ছোটবেলায় শান্তি একটা নিঃসঙ্গ মেয়ে ছিল। তার বয়সী কেউ থাকত না পাড়ায়। সারাটা দিন একা থাকতে থাকতে কেমন জানি একটা বিষণ্ণতা চেপে ধরতো। বড়দের সঙ্গ তাকে আনন্দ দিত না। তার মনের মতো খেলা করার বা গল্প করার কেউ ছিল না। কিন্তু একটা ক্রিসমাসের রাতে তার জীবনে এলো এক অসাধারণ পরিবর্তন।
সেদিন রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে শান্তির মনে কেবলই একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল – কুকুরছানা! সে মাকে কত কাকুতি মিনতি করেছিল, কিন্তু মা বলেছিলেন, “কুকুরছানা ঠিক আছে, কিন্তু তার দেখাশোনাটা তুমি একাই করতে পারবে না।” অসম্ভব হতাশায় সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙতেই সে যা দেখলো, তাতে তার চোখ ছানিয়ে উঠলো। বিছানার পাশেই বসে আছে একটা ছোট্ট, সাদা, লম্বা লোমের পোষা কুকুরছানা!
শান্তি তো আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে ঝাঁপিয়ে পড়লো কুকুরছানার ওপর, জড়িয়ে ধরলো। কুকুরছানাটাও তার লেজ দলিয়ে খেলতে শুরু করলো। শান্তি জিজ্ঞাসা করলো, “মা, এটা আমার?” মা হাসলেন, “হ্যাঁ, তোর ক্রিসমাস উপহার!” সেদিন থেকে শান্তির নাম হলো শান্তি আর কুকুরছানার নাম হলো শঙ্কর।
শঙ্কর ছিল একটা চঞ্চল কুকুরছানা। শান্তির মতোই সেও সারা ক্ষণ খেলা করতে চাইত। তারা দুজনে খেলতো, দৌড়াদৌড়ি করতো, লুকোচুরি খেলতো। শঙ্কর খুব তাড়াতা শেখা নিত। শান্তি তাকে বল দিয়ে আনা, হাত ছুঁয়ে বসা, এমনকি দাঁড়িয়ে হাঁটাও শিখিয়ে দিল। তারপর শঙ্করকে নিয়ে পাড়া জুড়ে ঘুরতো শান্তি। সবাই দেখতো শঙ্করের কাণ্ডকারখানা আর শান্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা। এভাবেই শান্তি অনেক বন্ধু লাভ করলো।
শঙ্করের সাহায্যে শান্তি আর নিঃসঙ্গ ছিল না। সে এখন সব সময় খেলাধুলা আর গল্প করার জন্য কাউকে না কাউকে পেতো। শঙ্করের সাথে থাকতে থাকতে শান্তিও অনেকটা সাহসী হয়ে উঠলো। এখন সে আর বড়দের সঙ্গেও কথা বলতে ও খেলা করতে পারে।
কিন্তু একদিন ঘটলো এক বিপত্তি। সন্ধ্যায় পার্কে খেলার সময় শঙ্কর হঠাৎ করেই হারিয়ে গেল। শান্তি সারা পাড়া খুঁজেও তাকে পেল না। সে কান্নাজড়িয়ে বাড়ি ফিরলো। শঙ্কর রাতেও ফিরলো না। শান্তি সারারাত কাটলো অসহ্য উদ্বেগের মধ্যে। সকালে শান্তি খুব সকালেই ঘুম থেকে উঠে পড়ল। সে জানতো, শঙ্কর হারিয়ে গেলে প্রথমে কোথায় খুঁজতে হবে। বাড়ির উঠোনের পাশেই ছিল একটা পুরনো, পরিত্যক্ত বাড়ি। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করতে সেখানে যেতো না, কিন্তু কখনো কখনো কুকুররা ঢুকে পড়তো। দৌড়ে সেই বাড়ির দিকে ছুটলো শান্তি।
