এক রহস্যময় চিত্রকর্ম, এক তরুণ শিল্পী, এবং 1857 সালের বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস - "মুক্তার ময়ুরের রহস্য" ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের এক অসাধারণ গল্প। এই বাংলা গল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ুন রোমাঞ্চ, প্রেম, এবং দেশপ্রেমের এক অপূর্ব মিশ্রণে।

বাংলা ছোট গল্প

Home » বাংলা ছোট গল্প » আঁখিজলের রহস্য

আঁখিজলের রহস্য

এক রহস্যময় চিত্রকর্ম, এক তরুণ শিল্পী, এবং 1857 সালের বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস - "মুক্তার ময়ুরের রহস্য" ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের এক অসাধারণ গল্প। এই বাংলা গল্পে ঝাঁপিয়ে পড়ুন রোমাঞ্চ, প্রেম, এবং দেশপ্রেমের এক অপূর্ব মিশ্রণে।

কলকাতার ঐতিহ্যবাহী আর্ট গ্যালেরিটির নীলচে আলোয় সজ্জিত প্রদর্শনীকক্ষে ঝুলছিল অসংখ্য চিত্রকর্ম। বাংলার সবুজ গ্রাম, হিমালয়ের শীতল চূড়া, মুর্শিদাবাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ – প্রত্যেকটি চিত্রকর্মই যেন মুখ খুলে কথা বলছিল, নিজের গল্প বর্ণনা করছিল। কিন্তু, এই নান্দনিক পরিবেশে ঢুকে এক তরুণী শিল্পী, অবিনাথ, শুধু একটা চিত্রের সামনেই থমকে দাঁড়ালেন।

চিত্রটিতে ছিলেন এক যুবক। মাথার কালো কোঁকড়া চুল, দৃঢ় চেহারা, আর চোখ? দু’টি পান্না পাথরের মতো সবুজ, যেন গভীর সমুদ্রের রহস্য লুকিয়ে আছে সেখানে। অবিনাথের মনে হলো যেন চিত্রটির ঐ যুবক তাকেই দেখছেন। দিনের পর দিন, গ্যালেরিতে আসতেই অবিনাথের অভ্যাস হয়ে গেল। প্রতিবারই এই চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে যুবকের চোখের রহস্য খুঁজতে চেষ্টা করতেন। কখনো কখনো তিনি খাতায় কিছু লিখছেন, যেন চিত্রের গল্পকে ধরে রাখার চেষ্টা করছেন।

একদিন, গ্যালেরির কোণে বসে থাকা বয়স্ক চিত্রকলার অধ্যাপক শ্রীকান্ত ঠাকুর অবিনাথের কার্যকলাপ লক্ষ্য করলেন। উঠে এসে অবিনাথের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এই চিত্রটি কি আপনাকে খুব আকর্ষণ করে?”

“হ্যাঁ,” কাছুটা অবাক হয়ে জবাব দিলেন অবিনাথ, “যেন জানি, চোখ দুটো আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। কিন্তু, কী বলছে বুঝতে পারছি না।”

শ্রীকান্ত ঠাকুর মৃদু হাসলেন, “এই চিত্রের নাম ‘মুক্তার ময়ুর’’।

“মুক্তার ময়ুর?” অবিনাথ অবাক হয়ে বললেন।

“হ্যাঁ,” শ্রীকান্ত ঠাকুর নিশ্চিত করলেন, “১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়কার এক কিংবদন্তি।”

অবিনাথ মুগ্ধ হয়ে শ্রীকান্ত ঠাকুরের দিকে তাকালেন। এই চিত্রের পেছনে এত বড় ইতিহাস লুকিয়ে আছে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। শ্রীকান্ত ঠাকুর তখন গল্প শুরু করলেন –

