কলকাতার বুকে, এই ঠাণ্ডা, ধোঁয়াটে শহরে, লিখেছি এমন গল্প, যা আপনাকে রাতের অন্ধকারে একবার চমকে দেবে। গল্পটা শুরু হয় শ্মশান কালীবাড়ির পাশেই থাকা জীর্ণশীর্ণ একতলার বাড়িতে। এখানে থাকেন বিধবা রতনমণি দেবী, তাঁর নাতি শ্যামল আর এক অদ্ভুত ছেলে, অগ্নি।
শ্যামল, ষোলো বছরের কিশোর, স্বপ্ন দেখে লেখক হওয়ার। সে লিখে ফেলে অদ্ভুত গল্প, যা রাতের বাতাসে উড়ে যায় শ্মশানের দিকে। অগ্নি, দেখতে সাদাসীধা ছেলেটি, কিন্তু তার চোখ দুটি অদ্ভুত সবুজ। কেউ জানে না সে কোথা থেকে এলো, কী তার পরিচয়। রতনমণি দেবী তাকে আশ্রয় দিয়েছেন সদয়তার সাথে। কিন্তু অগ্নি কথা কয় না, শুধু চুপিসারে শ্যামলের লেখা পড়ে।
এক রাতে ঝড়ের মধ্যে লিখছিল শ্যামল। সে লিখলো এক ডাইনি, যে তার মন্ত্র জপে মৃতদের আত্মা ডাকে। ঠিক সেই সময় জানলা দিয়ে ঢুকে পড়লো অগ্নি। সে হাতছানি করে থামালো শ্যামলকে। কিন্তু লেখা থেমে গেছে, শব্দ ফুরিয়ে গেছে।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো শ্যামল, অগ্নি নেই। খুঁজতে বেরিয়ে সে গিয়ে পৌঁছলো শ্মশান কালীবাড়িতে। সেখানে দেখলো এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য। একটা ঝোপের নিচে পড়ে আছে বৃদ্ধ পুরোহিতের ছেঁড়া-ছেঁড়ি করা দেহ। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নি, তার সবুজ চোখ জ্বলজ্বলিয়ে।
শ্যামল চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু অগ্নি তাকে চুপ করিয়ে বললো, “ও ডাইনি ছিল। মৃতদের আত্মা খেত। আমি থামিয়েছি।” শ্যামল বিশ্বাস করতে পারলো না। সে জানতো অগ্নি কথা কয় না। কিন্তু এই কথাগুলো কোথাকার?
এরপর শুরু হলো রহস্যের খেলা। পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলো রতনমণি দেবী ও শ্যামলকে। কিন্তু কোনো ক্লু পাওয়া গেল না। শ্যামল বুঝতে পারলো না, অগ্নি কে? সে কোথা থেকে এলো? আর কী তার উদ্দেশ্য?
দিন যত গেল, ততই অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে লাগলো। রাতে শ্মশানের দিকে আজব আলো দেখা যেত। কখনও ভাসতো বিষণ্ন সুরের গান। মানুষজন ভয় পেতে লাগলো।
এক রাতে শ্যামল স্বপ্ন দেখলো, এক বৃদ্ধা তাকে বলছে, “অগ্নি আসুরের সন্তান। সে এসেছে পৃথিবী ধ্বংস করতে। তাকে থামাতে হবে তোমাকেই।” শ্যামল ঘুম থেকে উঠে জানালো অগ্নি কে, কী তার উদ্দেশ্য – এই প্রশ্ন নিয়ে ঘুম হলো না শ্যামলের। সকালে সে দেখল অগ্নি উধাও। রতনমণি দেবীও চিন্তিত। জানালেন, আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন অগ্নি নেই। তার বিছানায় রক্তের একটা ফোঁটা ছিল, আর তার সাথে থাকা একটা অদ্ভুত পাথরটাও খোঁজা গেল না।
দিনের বেলায় খবর পেল শ্যামল, রাতে শ্মশানের কাছে একটা ছেলের ঝলসানো দেহ পাওয়া গেছে। পুলিশ সন্দে করছে, সেটা হয়তো অগ্নিই। শ্যামলের বুক কেঁপে উঠলো। অগ্নি কি মারা গেল? কিন্তু তার স্বপ্নের কথা? বৃদ্ধার কথা মিথ্যে হতে পারে না।
অগ্নি মারা গেলে পৃথিবী কি নিরাপদ হয়ে গেল? না, শ্যামলের মনে হলো না। সে ঠিক করলো, সত্যিটা উঘাটন করবে। সেই রাতে সে বেরিয়ে পড়লো শ্মশানের উদ্দেশ্যে।
শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভাঙল শ্যামলের পায়ের আওয়াজে। চারপাশে অন্ধকার, শুধু মাঝেমধ্যে ঝলক দিচ্ছে কবরের উপরের প্রদীপের আলো। হঠাৎ, শ্যামলের চোখ আটকে গেল একটা ঝোপের নিচে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে অগ্নি, তার সবুজ চোখ জ্বলজ্বলিয়ে। কিন্তু অগ্নি আগের অগ্নি নেই। তার গায়ের রং মৃতের মতো ফ্যাকাশে, চোখ দুটি লাল।
“অগ্নি!” চমকে গিয়ে ডাকল শ্যামল।
“আমি অগ্নি নই,” শব্দটা এলো অগ্নি বা অজ্ঞাত কোনো কণ্ঠ থেকে। “আমি সেই আসুর, যাকে বন্দী করে রেখেছিল বৃদ্ধ পুরোহিত। তুমি ছেড়ে দিয়েছো আমাকে তোমার লেখার মন্ত্র দিয়ে।”
শ্যামলের পায়ের নিচে থেকে সরে গেল জমি। তার লেখা, তার স্বপ্ন – সবই ছিল ফাঁদ। সেই ফাঁদে পা দিয়ে সে এনে দিয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের ঝড়।
“কী করবো তুমি?” কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলো শ্যামল।
“যা করার, তা করবো।” হিংস্র হাসি ছড়িয়ে দিল আসুর। “এই পৃথিবীকে নরকে পরিণত করবো।”
আসুরের চোখ জ্বলে উঠলো ভয়ঙ্কর আগুনে। শ্যামল জানতো, তার লেখা এখন অস্ত্র। সেই অস্ত্র দিয়েই লড়তে হবে তাকে এই আসুরের বিরুদ্ধে। সেই মুহূর্তে মনে পড়লো স্বপ্নের কথা। বৃদ্ধা বলেছিল, সেই পাথরই আসুরের দুর্বলতা। কিন্তু পাথরটা কোথায়?
শ্যামল চোখ ব্যাপক করে চারপাশে তাকালো। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়লো অগ্নি বা আসুরের পায়ের কাছে মাটির উপর চকচকে একটা সাদা পাথরের টুকরো। সব আশা ঝলক দেওয়ার মতো সেই সাদা পাথরের টুকরোটা যেন শ্যামলের জীবন ধরে রাখার একমাত্র সুতোয় পরিণত হলো। সে জানতো না, পাথরটা দিয়ে ঠিক কি করতে হবে, তবে চেষ্টা করতেই হবে। সে বাঁকা হয়ে পাথরটা তুলতে গেল, ঠিক সেই সময় আসুরটা চিৎকার করে ঝাঁপিয়ে পড়লো তার দিকে। শ্যামল কোনোরকমে সরে গেল, কিন্তু আসুরের দীর্ঘ, নখরখচিত হাতটা খপ করে ধরে ফেললো।
চোখে জ্বালা আর ব্যাথায় ঝাপসা দেখতে লাগলো শ্যামল। সে জানতো, আর দেরি করা যাবে না। সেই পাথরের টুকরাটা আঁচলে ধরে সে বললো, “আমি লেখক, আমার শব্দই আমার অস্ত্র।” তারপর নিজের গল্পের বইটা বের করলো থলে থেকে।
আসুরটা থমকে গেল। এতদিন ধরে সে শুধু ছেলের লেখা শব্দ শুনেছে, কিন্তু কখনো লেখা দেখেনি। শ্যামল জানতো, এই তার সুযোগ। সে জোরে জোরে পড়তে শুরু করলো তার গল্প। সেই গল্প, যেখানে সে লিখেছিল এক সাহসী রাজপুত্রের কথা, যে শয়তানকে পরাজিত করে।
ক্রমে ক্রমে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি টানছে, আসুরটা পাথরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। শ্যামল পড়তে থাকলো আরও জোরে। চারপাশে বাতাস উঠলো, গাছের পাতা কাঁপতে লাগলো। শ্মশানের মধ্যে জ্বলে উঠলো অসংখ্য নীল আলো।
ঠিক যখন আসুরটা পাথরের টুকরোটা হাত দিতে যাচ্ছে, শ্যামল তার গল্পের শেষ লাইনটা চিৎকার করে বললো, “রাজপুত্র শয়তানকে তার স্বরূপে ফিরিয়ে দিল, আর সেই স্বরূপে ধ্বংস হয়ে গেল!”
এক জমকালো আলোয় সবকিছু সাদা হয়ে গেল। যখন আলোটা কমলো, শ্যামল দেখতে পেল তার সামনে শুধুই পুড়ে যাওয়া কাপড়ের টুকরো ছাড়া আর কিছু নেই। পাথরের টুকরোটাও নেই।
শ্যামল বুঝলো, সে জিতেছে। সে ক্লান্ত পা এঁকেলে বাড়ির দিকে রওনা হলো। সারা রাত ঘুম হয়নি, চোট পেয়েছে, কিন্তু মনের মধ্যে এক অদ্ভুত শান্তি ছিল। সে জানতো, হয়তো লেখা শুধু মানুষের কল্পনাকে জীবিত করে না, কখনও কখনও সত্যিকারের যুদ্ধেও জয় এনে দেয়।