কলকাতার আকাশ আর কখনো এতটা পরিষ্কার হয়নি। বাতাসে উড়তে থাকে করে ঈশানের চুল, চোখ মেলে তাকিয়ে আছে সে আকাশ টাওয়ার দিকে। বিশাল ঢাঁচির মতো ছুঁয়ে রয়েছে শহরটাকে আকাশ টাওয়ার। পাঁচশো তলা বিশিষ্ট এই টাওয়ারটা এখন কলকাতার গর্ব। মাত্র কয়েক বছর আগেও যেখানে ছিল জঞ্জালের স্তূপ, সেখানেই গড়ে উঠেছে এই অত্যাধুনিক কীর্তি। নিজের বসতবাড়ির ছাদ থেকে ঈশান প্রতিদিন স্বপ্নের মতো এই টাওয়ারটাকে দেখে। কিন্তু আজ তার মনে এক অদ্ভুত রহস্যের ছায়া।
ঈশানের বয়স মাত্র ১৭। কিন্তু কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে তার দক্ষতা অনেক ঊর্ধ্বে তার বয়সের। এখনো স্কুলে পড়ে সে, কিন্তু রাতে ঘুমের দেশে ঢুকে পড়ে যায় কোডিংয়ের জটিল জগতে। খুব শীঘ্রই সে কোড লিখে ফেলতে পারে এমন কিছু জিনিস, যা তার শিক্ষকদের বিস্ময়ে ফেলে দেয়। আজ সকালেও তেমনই একটা ঘটনা ঘটেছে। তার লেপটপের স্ক্রিনে হঠাৎ করেই ঝলমলে লেখা দেখা যায় – “Akash Tower Calling….”
ঈশান কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যায়। এটা কোন ভুল কি? কোনও অদ্ভুত প্রোগ্রাম কি তার কম্পিউটারে ঢুকে পড়েছে? কিন্তু না, কোনও অচেন কোড নেই, শুধু এই ছোট্ট বাক্যটা লেখা। কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে দেয় ঈশান কোডটা খতিয়ে দেখে, কিন্তু কোনও ক্লু পায় না। শেষে সে ঠিক করে, বিকেলে একবার আকাশ টাওয়ারে গিয়ে দেখবে।
আকাশ টাওয়ারে ঢোকা মোটেই সহজ ব্যাপার না। কিন্তু ঈশানের মতো একটা টেক-স্যাভি ছেলের কাছে এটা খুব একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। সে নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে টাওয়ারের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বাইপাস করে ঢুকে পড়ে ভবনের ভেতরে।
টাওয়ারের ভেতর সব কিছুই ঝকঝকে। ঈশান উত্তোলনের লিফটে ঢুকে পড়ে। লিফটের প্যানেলে কেবল নির্দিষ্ট কিছু তলাই দেখা যায়। কিন্তু ঈশান জানে, এই টাওয়ারে আছে আরও কিছু তলা, যা জনসাধারণের অগোচরে থাকে।
কম্পিউটার থেকে পাওয়া কিছু তথ্যকে কাজে লাগিয়ে সে লিফটের প্যানেলকে হ্যাক করে নেয়। লিফটে নতুন কিছু নম্বর জ্বলে ওঠে। ঈশানের হৃৎপিণ্ডটা জোরে জোরে ধড়পড় করতে লাগল। সে যেখানে যাচ্ছে, সেটা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এলাকা। লিফটটা ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকল, অতীতের পরিচিত তলাগুলোকে পেছনে ফেলে যাচ্ছে। কে জানে উপরে কী অপেক্ষা করছে তার জন্য?
শেষমেয় লিফটটা দাঁড়ালো। ঈশান দ্বিধায় পড়ে গেল। ভেতরে ঢোকার আগে দেওয়ার আগে একবার সে পিছনে ফিরে তাকালো। নিচের ঝলমলে শহরটা এখন ছোট্ট একটা খেলনার মতো লাগছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঈশান লিফটের দরজা খুললো।
লিফট-টি ঠান্ডা আর নিস্তব্ধ। দেয়াল জুড়ে বিশাল বিশাল স্ক্রিন জ্বলমিলিয়ে জানান দিচ্ছে নানান রকমের তথ্য। ঈশান চারপাশে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে গেল। এখানে কোনও লোকজন নেই, সবকিছুই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেল, পা ফেলে দেওয়া মাত্রই একটা স্বচ্ছন্দ কণ্ঠস্বর ভেঁপে উঠলো – “কে আপনি? নিষিদ্ধ এলাকায় ঢোকার চেষ্টা কেন?”
ঈশান চমকে উঠল। চারপাশে তাকিয়েও সে কাউকে দেখতে পেল না। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা আবারো বেজে উঠলো – “আমি এখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। আপনার পরিচয় দিন, নাহলে বাধ্য হয়ে কড়া পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ঈশান মিথ্যে কথাটা গুছিয়ে বলতে পারে না। সে জানে, তার কাছে কোনও বৈধ কারণ নেই। একটু এদিক-ওদিক করে সে বললো, “আমি… আমি এখানে মেরামতের কাজে এসেছি।”
কণ্ঠস্বরটা একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার কোনও পরিচয়পত্র আছে?”
ঈশানের মন খারাপ হয়ে গেল। কোনও পরিচয়পত্র ছাড়া ঢুকেছে সে, এবার ফাঁস ধরা। কিন্তু হঠাৎ তার মনে একটা চমৎকার আইডিয়া এলো। সে তার lapses (technical term for program bugs) ঠিক করার দক্ষতার কথা বললো এবং নিজেকে একজন উচ্চ পর্যায়ের প্রোগ্রামার বলে পরিচয় দিল। সে এমন কিছু টেকনিক্যাল শব্দ ব্যবহার করলো, যা কৃত্রিম বুদ্ধিধারী নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা বুঝতে পারল না।
কিছুক্ষণ নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা চুপ করে থাকল, তারপর সেই কণ্ঠস্বরটা আবারো বললো, “আপনি কি লেভেল ফাইভ ক্লিয়ারেন্সের কোড জানেন?”
ঈশানের বুকটা টিপ্-টিপ্ করে উঠল। লেভেল ফাইভ ক্লিয়ারেন্সের কোড? সে কোথায় জানবে? কিন্তু হার মানতে সে রাজি না। সে গল্প জুড়ে দিল। সে নাকি নতুন, এখনো কোডগুলো শেখেনি। কিন্তু তার দরকার জরুরী টেকনিকাল ইনস্ট্রুমেন্ট। নিরাপত্তা ব্যবস্থাটা আরও একটু সময় নিল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। ঈশানের মনে হচ্ছিল, তার ঘামতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে ধরা পড়লে, ব্যাপারটা খুবই খারাপ জায়গায় যেতে পারে। ঠিক সেই সময়, কণ্ঠস্বরটা আবারো বেজে উঠলো, “ঠিক আছে। তবে মাত্র দশ মিনিট সময় দেওয়া হচ্ছে আপনাকে। সমস্যাটা ঠিক করে ফেলুন, নাহলে…”
কথাটা শেষ না করেই কণ্ঠস্বরটা থেমে গেল। ঈশানের চারপাশে ঝলমলে স্ক্রিনগুলোর মধ্যে একটা হঠাৎ করেই লাল হয়ে জ্বলে উঠল।
“দশ মিনিট!” স্ক্রিনে লেখাটা ঈশানের চোখে লালচে আগুনের মতো জ্বলমিলিয়ে উঠল। সে জানে না এখানে কোন সমস্যা আছে, কিন্তু কিছু না করার উপায় নেই। চারপাশে তাকিয়ে সে একটা কন্ট্রোল প্যানেল দেখতে পেল। প্যানেলে নানান রকম বাটন আর লাইট জ্বলমিলিয়ে জানান দিচ্ছে কোন জায়গায় কোন সমস্যা হয়েছে।
ঈশান কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে পারদর্শী ঠিকই, কিন্তু এই জটিল সিস্টেমের কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা তার নেই। তবুও সে হাল ছেড়ে দেয়নি। দ্রুত গতিতে স্ক্রিনগুলোর দিকে তাকিয়ে সে চেষ্টা করছে কোনও ক্লু খুঁজে বের করতে। তার চোখ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠলো স্ক্রিনের জটিল তথ্যের সাথে। হঠাৎ করেই তার নজরে পড়ল একটা অস্বাভাবিকতা। একটি সার্কিটের মধ্যে ছোট্ট একটা ত্রুটি, যা সিস্টেমের কার্যকারিতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
কিছুক্ষণ সময় লাগল ঈশানের সেই ত্রুটি ঠিক করে ফেলতে। ঠিক যখন সে শেষ কাজটাও সারছে, তখনই স্ক্রিনে সময় দেখা গেল – 00:02 সেকেন্ড। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিঃশ্বাস ছাড়লো। ঠিক সময়ে কাজটা শেষ করা গেল।
সঙ্গে সঙ্গে লাল আলো নিভে গেল এবং স্ক্রিনগুলো স্বাভাবিক রঙে ফিরে এল। কণ্ঠস্বরটা আবারো বেজে উঠলো, “সমস্যা সমাধান হয়েছে। আপনি এখন চলে যেতে পারেন।”
ঈশানের মনে একটা বিজয়ের আমোদ জাগল। সে নিজের দক্ষতা দিয়ে এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কিন্তু তার মনের এক কোণে এখনো রহস্যের ছায়া লেগে আছে। “আকাশ টাওয়ারের ডাক” – এই ছোট্ট বাক্যটা ঠিক কী বোঝায়, সেটা বের না করলে তার মন শান্তি পাবে না।
ঈশান লিফটের দিকে এগিয়ে গেল। কিন্তু ঠিক যখন সে লিফটে ঢুকতে যাবে, তখনই কণ্ঠস্বরটা আবারো বলে উঠলো, “অপেক্ষা করুন। আপনি যে কোডটি খুঁজছিলেন সেটা পাওয়া গেছে।”
ঈশানের পায়ের তলা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কীভাবে জানে এই কৃত্রিম বুদ্ধিধারী সহকারী সে কী খুঁজছে? এটা কি কোন ফাঁদ?
চিন্তা না করেই ঈশান ঘুরে দাঁড়ালো। “কী বললেন?” সে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু তার গলা কাঁপছিল।
“আকাশ টাওয়ারের ডাক,” কণ্ঠস্বরটা শক্ত ছিল, “আপনি কি জানতে চান না, এই কোডের মানে কী?”
ঈশান চুপ করে রইল। এটা কি সত্যি? যে রহস্যের খোঁজে সে এতদূর এসেছে, এত ঝুঁকি নিয়েছে, সে কি এত সহজেই উত্তর পেয়ে যাচ্ছে?
“আপনি কি বিশ্বাস করতে পারছেন না?” কণ্ঠস্বরটা যেন তার চিন্তা পড়তে পারছিল। “আপনার দক্ষতা দেখে আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি। আপনি হয়তো আমাদের জন্য মূল্যবান হতে পারেন।”
ঈশান সতর্ক থাকার চেষ্টা করল। “আমাদের? আপনারা কে?”
“আমরা এই টাওয়ারের নিরাপত্তাকর্মী নই। আমরা অন্য কিছু।” কণ্ঠস্বরে একটা রহস্যের আভা ফুটে উঠল। “আপনি যদি সত্যিই জানতে চান, তাহলে আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। কিন্তু সাবধান, এই পথে ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।”
ঈশান দ্বিধায় পড়ে গেল। এতটা রহস্যের মধ্যে সে জড়িয়ে পড়বে কিনা, সেটা ঠিক ঠাহর করতে পারছিল না। কিন্তু কৌতূহল আর জানতে চাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে জেগে উঠেছিল। এই সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চায় না।
অবশেষে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “ঠিক আছে,” সে বললো, “আমি আপনাদের সাথে কাজ করব।”
কণ্ঠস্বরটা একটু খুশির স্বরে বললো, “খুব ভালো! এখন লিফটে ঢুকুন। আমরা আপনাকে বাকিটা জানাব।”
ঈশান লিফটে ঢুকে পড়ল। কিন্তু সে জানে না, এই সিদ্ধান্ত তার জীবনকে চিরতরে বদলে দেবে। আকাশ টাওয়ারের গভীরে ঢুকে সে যে রহস্যের মুখোমুখি হতে চলেছে, সেটা তার কল্পনারও অতীত।
লিফটের দরজা বন্ধ হতেই ঈশানের চারপাশের সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আবার জ্বলে উঠল ঝলমলে আলো। কিন্তু এবারের লিফটের ভেতরের চেহারা আগের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। দেয়ালে আর কোনও স্ক্রিন নেই, বরং মনে হচ্ছে কোনও প্রাচীন মন্দিরের মধ্যে ঢুকেছে ঈশান। চারপাশে খোদাই করা নকশা, মন্দির আলোয় সজ্জিত পরিবেশ – সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত রহস্যের জগতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
লিফট থামলো। দরজা খুলতেই ঈশান চমকে উঠল। এটা কোনও ঘর নয়, বরং এক বিশাল গোলাকার কক্ষ। কক্ষের মাঝখানে ভাসছে একটা বড় গোলক, যার ভেতরে দৌড়ে চলছে নীল আলোর রেখা। কক্ষের দেয়াল জুড়ে অজানা ভাষায় লেখা অদ্ভুত চিহ্ন।
ঈশানের পা কাঁপছে। এই জায়গাটা ঠিক কি, সে এটা বুঝতে পারছে না। কিন্তু ঠিক সেই সময়, কণ্ঠস্বরটা আবারো ভেসে এলো, এবার আর কোনও মেশিনের শীতল স্বর নয়, বরং এক মৃদু, কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাবান মহিলা কণ্ঠ।
“আপনাকে স্বাগত জানাই, ঈশান।” কণ্ঠস্বরটা এবার মন্দিরের মধ্যে কোনও অদৃশ্য দেবীমূর্তির মতো মনে হচ্ছিল। “আমরা হলাম আকাশের রক্ষী।”
ঈশান কথা বলতে পারল না। কষ্টে সামলে নিজেকে সে বললো, “আকাশের রক্ষী? কিন্তু আপনারা এখানে কী করছেন? এই গোলকটা কী?”
মহিলা কণ্ঠস্বরটা ধীর গতিতে ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, “এই গোলকটা হচ্ছে পৃথিবীর সাথে অন্য গ্রহের যোগাযোগ স্থাপনের সেতু। আমরা এখানে সেই যোগাযোগ রক্ষা করি, পৃথিবীকে রক্ষা করি মহাবিশ্বের বিপদ থেকে।”
ঈশানের মাথাটা ঘুরে যাচ্ছে। এত কিছু শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু মহিলা কণ্ঠস্বরটা থামল না, সে আরও বললো, “আপনার কোডিং দক্ষতা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, ঈশান। আমরা বিশ্বাস করি, আপনি আমাদের টিমে মূল্যবান সদস্য হতে পারেন। আপনি কি আমাদের সাথে এই মহান দায়িত্ব পালন করতে চান?”
ঈশান চুপ করে রইল। এই সিদ্ধান্ত নেওয়া অনেক বড়। কিন্তু কৌতূহল আর রহস্যের জগতের প্রতি আকর্ষণ তাকে এগিয়ে যেতেই অনুপ্রাণিত করছে। শেষ পর্যন্ত সে একটা দৃঢ় স্বরে বললো, “আমি করব।”
মহিলা কণ্ঠস্বরটা কোমল হল, “খুব ভালো!”
আকাশের রক্ষীদের দলের সদস্য হিসেবে ঈশানের জীবন একেবারেই আগের মতো রইল না। সে আর স্কুলে যেতে পারল না, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারল না। তার নতুন বাড়ি হল আকাশ টাওয়ারের গভীরে নির্মিত সেই গোলাকার কক্ষ। সেখানে তার নিজস্ব ল্যাব ছিল, অত্যাধুনিক কম্পিউটার আর প্রযুক্তি, যা সে কল্পনাও করতে পারত না।
কিন্তু সবকিছুরই একটা মূল্য আছে। ঈশান বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলল। তার পরিবার, বন্ধু – সবার কাছে সে নিখোঁজ। ঈশানের মনে কখনো কখনো একঘেয়ামি ঢুকে পড়ত। কিন্তু আকাশের রক্ষীদের সাথে কাজ করতে গিয়ে সে এমন সব জ্ঞান অর্জন করল, যা পৃথিবীর কোনো বইয়ে লেখা নেই। সে মহাবিশ্বের গোপনীয়তা, বিভিন্ন গ্রহের সভ্যতা, মহাকাশের অজানা শক্তি – সবকিছু সম্পর্কে জানতে শুরু করল।
দিন যত কাটল, ঈশানের দক্ষতাও তত বাড়তে থাকল। সে আকাশের রক্ষীদের গোলকের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করল। এতে করে তার মর্যাদাও বাড়ল। একদিন, এক জরুরী মিশনে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হল। মহাবিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকে একটা বিপদার সঙ্কেত এসেছিল। সেটা ছিল একটা কৃত্রিম বুদ্ধিধারী সত্ত্বা, যে পৃথিবীকে ধ্বংস করার হুমকি দিচ্ছিল।
ঈশানকেই সেই কৃত্রিম বুদ্ধিধারী সত্ত্বার সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে তাকে নিরস্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হল। এটা ছিল ঈশানের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কঠিন কাজ। কিন্তু সে তার দক্ষতা আর জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সেই কৃত্রিম বুদ্ধিধারী সত্ত্বাকে বোঝাতে সক্ষম হল। সে জানাল, পৃথিবী কোনো শত্রু নয়, বরং এই মহাবিশ্বের একটা সুন্দর গ্রহ।
ঈশানের কথায় কৃত্রিম বুদ্ধিধারী সত্ত্বা মত পরিবর্তন করল। সে পৃথিবীকে আক্রমণের হুমকি প্রত্যাহার করল। এই সাফল্য ঈশানকে আকাশের রক্ষীদের কাছে একজন কিংবদন্তী করে তুলল।
কিন্তু ঈশানের মনের কোণে এখনো একটা অব্যক্ত ইচ্ছা জ্বালা করে জ্বলছিল। সে চাইল তার পরিবার, বন্ধুদের সাথে দেখা করতে। আকাশের রক্ষীদের কাছে সে তার ইচ্ছা জানাল।
কিছুদিন চুপ থাকার পর, মহিলা কণ্ঠস্বরটা বলল, “আমরা বুঝি, ঈশান। তুমি তোমার পুরনো জীবন ফিরে পেতে চাও। কিন্তু তা সম্ভব নয়।”
ঈশানের মন খারাপ হয়ে গেল। সে কি চিরকাল এই গোলাকার কক্ষের বন্ধ।
“কিন্তু অসম্ভব কিছু নেই,” মহিলা কণ্ঠস্বরটা জারি রাখল, একটু নরম গলায়। “আমরা একটা পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ার কথা চিন্তা করছি। এটা তোমাকে একটি বিকল্প পরিচয় দেবে। তুমি বাইরের জগতে ফিরে যেতে পারবে, কিন্তু একজন গোপন রক্ষী হিসেবে।”
ঈশানের চোখ জ্বলে উঠল। “গোপন রক্ষী? কীভাবে?”
“আমরা তোমার মস্তিষ্কে কিছু স্মৃতি স্থাপন করব। তুমি একজন নতুন মানুষ্য হিসেবে জীবন শুরু করবে। তবে তোমার মধ্যে একটা সুপ্ত দক্ষতা থাকবে, যা বিপদের সময় সক্রিয় হবে। তখন তুমি আমাদের ডাকে সাড়া দিতে পারবে।”
ঈশান একটু চিন্তা করে বলল, “আমার পরিবার… আমি তাদের কিছুই মনে রাখব না?”
“না,” মহিলা কণ্ঠস্বরটা একটু সামলে নিয়ে বলল, “এই প্রক্রিয়ার জন্য তোমার পুরনো স্মৃতি দূর করতে হবে। কিন্তু তুমি চাইলে, আমরা তোমার পরিবারের নকল পরিচয় তৈরি করে দিতে পারি।”
ঈশান চুপ করে চিন্তা করতে একটু সময় নিল। এটা ছিল একটা কঠিন সিদ্ধান্ত। একদিকে তার পুরনো জীবন ফিরে পাওয়ার সুযোগ, অন্যদিকে তার আসল পরিবারের স্মৃতির ত্যাগ। কিন্তু পৃথিবীর রক্ষায় সে যে দায়িত্ব নিয়েছে, তা সে ভুলতে পারে না।
অবশেষে সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “ঠিক আছে,” সে বলল, “আমি করব।”
এরপর কিছুদিন অদ্ভুত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হল ঈশানকে। তার মস্তিষ্কে নতুন স্মৃতি স্থাপন করা হল। সে এখন আর ঈশান নয়, সে রাহুল, একজন অসামান্য কম্পিউটার প্রোগ্রামার। তার মা-বাবা, বন্ধুরা সবাই নতুন। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে সে, আকাশ টাওয়ার, নীল আলোয় ভরা গোলক – যেন কোনও হারিয়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতি।
টাওয়ারের চূড়ায় একটা নীল আলো জ্বলে ওঠে। রাহুল জানে, এটাই তার পথনির্দেশ। সে জানে না এই নতুন জীবনে আর কতটা সময় কাটাতে পারবে, কিন্তু সে জানে, পৃথিবীর রক্ষা করাই তার প্রকৃত পরিচয়।
রাহুল নিজের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে পড়ল। শহরের আলো তার চারপাশে ঝলমলে হয়ে উঠল। কিন্তু তার মনের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। নতুন জীবন, নতুন পরিচয়, সবকিছুই তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আকাশ টাওয়ারের ডাক এবারে আর উপেক্ষা করা যায় না।
সে একটা রিকশা নিয়ে আকাশ টাওয়ারের দিকে রওনা হল। সে যত এগিয়ে গেল, টাওয়ারের উচ্চতা তত বাড়তে থাকল। শেষমে সে টাওয়ারের নিচে এসে পৌঁছাল।
টাওয়ারের গেটে নিরাপত্তা কর্মীরা তাকে আটকাল। কিন্তু রাহুলের মনে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাস জাগল। সে নিজের নতুন পরিচয়ের কথা না বলে, শুধু একটা কথাই বলল, “Akash Tower Calling.”