“১৮৫৭ সাল। ব্রিটিশ শাসনের অত্যাচারে অতিষ্ট ছিল গোটা ভারত। সেই সময় ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে বিদ্রোহের আঁচ জাগে ঊর্ধ্বগতি লাভ করে। নেতৃত্বে ছিলেন বীর সিদ্ধার্থ রায়।”

এই নাম শুনে অবিনাথের চোখ কপালে উঠল, “সিদ্ধার্থ রায়? কিন্তু, এ তো এই চিত্রের যুবকের নাম।”

অবিনাথের বিস্ময় দেখে শ্রীকান্ত ঠাকুর আরও একটু হাসলেন, “হ্যাঁ, এ চিত্রে যে যুবককে দেখছ, সেই হলেন বীর সিদ্ধার্থ রায়।”

কৌতূহল আরও বেড়ে গেল অবিনাথের। “কিন্তু, এই চিত্র তো আঁকা হয়েছে কিছু বছর আগে। বিদ্রোহ তো ১৮৫৭ সালের!”

“ঠিক কথা,” শ্রীকান্ত ঠাকুর গল্প চালিয়ে গেলেন, “ব্রিটিশরা সিদ্ধার্থ রায়কে ধরে ফেলার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু, ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে সিদ্ধার্থের সৈন্যদের খুঁজে বের করা ছিল এক কঠিন কাজ।”

“তাহলে?” অবিনাথ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“তখন ব্রিটিশরা একটা ফন্দ আঁটে। তারা সিদ্ধার্থের ছবি আঁকিয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়। মোটা পুরস্কার ঘোষণা করে যে, সিদ্ধার্থকে ধরে দিতে পারবে তাকে দেওয়া হবে।”

“কিন্তু, এ তো বিশ্বাসঘাতকতা!” অবিনাথের মুখে ক্ষোভ ফুটে উঠল।

“তা ঠিক,” শ্রীকান্ত ঠাকুর সায় দিলেন, “কিন্তু, যুদ্ধে সবই চলে।”

“কিন্তু, এই চিত্রটি তো এখানে আছে। তাহলে কি…?” অবিনাথের কথা শেষ হবার আগেই শ্রীকান্ত ঠাকুর বললেন, “এই চিত্রটি আলাদা। এটা আঁকা হয়েছিল এক রহস্যময় নারী দ্বারা।”

অবিনাথ আরও কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন, “কে এই নারী? সিদ্ধার্থের কেউ?”

“সেটা কেউ জানে না,” শ্রীকান্ত ঠাকুর নিবিড় গলায় বললেন, “কথিত আছে, এই নারী প্রতিদিন গোপনে গ্যালেরিতে আসতেন এবং সিদ্ধার্থের চিত্র আঁকতেন। কেউ তাকে দেখতে পেত না। শুধু দেখা যেত, চিত্রের সামনে রাখা একগুচ্ছ লাল গোলাপ।”

অবিনাথ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। এই চিত্রের পেছনে এত রোমাঞ্চ, এত রহস্য! হঠাৎ তার মনে পড়ল, “কিন্তু, এই নারীর চোখের কথা? চিত্রে তো সিদ্ধার্থের চোখ সবুজ!”

শ্রীকান্ত ঠাকুর একটু হেসে বললেন, “কথিত আছে, নারীটির চোখ ছিল ঠিক এই চিত্রের মতো সবুজ। আর এই চোখের রহস্যই হচ্ছে গল্পের আসল অংশ।”

অবিনাথের চোখ জ্বলে উঠল। শ্রীকান্ত ঠাকুর থামলেন। সন্ধ্যার আঁধার গ্যালেরিকে আরও গাঢ় করে দিচ্ছিল। দুজনের চোখ ছিল মুক্তার ময়ুরের দিকে, সেই সবুজ চোখের দিকে, যেন গল্পের আরও অধ্যায় খোলার জন্য অপেক্ষা করছে।

কৌতূহলে অস্থির হয়ে অবিনাথ প্রশ্ন করলেন, “এই সবুজ চোখের রহস্য কী, শিক্ষক?”

