শাওনলী, এক জলজ্যান্ত, উজ্জ্বল মেয়ে, বড়ো হয়েছিল ঠাকুরগাঁওয়ের রক্ষণশীল পরিবেশে। বাপ্তি স্মধর্মাবলম্বী পরিবারে জন্ম তার, যেখানে রীতি-নীতির চৌকাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে হয় সবকিছু। কিন্তু শাওনলীর মনের গহনে এক অস্থিরতা, এক অজানা টান, যা ঠিক বোঝা যায় না।
এক দুপুরবেলা, খেলার ছলে বান্ধবী রীনা হঠাৎ জড়িয়ে ধরে শাওনলীকে। সেই স্পর্শে শিহরে উঠেছিল শরীর, বুকে জেগেছিল অদ্ভুত এক তড়িৎ। মুহূর্তের সেই ঘটনা পাল্টে দিয়েছিল শাওনলীর জীবনের চলন। প্রতিটি স্পর্শ, রীনার চোখের হাসি, সবকিছুই এখন অন্যরকম মনে হতে লাগলো। কিন্তু সমাজের চোখ এড়িয়ে চলা, অপরাধের বোঝা নিয়ে বেঁচে থাকা- এটাই ছিল শাওনলীর নিয়তি, বলে মনে হতো।
একদিন সহ্যের সীমা অতিক্রম হলো। রীতিমতো শ্বাসরুদ্ধকর লাগছিল। বাড়ি, পরিবার, সমাজের সব নিয়মের চাপে আর সহ্য করতে পারছিল না শাওনলী। ঠিক করলো, একটু দূরে চলে যাবে। সমুদ্রের কাছে থাকবে কয়েকদিন।
সাগরের বিশাল বিস্তৃতির সামনে দাঁড়িয়ে মুক্ত লাগলো শাওনলী। কিন্তু মনের অশান্তি এত সহজে শান্ত না। ঢেউয়ের গর্জন যেন তারই মনের আঁকশের সাথে মিশে গেল।
অচেনা এক হোটেলে থাকতে শুরু করলো। ম্যানেজার, দুলালদা, এক বয়স্ক লোক, যার চোখে অদ্ভুত এক স্নেহের ঝিলিক। শাওনলীর একাকীত্বটা বুঝতে পেরে, মাঝেমধ্যে এসে কথা বলতেন দুলালদা। তার কাছে শাওনলী একটু একটু করে খুলে বলতে শুরু করলো মনের গল্প। রীনার কথা, সমাজের চাপ, নিজের অস্বস্তি – সবই। দুলালদা শান্ত স্বরে শুনলেন। তারপর বললেন, “মেয়ে, জীবনে অনেক কিছুই হয়, কিন্তু আত্মপরিচয় হারিয়ে ফেলা যাবে না। তুমি যে, সেটা জানা জরুরি।”
দুলালদার কথাগুলো ছিল শান্তির মন্ত্র। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতোই তা উঠালো-নামালো শাওনলীর মনকে। সমুদ্র সৈকতে হাঁটার সময় দেখা হলো ঐশীর সাথে। এক বিদেশী মেয়ে, বাংলা শেখার জন্য এসেছে এখানে। এক অদ্ভুত বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো তাদের মধ্যে। ঐশী খুব সহজসাধ্য, নিজের সম্পর্কে খোলাখুলি। শাওনলীকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার বদলে নিজের মনের কথা বলা শেখালো। কয়েকদিনের সঙ্গে ঐশীর কাছে নিজের টানটা, রীনার স্পর্শের কথা সবকিছু খুলে বললো শাওনলী। ঐশী একটু চমকে গেলেও, মুখ ফিরিয়ে নিল না। বরং, স্নেহের স্পর্শে হাত ধরে বললো, “শাওনলী, তুমি এভাবে লুকিয়ে কেন থাকবে? তোমার মতো অনেক আছেন। সমাজের চাপে চেপে থাকলে চলবে না।”
ঐশীর কথাগুলো শাওনলীর চোখে জল এনে দিল। এতদিন নিজের মনের কথা কাউকে বলতে পারেনি সে, আর আজ এক অচেনা মেয়ে…। কিন্তু ঐশীর কথায় সত্যিই তো! কেন সে লুকিয়ে থাকবে? সে ঠিক যে খারাপ কিছু করছে না। সে শুধু নিজের মতো থাকতে চায়।
সমুদ্রের সৈকতে বসে সূর্যাস্ত দেখছিল শাওনলী ও ঐশী। লালচে আকাশ, দূরে মিশে যাওয়া সূর্য, আর ঢেউয়ের গর্জন – সবকিছুই যেন নতুন করে মনে হচ্ছিল শাওনলীকে। হঠাৎ ঐশী জিজ্ঞেস করলো, “শাওনলী, তুমি রীনাকে ভালোবাসো?”
