এক ছিল গ্রাম। সেই গ্রামের নাম ছিল সোনাপুর, এবং এখানে বাস করত ছোট্ট একটি মেয়ে যার নাম লিলি। লিলি ছিল খুবই চঞ্চল আর কৌতূহলী। তার নরম নরম চুল আর উজ্জ্বল চোখের মায়াবী দৃষ্টিতে যেন সবসময়ই কোনো রহস্য লুকিয়ে থাকত। দিনভর লিলি গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়াতো, ফুলের গন্ধ নিতো, রঙ-বেরঙের প্রজাপতির পেছনে দৌড়াতো আর মাঝে মাঝে পুকুরের পাশে বসে রূপকথার গল্পের বই পড়তো।
লিলির পরিবার বলতে ছিল তার দিদা, মাধবী দিদা। মাধবী দিদা ছিলেন গল্পকথার এক জাদুকর। প্রতি রাতেই লিলির ঘুম পাড়ানোর আগে দিদা তাকে এক একটি জাদুকরি গল্প শোনাতেন। আর সবচেয়ে প্রিয় ছিল দিদার তারা দেখার গল্প। দিদা বলতেন, “আকাশের তারারা কেবল আলোর বিন্দু নয়, ওদেরও আমাদের মতো মন আছে, রাগ আছে, আনন্দ আছে।” এ কথা শুনে লিলির মন ভরে যেত। সে ভাবত, আকাশের তারা কি সত্যিই আমাদের মতো কথা বলে, হাসে? তারাও কি ছোট ছোট ইচ্ছা পূরণের জন্য অপেক্ষা করে?
এক রাতে, ঠিক এমনই গল্প বলছিলেন মাধবী দিদা। বাইরে পূর্ণিমার আলোতে গোটা গ্রাম ঝলমল করছিল। বাতাসে ছিল মৃদু মৃদু গন্ধ, যেন দূর থেকে কেউ ফুল ছড়িয়ে দিয়েছে। লিলি তখন বিছানায় বসে, দিদার মুখের দিকে তাকিয়ে গল্প শুনছিল। দিদা বলছিলেন, “লিলি, আকাশের তারারা এক এক সময় এক এক রকম থাকে। কিছু তারা খুব হাসিখুশি আর ঝলমল করে, কিছু তারা চুপচাপ আলোর ছটায় ম্লান হয়ে থাকে। আর কিছু তারা তো আবার লুকিয়ে থাকে, যেন কৌতূহলে আমাদের দেখে।”
লিলি মুগ্ধ হয়ে বলল, “দিদা, আমি যদি একবার তারাদের দেশে যেতে পারতাম! আমি ওদের সাথে কথা বলতাম, জানতে চাইতাম ওদের সব গোপন কথা।”
দিদা হেসে বললেন, “তুমি তো সত্যিই কৌতূহলী, আমার মেয়ে। আচ্ছা, যদি একদিন সত্যি তোমার ইচ্ছে পূরণ হয় আর তুমি তারাদের সাথে দেখা করতে পারো, তাহলে কেমন হবে?”
লিলির চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে কল্পনা করতে লাগল, যদি সত্যিই একদিন সে তারাদের দেশে যেতে পারে! সেই কল্পনায় ডুব দেওয়ার সাথে সাথে লিলির মনে আরো অনেক প্রশ্ন জমা হলো। আচ্ছা, তারা কি আমাদের মতো খেলতে পারে? তারা কি কখনো গাছের পাতার মত ঝরে পড়ে?
সেই রাতে, মাধবী দিদা গল্প শেষ করে যখন লিলিকে শুইয়ে দিলেন, তখন লিলি আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা ইচ্ছা করল—“তারাদের সাথে দেখা করব, ওদের সাথে মজা করব।”
তারপর হঠাৎ করেই, এক অদ্ভুত জাদুকরি ঘটনা ঘটল। একটু ঠাণ্ডা হাওয়া লিলির চারপাশে ঘুরতে লাগল, যেন তার কথা শুনে আকাশের তারারা হাসছে। বাতাসের সেই কোমল স্পর্শে লিলির শরীরে একটা আনন্দের স্রোত বয়ে গেল। ধীরে ধীরে সে অনুভব করল, তার পা যেন মাটিতে নেই। সে হালকা হয়ে উঠেছে, যেন বাতাস তাকে উপরে তুলে নিচ্ছে।
লিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, সে সত্যিই আকাশের দিকে ভাসছে! গ্রামটাকে নিচে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো দেখা যাচ্ছে, আর তার চারপাশে আকাশের তারা তাকে ঘিরে হাসছে। সে অবাক হয়ে ভাবল, “আহা, এটা কি সত্যিই ঘটছে?”
তারপর লিলি দেখতে পেল দূরে একটি আলোকিত পথ, যেন তারাদের হাত ধরে গড়া কোনো সেতু। সেই পথ ধরে সে আরো উপরে উঠতে লাগল। প্রত্যেকটি তারা যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে, কেউ হালকা আলোয় মৃদু হাসছে, কেউ আবার ঝলমল আলো ছড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ তার পাশে এসে বলল, “লিলি, তুমি আমাদের মাঝে এসেছ! আমাদের জগতে তোমাকে স্বাগতম!”
