কলকাতার বুকে, এই গরমের ঝলসানো দুপুরে বসে লিখছি, আপনার জন্য এক অবিস্মরণীয় ঐতিহাসিক গল্প।
এ গল্প ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ঠিক আগের সময়ের। ব্রিটিশ শাসনের জাল পুরো দেশ জুড়ে বিস্তৃত, কিন্তু ভারতীয়দের মনে জ্বলে উঠেছে স্বাধীনতার আগুন। এই গল্প তিন মহিলার – রাধা, সীতা ও পারুলের – গল্প।
রাধা, এক নিঃসন্তানা গৃহিনী। স্বামী দেশের কাজে বিদেশে থাকেন, আর সেই একাকিত্বে রাধা জড়িয়ে পড়েছে শাড়ি কাঁথা সেলাইয়ের কাজে। তার হাতের কারুকার্য্য করা শাড়ি সারা কলকাতায় বিখ্যাত। রাধার বাসায় নিয়মিত আসে সীতা, এক তরুণ বিধবা। স্বামীকে হারানোর শোকে সে নিমজ্জিত থাকলেও, তার দৃঢ় মনোভাব ও সাহস সবার চোখে ধরা পড়ে। রাধার কাছে সে শেখে কাঁথাকুঁড়ি, আর তাতেই দু’জনের মধ্যে গড়ে ওঠে এক অসাধারণ বন্ধুত্ব।
এই দু’জনের জীবনে ঢেউ খেলে আসে পারুল। সে এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের মতো তরুণী, ব্রিটিশ বিদ্যালয়ে শিক্ষিতা। তার চোখে জ্বলে উঠেছে বিদ্রোহের আগুন, সে গোপনে বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ রাখে। সে রাধার কাছে আসে শাড়ি কিনতে, কিন্তু আসল কাজ তার অন্য কিছু। সে রাধার সেলাইয়ের মাধ্যমে গোপন বার্তা পাঠানোর পরিকল্পনা করে।
কথামালা গড়ায় সূক্ষ্ম সেলাইয়ের মতো। রাধা ও সীতা, পারুলের দেওয়া কাঁথাকুঁড়িতে বিদ্রোহীদের গোপন বার্তা খুঁজে পায়। প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও, দেশের মুক্তির আকাঙ্ক্ষায় তারা সেই বার্তা আগে বাড়িয়ে দেয়। ধীরে ধীরে তিনজনে জড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের জালে। রাধার বাড়ি হয়ে ওঠে গোপন আড্ডা। সীতা, তার সাহসিকতায় বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও খাদ্য সরবরাহ করে।
কিন্তু এই গল্পের মধ্যে লুকিয়ে আছে বিশ্বাসঘাতকতার এক কালো ছায়া। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বিদ্রোহের গোপন সংবাদ পেয়ে যায়। এক রাতে, রাধার বাড়িতে হানা দেওয়া হয়। তিন মহিলাকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সীতা স্বীকার করে ফেলে, সেই বিদ্রোহীদের একজন। কিন্তু রাধা ও পারুল, নিজেদের লুকিয়ে ফেলে।
ব্রিটিশরা সীতাকে নির্যাতন করে, বিদ্রোহীদের নাম জানার চেষ্টা করে। কিন্তু সীতা অবিচল। শেষ পর্যন্ত, ব্রিটিশরা তাকে ফাঁসির দণ্ড দেয়। সীতার মৃত্যু তিনজনের বন্ধুত্বের চ্যুতি ঘটে না।
রাধা ও পারুল জেলে থাকলেও, তাদের মনোবল ক্ষুন্ন হয়নি। পারুল, গোপনে জেলে ঢোকানো কাঠখোট্টা দিয়ে লিখেছিল, বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যাহতিগ্রস্ত হয়নি। তারা জানে, বাইরে তাদের মতো আরো অনেকেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। মুক্তির স্বপ্ন এখনো জ্বলজ্বলে জ্বলছে।
এক রাতে, ঝড়ঝঞ্ঝার রাতে, জেলে হঠাৎ করেই হৈ-হৈ শুরু হয়। বাইরে থেকে বিদ্রোহীরা জেলে আক্রমণ করে। বন্দীদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। রাধা ও পারুল বের হয়ে দেখে, শহর জুড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। সিপাহীরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
এই বিদ্রোহের ঢেউয়ে রাধা ও পারুলও ঝাঁপিয়ে পড়ে। রাধা, তার সূক্ষ্ম সেলাইয়ের কৌশল কাজে লাগায়। সে বিদ্রোহীদের জন্য পতাকা সেলাই করে, যুদ্ধের আহবান জানায়। অন্যদিকে, পারুল, তার শিক্ষা ও বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহীদের পরিকল্পনা গড়ায়।
কিন্তু এই যুদ্ধ কঠিন ছিল। ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে, বিদ্রোহীরা ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে থাকে। শহরে লুটপাট ও অগ্নিকাণ্ডের লাল আগুন জ্বলে ওঠে। রাধার বাড়িও ব্রিটিশদের গোলাগুলির আঘাতে বিধ্বস্ত হয়।
একদিন, যুদ্ধের মাঝে রাধা ও পারুলের দেখা হয় সীতার ভাইয়ের সাথে। সে জানায়, সীতা মারা যাওয়ার আগে, রাধার হাতের একটা সেলাই করা শাড়ি চেয়েছিল। সেই শাড়িই ছিল বিদ্রোহের গোপন কোড। প্রতিটি কাঁথাকুঁড়ি, প্রতিটি ফুলের অবস্থান, সবকিছুই একটা গোপন বার্তা বহন করছিল। সেই বার্তা অনুসারে, বিদ্রোহীরা এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে লড়াই করছে।
এই খবরে রাধা ও পারুলের চোখে জল আসে। সীতার মৃত্যু তো বৃথা যায়নি। সে তার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেছে। রাধা ও পারুল নতুন করে প্রতিজ্ঞা করে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাবে। তাদের বন্ধুত্বের গল্প, তাদের সাহসের গল্প, বিদ্রোহের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।