কলকাতার বুকে, হাজারো গল্পের নির্যাস – মতিঝিল। এই ঐতিহ্যশীল জমিদারি এলাকার পুরনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে দেখা মায়াবি কাণ্ড। ইতিহাসের স্বাক্ষী এই বাড়িটা আমার পিতৃপুরুষের, কিন্তু আজ আর কেউ এখানে থাকে না। কেবল আমি, ঐতিহাসিক উপন্যাসের লেখিকা, অহনা।
এই বাড়ির গল্প খুঁজতেই এসেছি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের ছায়া এখনও যেখানে লেগে আছে, ব্রিটিশ জুলুমের বিরুদ্ধে মুক্তির স্বপ্ন যেখানে এখনও শোনা যায় বাতাসের ফিসফিসানিতে। আজ সন্ধ্যায় বাতাস কেমন দুরু দুরু, যেন কিছু গোপন কথা ফাঁস করে দেবে মুহূর্তের মধ্যে।
একটা ঝমঝম শব্দে আমার পিছনে ফিরে তাকালাম। ছাদে উঠে এসেছে একজন ছেলে, বয়স হয়তো পঁচিশের কাছাকাছি। ধুতি-পাঞ্জাবি পরনে, চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা। আমাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল।
“কে আপনি?” সে জিজ্ঞাস করলো, সতর্ক দৃষ্টিতে।
আমি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, “আমার নাম অহনা। এই বাড়ির ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করছি।”
ছেলেটি কিছুক্ষণ চুপ থাকল, তারপর বলল, “আপনি কি জানেন, এই বাড়ির আসল গল্পটা?”
আমি মাথা নাড়লাম। “না, জানিনা। কিন্তু জানতে চাই।”
সে ছেলেটির নাম অভিজিৎ। সে এই বাড়িরই দেখভালকারী, প্রজন্মের কায়স্থ পরিবারের সন্তান। অভিজিৎ আমাকে সেই রাতে এক অবিশ্বাস্য গল্প শোনালো – ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময় এই বাড়ির জমিদার, যতীন্দ্রনাথ রায়, বিদ্রোহীদের নেতাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সৈন্যরা তাকে ধরে ফেলতে পারেনি, কারণ বাড়ির ভেতরেই এক গোপন পথ ছিল, যা লেকের দিকে খুলে যেত।
অভিজিতের কাহিনী আমাকে মুগ্ধ করে ফেলেছিল। এই গোপন পথের কথা কেউ জানত না! পরের দিন, অভিজিতের সাহায্যে, আমরা বাড়ির দেওয়ালে একটা গোপন ফাঁক খুঁজে বের করলাম। তার মধ্যে ঢুকে দেখলাম একটা সরু সাঁকো পথ, যা অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
আমার মনে জাগলো আগ্রহের ঝড়। সেই পথ ধরে কি পাওয়া যাবে? ইতিহাসের কোনো অজানা অধ্যায় কি সেখানে লুকিয়ে আছে? অভিজিতকে নিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই অন্ধকার পথে।
পথটা খুবই সরু, মাথা খুঁজিয়ে যেতে হচ্ছে। বাতাসে একটা আঁশের গন্ধ, যেন অনেকদিন কেউ আসেনি এ পথ
একটু এগিয়ে যাওয়ার পর, পথটা একটু চওড়া হলো। হঠাৎ, আমার হাত কিছু একটা ধরে ফেললো। চমকে উঠে দেখি, একটা পুরনো কাঠের বাক্স। অভিজিতের কাছে থেকে মশালটা নিয়ে বাক্সটা খুললাম। ভেতরে পুরনো কাগজপত্র, কিছু বই, আর একটা ময়লা হয়ে যাওয়া ছবি।
কাগজপত্রগুলো খুলে পড়তে শুরু করলাম। সেগুলো ছিল যতীন্দ্রনাথ রায়ের লেখা ডায়েরি। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়কার ঘটনা, ব্রিটিশদের জুলুম, বিদ্রোহীদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ – সব কিছুই বিস্তারিত লেখা আছে সেখানে। এমনকি, বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর, যতীন্দ্রনাথ কীভাবে এই গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কাহিনীও লেখা।
ডায়েরি পড়তে পড়তে রোমাঞ্চ হচ্ছিল। ইতিহাসের একটা অজানা অংশ হঠাৎ করে আমার হাতে এসে গেল! কিন্তু ছবিটা কার? যতীন্দ্রনাথের স্ত্রী, সাবিত্রী? না হয় কোনো বিদ্রোহী নেতা?