শাওনলী চুপ করে রইল। মনের কথা স্বীকার করা এত সহজ না। কিন্তু ঐশীর চোখের স্নেহ দেখে মনে হলো, সে এবারে আর লুকিয়ে থাকবে না। “হয়তো,” কাঁপা কাঁপা গলায় বললো সে।
ঐশী হাসলো, “হয়তো না, ঠিকই ভালোবাসো। ভালোবাসা লুকিয়ে রাখার কি দরকার? নিজের মনের কথা রীনাকে জানাও।”
ঐশীর কথাগুলো ছিল ঝড়ের মতো। নিজের মনের কথা রীনাকে জানানো? কিন্তু সমাজ? পরিবার? এই সব ভাবনা আবার ঘুরেফিরে এলো শাওনলীর মাথায়।
ঐশী যেন তার চিন্তা বুঝতে পেরে বললো, “সমাজের চিন্তা করো না। তোমার সুখের জন্য তোমাকেই লড়াই করতে হবে। আর পরিবার… সময়ের সাথে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
ঐশীর কথাগুলোয় যেন এক আশার সঞ্চার হলো শাওনলীর মনে। সে ঠিক করলো, সে আর লুকাবে না। ফিরে যাওয়ার পর রীনাকে সব খুলে বলবে।
কয়েকদিন পর সমুদ্রের কাছ থেকে ফিরলো শাওনলী। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। একদিকে ঐশীর কথা, অন্যদিকে পরিবারের চাপ। কিন্তু এবার সে আর পিছিয়ে যাবে না। রীনার সাথে দেখা করলো। রীনাও খুশি, কিন্তু শাওনলীকে দেখে একটু অবাক লাগলো। কারণ, শাওনলীর চোখে এক আশ্চর্যের জ্যোতি।
শাওনলী সব খুলে বললো রীনাকে। শুরু থেকে, সেদিনের ঘটনা, সমুদ্র সৈকতে ঐশীর সাথে দেখা, সবকিছু। রীনা একটানা শুনলো। তার চোখেও জল এলো। কিন্তু অবাক লাগলো শাওনলীর কথা শুনে। সমাজের এত চাপের মধ্যেও নিজের মনের কথা স্বীকার করেছে শাওনলী।
একটু থেমে রীনা বললো, “শাওনলী, আমিও তোমাকে ভালোবাসি।”
শাওনলী অবাক হয়ে গেল। সে আশা করেনি রীনাও তার মতো অনুভব করে। কিন্তু এখন কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিল না।
“কিন্তু… আমরা কী করবো?” জিজ্ঞেস করলো শাওনলী।
রীনা হাত ধরে বললো, “আমরা ঠিক জানি না, কী হবে। কিন্তু একসাথে থাকতে চাই। সমাজের চাপ থাকবে ঠিকই, কিন্তু লুকিয়ে থাকব না। সত্যিটা বলা উচিত।”
শাওনলী রীনার কথাগুলোর সাথে একমত হলো। সত্যি লুকিয়ে রাখলে চলবে না। কিন্তু পরিবারকে কীভাবে বলা যায়, সেটা বুঝতে পারছিল না।
ফিরে এসে বাড়িতে ঢুকতেই মা এগিয়ে এলো। শাওনলীকে দেখে খুশি হলেও, চিন্তা দেখা গেল মায়ের চোখে। “কী হয়েছে মা?” জিজ্ঞেস করলো শাওনলী।
মা একটু ইতস্তত করে বললো, “শোনা, তোমার জন্য ছেলের খোঁজ শুরু হয়েছে।”
শাওনলীর মাথাটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল। সমুদ্রের কাছে থাকার কয়েকটা দিনের মধ্যেই ছেলের খোঁজ শুরু! আর তার মনের মধ্যে একটা ঝড়। কীভাবে বাবা-মাকে সব সত্যিটা বলবে? সমাজের চোখে সে কি হয়ে যাবে? কিন্তু রীনার হাত তার হাতে, আর ঐশীর কথা মনে পড়ছে, “time heals everything…”
নিজের মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে রাত কাটলো শাওনলীর। সকালে সিদ্ধান্ত নিল, সে সত্যিটা সবার সামনে খুলবে।
সকালের নাস্তা সারতে শাওনলীর গলা শুকিয়ে এলো। বাবা-মা দুজনেই চুপচাপ খাচ্ছেন। ছেলের খোঁজ শুরুর কথাটা মাথা ঘুরিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। এক গলায় সবটা বলে ফেলতে চাইলো শাওনলী, কিন্তু কথাগুলো গলায় আটকে গেল।
ঠিক সেই সময় বাবা বললেন, “শোনা, তোমার মনের কথা বলো।”
এই সুযোগটা আর নষ্ট করতে চাইলো না শাওনলী। কাঁপা কাঁপা গলায় শুরু করলো সে। সমুদ্রের কাছে যাওয়া, নিজের টান, রীনার সঙ্গে দেখা, সবকিছু খুলে বললো। কথা শেষ হতেই বাড়ির মধ্যে এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো। শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দ আর শাওনলীর দ্রুত হৃদস্পন্দন শোনা যাচ্ছে।
মা চোখের কোণে জল টানতে টানতে বললেন, “এতদিন কেন বললে না শোনা?”
