে বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা।
মিরিয়াম জানে, তার জীবনের এই পর্ব শেষ হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন এক অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। যুদ্ধ তাকে কেবল শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবেও ভেঙেছে। কিন্তু সে ভেঙে পড়েনি। তার মধ্যে সেই শক্তি আছে যা তাকে নতুন জীবনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে। হেলেনার কাছ থেকে সে এই শিক্ষাই পেয়েছে—সাহসিকতা, ভালোবাসা, আর ত্যাগের মাধ্যমে নতুন করে নিজেকে খুঁজে পাওয়া।
হেলেনার সেই সাহসিকতা তাকে শিখিয়েছে যে কিভাবে নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন করে গড়ে তুলতে হয়। হেলেনা হয়তো আজ নেই, কিন্তু তার শিক্ষা মিরিয়ামের সাথে চিরদিন থাকবে।
একদিন, শহরের একটি পুরানো ক্যাফেতে মিরিয়াম বসে ছিল। সামনের রাস্তায় লোকজন আসছে-যাচ্ছে। যুদ্ধের পরে এই শহর আবার ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠছে। ক্যাফের কোণে বসে থাকা মিরিয়ামের মনে পড়ে যায় সেই দিনগুলো, যখন হেলেনার সাথে তাদের জীবনের জন্য লড়াই করেছিল। তাদের দুজনের সেই দিনের কথা, যখন তারা আলাদা হয়েছিল।
মিরিয়ামের চোখে অশ্রু জমতে শুরু করে, কিন্তু সেই অশ্রু আজ বেদনার নয়, বরং কৃতজ্ঞতার। হেলেনার সাহসই তাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। সেই স্মৃতি, সেই ত্যাগ, সেই ভালোবাসা—সবকিছু আজও মিরিয়ামের ভেতরে জীবন্ত।
মিরিয়াম ধীরে ধীরে এক কাপ কফি হাতে তুলে নিয়ে বাইরে তাকায়। শহরের নতুন ভোর আসছে। মানুষের মধ্যে নতুন আশা জেগে উঠছে। আর মিরিয়ামের মনে জাগছে এক অদ্ভুত আশার বীজ।
“আমি বাঁচব, হেলেনা,” মিরিয়াম ফিসফিস করে বলে। “আমি তোমার সেই শিক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকব। আমি তোমার মতো একজন হব, যে ভালোবাসা দিয়ে অন্যদের রক্ষা করবে।”
একদিন, মিরিয়াম শহরের একটি ছোট্ট স্কুলের সামনে দাঁড়ায়। যুদ্ধের পরে শহরের শিশুরা ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে এসে নতুন করে জীবনের পাঠ নিচ্ছে। মিরিয়াম সেই স্কুলে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যোগ দেয়। তার মনে একটাই লক্ষ্য—শিশুদের মধ্যে সাহস আর ভালোবাসার বীজ বপন করা, যেমন হেলেনা তার মধ্যে করেছিল।
শিশুদের হাসির মধ্যে মিরিয়াম নতুন করে জীবনের মানে খুঁজে পায়। তারা নতুন করে গড়ে উঠছে, নতুন পৃথিবী তৈরির স্বপ্ন দেখছে। মিরিয়াম তাদেরকে শেখায় কিভাবে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে পূর্ণতা দিয়ে বাঁচতে হয়।
মিরিয়ামের হৃদয়ে একটা নতুন অনুভূতি জাগে। হয়তো সে তার পরিবারকে আর খুঁজে পাবে না, কিন্তু তার সামনে নতুন একটা পরিবার দাঁড়িয়ে আছে। এই শিশুরা, এই নতুন প্রজন্ম—তাদের মাঝেই সে তার হারানো ভালোবাসা ফিরে পাবে। তাদের জন্য সে হেলেনার শিক্ষা বয়ে নিয়ে যাবে।
এই যুদ্ধের মাঝে যে জীবন রক্ষা পেয়েছে, সেই জীবন এখন নতুন পথে এগোচ্ছে। মিরিয়ামের চোখের সামনে সেই নতুন ভোর ফুটে উঠছে, যেখানে নতুন পৃথিবী গড়ে তোলার আশা আছে। আর সেই আশার মধ্যেই মিরিয়াম খুঁজে পায় তার জীবনের নতুন মানে।
এই চূড়ান্ত অধ্যায়ে মিরিয়ামের যাত্রার ইতি হলেও, তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং হেলেনার স্মৃতি তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্জন্মের মধ্যে দিয়ে সে জীবনের নতুন মানে খুঁজে পায়, যা ভালোবাসা আর সাহসের প্রতীক।