ছবিতে এক সুন্দরী তরুণী মেয়েকে দেখা যায়। চোখে এক অপার দৃঢ়তা, চুলগুলো বেণী করে বাঁধা। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মেয়েটির পোশাক সাধারণ বাঙালি মেয়েদের পোশাকের চেয়ে আলাদা। দেখতে একটু ইউরোপীয় ধাঁচের মতো লাগে।
অভিজিতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাস করলাম, “এই ছবির মেয়েটিকে চেনো?”
অভিজিত মাথা নাড়লো। “না, কখনো দেখিনি।”
হঠাৎ, আমার মনে একটা চমক লাগলো। ডায়েরিতে পড়েছিলাম, যতীন্দ্রনাথের বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। হয়তো এই মেয়ে কোনো বিদ্রোহী দলের বিদেশী সদস্য? বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর, যতীন্দ্রনাথ তাকেই কি এই গোপন পথ দিয়ে পালাতে সাহায্য করেছিলেন?
আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল প্রশ্নের ঝড়। এই ছবির মেয়ে কে? আর কী গোপন কথা লুকিয়ে আছে এই ঐতিহাসিক বাড়ির দেওয়ালের ভেতরে? রহস্যের জাল আরও জড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই রহস্যের সমাধান খুঁজতেই তো এতদূর এসেছি।
পুরনো ডায়েরি আর ছবি নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। রাতে সেগুলো পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, খেয়ালই রাখিনি। স্বপ্নে দেখলাম, সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, হাতে একটা তलवार। আমাকে বলছে, “আমার গল্প শোনো…”
আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। চারদিকে অন্ধকার। কিন্তু সেই স্বপ্নের কথা মনে থেকে গেল। মনে মনে জানি, এই রহস্যের সমাধান করতে হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার আগে অভিজিতের সঙ্গে দেখা করলাম। ডায়েরি আর ছবিটা দেখিয়ে সব খুলে বললাম। অভিজিতের চোখ ছানিছানি হয়ে গেল। সে জানালো, এই এলাকায় কখনও কোনো বিদেশী মেয়ের কথা শোনা যায়নি। তবে, একটা কাহিনী প্রচলিত আছে – বিদ্রোহের সময়, এক বিদ্রোহী দলের নেতা নাকি এই এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু কেউ কখনও তাঁকে দেখেননি, শুধু রাতের অন্ধকারে তাঁর তলোয়ারের ঝলকানি দেখা যেত।
অভিজিতের কথা শুনে আমার মনে একটা ধারণা হলো। হয়তো সেই বিদ্রোহী নেতা আর এই ছবির মেয়ে কোনোভাবে জড়িত। কিন্তু কীভাবে? আর কেন তাঁকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল?
ডায়েরিটা পড়তে পড়তে আরও কিছু তথ্য পেলাম। যতীন্দ্রনাথের লেখা অনুসারে, বিদ্রোহের শেষের দিকে ব্রিটিশরা এক গুরুত্বপূর্ণ নথি হাতছাড়া করে। সেই নথিতে বিদ্রোহীদের গোপন পরিকল্পনা লেখা ছিল। যতীন্দ্রনাথ মনে করতেন, সেই নথিটা ব্রিটিশদের হাতে না পড়ুক, সেজন্যেই কোনো বিদ্রোহী সেটা নিয়ে পালিয়ে গেছেন।
মনে মনে ভাবলাম, হয়তো এই নথিটা নিয়েই পালিয়ে গিয়েছিলেন সেই বিদ্রোহী নেতা, আর তাঁকে সাহায্য করেছিলেন যতীন্দ্রনাথ। আর সেই বিদ্রোহী নেতা হলেন এই ছবির রহস্যময়ী মেয়েটি! কিন্তু কেন তাঁর পোশাক সাধারণ বাঙালি মেয়েদের পোশাকের চেয়ে আলাদা? আর তিনি কোথায় গেলেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে লাগলাম। কলকাতার ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার খুঁজে মুখিয়ে পড়লাম। পুরনো খবরের কাগজপত্র, বিদ্রোহের সময়কার নথিপত্র – সব কিছুই ঘাঁটতে লাগলাম। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ কেটে গেল। হঠাৎ একদিন, এক পুরনো খবরের কাগজে চোখ আটকে গেল।
খবরে লেখা ছিল – ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ভারতে এসেছিলেন এক ইতালীয় বিপ্লবী, লুচিয়া মাজ্জিনি। খবরে ছিল তাঁর ছবিও। সেই ছবিতে মেয়েটির সঙ্গে অবিশ্বাস্য মিল!