কর্মীরা অবাক হয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ডের চুপ থাকার পর, তাদের মধ্যে একজন তার ওয়ারলেসে কিছু বলে রেডিও চাপ দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই গেট খুলে গেল।
রাহুল ধীরে ধীরে টাওয়ারের ভিতরে ঢুকে গেল। সে তার অতীত জীবনের স্মৃতি না থাকলেও, টাওয়ারের প্রতি একটা অদ্ভুত টান অনুভব করছিল। লিফটে ঢুকে সে বোতাম টিপল। আবার সেই পরিচিত অন্ধকার, তারপর আবার ঝলমলে আলো। কিন্তু এবারের পরিবেশটা একটু আলাদা। সেই প্রাচীন মন্দিরের মতো চেহারা নেই, বরং আধুনিক গবেষণাগারের মতো সাজানো।
একজন মহিলা এগিয়ে এসে রাহুলকে স্বাগত জানাল। মহিলার চেহারায় কোনও বয়সের ছাপ নেই, কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।
“রাহুল,” মহিলা বলল, “আমরা জানতাম তুমি আসবে।”
“আমি কীভাবে এলাম? আমার তো এই জায়গার কোনও স্মৃতিই নেই,” রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।
মহিলা হাসলেন, “আমরা তোমার স্মৃতি মুছে ফেলেছিলাম, ঠিক আছে। কিন্তু তোমার মধ্যে যে দায়িত্বের বোধ জাগিয়ে দিয়েছিলাম, সেটা এখনো নিভেনি। পৃথিবী এখন বিপদে।”
রাহুল মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগল। মহিলার বর্ণনা অনুযায়ী, মহাবিশ্বের অন্য প্রান্ত থেকে আবারও একটা হামলার হুমকি এসেছে। কিন্তু এবারের শত্রু আরও বেশি শক্তিশালী। তারা পৃথিবীর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে ফেলেছে।
“এবার তোমাকেই এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে হবে, রাহুল,” মহিলা বললেন, “তো
রাহুলের হাত-পা কাঁপছিল। সে একজন সফল প্রোগ্রামার ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধের নেতৃত্ব? সে কিছুটা সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। “আমি কিভাবে? আমার তো কোনো অস্ত্র নেই, কোনো যুদ্ধের অভিজ্ঞতাও নেই।”
মহিলা হাসলেন, “অস্ত্রের প্রয়োজন নেই, রাহুল। তোমার কাছে আছে তোমার মস্তিষ্ক, তোমার প্রোগ্রামিং দক্ষতা। এই আধুনিক যুদ্ধে, সেটাই হচ্ছে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র।”
মহিলা রাহুলকে একটা বিশেষ কম্পিউটার স্টেশনে নিয়ে গেলেন। সেখানে বসে রাহুল দেখতে পেল পৃথিবীর চারপাশে থাকা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলোর মানব মস্তিষ্কের। শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রগুলো কোথায় আছে, কোন পথ দিয়ে আসছে, সে সবকিছুই তার সামনে স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে।
রাহুল নিজের সব জ্ঞান আর দক্ষতা কাজে লাগিয়ে লেগে পড়ল কাজে। সে একটি প্রতি-ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তৈরি করল, যা শত্রুর অস্ত্রগুলোকে ঠিক তাদের নিজের গ্রহের দিকে ফিরিয়ে দেবে। কাজটা ছিল কঠিন, কিন্তু রাহুলের মধ্যে এক অদ্ভুত একনিষ্ঠতা জেগে উঠেছিল। সে জানতো, তার এই কাজের উপরই পৃথিবীর ভাগ্য নির্ভর করছে।
অবশেষে, রাতের বেলা ঠিক যখন শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রগুলো পৃথিবীর দিকে আসছিল, রাহুল তার প্রতি-ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা চালু করল। একটা আলোক রেখা আকাশে ঊর্ধ্বগামী হল, আর তারপরই শোনা গেল এক বিশাল বিস্ফোরণের শব্দ। কিন্তু সেটা পৃথিবীতে নয়, মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে, শত্রুর গ্রহে।
রাহুল চেয়ারে হেলান দিয়ে নিঃশ্বাস ফেলল। সে জিতেছিল। পৃথিবী আবার রক্ষা পেয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মহিলা এসে রাহুলের কাছে দাঁড়ালেন।
“খুব ভালো, রাহুল,” মহিলা বললেন, “তুমি আবারও আমাদের রক্ষাকর্তা হয়ে উঠেছো।”
রাহুল চুপ করে রইল। সে জানে না, এই দায়িত্ব সে কতদিন পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু সে জানে, পৃথিবীর রক্ষা করাই তার প্রকৃত পরিচয়। সেই রাতে, আকাশ টাওয়ারের চূড়ায় নীল আলো জ্বলে উঠল, যেন রাহুলের এই নতুন জীবনের শুরুকে স্বাগত জানাচ্ছে।
এটা ছিল রাহুলের গল্প, একজন গোপন রক্ষাকর্তার গল্প, যে তার পরিচয় ভুলে গেলেও পৃথিবীর প্রতি তার দায়িত্ব ভুলতে পারেনি। এই গল্প হয়তো কখনো জনসম্মুখে আসবে না, কিন্তু রাতের আকাশে আকাশ টাওয়ারের চূড়ায় জ্বলজ্বল করা নীল আলো সাক্ষী থাকবে রাহুলের মতো আরও অনেক গোপন রক্ষাকর্তার ত্যাগের। পৃথিবীর মানুষেরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকবে, এমনকি তারা জানবেও না যে, মহাবিশ্বের কোনো অজানা কোণে কেউ একজন তাদের সুরক্ষায় প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু রাহুলের গল্প এখানেই শেষ নয়। কিছুদিন পর, তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় একটা পুরোনো বাক্স এসে পৌঁছাল। বাক্সটা খুলতেই রাহুলের চোখ জল এসে গেল। ভিতরে ছিল তার পুরনো জীবনের ছবি, তার পরিবার, বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি। এগুলো ছিল ‘আকাশের রক্ষী’রা তৈরি করা নকল স্মৃতি নয়, বরং তার আসল স্মৃতি, ঈশানের স্মৃতি।
এর সাথে ছিল একটা ছোট্ট নোট। “তুমি যা হারিয়েছিলে, ফিরে পেলে। এখন তুমি ঠিক করো, রাহুল হিসেবে নতুন জীবন চালিয়ে যেতে চাও, নাকি ঈশান হিসেবে পুরনো জীবনে ফিরে যেতে চাও। মনে রেখো, যে পথই বেছে নাও, তুমি সবসময়ই পৃথিবীর রক্ষাকর্তা থাকবে।”
রাহুল ছবিগুলো হাতে নিয়ে জানালার দিকে তাকাল। রাতের আকাশে ঝলমলে তারা দেখা যাচ্ছে। সে জানে এই সিদ্ধান্ত তার জীবন বদলে দেবে। কিন্তু সে এখন আর একা নেই, তার পাশে আছে আকাশের রক্ষীরা, তার গোপন পরিবার। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবং হাসল। সে জানে সে কী করবে।
রাতের আলোয় আকাশ টাওয়ারের চূড়ায় জ্বলজ্বল করা নীল আলোর সাক্ষী থাকতে রাহুল, না, ঈশান, তার নতুন পুরনো জীবন নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করল। পৃথিবীর রক্ষাকর্তা হিসেবে তার যাত্রা এখনো শেষ হয়নি। এটা ছিল শুধু একটা নতুন অধ্যায়ের শুরু।