শ্রীকান্ত ঠাকুর চিন্তা করে বললেন, “কথিত আছে, সিদ্ধার্থের এই রহস্যময় দর্শনে ভালোবাসা জাগে। সে প্রতিদিন গ্যালেরিতে আসতেন, লাল গোলাপের গন্ধ শুঁকে ভাবতেন এই নারীকে। কিন্তু, তাকে কখনো দেখতে পেতেন না।”

“কিন্তু, তাহলে…”

শ্রীকান্ত ঠাকুর বললেন, “তাঁর বিশ্বাস ছিল, এই নারীই তাঁকে ব্রিটিশদের ফাঁদ থেকে বাঁচাবে।”

কথাটা শুনে অবিনাথের মাথায় একটা চমক লাগল। সেই রাতে ঘুম আসল না তার। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পেতেন সেই সবুজ চোখ। কে সেই নারী? সিদ্ধার্থকে সে কীভাবে বাঁচাল? প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খাচ্ছিল মনে।

পরদিন গ্যালেরিতে গিয়ে অবিনাথ সিদ্ধার্থের চিত্রের সামনে আরও মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। হঠাৎ, চোখে পড়ল চিত্রের কোণায় একটা খুব সূক্ষ্ম লেখা। অনেক কষ্টে পড়লেন তিনি – “আমি আছি, অপেক্ষায় থাকো।”

লেখাটা দেখে অবিনাথের কাছে মনে হলো, যেন এই লেখাটি তাকেই লেখা হয়েছে। একটা অদ্ভুত টান অনুভব করলেন তিনি। সিদ্ধার্থের মতো তিনিও প্রতিদিন গ্যালেরিতে আসতে শুরু করলেন। লাল গোলাপ নিয়ে আসতেন এবং চিত্রের সামনে রেখে আসতেন।

দিনের পর দিন অবিনাথ এই রুটিনটা চালিয়ে গেলেন। একদিন, সন্ধ্যায় গ্যালেরি বন্ধ হওয়ার পরেও অবিনাথ লুকিয়ে থেকে গেলেন। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, দেখলেন একটা মৃদু আলোয় গ্যালেরিতে ঢুকলেন এক নারী। সবুজ শাড়ি পরা, চোখ দুটি ঠিক চিত্রের মতো সবুজ। অবিনাথ নিজের আশ্চর্য ঢাকতে পারলেন না।

নারীটি সিদ্ধার্থের চিত্রের সামনে এসে দাঁড়ালেন। অবিনাথ দেখলেন, চোখ দুটি ভিজে এলো তার।

“সিদ্ধার্থ,” ফিসফিসিয়ে বললেন নারীটি, “আমি এসেছি।”

অবিনাথ আর থাকতে পারলেন না। এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আপনি কে?”

নারীটি চমকে উঠলেন, তারপর অবিনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি সোনামণি। সিদ্ধার্থের…” কথাটা শেষ করতে পারলেন না।

“সিদ্ধার্থের…” অবিনাথ পুনরুক্তি করলেন।

“প্রতিশ্রুত বধূ,” দুঃখের স্বরে বললেন সোনামণি।

গল্প শুনে অবিনাথ জানতে পারলেন, সোনামণি বিদ্রোহের সময় সিদ্ধার্থের পাশে থাকতে পারেননি। কিন্তু, তিনি গোপনে বিদ্রোহীদের সাহা

সাহায্য করতেন। সিদ্ধার্থের চিত্র আঁকা তার একটি কৌশল ছিল। প্রতিদিনের লাল গোলাপ ছিল একটা গোপন সংকেত, যা বিদ্রোহীদের মধ্যে বার্তা আদান-প্রদানের কাজে লাগত।

অবিনাথ মুগ্ধ হলেন সোনামণির সাহস আর কৌশলে। সিদ্ধার্থের গল্প শেষ হয়নি ঠিক। সোনামণি আর অবিনাথ মিলে ইতিহাসের এই অজানা পাতা উন্মোচন করার দায়িত্ব নিলেন।

অবিনাথ তার শিল্পের মাধ্যমে সোনামণির গল্প, বিদ্রোহের গল্প তুলে ধরলেন। সোনামণি তার জ্ঞান দিয়ে বিদ্রোহের ইতিহাসের অজানা তথ্য উদঘাটন করলেন। তাদের এই যৌথ প্রচেষ্টায় ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায় সৃষ্টি হলো। সিদ্ধার্থের রহস্যময় চোখ আর সোনামণির লাল গোলাপ আর রহস্য রইল না।

একদিন, অবিনাথের নতুন আঁকা সোনামণির ছবির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রীকান্ত ঠাকুর বললেন, “এই চোখে আছে সাহসের আঁচ, এই হাতে আছে দেশপ্রেমের আগুন। এই মুখটিই ইতিহাসকে নতুন করে লিখবে।”

অবিনাথ হাসলেন। হ্যাঁ, সোনামণির গল্প শুধু একটা প্রেমের গল্প বা বিদ্রোহের গল্প ছিল না। এটা ছিল ইতিহাসকে নতুন করে লিখে ফেলার গল্প।

এই রকম চিত্তাকর্ষক বাংলা ছোট গল্প -এর আপডেট পেতে আমাদের WhatsApp চ্যানেল জয়েন করুন।

About The Author

নতুন বাংলা ছোট গল্প

মিরার মায়া

"মিরার মায়া" এক হৃদয়ছোঁয়া ছোটদের গল্প যেখানে মিরা নামের এক মেয়ে তার জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে প্রাণীদের সাহায্য করে। এই রূপকথার গল্প ভালোবাসা, দয়া ও প্রকৃত সুখের সন্ধানে রচিত।

"মিরার মায়া" এক হৃদয়ছোঁয়া ছোটদের গল্প যেখানে মিরা নামের এক মেয়ে তার জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে প্রাণীদের সাহায্য করে। এই রূপকথার গল্প ভালোবাসা, দয়া ও প্রকৃত সুখের সন্ধানে রচিত।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: মিরার মায়া

অন্তিম যাত্রা

"অন্তিম যাত্রা" একটি হৃদয়স্পর্শী ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প, যেখানে যুদ্ধের অন্ধকার পেরিয়ে আশার খোঁজে এগিয়ে চলে। বাংলা ছোট গল্পের ভক্তদের জন্য অনুপ্রেরণায় ভরপুর এক অনন্য সৃষ্টি।

"অন্তিম যাত্রা" একটি হৃদয়স্পর্শী ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প, যেখানে যুদ্ধের অন্ধকার পেরিয়ে আশার খোঁজে এগিয়ে চলে। বাংলা ছোট গল্পের ভক্তদের জন্য অনুপ্রেরণায় ভরপুর এক অনন্য সৃষ্টি।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অন্তিম যাত্রা

ক্লারার রাজ্য

"ক্লারার রাজ্য" একটি মায়াবী রূপকথার গল্প যেখানে ক্লারা ও প্রাণীরা একসাথে তৈরি করে বন্ধুত্বের রাজ্য। ছোটদের গল্পে জাদু, বন্ধুত্ব, ও ভালোবাসার স্পর্শে গড়ে ওঠা এক অনবদ্য রূপকথার দুনিয়া।

"ক্লারার রাজ্য" একটি মায়াবী রূপকথার গল্প যেখানে ক্লারা ও প্রাণীরা একসাথে তৈরি করে বন্ধুত্বের রাজ্য। ছোটদের গল্পে জাদু, বন্ধুত্ব, ও ভালোবাসার স্পর্শে গড়ে ওঠা এক অনবদ্য রূপকথার দুনিয়া।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: ক্লারার রাজ্য

Leave a Comment

অনুলিপি নিষিদ্ধ!