আমার হাত-পা কাঁপতে শুরু করলো। লুচিয়া মাজ্জিনি! ইতালির বিখ্যাত বিপ্লবী জোসেফ মাজ্জিনির বোন। তিনি কি এসেছিলেন ভারতে? আর যতীন্দ্রনাথ তাঁকে সাহায্য করেছিলেন? কিন্তু ইতিহাসে তো তাঁর কোনো উল্লেখ নেই!
এই রহস্যের সমাধান খুঁজতে আরও জোর দিলাম। মাসের পর মাস কঠিন পরিশ্রমের পর, অবশেষে আরো কিছু তথ্য পেলাম। ইতালির একটা ছোট্ট সংবাদপত্রে লুচিয়ার একটা সাক্ষাৎকার পেলাম। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, কিভাবে ভারতে বিদ্রোহীদের সাহায্য করতে এসেছিলেন। কিন্তু বিদ্রোহ ব্যর্থ হওয়ার পর, ব্রিটিশদের হাতে না ধরা পড়ার জন্য তাকে গোপনে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। যতীন্দ্রনাথ রায়ের সাহায্যে তিনি মতিঝিলের এই গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন।
লুচিয়া আরো লিখেছিলেন, যতীন্দ্রনাথ তাকে বিদ্রোহের গোপন পরিকল্পনা লেখা নথিটা দিয়েছিলেন। সেই নথি নিয়েই তিনি ইতালি ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানে সেই নথিটা বিদ্রোহীদের কাজে লাগানো হয়, যা পরবর্তী বিপ্লবের জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়।
লুচিয়ার লেখা পড়ে আমার গায়ে কাঁটা দাঁড়িয়ে গেল। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে যাওয়া এক বিদ্রোহী নারীর গল্প, ভারত ও ইতালির বিপ্লবের অজানা সম্পর্ক – সবকিছুই যেন হঠাৎ করে ফুটে উঠল।
আমি এই গল্পটা লিখব, ঠিক করে ফেললাম। যতীন্দ্রনাথের ডায়েরি, লুচিয়ার সাক্ষাৎকার, আর মতিঝিলের সেই গোপন পথ – এই সবকিছু জুড়ে দেব আমার উপন্যাসে। যাতে সকলে জানতে পারে, লুচিয়া মাজ্জিনির মতো নারীরাও ছিলেন, যাঁরা নিজের দেশের সীমা পেরিয়ে এসে লড়াই করেছিলেন স্বাধীনতার জন্য।
কয়েকটা বছর লেখালেখির পর, উপন্যাসটা শেষ করলাম। বইটা বেরোলো, আর হঠাৎ করেই হই গেল বেস্টসেলার। লোকে পড়লো, আলোচনা করলো। লুচিয়া মাজ্জিনির নাম, তাঁর সাহসিকতার কাহানি-র অজানা অধ্যায় – সবকিছুই মানুষের মনে গেঁথে গেল।
মতিঝিলের সেই পুরনো বাড়িটাও আর একাকী থাকলো না। ইতিহাসের সাক্ষী এখন আর পর্যটকদের কাছে একটা আকর্ষণের কেন্দ্র। আর আমি, অহনা, সেই বাড়ির গল্প বলে দিলাম সকলকে। লুচিয়া মাজ্জিনির গল্প বলে দিলাম পৃথিবীকে।