বাড়ির ভাঙা জানালার কাছে গিয়ে ডাক দিল, “শঙ্কর! শঙ্কর!” জবাব এলো না। কিন্তু হঠাৎ একটা দুর্বল আওয়াজ শোনা গেল। ভাঙা দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে একটু উঁকি মারলো শান্তি। দেখলো, একটা ইটের নিচে আটকে আছে শঙ্কর। তার একটা পা আটকে গেছে, তাই সে নড়তে পারছে না। ভয় পেয়ে গেল শান্তি। কী করা উচিত বুঝতে পারলো না সে।
এমন সময় রাস্তা দিয়ে একটা মিস্ত্রি চলেছে। শান্তি দৌড়িয়ে গিয়ে তাকে সাহায্যের জন্য ডাকলো। মিস্ত্রিটি সব শুনে বাড়ির কাছে এলেন। দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখে বুঝলেন, কি অবস্থা। তিনি হাতুড়ি-কাঠি নিয়ে এসে দেওয়ালের একটা অংশ ভাঙলেন। সাবধানে ইট সরিয়ে শঙ্করকে বের করলেন। শঙ্কর একটু কষ্ট পেয়েছিল, কিন্তু কোনো গুরুতর আঘাত পায়নি।
শান্তি আনন্দে শঙ্করকে জড়িয়ে ধরলো। মিস্ত্রিকে ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ির দিকে ছুটলো। সারা সকাল খাবার খেতে পারেনি সে, কিন্তু এখন তার খুব ক্ষুধা লেগেছে। মা বাবার মুখে হাসি দেখে সে আরও বেশি খুশি হলো।
ঐ ঘটনার পর থেকে শঙ্কর আর কখনো পালিয়ে যায়নি। সে বুঝতে পেরেছিল, বাড়ির বাইরে একা থাকা তার জন্য নিরাপদ নয়। আর শান্তিও শিখলো, কোন জায়গায় খেলা করা ঠিক নয়। তারা দুজনেই একে অপরের প্রতি আরও বেশি মমতা অনুভব করতে শুরু করলো। শান্তির একাকী জীবনে শঙ্কর এনে দিলো আনন্দ, বন্ধুত্ব আর অঢেল ভালোবাসা।
খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লো পাড়ায়। শঙ্করকে বাঁচানোর গল্পটা শুনে সবাই শান্তিকে প্রশংসা করলো। তার সাহস আর ধৈর্যের কথা মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। এবার আর কেউ শান্তিকে নিঃসঙ্গ মেয়ে ভাবলো না। সবাই জানতো, তার পাশে আছে একটা বিশ্বস্ত বন্ধু, শঙ্কর।
এই ঘটনার পর থেকে শান্তির জীবনে এলো আরও একটা পরিবর্তন। পাড়ার ছেলেমেয়েরা এখন আর শুধু শঙ্করের খেলা দেখতে আসতো না, তারা শান্তির সাথেও খেলা করতো। শান্তি তাদের নানা রকম গল্প বলতো, শেখাতো নতুন নতুন খেলা। সে এখন আর একা একা বসে থাকতো না। সারা দিন কোন না কোন বন্ধুর সাথে খেলাধুলা, আড্ডা।
একদিন বিকেলে সবাই মিলে খেলার সময় শান্তি একটা নতুন খেলার কথা বললো। “চলো, আজকে আমরা গোয়েন্দাগিরি খেলা খেলি!” সবার মুখে উত্তেজনা। শান্তি বললো, “আমাদের একটা খেলার জিনিস চাই। কী নেব?” সবাই ভাবতে লাগলো। হঠাৎ একটা ছেলে বলে উঠলো, “শঙ্করকে নেওয়া যাক!”
শান্তি হাসলো, “শঙ্কর তো আমাদের সঙ্গী, সে চোর হতে পারে না!” কিন্তু অন্য ছেলেমেয়েরা রাজি হলো না। তারা বললো, “শঙ্করের গন্ধের সাহায্যে আমরা চোরকে খুঁজে বের করতে পারব!”
