কলকাতার ছেলে বোধন রায়, আপনাদের সবার কাছে ‘রোহান’ নামে পরিচিত, আর আমিই সেই গল্পের লেখক। আজ আপনাদের নিয়ে যাবো এক এমন গল্পের জগতে, যেখানে মরুভূমির রুদ্রতা আর দিগন্ত বিলীন হওয়ার মায়া একাকার। এই গল্পের নাম – ‘নিঃশ্বাসের দিকনির্দেশ’।
গল্পটা শুরু হয় 2147 সালে। পৃথিবী তখন চরম পরিস্থিতিতে। জলবায়ু পরিবর্তনের থাবায় মরুভূমি গ্রাস করছে সবুজ মাঠ। সূর্যের ঝলসানিতে কাত হয়ে যাচ্ছে জীবনধারা। এই অবস্থাতেই গবেষণা কেন্দ্র ‘অনন্ত জীবন’ খুঁজে বেড়াচ্ছে মানবজাতিকে বাঁচানোর কোনো রাস্তা।
আমাদের গল্পের নায়ক – অগ্নি, এক তরুণ বিজ্ঞানী, ‘অনন্ত জীবন’ এর মূল গবেষক দলের সদস্য। চারপাশে মৃত্যুর ছায়া ঘনিয়ে আসলেও, অগ্নির মধ্যে জ্বলে উঠেছে আশার দীপশিখা। সে বিশ্বাস করে, তারা খুঁজে ফেলবে সমাধান, পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে।
একদিন, গবেষণায় এক বিরাট সাফল্যের খবর আসে। মঙ্গল গ্রহের মাটির নমুনায় পাওয়া গেছে এক অদ্ভুত জৈব উপাদান। এই উপাদানের সঙ্গে মানব কোষের সংমিশ্রণে তৈরি হতে পারে এমন এক কাঠামো, যা মরুভূমির নিষ্ঠুর পরিবেশেও মানুষের টিকে থাকার ক্ষমতা বাড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু একটা সমস্যা – মঙ্গলে গিয়ে এই উপাদান সংগ্রহ করা।
নির্বাচিত হয় অগ্নি। মঙ্গল অভিযানের ঝুঁকিপূর্ণ পথ চলার জন্য সেই সবচেয়ে সাহসী ও দক্ষ বিজ্ঞানীর দরকার, আর অগ্নির মধ্যে সেই গুণ আছেই। কিন্তু মঙ্গলে যাওয়ার আগে, একটা পরীক্ষামূলক অভিযানের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে – পৃথিবীর সবচেয়ে নির্মম মরুভূমি, ‘নিঃশ্বাসের মাঠ’ এ যাওয়া।
নিঃশ্বাসের মাঠ – এক বিশাল মরুভূমি, যেখানে সূর্যের তাপ অসহনীয়। বাতাস বয়ে চলে ঝড়ের মতো, ঢেউ খেলে বালির টিলা। কোনো দিকনির্দেশ নেই, কোনো গাছপালার ছায়া নেই। সেখানে মানুষের টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু অগ্নি জানে, এই অভিযানের সাফল্য নির্ধারণ করবে মঙ্গল অভিযানের ভবিষ্যৎ।
এক ক্ষুদ্র মহাকাশযানে চড়ে নিঃশ্বাসের মাঠে নামে অগ্নি। চারপাশে শুধু বালি। ঢেউ খেলানো বালির সমুদ্র আর নিঃশ্বাস রুদ্ধকর ঝোড়ো হাওয়ায় কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অগ্নি। সূর্যের আগুন ঝলসাচ্ছে, কোনো দিকে কোনো স্থির বস্তু নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে বিস্ময়ের সময় নেই। মহাকাশযানের ভিতর থেকে বের করে সে নিজের বিশেষভাবে তৈরি মরুভূমি স্যুট পরে নিল। এই স্যুটটি মানবদেহকে ঠান্ডা রাখার পাশাপাশি, বালির ঝড় থেকেও রক্ষা করবে।
হাতে থাকা বিশেষ যন্ত্রটির সাহায্যে অগ্নি তার অবস্থান এবং মিশনের উদ্দেশ্যস্থল চিহ্নিত করল। কিছুটা দূরেই ছিল এক বিশাল গর্ত, গবেষণা অনুযায়ী, সেখানেই পাওয়া যেতে পারে মঙ্গলে পাওয়া উপাদানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু। কিন্তু সেখানে পৌঁছতে হবে ঢেউ খেলানো বালির পাহাড় ঠেলে, ঝোড়ো হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে।
প্রতিটি পদক্ষেপই যেন কঠিন লড়াই। বালি ঢুকে যেতে চায় স্যুটের ফাঁকে ফাঁকে। ঝোড়ো হাওয়া টেনে নিয়ে যেতে চায় মাটির দিকে। কিন্তু অগ্নি থামল না। সে জানে, তার টিকে থাকার সময় সীমিত। স্যুটের অক্সিজেন সরবরাহ কয়েক ঘণ্টা মাত্র স্থায়ী হবে। সে যত দ্রুত পারে, গন্তব্যে পৌঁছতে হবে।
ঘণ্টাখানেক চলার পর, হঠাৎ যন্ত্রটির স্ক্রিনে ঝলসে উঠল লাল আলো। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে! অগ্নি চমকে উঠল। সে জানতো স্যুটে সমস্যা হতে পারে, কিন্তু এত তাড়াতাড়ি? মনের মধ্যে একটা অশান্তি জেগে উঠল। ফিরে যাওয়া দূরের কথা, এখন গন্তব্যে পৌঁছানোটাও জরুরি হয়ে পড়ল।
দৌড় লাগালো অগ্নি। বালিতে পা ফেলা শক্ত, তবু সে ছুটে চলল। হঠাৎ, ঝড়ের এক ফাঁকে সে দেখতে পেল – দূরে, গর্তের ঠিক মাঝখানে, একটা ধাতব বস্তু চমকায়! মরুভূমিতে এমন বস্তু কীভাবে? অবাক হয়ে থেমে গেল অগ্নি। সে জানত, এখানে কোনো গবেষণা দল আসেনি। তাহলে এই বস্তুটা?
একটা নতুন রহস্যের সম্মুখীন হলো অগ্নি। কিন্তু এখন সময় নেই কোনো রহস্য খোঁজার। অক্সিজেনের অভাবে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে জানে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সে অচেতন হয়ে পড়বে। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে হাঁটু মুড়ে বসল সে। হাত বাড়িয়ে স্যুটের হেলমেট খুলতে গেল, ঠিক সেই সময় –
একটা ঝাপটা। চোখের পলকে একটা ধ্বনি তাকে চমকে দিল। ঝাপটার শব্দ নয়, বরং ধাতব কিছু ঘষাঘষির আওয়াজ। হেলমেট খোলা অবস্থায়ই সে চারপাশে তাকাল। বাতাসের দাপটে বালির ঝড় আবার ঘনীভূত হয়েছে, তবুও সে দেখতে পেল – ধাতব বস্তুটির কাছে কিছু একটা নাড়ছে।
অগ্নি চেষ্টা করলো উঠে দাঁড়াতে কিন্তু অক্সিজেনের অভাবে শরীর অসাড়। হঠাৎ, ধাতব বস্তুটি খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এক অদ্ভুত প্রাণী। দ্বিপদ, কিন্তু মানুষের চেয়ে অনেক লম্বা ও ক্ষীণ। গায়ের রং তামাটে, মাথায় কোনো চুল নেই, দু’টি বড় বড় চোখ চারপাশে ঘুরছে।
অগ্নি কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর আবার চেষ্টা করলো উঠে দাঁড়াতে। এই অদ্ভুত প্রাণীটিই কি তাকে বাঁচাবে? না কি এই মরুভূমির নির্মম শিকারে সে পরিণত হবে?
ঠিক সেই সময়, অদ্ভুত প্রাণীটির হাত থেকে একটা নল বেরিয়ে এলো। সেই নল দিয়ে অগ্নির মরুভূমি স্যুটের সাথে সংযোগ স্থাপন করল। অবাক হয়ে দেখল অগ্নি, তার স্যুটের অক্সিজেন মাত্রা আবার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে! একটা আশার সঞ্চার হলো তার মনে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অক্সিজেনের মাত্রা স্বাভাবিক হয়ে গেল। অগ্নি হ্যান হয়ে উঠে দাঁড়াল। অদ্ভুত প্রাণীটি তার দিকে তাকিয়ে রইল। এই প্রাণী কিভাবে তার স্যুটের সাথে যোগাযোগ করলো? এরা কে? আর এই মরুভূমিতে এরা কী করছে?
কিন্তু অগ্নি জানতো, এখন প্রশ্ন করার সময় নেই। প্রথমে নিজের পরিচয় দিতে হবে। সে তার স্যুটের কমিউনিকেশন ডিভাইসটি চালু করলো এবং ইংরেজি ভাষায় বলল, “আমি অগ্নি। পৃথিবী থেকে।”
কিন্তু কোনো সাড়া নেই। অগ্নি আবার চেষ্টা করলো, এবার হিন্দিতে। তারপর আরও কয়েকটা ভাষায়। কিন্তু অদ্ভুত প্রাণীটি কিছুই বুঝলো না, কিংবা কোনো সাড়া দিল না।
একটা অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এলো তাদের দু’জনের মাঝে। অগ্নি বুঝতে পারছিল না, এই পরিস্থিতি থেকে সে কীভাবে বের হবে? এই অদ্ভুত প্রাṇীটির উদ্দেশ্য ভালো না মন্দ, সেটাও তার জানা নেই।
ঠিক সেই সময়, ধাতব বস্তুটির দিকে অদ্ভুত প্রাণীটির হাত ইশারা করল। তারপর অগ্নি দিকে তাকিয়ে, একটা অজানা ইশারা করল। বুঝতে না পারলেও, অগ্নি বুঝলো এটা একটা আমন্ত্রণ। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেওয়া কি ঠিক হবে? না জেনে কোনো জায়গায় যাওয়া কি ঠিক হবে?
নিঃশ্বাসের মাঠের বিশাল বালির সমুদ্রের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অগ্নি এক বিরাট দ্বিধান্বিত। একদিকে, মিশনের উদ্দেশ্য, নির্মম সময়ের সীমাবদ্ধতা, আর অজানা ভবিষ্যৎ। অন্যদিকে, এই অদ্ভুত প্রাণীটির ইশারা, ধাতব বস্তুটির রহস্য, এবং হয়তো নিজের প্রাণ বাঁচানোর একমাত্র সুযোগ। অচেন জায়গায় যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এখানে থাকাও আত্মঘাতী।
কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর, অগ্নি একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে জানতো, পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে তার এই মিশনের উপর। আর এই অদ্ভুত প্রাণীটিই হয়তো তাকে গর্তের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করতে পারে, সেখানে থাকতে পারে মঙ্গল গ্রহের উপাদানের সন্ধান।
একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে, অগ্নি অদ্ভুত প্রাণীটির দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। প্রাণীটি অগ্নি হাত ধরলো না, কিন্তু আবার সেই অজানা ইশারা করল। অগ্নি বুঝলো, তাকে অনুসরণ করতে হবে।
ধাতব বস্তুটির দিকে হাঁটতে শুরু করল অগ্নি। কিন্তু এবার ঝড়ের তীব্রতা আরও বেড়েছে। বালি চোখে ঢুকে যাচ্ছে, হাওয়া টেনে নিয়ে যেতে চাইছে। প্রতিটি পদক্ষেপই যেন এক যুদ্ধ। কিন্তু অদ্ভুত প্রাণীটি এগিয়ে চলেছে অবলীলভাবে, যেন এই মরুভূমির রুদ্রতা একেবারেই স্পর্শ করতে পারে না।
অবশেষে, তারা ধাতব বস্তুটির কাছে পৌঁছাল। এটা দেখতে অনেকটা মডিউলার বাড়ির মতো। ধাতব পাত দিয়ে তৈরি, বাতাস-অভেদ্য। অদ্ভুত প্রাণীটি একটা নির্দিষ্ট স্থানে হাত দিতেই, ধাতব দেওয়ালে একটা ফাঁক খুলে গেল। অগ্নি দ্বিধায় থামল। এই অন্ধকার গহ্বরে ঢোকা কি ঠিক হবে? কিন্তু আর কোনো উপায় নেই। সে নিজের স্যুটের লাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে ভিতরে ঢুকল। অদ্ভুত প্রাণীটি তার পিছু নিল। ভিতরে ঢুকে অগ্নি চমকে উঠল। এটা কোনো গুহা নয়, বরং একটা ছোট্ট কক্ষ। কক্ষের দেওয়ালে অজানা লিপি আর চিত্র অঙ্কিত। কক্ষের মাঝখানে রয়েছে একটা বড়ো স্বচ্ছ ট্যাঙ্ক। তার মধ্যে একটা স্বচ্ছ, নীল তরল পদার্থ ভরা।
অদ্ভুত প্রাণীটি ট্যাঙ্কের দিকে ইশারা করল। অগ্নি তার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। প্রাণীটির চোখে এক অসাধারণ জ্ঞানের ঝিলিক। যেন বলছে, এই তরল পদার্থই হলো তুমি যা খুঁজছো।
অগ্নি এগিয়ে গিয়ে ট্যাঙ্কের কাছাকাছি যাওয়ার সাথে সাথে অগ্নি দেখতে পেল, নীল তরল পদার্থের মধ্যে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকা ভাসছে। এই কণিকাগুলো কিছুটা চমকালো ধাতবের মতো ঝিলমিল করছে। সে হাত বাড়িয়ে ট্যাঙ্কের প্রতিচ্ছবি স্পর্শ করলো, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। হঠাৎ, অদ্ভুত প্রাণীটির হাত তার হাতের উপর এসে থামল। অগ্নি চমকে উঠে পিছিয়ে এলো। কিন্তু প্রাণীটির কোনো ক্ষতিকারক উদ্দেশ্য নেই, তা বুঝতে পারল অগ্নি।
এবার প্রাণীটি নিজের হাত বাড়িয়ে ট্যাঙ্কের প্রতিচ্ছবি স্পর্শ করল। অবিশ্বাস্য! দেওয়ালে অঙ্কিত কিছু চিহ্ন জ্বলজ্বল করে উঠল। তারপর ট্যাঙ্কের একটা অংশ সরে গেল, একটি ছোট্ট কক্ষ উন্মোচিত হলো। তার মধ্যে রয়েছে একটা ধাতব কন্টেনার, ঠিক অগ্নি যে ধরনের নমুনা সংগ্রহের জন্য এসেছিল, তার মতো।
অগ্নি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠতে চাইল, কিন্তু মরুভূমির নিঃশব্দতা ভঙ্গ করার সাহস পেল না সে। সে সাবধানে ধাতব কন্টেনারটি তুলে নিল। ঠিক সেই সময়, দেওয়ালে আবার জ্বলজ্বল করে উঠল চিহ্নগুলো। কিন্তু এবার আলাদিন চিহ্নের পাশে একটা লাল আলো জ্বলে উঠল। যেন কোনো সতর্কবার্তা দিচ্ছে।
অদ্ভুত প্রাণীটি দ্রুত এগিয়ে এলো এবং আবার অগ্নির হাত ধরল। এবার আর দ্বিধা করল না সে। প্রাণীটি তাকে টেনে নিয়ে গেল কক্ষের এক কোণে। সেখানে ছিল একটা ছোট্ট প্যানেল। প্রাণীটি প্যানেলে হাত বুলিয়ে কিছু করলো, আর তারপর দেওয়ালে একটা ত্রি-মাত্রিক চিত্র ফুটে উঠল।
চিত্রটিতে দেখা গেল মহাকাশ, বিভিন্ন গ্রহ, তারা। তারপর পৃথিবীর চিত্র ফুটে উঠল, ধীরে ধীরে মরুভূমিতে মরুঝড় হওয়া দেখা গেল। হঠাৎ, লাল আলোয় জ্বলে উঠল মঙ্গল গ্রহ। তারপর আবার পৃথিবীর চিত্র ফুটে উঠল, কিন্তু এবার সেখানে ছিল সবু গাছপালা, নীল আকাশ।
অগ্নি বুঝতে পারল, এই চিত্রের মধ্যে রহস্য লুকিয়ে আছে। এই অদ্ভুত প্রাণীরা হয়তো পৃথিবীকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কীভাবে? আর লাল আলোর সতর্কবার্তাটা কী বোঝাচ্ছে?
অগ্নি প্রশ্ন করতে চাইল কিন্তু প্রাণীটির কোনো ভাষা সে জানে না। হঠাৎ, প্যানেলের নিচে একটা ছোট্ট বাক্স খুললো। তার মধ্যে রয়েছে একটা ডিভাইস, দেখতে অনেকটা অগ্নি যে স্যুট পরেছে, তার হেলমেটের মতো। অদ্ভুত প্রাণীটি ডিভাইসটি অগ্নির হাতে তুলে দিল। তার চোখে একটা অনুরোধের ঝিলিক দেখল অগ্নি। সে বুঝলো, এই ডিভাইসটি হয়তো তাকে এই গোপন জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে সাহায্য করবে। কিন্তো কোথায় যেতে হবে, সেটা বুঝতে পারল না।
অগ্নি ডিভাইসটি পরল। হেলমেটের ভিতরে একটা শীতল আবহাওয়া তৈরি হলো। তারপর কানে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, অদ্ভুত প্রাণীটির কণ্ঠ! কিন্তো এবার সে মানুষের ভাষায় কথা বলছে।
“আমরা ‘রক্ষক” কণ্ঠস্বরটি বলল, “হাজার বছর ধরে আমরা মহাকাশ পর্যবেক্ষণ করছি। আমরা জানি পৃথিবীর কী অবস্থা হচ্ছে।”
অগ্নি অবাক হয়ে গেল। এই অদ্ভুত প্রাণীরা এতদূর থেকে পৃথিবী দেখছে?
“মঙ্গল গ্রহের উপাদান তোমাদের বাঁচাবে না,” কণ্ঠস্বরটি চলল, “এটি মাত্র একটি অস্থায়ী সমাধান। আমরা তোমাদেরকে আসল সমাধান দিতে চাই। কিন্তু লাল আলোর সতর্কবার্তাটি মেনে চলতে হবে।”
কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা। তারপর আবার বলল, “নিজের গ্রহে ফিরে যাও। কিন্তু মনে রেখো, প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করলে, কোনো উপাদান বা প্রযুক্তি তোমাদের বাঁচাতে পারবে না।”
ডিভাইসটি মাথা থেকে খুলে রেখে অগ্নি অদ্ভুত প্রাণীটির দিকে তাকাল। কৃতজ্ঞতায় মাথা নীচু করল। সে বুঝতে পারলো, এই মিশন তার ধারণার চেয়েও অনেক বড়। পৃথিবীকে বাঁচানোর চাবিকাঠি শুধু মঙ্গল গ্রহের কোনো উপাদান নয়, বরং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ্য বসবাস। একটা গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে অগ্নি ডিভাইসটি পরল। হঠাৎ, ধাতব কক্ষটি কম্পমান হতে শুরু করল। দেওয়ালে একটা ফাঁকা ফুটো হলো, আর তার মধ্যে থেকে আলো বের হলো। অগ্নি চোখ বন্ধ করল। চোখ খুললে সে দেখল সে নিঃশ্বাসের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। সকালের সূর্য উঠছে, আর ঝড় থাম হয়ে গেছে। হাতে ছিল ধাতব কন্টেনারটি। মনে পড়ল অদ্ভুত প্রাণীটির কথা।
অগ্নি জানতো, সে যে ডিভাইসটি পরেছিল, সেটা সম্ভবত তাকে মরুভূমের নিরাপদ স্থানে ফিরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে, সেটা তার জানার আওতায় নেই। কিন্তু একটা জিনিস সে নিশ্চিত ছিল, পৃথিবীকে বাঁচানোর লড়াই এখনো শেষ হয়নি। মঙ্গল গ্রহের উপাদান গবেষণা হয়তো থেমে যাবে, কিন্তু প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ্য বিধানের গবেষণা শুরু হবে। সেই গবেষণায় তার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তার উপর একটা বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে, সেটা সে বুঝতে পারছিল।
অগ্নি হাত বাড়িয়ে কাছে থাকা একটা বালির ঢিবির উপর উঠল। সেখান থেকে চারপাশে তাকাল। বিশাল মরুভূমি, এখন আর নিষ্ঠুর মনে হলো না। সূর্যের আলোয় বালিগুলো ঝকমকাচ্ছে। হয়তো এই মরুভূমিকেও বাঁচানোর দরকার, যাতে সে আবার সবু হয়ে উঠতে পারে।
কম্পিউটারের সাথে সংযোগ স্থাপন করে অগ্নি কন্ট্রোল সেন্টারকে জানালো তার অবস্থান এবং নিরাপদে ফিরে আসার খবর। তারপর সে কন্টেনারটি খুলল। ভিতরে ছিল স্বচ্ছ, নীল তরল পদার্থের মতো কিছু, কিন্তু আরো জটিল গঠন। এটাই কি পৃথিবীকে বাঁচানোর আসল সমাধান? সম্ভবত।
মিশন কন্ট্রোল থেকে উদ্ধারকারী দল আসতে কিছুটা সময় লাগবে। অগ্নি সেই সময়টা কাজে লাগাল। সে তার অভিজ্ঞতা, অদ্ভুত প্রাণীদের কথা, এবং দেওয়ালে দেখা ত্রি-মাত্রিক চিত্রের বিবরণ নোট করতে শুরু করল। এগুলো হয়তো ভবিষ্যতে গবেষণায় কাজে লাগবে।
কিছুক্ষণ পরে দূরে একটি ক্ষুদ্র মরুভূমি যানের আলো দেখা গেল। উদ্ধারকারী দল এসে পৌঁছেছে। অগ্নি তাদের দিকে হাত নাড়ল। সে জানতো, তার কাছে থাকা নমুনা পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে। কিন্তু সে আরো জানতো, এই নমুনা শুধু একটা সমাধান নয়, বরং একটা সতর্কবার্তা – প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ না করে, তার সাথে বসবাস করতে শেখাটাই হলো আসল সমাধান। পৃথিবীকে বাঁচানোর লড়াই এখনো শুরু হলো মাত্র।