লিলির মনে হল যেন স্বপ্নে রয়েছে। সে তাদের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা কি সত্যিই কথা বলতে পারো? আমি শুনতে চেয়েছিলাম তোমাদের গল্প, তোমাদের হাসি-কান্নার কথা।”
এক উজ্জ্বল তারা, যার নাম ছিল রূপা, লিলির দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, আমরা কথা বলি। আমরা আকাশের গল্প, মানুষের ইচ্ছা আর ভালোবাসার কথা শুনি। আমরা মানুষদের ছোট ছোট ইচ্ছা পূরণ করি। তবে আমাদের কাছে আসতে হলে তোমার মনে ভালোবাসা আর বিশ্বাস থাকতে হবে।”
লিলি মুগ্ধ হয়ে রূপার কথা শুনতে লাগল। সে ভাবল, এতদিন দিদার গল্পে যা শুনেছিল, তা সব সত্যি! তারারা আসলেই কথা বলে, তাদেরও মন আছে। সে আবেগে বলল, “আমি তোমাদের সাথে এইসব রহস্য জানতে চাই, তোমাদের বন্ধু হতে চাই।”
তারা সবাই হাসতে লাগল। এরপর রূপা আর তার অন্যান্য তারা বন্ধুরা লিলিকে নিয়ে খেলতে শুরু করল। কেউ তার চারপাশে নাচতে লাগল, কেউ আবার আলো দিয়ে সুন্দর সুন্দর নকশা আঁকতে লাগল। সেই সময় লিলির মন এতটাই খুশি হয়ে গেল যে সে বুঝতেও পারল না কত সময় কেটে গেছে।
কিছুক্ষণ পর, রূপা বলল, “লিলি, আমরা তোমাকে আরও একটি গোপন কথা বলতে চাই। আমাদের মধ্যে প্রতিটি তারা একটি বিশেষ ইচ্ছা পূরণ করতে পারে, কিন্তু সেই ইচ্ছা পূরণে একটাই শর্ত আছে—তোমাকে ভালোবাসা আর দয়ার মাধ্যমে মানুষের কাছে সেই জাদু ছড়িয়ে দিতে হবে।”
লিলি একমনে শুনছিল। তার মনে অদ্ভুত এক ভালো লাগা অনুভব হলো। সে বলল, “আমি তো গ্রামে ফিরে গিয়ে আমার বন্ধুদেরও এই জাদুর কথা জানাতে চাই।”
রূপা বলল, “তা হলে শোন, লিলি, আমরা তোমাকে কিছু বিশেষ জাদুর উপায় শিখিয়ে দেব। তুমি এই জাদু নিয়ে গ্রামে ফিরে যাবে আর সেখানে সবাইকে সুখী করার চেষ্টা করবে। তবে মনে রেখো, যেকোনো ভালো কাজই সত্যিকারের জাদুর চাবি।”
তখনই হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এল এক মৃদু আলোর কণ্ঠস্বর, যেন রাত শেষ হওয়ার সংকেত দিচ্ছে। লিলি একটু মন খারাপ করে বলল, “এত তাড়াতাড়ি রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে? আমি তো আরও থাকতে চাই!”
রূপা হেসে বলল, “আবার দেখা হবে, লিলি। ততদিন তোমার হৃদয়ে আমাদের ভালোবাসা আর সেই জাদু নিয়ে থাকো। আর যেকোনো সময় আকাশের দিকে তাকালেই আমাদের স্মরণ করতে পারবে।”
এই বলে তারা সবাই একসাথে বিদায় জানাল লিলিকে। লিলির মনে হল যেন সে নীচের দিকে ধীরে ধীরে নেমে আসছে। তার চারপাশের তারা বন্ধুরা আলোর ঝিলিক দিয়ে বিদায় জানাল। তার চোখ বুজে এল, আর যখন সে আবার চোখ খুলল, দেখল সে বিছানায় শুয়ে আছে। কিন্তু তার হাতের মুঠোয় এক উজ্জ্বল তারাময় লকেট। লিলি মিষ্টি হেসে ভাবল, “সত্যিই আমি তারাদের দেশে গিয়েছিলাম।”
পরের রাতে লিলি আকাশের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করল, আবার যেন সেই তারা বন্ধুদের সাথে দেখা হয়। কিন্তু তারপরই মনে হল, ওদের সাথে আবার দেখা করতে হলে তাকে প্রথমে গ্রামের সবার জন্য কিছু করতে হবে। তার নিজের ভালোবাসা আর দয়া দিয়ে সত্যিকারের জাদুর ছোঁয়া দিতে হবে।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - প্রেমের অভিশাপ: "প্রেমের অভিশাপ" একটি রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প যেখানে শিখা তার মায়ের অতীতের গোপনীয়তা ও একটি দুষ্ট শক্তির বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে। রহস্য ও উত্তেজনা অপেক্ষা করছে! সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
তারাদের জগতে প্রবেশ
লিলি ধীরে ধীরে আকাশের দিকে ভাসতে লাগল। তার চোখে-মুখে যেন কল্পনার আলো এসে পড়ল। এ কোন জগৎ! চারদিকে তারার ছড়াছড়ি। নীল আকাশের মাঝে ঝলমল করে ওঠা লক্ষ লক্ষ তারা যেন তাকে স্বাগত জানাচ্ছে। তার ছোট্ট মন বিস্ময়ে ভরে উঠল।
সামনে তাকিয়ে লিলি দেখতে পেল এক রহস্যময় সেতু। সোনালী আলো দিয়ে তৈরি সেই সেতুর প্রতিটি ধাপে জাদুকরি ছোঁয়া, যেন প্রতিটি তারার হাত ধরে সে নতুন কোন দেশে প্রবেশ করছে। এক এক করে সেই সেতু পেরিয়ে সে এক বিস্ময়কর দুনিয়ায় পৌঁছাল। চারপাশে অসংখ্য তারা ঝিকমিক করছে। কেউ বড়, কেউ ছোট, কেউ উজ্জ্বল, কেউ আবার একটু ম্লান। কিন্তু প্রতিটি তারার মধ্যে একরকম জীবন্ত ভাব।
একটি উজ্জ্বল তারা, যার নাম ছিল রূপা, হাসিমুখে লিলির দিকে এগিয়ে এল। রূপা ছিল আকাশের সবচেয়ে ঝলমলে তারাগুলির মধ্যে একটি, আর তার আলোয় চারপাশ যেন ঝিকমিক করে উঠল। রূপা বলল, “স্বাগতম, লিলি! এই আমাদের তারাদের জগৎ।”
লিলি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল এই যেন এক স্বপ্ন, যেখানে সে এতদিন দিদার গল্পে শুনেছে। সে ভয়ে ভয়ে বলল, “তোমরা কি সব সময় এভাবে আকাশে নাচ করো?”
রূপা হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমরা সবসময় আনন্দে থাকি, নাচি, গাই। আমাদের মাঝে নানা ধরনের তারারা আছে। আসো, তোমাকে আমাদের বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।”
তারা মিলে এগিয়ে গেল আরও কিছু দূরে, যেখানে কয়েকজন তারা একসাথে গোল করে বসে গল্প করছিল। প্রথমে লিলির দেখা হলো ছোট্ট একটি তারার সাথে, তার নাম ছিল টুকটুকি। টুকটুকির আলো ছিল নরম, কিন্তু সে খুব চঞ্চল আর মজার। টুকটুকি বলল, “লিলি, তুমিই প্রথম মানুষ যাকে আমি দেখছি! তোমার সাথে অনেক মজা হবে।”
তারপর পরিচয় হলো উজ্জ্বল আর স্থির এক তারার সাথে, যার নাম ছিল শশী। শশী খুব শান্ত আর চিন্তাশীল। সে বলল, “লিলি, আমরা এক এক ধরনের। কেউ চঞ্চল, কেউ শান্ত। আমরা সবাই মিলে এই আকাশের সুন্দরতা তৈরি করি।”
লিলি মুগ্ধ হয়ে এক এক তারার দিকে তাকিয়ে থাকল। সে ভাবল, এত রকমের তারারা এখানে একসাথে আছে, অথচ কেউ কাউকে বিরক্ত করে না, বরং সবাই মিলে কত সুন্দর একতার সাথে থাকে। এই ভাবতে ভাবতেই লিলি দেখতে পেল আরও কিছু তারা, যারা মৃদু সুরে গান গাইছিল। তাদের গানের সুর এতই কোমল আর মিষ্টি ছিল যে লিলি মুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল।
এমন সময় হঠাৎ একটি তারার কান্নার শব্দ শোনা গেল। লিলি অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখল, ছোট্ট আর নরম আলোয় জ্বলতে থাকা এক তারা এক পাশে বসে চুপচাপ কাঁদছে। লিলি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কাঁদছো কেন? তোমার কি মন খারাপ?”
ছোট্ট তারাটি মাথা নীচু করে বলল, “আমার নাম ঝিলিক। আমার আলো খুব কম, তাই অন্য তারারা আমাকে দেখে হাসে। আমি চাই আমি যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারি।”
লিলি তার ছোট্ট হাতে ঝিলিককে ছুঁয়ে বলল, “ঝিলিক, সবাই তো এক রকম হতে পারে না। তুমি তোমার মতো সুন্দর। তোমার আলোর কোমলতাতেই তো আসল সৌন্দর্য। সবাই তো উজ্জ্বল হলে আকাশের মাধুর্য থাকত না।”
লিলির কথা শুনে ঝিলিক একটু হাসল আর বলল, “তুমি সত্যি মনের কথা বলেছ, লিলি। এবার থেকে আমি আমার মতোই খুশি থাকতে চেষ্টা করব।”
তাদের কথা শুনে অন্য তারারাও এগিয়ে এল। তারা সবাই ঝিলিককে উৎসাহ দিতে শুরু করল, আর ঝিলিক ধীরে ধীরে আবার হাসতে শুরু করল। এই আনন্দঘন মুহূর্তে চারপাশে সুরের ঝঙ্কার বেজে উঠল, যেন আকাশে এক নতুন সুরের মেলা বসেছে।
এরপর, রূপা বলল, “লিলি, এবার আমরা তোমাকে এক বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাব। তুমি কি প্রস্তুত?”
লিলি আগ্রহে বলল, “হ্যাঁ, আমি যেতে চাই।”
রূপা আর অন্য তারারা তাকে নিয়ে গেল এক সুন্দর স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল ঝরনার কাছে। সেই ঝরনায় ছিল এক আশ্চর্য জাদু। যখন কেউ তার ইচ্ছা প্রকাশ করত, তখন ঝরনার পানিতে সেই ইচ্ছার প্রতিচ্ছবি দেখা যেত। লিলি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা কি?”
রূপা বলল, “এই ঝরনায় আমাদের প্রত্যেকের ইচ্ছার ছোঁয়া আছে। তুমি এখানে তোমার সবচেয়ে গভীর ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারো, আর ঝরনা তোমাকে সেই ইচ্ছা পূরণের পথে সাহায্য করবে।”
লিলি মুগ্ধ হয়ে নিজের ইচ্ছার কথা ভাবতে লাগল। সে ভাবল, যদি সে এই আকাশে তারাদের সাথে আরো কিছুদিন থাকতে পারত! কিন্তু তখনই তার মনে হলো, তার দিদা তো তাকে খুঁজবে। তার মনে একটু কষ্ট হলো, সে ভাবল, “দিদা কি আমার কথা ভাবছেন?”
রূপা তার মনের কথা বুঝে বলল, “লিলি, আমরা জানি তোমার খুব ইচ্ছে আমাদের সাথে থাকতে। কিন্তু পৃথিবীতে তোমার নিজের দিদা আছে, তোমার নিজের গ্রাম আছে। তুমি তাদের ছেড়ে বেশিদিন থাকতে পারবে না। তবে আমরা চাই তুমি আবার ফিরে আসো, আমাদের সাথে খেলা করো।”
লিলি একটু মন খারাপ করল, কিন্তু তার মনে এক নতুন আশা জাগল। সে ভাবল, “যদি সত্যিই আমি আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে তো খুবই ভালো হবে।” সে ঝরনার পানিতে হাত রাখল আর মনে মনে বলল, “তারাদের দেশে আমি যেন আবার আসতে পারি, আরও অনেকবার ওদের সাথে গল্প করতে পারি।”
ঝরনা হালকা আলো দিয়ে ঝিলমিল করে উঠল, যেন তার ইচ্ছা শুনে তারাও খুশি হয়েছে। রূপা আর টুকটুকি তার হাত ধরে বলল, “চলো লিলি, এবার তোমাকে বিদায় জানাই। আবার দেখা হবে।”
তারপর ধীরে ধীরে লিলি আকাশ থেকে নেমে আসতে লাগল। তার চারপাশে এক এক করে তারারা বিদায় জানাচ্ছিল। টুকটুকি শেষবারের মতো তার কাছে এসে বলল, “লিলি, আবার দেখা হবে। এই আকাশের দিকে তাকালেই আমাদের স্মরণ করবে।”
এই বলে লিলি মাটির দিকে ধীরে ধীরে নামতে লাগল। সে মনে মনে ভাবল, এই যাত্রা তার জীবনের এক আশ্চর্য অভিজ্ঞতা। সে জানে, আবার যখন আকাশের দিকে তাকাবে, তারার জগতে তার সেই বন্ধুদের স্মরণে সে মনে মনে হাসবে।
তারাদের গল্প শোনা
আকাশের ওই বিশাল বিস্তৃতির মাঝে লিলি যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিল। চারদিকে তারার স্নিগ্ধ আলো, আর তারারাদের মিষ্টি মিষ্টি হাসির শব্দে তার মন আনন্দে ভরে উঠল। ঠিক তখনই রূপা, সেই উজ্জ্বল তারাটি, লিলির পাশে এসে বসে বলল, “লিলি, আমরা প্রতিদিন অনেক কিছু দেখি, অনেক অভিজ্ঞতা হয় আমাদের। চাও কি আমাদের কিছু গল্প শোনাতে?”
লিলি উত্তেজনায় বলল, “ওহ! গল্প শুনতে আমি খুব ভালোবাসি। বলো না, তোমাদের গল্প কেমন হয়?”
রূপা মিষ্টি হেসে বলল, “ঠিক আছে, তাহলে শুনো। শুরু করি আমার প্রিয় বন্ধু মণির গল্প দিয়ে।”
মণি ছিল এক ছোট্ট, শান্ত তারা। সে খুব লাজুক ছিল এবং অন্য তারার চেয়ে একটু ম্লান আলো নিয়ে আকাশে জ্বলত। মণি তখন মাথা নীচু করে একটু লজ্জার সাথে হাসল। তার কণ্ঠে মৃদু সুরের ছোঁয়া ছিল, যা শুনে মনে হয় সে আসলে কত কোমল। মণি একটু থেমে বলল, “আমি আকাশের অনেক কাহিনি শুনি আর আমার মনে মনে তাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি। তবে আমি সবার সামনে সেগুলো বলি না।”
লিলি আগ্রহে মণির দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি একটু বলবে আমাকে? আমি খুব শুনতে চাই তোমার কাহিনি।”
মণি লাজুকভাবে শুরু করল, “একদিন আমি আর রূপা একসাথে রাতের আকাশে জ্বলছিলাম। তখন হঠাৎ আমরা একটা ছোট্ট গ্রাম দেখতে পেলাম। গ্রামের লোকেরা খুব ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরছিল। তাদের কষ্ট দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তখনই আমি আমার আলো দিয়ে সেই গ্রামের ওপর আলোকিত করতে শুরু করলাম। তারা যেন একটু আনন্দ পায়, এই ইচ্ছাতেই আমার আলোর জাদু দিয়ে তাদের মন ভালো করার চেষ্টা করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রামের মানুষজন আমাদের আলো দেখে আনন্দে নাচতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে আমার মনে হলো, আমার ম্লান আলোও কারো মুখে হাসি এনে দিতে পারে।”
মণির কথা শুনে লিলি গভীরভাবে ভাবল। সে বুঝল, যে মণি নিজের ছোট আলো দিয়ে কত বড় আনন্দ দিয়েছে। তার মনে হলো, হয়তো আমাদের সবার মধ্যে একটা বিশেষ জাদু আছে, যা অন্যদের মুখে হাসি ফোটাতে পারে।
এই সময় আরও কয়েকটা তারা লিলির চারপাশে এসে জড়ো হলো। তাদের মধ্যে ছিল ঝিনুক আর সুর। ঝিনুক একটু মজারু ধরনের তারা ছিল। সে সবসময় হাসি-তামাশায় মেতে থাকত। আর সুর ছিল এক দারুণ সুরের তারকা। সে এমন এক তারা ছিল যার আলোতে মৃদু মৃদু সুর বাজত। লিলি একে একে তাদের সবার গল্প শুনতে লাগল।
ঝিনুক হাসতে হাসতে বলল, “আচ্ছা লিলি, তুমি জানো, আমি একবার ভূতুড়ে মেঘের সাথে মজা করেছিলাম?”
লিলি অবাক হয়ে বলল, “ভূতুড়ে মেঘ মানে কী?”
ঝিনুক তার মজার কাহিনি বলতে শুরু করল, “হ্যাঁ, সেদিন আকাশে একটা বড় মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছিল, একদম অন্ধকার। আমি ভাবলাম, তার সঙ্গে একটু দুষ্টুমি করি। আমি গিয়ে তার পেছনে লুকিয়ে আমার আলোটা বন্ধ করে দিলাম। সে কিছু বুঝতে পারল না। আর তারপর হঠাৎ আলো জ্বেলে তাকে ভয় দেখালাম। মেঘটা ভয়ে কাঁপতে লাগল, আর শেষে সে জোরে বাতাস ছেড়ে পালিয়ে গেল। সেই দেখে আমার এত হাসি পেল যে আমি রাতভর নাচতে নাচতে হাসতে থাকলাম।”
ঝিনুকের কথা শুনে লিলি হেসে কুটিপাটি। সে ভাবল, তারারাও এত মজার হতে পারে! এরপর সুর ধীরে ধীরে মৃদু গলায় বলল, “আমার তো অন্য রকম অভিজ্ঞতা আছে। আমি এক রাতে একটা ছোট্ট শিশুর কান্না শুনেছিলাম। তার মা তখন তাকে কোলে নিয়ে বসেছিল, কিন্তু সে কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। তখন আমি আমার সুর মেলাতে শুরু করলাম। আমার আলোর সুরে শিশুটি মিষ্টি ঘুমিয়ে পড়ল। সেই মায়ের মুখের হাসিটা আজও আমার মনে আছে।”
লিলি বিস্ময়ে সুরের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই তারাদের জগতে যেন এক এক তারার নিজস্ব গল্প, নিজেদের এক এক রকম অভিজ্ঞতা।
রূপা তখন একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “লিলি, আমাদের গল্প শোনার জন্য ধন্যবাদ। আমরা তারারা আকাশে থেকে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে আনন্দ দিতে চেষ্টা করি। তোমার পৃথিবীতে কেউ যদি কখনো মন খারাপ করে, তবে তারা যেন আকাশের দিকে তাকায়। কারণ আমরা সবাই আমাদের আলো দিয়ে তাদেরকে সুখী করার চেষ্টা করি।”
লিলি এই কথাগুলো শুনে ভাবল, সত্যিই তো! তারারা শুধুমাত্র আকাশে ঝলমল করে না, তারা পৃথিবীর মানুষদের আনন্দ আর স্বস্তি দিতেও সাহায্য করে। সে মনের মধ্যে এই সুন্দর ভাবনা নিয়ে চারপাশে তাকিয়ে বলল, “তোমাদের গল্পগুলো সত্যিই অসাধারণ। আমি কখনো ভাবিনি যে আকাশের তারারাও এত কাহিনি লুকিয়ে রাখে।”
রূপা হাসিমুখে বলল, “এখনো তো সব গল্প শেষ হয়নি, লিলি। আরও অনেক গল্প আছে। কিন্তু আজ তো তোমার ঘুমোবার সময়। আমরা চাই তুমি আবার আমাদের কাছে ফিরে আসো, তখন আরও অনেক গল্প শুনবে।”
লিলি একটু মন খারাপ করল, কিন্তু মনে মনে আনন্দেও ভরে উঠল। সে জানে, আবার এই তারার জগতে ফিরে আসতে পারবে। আকাশের এই রহস্যময় জগত তার জন্য অপেক্ষা করছে।
সেই রাতে লিলি তারার দেশের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। তার চোখের পাতায় ঝিলমিল তারার আলো যেন নাচতে লাগল। মনে হলো, এই তারারা তাকে ডেকে বলছে, “আবার আসবে, লিলি। আমাদের জগতে আবার গল্প শুনতে আসবে।”
ছোটদের রূপকথার গল্প - মায়াবী বনভূমি: "মায়াবী বনভূমি" - একটি আকর্ষণীয় ছোটদের গল্প যা রূপকথার গল্পের মতো জাদু ও শিক্ষার সমন্বয়ে ভরা। এলারার ভালোবাসা ও যত্নে জাগ্রত বনভূমি শিশুদের মনে আনন্দ ও বন্ধুত্বের বার্তা ছড়িয়ে দেবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
ইচ্ছা পূরণের জাদু
আকাশের তারার জগতে লিলি এক আশ্চর্য অনুভূতিতে ভেসে যাচ্ছে। চারপাশে অগণিত তারা, সবাই যেন তাকে নিয়ে আনন্দে নাচছে, খেলছে। রূপা, ঝিনুক, সুর আর মণি—সবাই যেন তার ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছে। লিলি তাদের কাছে জানতে চাইল, “তোমরা মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতে পারো? কেমন করে সেটা সম্ভব?”
রূপা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, লিলি, আমরা মানুষের ইচ্ছা পূরণ করি। তবে সেটা খুব সহজ নয়। শুধু তাদেরই ইচ্ছা পূরণ হয়, যাদের হৃদয়ে সৎ ইচ্ছে আর ভালোবাসা থাকে। যারা অন্যের জন্য ভালো কিছু করতে চায়, তাদের ইচ্ছাগুলোই আমরা সত্যি করি।”
লিলি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল। সে ভাবল, “তাহলে যদি আমি আমার গ্রামের সবার জন্য কিছু করতে চাই, তবে কি তাদেরও ইচ্ছা পূর্ণ হবে?”
মণি স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “হ্যাঁ, লিলি। তোমার মনে যদি সত্যি ইচ্ছা থাকে অন্যের ভালো করার, তবে আমরা তোমার সেই ইচ্ছাকে পূর্ণ করার শক্তি দেব।”
লিলির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। তার মনে হলো, এই আশ্চর্য ক্ষমতার মাধ্যমে সে তার গ্রামের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে। কিন্তু কীভাবে? এই জাদুটা সে কীভাবে কাজে লাগাতে পারে?
ঝিনুক তখন হেসে বলে উঠল, “তাহলে শুরু করো, লিলি। আমরা সবাই তোমার সাহায্য করতে প্রস্তুত। তোমার যদি সত্যিকারের ইচ্ছা থাকে, তবে তুমি আমাদের সঙ্গে নতুন এক যাত্রায় নামতে পারো, যেখানে ভালোবাসা আর সহানুভূতির শক্তি তোমাকে সাহায্য করবে।”
লিলি একটুখানি দ্বিধায় পড়ে গেল। এই যাত্রা ঠিক কেমন হতে পারে? সে একটু ভয় পেলেও তার ভেতর থেকে একটা সাহসের সুর এসে তাকে ভরসা দিল। সে বলল, “তবে চল, আমি প্রস্তুত। তোমাদের সঙ্গে এই জাদুময় যাত্রায় যেতে আমার ভালো লাগবে।”
এই কথা শুনে রূপা, ঝিনুক, সুর আর মণি সবাই খুশিতে ঝলমল করতে লাগল। তারা লিলিকে তাদের জাদুর গোপন রহস্য শেখাতে শুরু করল। তারা বলল, “তুমি যখন সত্যিকার ইচ্ছা করবে কারও জন্য, তখন তোমার হৃদয়ের আলোয় সেই ইচ্ছা আলোকিত হবে। সেই আলো দেখে আমরা বুঝতে পারব, তুমি সৎ পথে আছ। তারপর আমরা সবাই মিলে সেই ইচ্ছা পূর্ণ করার শক্তি তোমাকে দেব।”
লিলি আশ্চর্য হয়ে শিখতে লাগল। তার মনে সাহস আর ভালোবাসা মিশে এক নতুন শক্তির জন্ম দিল। সে ভাবল, এবার সে গ্রামের মানুষের জন্য কিছু ভালো কাজ করবে, তাদের ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজের ছোট্ট অবদান রাখবে।
তখনই হঠাৎ, লিলির সামনে একটি ছোট্ট নীল আলো ঝিকমিক করতে শুরু করল। সেই আলো আসলে আকাশের এক অন্য তারার, যার নাম ছিল শুভ। শুভ খুবই রহস্যময় এক তারা ছিল, আর তার বিশেষ ক্ষমতা ছিল মানুষের মনের গোপন ইচ্ছাগুলো দেখতে পারা।
শুভ হাসিমুখে বলল, “লিলি, তুমি কি জানো, তোমার গ্রামের মেয়েটি—ছোট্ট তুলসী—সে খুব ইচ্ছা করে একদিন একটা ছোট পোষা খরগোশ পাবে? ওর মনে অনেক ভালোবাসা, কিন্তু তার ইচ্ছা এখনো পূর্ণ হয়নি।”
লিলি শুনে অবাক হয়ে গেল। সে ভাবল, তুলসী তো সবসময় একটা পোষা প্রাণীর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ওর পরিবারে কেউ হয়তো এটা বুঝতে পারে না। তাই তুলসীর জন্য একটা খরগোশ পাওয়াই তার প্রথম কাজ হবে।
সে মুগ্ধ হয়ে তারাদের বলল, “আমি তুলসীর জন্য একটা খরগোশ আনতে চাই, যা তার সাথী হবে। তাতে ওর স্বপ্ন পূর্ণ হবে, আর ও অনেক খুশি হবে।”
তারারা সবাই মিলে হাসল। রূপা বলল, “তাহলে লিলি, নিজের মনের আলো দিয়ে ইচ্ছা করো। আমরা তোমাকে সাহায্য করব।”
লিলি চোখ বন্ধ করে নিজের মনের গভীর থেকে ইচ্ছা করতে লাগল। তার মনে তুলসীর খুশি মুখটা ভেসে উঠল। সে ভাবল, “তুলসীর জন্য খরগোশ যেন আসে, আর তার মুখে হাসি ফুটুক। ও যেন ভালোবাসা আর আনন্দে ভরে ওঠে।”
তখনই চারপাশে এক মায়াবী আলো ছড়িয়ে পড়ল। রূপা, ঝিনুক, সুর, মণি আর শুভ সবাই মিলিত আলো দিয়ে এক রঙিন জাদুময় মেঘ সৃষ্টি করল, আর সেই মেঘ থেকে ধীরে ধীরে এক ছোট্ট, নরম খরগোশ লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে এলো। খরগোশটির নরম নরম লোম, আর চোখ দুটো যেন মিষ্টি মায়ার ঝলক।
লিলি খুশিতে লাফিয়ে উঠল। তার মনে হলো, সত্যি সে এক জাদুময় জগতে চলে এসেছে, যেখানে ইচ্ছা পূরণের ক্ষমতা আছে। খরগোশটিকে দেখে সে ভালোবাসায় ভরে গেল। মনে মনে ভাবল, এবার তুলসীর স্বপ্ন পূরণ হবে।
তারারা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “তুমি এবার এই খরগোশটিকে গ্রামে নিয়ে যাবে, আর তুলসীর ইচ্ছা পূর্ণ করবে।”
লিলি খরগোশটিকে নিয়ে গ্রামের দিকে রওনা হলো। তার মনে আনন্দের ঢেউ খেলল, কারণ সে জানত, তার ইচ্ছা পূরণের এই জাদু তুলসীর মনকে খুশিতে ভরিয়ে দেবে। তার মনে এখন কেবল একটাই চিন্তা—কিভাবে আরও অনেক মানুষের জন্য সে এই জাদুময় জগতের সাহায্যে কিছু করতে পারে।
কিন্তু এর মধ্যে হঠাৎ আকাশ থেকে একটি মৃদু শব্দ ভেসে এলো। একটি নতুন তারা এসে লিলিকে বলল, “লিলি, তোমার জন্য আরও কিছু বিশেষ কাজ অপেক্ষা করছে। যদি তুমি সত্যি ভালোবাসা নিয়ে কাজ করতে চাও, তবে আমরা তোমার সঙ্গে থাকব সবসময়।”
লিলির মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। সে জানল, তার এই যাত্রা এখানেই শেষ নয়; বরং আরও অনেক মানুষকে খুশি করার জন্য সে তারাদের সাহায্যে নতুন নতুন কাজের খোঁজে এগিয়ে যাবে।
গ্রামে সুখ বিতরণের সংকল্প
আকাশের তারাদের সঙ্গে সময় কাটানোর পর লিলি অনুভব করল তার মনের ভেতর একটা অদ্ভুত আলো জ্বলে উঠছে। তারারা তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে, বিশেষ করে কীভাবে মানুষের মনের গোপন ইচ্ছা আর ছোট ছোট স্বপ্নগুলোকে পূর্ণ করে সবাইকে খুশি করা যায়। লিলি মনে মনে সংকল্প করল, সে তার গ্রামে ফিরে গিয়ে এই জাদুর কথা বন্ধুদের জানাবে আর সবাইকে সুখী করার জন্য নিজের ভালোবাসা আর দয়ার শক্তি কাজে লাগাবে।
তারাদের শেষ বিদায় জানিয়ে লিলি ধীরে ধীরে মাটির দিকে নেমে আসতে লাগল। তার চোখে এক চিলতে আনন্দের ঝিলিক, আর মন ভরে আছে দয়ার অনুভূতিতে। মাটিতে পা রাখতেই সে দেখল, গ্রামের সকলে তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত। কিন্তু তাদের মুখে যেন একরকম ক্লান্তি আর একঘেয়েমির ছাপ।
লিলি ভাবল, “এত মলিন মুখগুলোতে হাসি ফোটানো কি সত্যিই সম্ভব? এই জাদুময় অভিজ্ঞতাগুলো কি সত্যি আমার গ্রামের মানুষের জন্য সুখ আনতে পারবে?” কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তার মনে পড়ল তারাদের দেওয়া শিক্ষা—শুধু ভালোবাসা আর সৎ ইচ্ছা দিয়েই এই যাত্রা শুরু করা সম্ভব।
সে প্রথমে গেল তার বন্ধুর, ছোট্ট বিনুর কাছে। বিনু খুব চুপচাপ মেয়ে; তার সবসময় মনে হত, সে বাকি সবার মতো নয়। লিলি তার কাছে গিয়ে মিষ্টি করে বলল, “বিনু, তুমি কি জানো? তারারা আমার বন্ধু, আর ওরা আমাকে একটা বিশেষ জাদু শিখিয়েছে।”
বিনু অবাক হয়ে বলল, “কী জাদু, লিলি? তুমি সত্যিই তারাদের সঙ্গে কথা বলতে পারো?”
লিলি হাসল, “হ্যাঁ, পারি। আর ওরা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসা দিয়ে মানুষের ইচ্ছা পূর্ণ করা যায়। তুমি কি তোমার কোনো ইচ্ছে বলবে আমাকে?”
বিনু একটু ভেবে বলল, “আমি খুব ইচ্ছা করি আমি যেন একদিন অনেক বড় গল্পের বই পড়তে পারি, যেমন তুমি পড়ো। কিন্তু আমার কাছে ভালো বই নেই, আর পড়াও আমি তেমন জানি না।”
লিলির মনে একরকম তৃপ্তি এল। সে ভাবল, “এই তো! এটা তো খুব সহজ কাজ।” সে তার মনের গভীর থেকে বিনুর ইচ্ছার কথা ভাবল আর মনে মনে ইচ্ছা করল, “তারাদের আলোর ছোঁয়ায় বিনু যেন গল্পের বই পড়তে পারে।”
এমন সময়, লিলির হাতে একটা ছোট্ট রঙিন বই এসে পড়ল, একেবারে ম্যাজিকের মতো। বইটার পৃষ্ঠায় সুন্দর সুন্দর ছবি আর সহজ ভাষায় গল্প লেখা। বিনুর হাতে বইটা তুলে দিয়ে লিলি বলল, “এই নাও, তোমার প্রথম গল্পের বই। এখন থেকে তোমার মন যা চাইবে, আমি চেষ্টা করব তা পূর্ণ করতে।”
বিনু বইটা হাতে পেয়ে খুশিতে লাফাতে লাগল। তার চোখে আনন্দের ঝিলিক, আর সে লিলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি সত্যি এক মায়াবী বন্ধু, লিলি। আমি সবসময় তোমার পাশে থাকতে চাই।”
লিলির আনন্দ হল। সে জানল, এই মুহূর্ত থেকেই তার জাদুময় যাত্রা সত্যি হতে শুরু করেছে।
এরপর সে গেল গ্রামের আরও কিছু মানুষের কাছে। বৃদ্ধ মানিক কাকু, যিনি সবসময় পা টেনে টেনে হাঁটেন, একসময় ছিলেন গ্রামের সব থেকে চঞ্চল মানুষ। তার ইচ্ছা ছিল, একদিন সে আবার ছোটদের সঙ্গে মনের আনন্দে খেলবে। লিলি মনে মনে সেই ইচ্ছার কথা ভাবল আর তারাও যেন একটা ছোট্ট খুশির ঢেউ তুলে দিল মানিক কাকুর মনের গভীরে। কিছুক্ষণ পর, মানিক কাকু হাসিমুখে ছোটদের সঙ্গে খেলা শুরু করলেন। তার চোখে ফিরে এল তারুণ্যের জ্যোতি, যেন তারাও আবার নতুন করে তাকে জীবন দিয়েছে।
লিলি সবার জন্য এমন ছোট ছোট ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে লাগল। গ্রামের মানুষগুলো ধীরে ধীরে আরও হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। যেন প্রতিটি মানুষ নতুন করে বাঁচতে শিখল। লিলি দেখল, তার এক টুকরো ভালোবাসা আর দয়া দিয়ে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে সে তারাদের মতোই আলো ছড়াতে সাহায্য করছে।
কিন্তু এই আনন্দময় মুহূর্তের মধ্যে হঠাৎ, দূর থেকে কে যেন এক ধ্বনি শোনাল। সেই ধ্বনি লিলির কানে আসতেই তার মন একটা অদ্ভুত চিন্তায় ভরে গেল। তার মনে হলো, আরও বড় কিছু কাজ তাকে অপেক্ষা করছে, যেখানে শুধু তার গ্রাম নয়, আরও অনেক মানুষের জন্য সুখ আনতে হবে।
তারার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার সে আকাশের দিকে তাকাল, আর তার মনে হলো যেন তারা বলছে, “লিলি, তোমার জন্য আরও বড়ো কিছু কাজ অপেক্ষা করছে। তুমি কি আরও সাহস নিয়ে সেই যাত্রায় এগোতে চাও?”
লিলির মনে আবার নতুন এক সংকল্প জন্ম নিল। সে ভাবল, এবার সে তার গ্রামের বাইরেও ভালোবাসা আর দয়ার শক্তি ছড়াবে, যেখানে তার প্রয়োজন।
উপহারের সন্ধান
আকাশের তারাদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটানোর পর লিলি অনুভব করল, আজকের এই রাতটা সত্যিই অন্যরকম। মায়াবী আকাশের নীচে তারারা তাকে শুধু নতুন কিছু শিখিয়েই থেমে থাকেনি, বরং একটা বিশেষ জাদুময় অনুভূতি দিয়েছে। তারাদের আলোয় যেন প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি অনুভূতি জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
এমন সময় হঠাৎই রূপা তারা লিলির কাছে এগিয়ে এসে বলল, “লিলি, তুমি আজকের রাতটিকে কখনো ভুলতে পারবে না। কিন্তু, আমরা তোমার জন্য একটা ছোট্ট উপহার রেখেছি, যাতে তুমি আমাদের সবসময় মনে রাখতে পারো।”
লিলি অবাক হয়ে বলল, “উপহার? কীরকম উপহার?”
রূপা তারার আঙ্গুলে ঝলমলে এক লকেট দেখা গেল। সেই লকেটটা যেন আকাশের তারাদের মতোই উজ্জ্বল আর রহস্যময়। লকেটের মধ্যে ছোট ছোট নক্ষত্রের মতো ঝিকিমিকি আলো জ্বলজ্বল করছে। রূপা তারা তার কোমল কণ্ঠে বলল, “এই লকেটের নাম ‘তারাময় স্মৃতি।’ এটা তোমাকে সবসময় মনে করিয়ে দেবে যে, প্রকৃত জাদু আসলে আমাদের সবার ভেতরেই আছে।”
লিলির চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে ধীরে ধীরে লকেটটা হাতে নিল, আর মনে হল যেন তার ছোট্ট হৃদয়টাও এই ঝকঝকে আলোয় ভরে উঠছে। “এত সুন্দর! আমি কি এটা সবসময় রাখতে পারব?” সে জিজ্ঞাসা করল।
রূপা তারা মুচকি হেসে বলল, “হ্যাঁ, লিলি। তুমি এই লকেটটা সবসময় নিজের কাছে রাখতে পারো। যখনই তুমি আমাদের মিস করবে, এই লকেটটা তোমাকে আমাদের স্মৃতি ফিরিয়ে দেবে।”
লিলি লকেটটা বুকে চেপে ধরে বলল, “আমি তোমাদের কখনো ভুলব না। তোমরা সবসময় আমার সঙ্গে থাকবে, এই লকেটের মধ্যে।”
মণি তারা এবার এগিয়ে এসে বলল, “তবে, মনে রেখো লিলি, শুধু এই লকেট নয়, প্রকৃত জাদু তোমার নিজের ভেতরেও আছে। তুমি সেই জাদু দিয়ে অন্যদেরও খুশি করতে পারো।”
লিলির মনে আনন্দে একরকম ঝিলিক খেলে গেল। সে ভাবল, তার তারাময় বন্ধুদের কথা যেন একদম ঠিক। গ্রামের মানুষদের ইচ্ছা পূরণ করতে সে যেমন আনন্দ পেয়েছে, তেমনি এই জাদু আরও অনেকের জন্য ছড়িয়ে দিতে সে বদ্ধপরিকর।
তারা সবাই মিলে লিলিকে তার ফিরে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল। আকাশে আরও বেশি তারার আলো যেন পথকে ঝিকিমিকি করে আলোকিত করে রেখেছে। লিলি আবার তারার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল সে এই জাদুময় অভিজ্ঞতাগুলো সবসময় মনে রাখবে আর তার বন্ধুদের ভালোবাসা ও সুখ ছড়িয়ে দেবে।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে, লকেটের মধ্য থেকে একটা নরম আলো বেরিয়ে এল আর সেই আলোর ঝলকানিতে লিলির মন আনন্দে ভরে উঠল। লকেট থেকে একটা মিষ্টি সুর ভেসে এল, যা তাকে বলল, “এই লকেটটা শুধু স্মৃতি রক্ষার জন্য নয়, বরং তোমাকে সাহস ও ভালোবাসা দেবে, যখনই তুমি কিছু ভালো কাজ করার চেষ্টা করবে।”
লিলির মনে হলো এই লকেটটা শুধুমাত্র একটা জাদুময় স্মৃতি নয়, বরং একটা আশীর্বাদও বটে। এই আশীর্বাদ তাকে নতুন করে শক্তি ও সাহস যোগাবে যখনই সে কাউকে সাহায্য করার ইচ্ছে করবে। লিলি মনস্থির করল, এই লকেটের আলো দিয়ে সে গ্রামের প্রতিটি মানুষকে আনন্দে ভরিয়ে তুলবে।
তবে, তার মনে হলো এই রাতে সে শুধু নিজের গ্রামেই নয়, আরও দূরের মানুষের কাছেও সুখ ছড়াতে চাইছে। তারার আলোয় সে বুঝতে পারল, তার যাত্রা এখানেই শেষ নয়। তার সামনে আরও অনেক রাস্তা আছে, আরও অনেক মানুষ আছে, যাদের জন্য তার ভালোবাসা আর দয়ার জাদু প্রয়োজন।
আকাশে একবার তাকিয়ে তারার উদ্দেশ্যে বলল, “আমি তোমাদের কথা মনে রাখব আর এই লকেটের আলোয় সবসময় ভালো কাজ করব।”
তারারা তাকে আশীর্বাদ জানিয়ে বিদায় দিল। তারা বলল, “লিলি, আমরা সবসময় তোমার পাশে থাকব। তোমার প্রতিটি ভালো কাজেই আমরা তোমাকে সাহায্য করব।”
লিলি তখন খুশিতে মাটির দিকে নামতে লাগল, আর মনে মনে ভাবল, তার এই জাদুময় রাতের গল্পটা সে একদিন অন্যদেরও শোনাবে। এই ভাবনা আর আনন্দ নিয়ে লিলি গ্রামে ফিরে গেল।
বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - চিরন্তন ছোঁয়া: "চিরন্তন ছোঁয়া" – এক হৃদয়ছোঁয়া রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প। কলকাতার প্রেক্ষাপটে মিয়া ও অ্যালেক্সের সৃজনশীলতা ও প্রেমের গল্পে ভালোবাসার গভীরতা ও স্বপ্নপূরণের আবেগে ভরা একটি অনন্য যাত্রা। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
গ্রামে ফিরে আসা
পরের দিন সকালে, সূর্যের সোনালি আলো যখন লিলির ছোট্ট ঘরটাকে আলোকিত করল, তখন লিলি ধীরে ধীরে চোখ মেলল। তার মনে হলো, যেন রাতের সেই জাদুময় অভিজ্ঞতা একটা স্বপ্ন ছিল। কিন্তু ঘুম থেকে উঠে হাতের মুঠোটা খুলতেই সে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল—তার হাতে ছিল সেই ঝকঝকে তারাময় লকেট! লকেটের আলোয় প্রতিফলিত সূর্যের ঝিলিকগুলো দেখে সে এক মুহূর্তের জন্য অভিভূত হয়ে গেল।
লিলি মনে মনে হাসল। আকাশের তারা বন্ধুরা তাকে সত্যিই একটা আশ্চর্য উপহার দিয়েছে। সেই লকেটটা শুধু একটা স্মৃতি নয়; এতে রয়েছে এমন এক শক্তি, যা তার জীবনকে চিরকাল জাদুময় করে রাখবে।
বাইরে এসে সে দেখল, গ্রামের পথ ধীরে ধীরে জনসমাগমে ভরে উঠছে। সকলে নিজের কাজে ব্যস্ত, কেউ জল আনছে, কেউ মাটিতে চাষ দিচ্ছে। লিলি তখন ভাবল, তার গতরাতের সেই জাদুকরি অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে জানানো দরকার। তারাও যদি এই আনন্দ আর ভালোবাসার জাদুর স্বাদ পেতে পারে, তবে কতই না ভালো হবে!
গ্রামের সবচেয়ে বড় বটগাছের নীচে এসে লিলি সবাইকে ডাকতে শুরু করল, “বন্ধুরা, আমি গতরাতে এমন একটা অভিজ্ঞতা পেয়েছি, যা তোমাদেরও জানাতে চাই!”
গ্রামের লোকেরা কৌতূহলী হয়ে জড়ো হতে লাগল। ছোট্ট লিলির মুখে এমন উৎসাহ আর আনন্দ দেখে সবার মনেও কিছুটা উত্তেজনা কাজ করছিল।
লিলি বলতে শুরু করল, “গত রাতে আমি আকাশের তারাদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে—তোমাদের ভালোবাসা আর ছোট ছোট ভালো কাজে কীভাবে আমাদের জীবনও তারা মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে পারে, সেই কথা!”
এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী হাসতে হাসতে বললেন, “তাহলে আমরা কীভাবে তারাদের মতো জ্বলজ্বল করতে পারি, লিলি?”
লিলি তারাময় লকেটটা হাতে তুলে দেখিয়ে বলল, “এই লকেটটা আমাকে মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরেই এক রকমের জাদু আছে। আমরা যখন কাউকে ভালোবাসি, সাহায্য করি, তখন আমাদের সেই জাদু আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর যখন সবাই মিলে ভালো কাজ করি, তখন আমাদের গ্রামও সেই জাদুর আলোয় ঝিকিমিকি করে।”
তার কথা শুনে সবার মন ভরে গেল। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো একদম খুশিতে লাফিয়ে উঠল। একজন বলল, “আমরাও তাহলে ভালো কাজ করব, লিলি!”
লিলি মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ, একদম। প্রতিদিন ছোট ছোট ভালো কাজ করলে আমাদের জীবনও তারা মতো উজ্জ্বল হবে। আর সেই জাদু সবসময় আমাদের পাশে থাকবে।”
সেই দিনের পর থেকে লিলি আর তার গ্রামবাসীরা ছোট ছোট ভালো কাজে মেতে উঠল। কেউ কারও সাহায্য করলে খুশি হয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরত। তাদের হৃদয়ে এক নতুন আনন্দের ছোঁয়া লাগল, যা এক সময় সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল।
প্রতিদিন রাত হলে লিলি আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলত, “ধন্যবাদ, তারারা। তোমাদের জাদু আজও আমাদের মাঝে আছে।”
তারাময় সেই রাতের স্মৃতিতে গ্রামবাসীর জীবন হয়ে উঠল আরও সুন্দর, আরও শান্তিময়। লিলি বুঝল, প্রকৃত জাদু আসলে ছোট ছোট ভালো কাজেই লুকিয়ে আছে।
এভাবেই লিলি গ্রামের সকলকে ছোট ছোট ভালো কাজের মাধ্যমে জীবনকে তারাদের মতো উজ্জ্বল করে তোলার পাঠ দিল। আর সেই দিনের পর থেকে, গ্রামে প্রতিটি মন আলোকিত হল, যেন সবাই একসঙ্গে এক রূপকথার জাদুতে মেতে উঠেছে।