ঠিক আছে, খেলা শুরু হলো। একটা ছেলে হলো চোর। সে ছোট্ট একটা কাগজের টুকরো লুকিয়ে রাখলো বাড়ির কোনো এক জায়গায়। শঙ্করকে ছেড়ে দেওয়া হলো। সে তার নাক ডুগডুগিয়ে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। একটু পর সে থামলো, লেজ দলিয়ে বাঁয়ে ঘুরে দাঁড়াল। সবাই জানলো, সে কিছু খুঁজে পেয়েছে। তার গন্ধের সাহায্যে ছেলেময়েরা খুঁজে বের করলো লুকানো জিনিসটা।
খেলাটা চললো আরো কিছুক্ষণ। প্রতিবারই শঙ্করের গন্ধের সাহায্যে চোরকে ধরা পড়ে যেতো। শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে গেল। বাড়ি ফিরার সময় শান্তি শঙ্করকে জড়িয়ে ধরে বললো, “তুই না থাকলে আমাদের গোয়েন্দাগিরি খেলাটা এত মজা হতো না!” শঙ্কর তার লেজ দলিয়ে খেলা করতে থাকলো।
এইভাবে শান্তি আর শঙ্করের বন্ধুত্ব আরো দৃঢ় হলো। তারা দুজনেই একে অপরের জীবনকে পূর্ণ করে তুললো। শান্তি পেলো একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী, আর শঙ্কর পেলো ভালোবাসা আর যত্ন। তাদের বন্ধুত্বের গল্প শুনে সবাই খুশি হতো।
কিছুদিন পরে শান্তির স্কুলে একটা আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হলো। সেখানে থাকবে নানা রকম খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, আর ছিলো একটি বিশেষ বিভাগ – ‘পালিত পশু প্রদর্শনী’। শান্তি জানতো, শঙ্কর খুব চটপট শেখে নিতে পারে। তাই সে ঠিক করলো, শঙ্করকে নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে।
কয়েক সপ্তাহ ধরে শান্তি শঙ্করকে প্রতিদিন নতুন নতুন কায়দা শেখালো। শঙ্কর শেখা নিলো দৌড়ে গিয়ে বল ধরে আনা, দুই পা দাঁড়িয়ে হাত টিপ দেওয়া, এমনকি কিছু সহজ কমান্ড শোনা মাত্রই সেগুলো মেনে চলা। প্রতিযোগিতার আগের দিন শান্তি একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো। কারণ, অন্যান্য ছেলেমেয়েরা হয়তো তাদের পোষা প্রাণীদের আরও বেশি কঠিন কায়দা শিখিয়েছে।
কিন্তু প্রতিযোগিতার দিন মাঠে গিয়ে শান্তি স্বস্তি পেল। অন্যদের পোষা প্রাণীরা যেমন বিলাসবহুল কুকুরের জাত, এরকম কিছু ছিল না। বরং, অনেকটা সাধারণ দেখতে কয়েকটা কুকুর, একটা বিড়াল, আর এমনকি একটা খরগোশ-ও ছিল।
শান্তির পালা এলো। সে আত্মবিশ্বাসের সাথে শঙ্করকে নিয়ে মাঠের মাঝখানে দাঁড়ালো। নির্দেশকের কথামতো, শান্তি শঙ্করকে কয়েকটা কমান্ড দিল। শঙ্কর সবকিছু নিখুঁতভাবে মেনে চললো। সে দৌড়ে গিয়ে বল ধরে এনে দিল, দুই পা দাঁড়িয়ে হাত টিপ দিল, এমনকি শান্তির পাশে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলো।
শঙ্করের পারফর্মেন্স দেখে বিচারকরা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার সহজ কিন্তু পরিষ্কার কায়দাগুলো তাদের মন জয় নিল। প্রতিযোগিতার শেষে ঘোষণা এলো – ‘পালিত পশু প্রদর্শনী’ বিভাগের বিজয়ী – শান্তি এবং শঙ্কর!
শান্তি আনন্দে আটখানো গেল না। সে শঙ্করকে জড়িয়ে ধরে লাফালাফি করতে লাগলো। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা-মাও ছেলের সাফল্যে গর্ববোধ করলেন। শঙ্কর তো লেজ দলিয়ে আকাশ-পাতাল এক করছিল। সে বুঝতে পারছিল না কি হচ্ছে, কিন্তু শান্তির আনন্দে সেও খুশিতে খেলা করছিল।
এই প্রতিযোগিতা শান্তি আর শঙ্করের বন্ধুত্বের গল্পকে আরও বড় করে তুললো। সবাই জানতে চাইলো, কিভাবে এতো কম সময়ে শান্তি শঙ্করকে এতো কাজ শিখিয়েছে। শান্তি হাসতে হাসতে বললো, “ভালোবাসা আর বোঝাপড়াই হলো সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা।”