কলকাতার বুকে, নিশ্চুপ এক গলির কোণে থাকে অবন্তী। বিশ বছর বয়সী এই মেয়েটির জীবনে যেন রং নেই। কালো সাদা ছবির মতো, তার চোখে এক অপার বিষণ্ণতা. কারণ? তার মায়ের প্রতি গভীর ক্ষোভ।
অবন্তীর ছোটবেলাটা সুখের ছিল না. তার বাবা মারা যায় যখন সে মাত্র পাঁচ বছর বয়সী। একা হয়ে পড়া মা, সোনামণি, দিনের পর দিন কাজ খুঁজে বেড়াতেন। অবন্তীকে রেখে যেতে বাধ্য হতেন আশ্রমে। অবহেলায় কাটতো তার শৈশব। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে গাঁথা হয়ে যেতো মাঝে মাঝে আশ্রম থেকে বাড়ি ফিরে এসে শূন্য বাড়ি দেখার দৃশ্যটা। মায়ের খোঁজে ছুটতো সে, কিন্তু পেতো না। সন্ধ্যের অন্ধকারে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যেতো সে। এই ঘটনাগুলোই তৈরি করেছিল অবন্তীর মনে এক অগাধ বিদ্বেষের সমুদ্র, তার মায়ের প্রতি।
একদিন সোনামণি জানতে পারে, তার মেয়ে আর আশ্রমে থাকতে রাজি নয়। অবশেষে স্থায়ীভাবে মেয়েকে বাড়িতে রাখার ব্যবস্থা করে। কিন্তু দূরত্বটা কমেনি; কথায়, কাজে, অবন্তী জেগে দিতো মায়ের প্রতি তার ক্ষোভ। সোনামণি সব সহ্য করতেন নিঃশব্দে।
এমন একদিন অবন্তীকে ডেকে পাঠালেন সোনামণি। একটা পুরানো আলবাম হাতে নিয়ে বললেন, “এই, দেখ.” ছোটবেলার ছবিগুলো দেখতে দেখতে অবন্তীর চোখে জল এলো। প্রতিটা ছবিতে সে হাসিমুখ, আর তার পাশে সোনামণি, এক অপার মমত্বের ছায়া চোখে। হঠাৎ, অবন্তীর মনে পড়লো সেই ঠান্ডা রাত, সে কাঁদছে, আর সোনামণি তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে আশ্রয় দিচ্ছেন। কিন্তু কেন সেই স্মৃতি এতদিন ভুলে গেলো?
সোনামণি আরও জানালেন, সেই কাজের খোঁজা নিয়ে ছোটাছুটির মধ্যেই ঠিক মতো খেতে না পারার জন্য তার শরীরটা ভেঙে গেছে। ডাক্তাররা বলেছেন, আর তেমন একটা বেশি দিন নেই। অবন্তী জমে গেলো. সেই সব ক্ষোভ, সেই সব অভিমান, মুহূর্তে ধুলিস্বাদ হয়ে গেলো তার কাছে।
মায়ের বাকি থাকা দিনগুলোয় সে হয়ে উঠলো সোনামণির সব। ঔষধপত্র, খাবার, সবকিছু সেই দেখতো। মায়ের হাত ধরে গল্প করতো, ছোটবেলার মতো। সোনামণি চলে যাওয়ার আগের রাতে, অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মা তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইনি, বাচ্চা। কিন্তু…” কথা শেষ করতে পারলেন না।
অশ্রুজলে ভেজা গালে অবন্তী বলল, “আমি জানি, মা. তুমি সবসময় আমার পাশেই ছিলে, এমনকি যখন আমি তা বুঝতে পারিনি। আমি ক্ষমা চাই, মা। আমার সেই সব রাগ, সেই সব অভিমান…” বাক্যটা শেষ করতে পারল না অবন্তী। সোনামণি চোখের কোণে জল টানতে টানতে বললেন, “এসব কী বলছিস, বাচ্চা? তুমি তো আমার মেয়ে। রাগ, অভিমান, এ সব মায়ের সঙ্গে হয়।”
কয়েকদিন পর সোনামণি চলে গেলেন, ছেড়ে চলে গেলেন অবন্তীকে একা. কিন্তু এবার সেই একা লাগল না। মায়ের দেওয়া শেষ কিছুদিনের সেই স্মৃতি, মায়ের ভালোবাসা, সবকিছুই থাকলো অবন্তীর কাছে অমূল্য ধন হয়ে।
মায়ের মৃত্যুর পর, অবন্তী খুঁজে বের করলেন সেই আশ্রম। সেখানে গিয়ে দেখা করলেন সেই সব দিদির সাথে, যারা তার শৈশবের একটা অংশ ছিলেন। তাদের কাছ থেকে জানতে পারলেন, সোনামণি কীভাবে প্রতিদিন আশ্রমে এসে দেখা করতেন অবন্তীর সাথে, কীভাবে ছেলের ছবি দেখিয়ে কষ্ট গোপন করতেন।
অবন্তী বুঝলেন, মায়ের ভালোবাসা কখনো কমেনি। পরিস্থিতিই তাকে দূরে রেখেছিল। ক্ষোভের গোঁজা খুলে, মায়ের প্রতি অপার ভালোবাসা আর কৃতজ্ঞতা জেগে উঠলো অবন্তীর মনে।
এখন অবন্তী একজন সফল লেখিকা। লেখেন প্রেমের গল্প, মায়ের মমত্বের গল্প। তার লেখায় ঝরে পড়ে মানুষের মনের কঠিন খোল, জাগে অনুভূতির ঝড়। কারণ, অবন্তী জীবনে বুঝেছেন, ক্ষমা করলে মুক্তি পাওয়া যায়, ভালোবাসলে জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর।