অপর্ণা, ছেলেবেলা থেকেই লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে। লেখালেখিতে তার দক্ষতা অসাধারণ, কিন্তু প্রকাশকরা তার লেখা ফিরিয়ে দেন বার বার। অপর্ণার হতাশা গভীর হতে থাকে। অন্যদিকে, সোহম একজন প্রতিভাবান সঙ্গীতশিল্পী। কিন্তু পরিবারের চাপে চাকরি নিয়েছে ব্যাংকে। তার গানের স্বপ্নগুলো ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে। এই দুই অপূর্ণ স্বপ্নের মানুষের জীবনে এক অদ্ভুত মোড় ঘটে যখন তারা দুজনেই ‘পুরোনো বইমেলা’য় একই স্টলে দেখা করেন। অপর্ণা তার লেখা দেখাতে এসেছে, আর সোহম খুঁজছে তার প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়ের আঁকা লেখাগুলি।
স্টলে দাঁড়িয়ে থাকা বয়স্ক ব্যক্তিটি হলেন সূর্যকাকা, মেলার আয়োজক। অপর্ণার লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যান তিনি। সূর্যকাকা অপর্ণাকে আশ্বাস দেন, তিনি তার লেখা একটা ছোট প্রকাশনার সংস্থার কাছে পাঠিয়ে দেবেন। সোহমের গানের প্রতিভাও ধরে ফেলেন সূর্যকাকা। তিনি সোহমকে প্রস্তাব দেন, মেলার শেষ দিনে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য।
অপর্ণা আশায় আকাশ ছোঁয়া। সোহমের মধ্যেও জাগে আশার সুর। কিন্তু এই আশার সাথে জড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তা। প্রকাশকরা কি তার লেখা নেবেন? সোহমের গান কি মানুষের মন ছুঁইবে? এই সব প্রশ্ন তাদের মাঝে এক অস্থিরতা জাগিয়ে দেয়।
মেলার শেষ দিন। অপর্ণা অস্থির হয়ে স্টলে বসে আছেন। হঠাৎ, একজন প্রকাশক আসেন। তিনি অপর্ণার লেখা পড়েছেন এবং খুবই মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি অপর্ণার সাথে চুক্তি করতে চান! একই সময়ে, মঞ্চে দাঁড়িয়ে সোহম তার মনের সুরে গান গেয়ে যাচ্ছেন। তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে যায় দর্শকরা। অনুষ্ঠান শেষে একটা বড় রেকর্ড কোম্পানির প্রতিনিধি সোহমের সাথে দেখা করতে চান।
এইভাবে অপর্ণা আর সোহমের জীবনে এক অবিশ্বাস্য মোড় ঘটে যায়। তাদের অক্লান্ত চেষ্টা আর স্বপ্নের প্রতি অবিচল থাকা তাদের সাফল্য এনে দেয়। এই গল্প আমাদের শেখায়, স্বপ্নের পিছনে ছোটা ছেড়ে দেওয়া যায় না। চ্যালেঞ্জ আসবেই, কিন্তু হার মানা চলবে না। নিজের মধ্যে থাকা প্রতিভা আর দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের ভাগ্য গড়তে হবে।
অপর্ণা আর সোহমের জীবন যেন রাতের আকাশে দুটি উজ্জ্বল তারার মতো ঝলমল করে উঠল। প্রকাশকের সাথে চুক্তি সারা হলো। অপর্ণা দিন-রাত লেখায় মগ্ন হলেন। তার লেখা ‘অপূর্ণ স্বপ্ন’ শিরোনামে বইটি বের হতেই ব্যাপক সাড়া পড়ল। বইটি সেরা বিক্রেতার তালিকায় ঠাঁই করে নিল। অপর্ণার নাম সাহিত্য জগতে ছড়িয়ে পড়ল।
অন্যদিকে, সোহমেরও জীবন পাল্টে গেল। রেকর্ড কোম্পানি তার গান রেকর্ড করল। তার ‘মোহনা’ গানটি মুক্তি পাওয়ার পর রাতারাতি সেনসেশন হয়ে উঠল। সোহমের গানে মুগ্ধ হলো সারা দেশ। শো চলতে লাগলো একের পর এক। সোহমের স্বপ্নের সাথে সংসারও সুন্দর হলো। সে তার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি গানের জগতে ঢুকে গেল।
কিন্তু সফলতার এই ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে অপর্ণা আর সোহম কোথায় যেন হারিয়ে ফেললেন তাদের পুরনো দিনগুলো। তারা আর আগের মতো একে অপেরের সাথে সময় কাটাতেন না। ফোনে কথা বলার সময়ও পাওয়া যেত না।
একদিন, অপর্ণা একটা বইমেলায় স্বাক্ষর দিচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় সোহম সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। জনতা, সাক্ষাৎকার, স্বাক্ষর দেওয়া – এই সবের মাঝে অপর্ণা সোহমকে ঠিকমতো কথা বলতে পারলেন না। সন্ধ্যের একটা অনুষ্ঠানে সোহমের গান ছিল। অপর্ণা সেখানে গেলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষে সোহমের সাথে দেখা করার সুযোগ পেলেন না।
অনেক রাতে, বাড়ি ফিরে অপর্ণা বুঝতে পারলেন, কোথায় যেন একটা ফাঁক তৈরি হয়েছে তাদের সম্পর্কে। সোহমকে ফোন করলেন। কিন্তু ফোন বন্ধ। অপর্ণার মনে এক অস্বস্তি থেকে গেল।
এর পরের কয়েকটা দিন অপর্ণা আর সোহমের কোনো দেখা-সাক্ষাৎ হলো না। ফোনেও যোগাযোগ করা গেল না। অবশেষে একদিন সকালে অপর্ণা দেখলেন, সোহমের একটা মেসেজ এসেছে। মেসেজে লেখা আছে, সে ঋষিকেশ যাচ্ছে একটু মনের শান্তি খুঁজতে। কয়েকটা দিনের মধ্যে ফিরবে।
অপর্ণার মন খারাপ হয়ে গেল। সোহমের সাথে কথা না বলতে পারার কষ্ট, তার উপর এই একাকীত্ব – সব মিলিয়ে অপর্ণা এক অসহ্য পরিস্তিতির এর মধ্যে পড়ে গেলেন।
কয়েকটা দিন কাটলো। হঠাৎ একদিন অপর্ণার মনে হলো, লেখা লেখার টেবিলে বসলেও অপর্ণার মন কোনোভাবেই লেখায় স্থির হতে চাইল না। সোহমের ছেড়ে যাওয়া, তাদের দূরত্ব – সবকিছুই ঘুরপাক খাচ্ছিল মনের কোণে। হঠাৎ, অপর্ণার চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা একটা ছবিতে। সেই ছবিটা ছিল ‘পুরোনো বইমেলা’র। ছবিতে দুজনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন, সূর্যকাকার স্টলের সামনে। সেই দিন, যেদিন তাদের জীবনে এক অবিশ্বাস্য মোড় এসেছিল।
অতীতের সেই স্মৃতি স্পর্শ করতেই অপর্ণার মনে একটা চিন্তা জাগল। সোহম কি ঋষিকেশ যাচ্ছে? নাকি সে কোনো গানের অনুষ্ঠানের জন্য কোথাও বেরিয়েছে? সোহমের কোনো খবর না পাওয়ার অস্বস্তি আর তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না।
অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলেন, সোহমকে খুঁজে বের করবেন। ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন। কিছুক্ষণ পরেই একটা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট চোখে পড়ল। পোস্টটি ছিল ঋষিকেশের একটা গেস্ট হাউসের। পোস্টের ক্যাপশনে লেখা ছিল, ‘এই সপ্তাহান্তে আমাদের সাথে থাকবেন প্রতিভাবান গায়ক সোহম রায়।’
অপর্ণা আর দেরি না করে গেস্ট হাউসটিকে ফোন করলেন। সোহমের কথা বলতে চাইলেন। কিন্তু, জানা গেল সোহম এখন মেডিটেশনে আছেন। তাকে ফোনে পাওয়া যাবে না।
হতাশা নেমে এল অপর্ণার মনে। তবে এবার সে হাল ছেড়ে দেবেন না, সেটা ঠিক করলেন। পরের দিনই সকালের প্রথম ট্রেনে ঋষিকেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।
ঋষিকেশের পাহাড়ি রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলতে থাকল। অপর্ণার মন অস্থির। সোহমের সাথে কীভাবে দেখা হবে, কী বলা যাবে – এই সব চিন্তায় তার বুকটা কেমন যেন হু হু করে উঠছিল। অবশেষে গেস্ট হাউসে পৌঁছলেন। সোহমের রুমের নাম্বার জেনে সেখানে গিয়ে দেখলেন, দরজা বন্ধ। হালকা ধাক্কা দিতেই দরজা খুলে গেল।
রুমের ভিতরে সোহম বসে ছিলেন। জানালার পাশে, একটা মাদুরের উপর। চোখ বন্ধ, মনে মনে কি যেন জপ করছিলেন। অপর্ণা দরজার ফাঁক দিয়ে একটু দাঁড়িয়ে রইলেন। সোহমের এই শান্ত মুখখানি দেখে অপর্ণার মনের রাগ কিছুটা কমে গেল। কিন্তু, সাথে সাথে জাগল একটা প্রশ্ন – ঋষিকেশে এসে সোহম ঠিক কী খুঁজছে?
কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর অপর্ণা আস্তে আস্তে সোহমের কাছে এগিয়ে গেলেন। সোহমের চোখ এখনও বন্ধ।
“সোহম,” অপর্ণার গলাটা কাঁপছিল।
সোহম চোখ খুললেন। অপর্ণাকে দেখে চমকে গেলেন।
“অপর্ণা! তুমি এখানে? কীসের এত তাড়া?”
“তোমাকে দেখতে এসেছি,” অপর্ণা উত্তর দিলেন, “তুমি ঠিক কোথায় যাচ্ছিলে, কাউকে কিছু বলোনি কেন?”
সোহম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “আমি কোথাও যাচ্ছিলাম না, অপর্ণা। একটু মনের শান্তি খুঁজছিলাম।”
“মনের শান্তি? কেন?”
“আমাদের সম্পর্কটা কোথায় যেন আটকে গেছে, অপর্ণা। সারাক্ষণ কাজ, সফর – আমরা একে অপেরের জন্য সময় দিতে পারছি না।”
অপর্ণা সোহমের সামনের মাদুরে বসে পড়লেন। “ঠিক কথাই বলছো। কিন্তু, এই সমস্যাটা তো হঠাৎ হয়নি, সোহম।”
“হয়নি ঠিকই, কিন্তু এখন আর সহ্য হচ্ছে না।” সোহম বললেন, “আমার মনে হয়, আমরা দু’জনেই আমাদের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে গিয়ে আমাদের সম্পর্কের দিকে খেয়াল রাখতে ভুলে গেছি।”
অপর্ণা সোহমের কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন। সোহম ঠিকই বলছিল। সাফল্যের এই ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে তারা কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছিল তাদের আগের সেই দিনগুলো, যখন তারা একে অপেরের সাথে সময় কাটাতে, গল্প করতে, স্বপ্নের কথা ভাগ করে নিতে এতটা আগ্রহী ছিল।
“কী করা উচিত মনে হয়, সোহম?” অপর্ণা জিজ্ঞাসা করলেন।
সোহম অপর্ণার হাতটা ধরলেন। তার চোখে একটা নতুন আশা দেখা গেল। “চল, ফিরে যাই, অ
“চল, ফিরে যাই, অপর্ণা।” সোহমের কথাগুলো শুনে অপর্ণার মনেও একটা আশার সুর জাগল। সে সোহমের হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরল। “হ্যাঁ, ফিরে যাই। কিন্তু শুধু ফিরে যাওয়াই যথেষ্ট হবে না। আমাদের বদলাতে হবে।”
“কীভাবে?” সোহম জিজ্ঞাসা করল।
“আমাদের একটা ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে,” অপর্ণা বলল, “স্বপ্নের সাথে সাথে আমাদের সম্পর্ককেও গুরুত্ব দিতে হবে। নিজেদের মধ্যে সময় বের করতে হবে। ঠিক আগের মতো।”
সোহম হাসল, “আগের মতোই সন্ধেবেলার গল্প, রাতে একসাথে তারা দেখা – এই সব?”
“হ্যাঁ, ঠিক সেই সব।” অপর্ণাও হাসল। তার মনে পড়ল, ‘পুরোনো বইমেলা’র সেই দিন। কিভাবে দুটো অপূর্ণ স্বপ্নের মানুষের জীবন একাকার হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে তারা যেন সেই একত্ব হারিয়ে ফেলেছিল। এখন ফিরে যেতে হবে সেই জায়গায়।
ঋষিকেশ থেকে ফিরে এসে অপর্ণা আর সোহম আগের চেয়ে বেশি সচেত হলো তাদের সম্পর্ক নিয়ে। সপ্তাহে একদিন তারা নিজেদের জন্য আলাদা করে রাখল। সেদিন কোনো কাজ, কোনো ফোন – শুধু তারা দু’জনে।
একদিন, সেই নিজেদের দিনে তারা আবার গেল ‘পুরোনো বইমেলা’য়। সেই স্টলে গিয়ে দেখলেন, সূর্যকাকা আর নেই। কিন্তু তার ছেলে রয়েছেন। ছেলেটি জানতে চাইল, কী খুঁজছেন।
অপর্ণা হাসলেন, “কিছু না, অতীতের স্মৃতিটুকুই খুঁজে এলাম।”
ছেলেটি তাদের দু’জনকে দেখে চমকে উঠল, “আপনারাই? সেই লেখিকা আর গায়ক?”
অপর্ণা মাথা নাড়লেন। “না, আমরা দু’জনেই লেখক। আমাদের লেখার জন্ম হয়েছিল এই মেলায়। আর সূর্যকাকার আশীর্বাদে।”
ছেলেটি হাসল, “তাহলে লেখা লিখুন। আমাদের মেলা, সবার স্বপ্নের জন্মভূমি।”
অপর্ণা আর সোহম হাত ধরাধরা বেরিয়ে এলো মেলা থেকে। তাদের স্বপ্নের পথ চলতে থাকবে, কিন্তু এবার সাথে সাথে। আর মাঝে মাঝে, ফিরে আসবে তারা এই ‘পুরোনো বইমেলা’য়, তাদের প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিটুকু জাগিয়ে রাখতে।