শাওনলীর চোখে জল চলে এলো। সে জানতো, সহজ হবে না। “ভয় করছিলাম,” ফ্যাল ফ্যাল গলায় বললো সে।
এবার বাবা কথা বললেন, “ভয় কিসের? তুমি যে আমাদের মেয়ে।” বাবার কথাটা শুনে একটু শান্তি পেলো শাওনলী। কিন্তু এখনো অনেকটা পথ বাকি।
“কিন্তু সমাজ…” শুরু করতেই বাবা হাত উঁচিয়ে বাধা দিলেন। “সমাজের কথা পরে। আগে তোমার সুখটা বুঝতে চেষ্টা করব।”
মা এগিয়ে এসে শাওনলীকে জড়িয়ে ধরলেন। “আমরা তোমার পাশে আছি।”
এটা ছিলো অবিশ্বাস্য। শাওনলী ভাবতেও পারেনি, বাবা-মা এতটা সহজে মেনে নেবেন। কিন্তু এখনো বাকি ছিল রীনা। সমাজের চোখে তাদের সম্পর্ককে কীভাবে স্বীকৃতি দেবে, সেটা নিয়ে মাথায় চিন্তা এলো শাওনলীর।
কয়েকদিন পর রীনাকে সব জানালো শাওনলী। রীনাও খুশি হলো শাওনলীর পরিবারের মানসিকতা জেনে। কিন্তু সমাজের চাপ নিয়ে তারও চিন্তা ছিল। তাই দুজনেই সিদ্ধান্ত নিল, আস্তে আস্তে সবাইকে জানাবে।
একদিন বাবা-মাকে নিয়ে রীনার বাড়িতে গেলো শাওনলী। রীনার বাবা-মাও খুব সহজে মেনে নিলেন তাদের সম্পর্ক। এমনকি ঐশীকেও সব জানালো শাওনলী। ঐশী খুব খুশি হলো এবং শাওনলীকে সাহসের জন্য প্রশংসা করলো।
সময় লাগলো ঠিকই, কিন্তু ধীরে ধীরে সবাই শাওনলী ও রীনার সম্পর্ক মেনে নিল। সমাজের কিছু কটু কথা শোনা গেল ঠিকই, কিন্তু পরিবারের পাশে থাকায় শাওনলী আর রীনা কোনো কথাই পাত্তা দিল না। তারা দুজনেই জানতো, পথটা সহজ হবে না। রক্ষণশীল সমাজে তাদের সম্পর্ককে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেওয়ার পথে অনেক বাঁধা, অনেক সমালোচনা থাকবে। কিন্তু একে অপরের হাত ধরে, পরিবারের সমর্থন নিয়ে, তারা সেই লড়াইয়ে নামলো।
শুরুতে, আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকেই বিরোধিতা শুরু হলো। কটু কথা, বিদ্রুপবাণী শোনা লাগলো। কিন্তু শাওনলী ও রীনা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল। নিজেদের মতো থাকতে চাইলো, সত্যিটা গোপন করলো না। তারা দুজনেই নিজেদের কাজে মনোযোগ দিল। শাওনলী লেখালেখি আরো মন দিয়ে ছেকল। সমাজের চাপ কাটিয়ে নিজের মনের গল্প লিখলো। আর রীনা তার শিল্পের মাধ্যমে ভালোবাসা, স্বাধীনতা, সামাজিক বন্ধনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ফুটিয়ে তুললো।
ধীরে ধীরে, সমাজের মনোভাবও বদলাতে শুরু করলো। শাওনলীর লেখা, রীনার শিল্প মানুষের মনে ছাপ ফেলল। সমাজের রক্ষণশীল চিন্তাধারার বাইরে এসে ভালোবাসার নতুন সংজ্ঞা দিলো তারা। তাদের সাহস, অবিচল থাকা দেখে অনেকেই তাদের সমর্থক হয়ে উঠলো।
কয়েক বছর পর, শাওনলী ও রীনা এক সফল লেখিকা ও শিল্পী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দিলো। তাদের সম্পর্ক আর লুকোনোর কিছু ছিল না। একটা ছোট্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সবার সামনে একে অপরকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করলো।
সেই সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে, অশান্ত মনের সাথে ঠিক যে লড়াইটা শুরু করেছিল শাওনলী, সেই লড়াইয়ে জয়ী হলো সে। সমাজের চাপ, পরিবারের চিন্তা, সব কিছুকে অতিক্রম করে নিজের ভালোবাসাকে স্বীকার করলো। আর সেই সঙ্গে রীনার হাত ধরে সমাজকে বার্তা দিলো – ভালোবাসা নির্দিষ্ট কোনো রূপ ধারণ করে না, সে মুক্ত, সীমাহীন, ঠিক সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো।