কলকাতার এক জানুয়ারির শীতল সকালে মায়া সেনগুপ্ত নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে চা হাতে শহরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কলকাতার ভিড়ে, কোলাহলে, শীতের মিষ্টি হাওয়ায় তিনি যেন নিজেকে একা অনুভব করছিলেন। জীবনের এই ঘূর্ণির মাঝে তাঁর কেমন যেন একটা শূন্যতা ভর করে আছে, এক অদ্ভুত শূন্যতা, যা তাঁর হৃদয়ের গভীরে বাসা বেঁধেছে।
মায়া একজন সফল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার। নিজের পেশাগত জীবন নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট, তবে ব্যক্তিগত জীবনে কোথাও যেন বড় ফাঁক পড়ে গেছে। তাঁর স্বামী ঋষি সেনগুপ্ত একজন খ্যাতনামা আইনজীবী, যিনি প্রতিদিন সকাল থেকে রাত অবধি কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। নিজেদের সম্পর্কের প্রথমদিকে ঋষি ছিলেন একেবারেই অন্যরকম – প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, মায়ার জন্য সবসময় সময় রাখা একজন মানুষ। কিন্তু ধীরে ধীরে ঋষির পেশাগত জীবনের চাপ, মামলা-মকদ্দমার জটিলতা, এবং নিরন্তর প্রেশার যেন তাঁর পুরো সময়টাকেই গ্রাস করেছে। আজকাল সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলেও ঋষি আর মায়ার দিকে চোখ মেলে তাকান না; নিজের কাজেই ব্যস্ত থাকেন।
বিয়ের পর প্রথম কয়েক বছর সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। তাঁরা দু’জনেই নিজেদের স্বপ্ন পূরণের জন্য একে অপরের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখন যেন সেই সম্পর্কের মূল বন্ধনটিই আলগা হয়ে গেছে। মায়া অনুভব করেন যে ঋষির প্রতি তাঁর ভালোবাসা ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে আসছে, যেন কাঁচের উপর জমে থাকা ধুলোর মতো যা ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রতিদিনের এই একঘেয়েমির মধ্যে মায়া বুঝতে পারেন, তাঁর জীবনে কোথাও এক গভীর শূন্যতা রয়ে গেছে।
এই শূন্যতা থেকে মুক্তি পেতে মায়া প্রায়ই পুরনো স্মৃতির আঁধারে হারিয়ে যান। তিনি ভাবতে থাকেন তাঁর কলেজ জীবনের কথা, তখনকার সেই প্রাণবন্ত দিনগুলো। সেদিনগুলোতে তাঁর এক বন্ধু ছিল, দেব। দেব এবং মায়ার মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব ছিল, যেটা সময়ের সাথে সাথে হারিয়ে গেছে। দেব ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলির মধ্যে একজন, একেবারে হাওয়ার মতো নরম, কিন্তু ভীষণ দৃঢ়। দেব সবসময়ই তাঁকে অনুভব করাতে পারত যে জীবনে আরও অনেক কিছুই আছে, যা তাঁকে হাসায়, বাঁচায়।
হঠাৎ করে তাঁর ফোনে একটি মেসেজ আসে। ডিজাইনারদের একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স জয়পুরে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে, আর তাঁকে সেখানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রথমে মায়া কিছুটা দ্বিধায় থাকলেও, পরে মনে হল, এটা হয়তো তাঁর জন্য ভালো একটা সুযোগ। এই ব্যস্ত শহরের জটিলতার মধ্যে, ঋষির নিঃশব্দ দূরত্বের মধ্যে, হয়তো তিনি কিছুটা নিজের মতো করে সময় কাটাতে পারবেন।
কিছুদিন পর, তিনি যখন জয়পুরে পৌঁছান, তখন সেখানে এক রঙিন উৎসবমুখর পরিবেশ। কনফারেন্সের দ্বিতীয় দিন এক সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই পুরনো বন্ধু দেবের সাথে দেখা হয়ে যায় তাঁর। দেব এখন সফল একজন আর্কিটেক্ট, এবং তাঁকে দেখে মায়ার মন আনন্দে ভরে ওঠে। দেবের মধ্যেও মায়ার প্রতি এক গভীর ভালোবাসা ছিল, যদিও সে তা কখনও বলেনি। সেই ভালোবাসা আজও দেবের মনে ছিল, সে তা অনুভব করতে পারে।
সন্ধ্যার আকাশের নীচে তাঁরা গল্পে মেতে ওঠেন। পুরনো দিনগুলির স্মৃতিচারণ, কলেজের মজার গল্প, জীবনের ওঠাপড়া সবকিছু যেন এক নতুন জীবন পায় দেবের উপস্থিতিতে। মায়ার মনে হয়, সেই শূন্যতা যেন একটু একটু করে পূর্ণ হচ্ছে। দেবের কথা শুনতে শুনতে, হাসতে হাসতে, মায়া আবার জীবনের একটা নতুন রঙ খুঁজে পান।
তবে মনের কোণে একটা ভয়ও রয়েছে। মায়া জানেন যে, এই মুহূর্তগুলো অস্থায়ী। এই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি একজন বিবাহিত নারী। তাঁর জীবনে ঋষির দায়িত্ব রয়েছে, কিন্তু তারপরও যেন একটা অদ্ভুত টান অনুভব করেন দেবের প্রতি। দেবের চোখে যেন তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে এক অজানা সমুদ্র, যেখানে তিনি ডুবে যেতে চান, সবকিছু ভুলে, সবকিছু ছেড়ে।
এই দ্বিধা-ভরা মনের মধ্যে তিনি জয়পুরে কাটানো প্রতিটি মুহূর্তকে বাঁচিয়ে রাখতে চান। সময়ের এই ক্ষুদ্র, কিন্তু গভীর টান তাঁকে আবারও জীবনের প্রতি আশাবাদী করে তোলে।
সন্ধ্যার আলো একটু একটু করে নিভে আসে, আর মায়া সেই রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করা তারা দেখে ভাবতে থাকেন তাঁর জীবনের এই অদ্ভুত টানাপোড়েনের কথা। তিনি জানেন, এ পথে এগোতে গেলে তাঁকে আরও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই ভাবনাতেই রাত গভীর হয়ে আসে, কিন্তু তাঁর মনের গভীরে দেবের সেই হাসি, কথাগুলি যেন বেঁচে থাকে, তাঁকে এক নতুন জাগরণের দিকে নিয়ে যায়। তাঁর জীবনের এই নতুন অধ্যায়ের শুরু এখানেই, যা তাঁকে জীবনের নতুন পথে পা বাড়াতে উত্সাহিত করে।
পুনর্মিলন
মায়া রাজস্থানের ঐতিহ্যবাহী শহর জয়পুরে পা রাখতেই যেন একটু অন্যরকম অনুভূতি হয়। কলকাতার চাপা ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি নতুন একটা মুক্তির স্বাদ পান। রোদ ঝলমলে আকাশের নীচে, ঐতিহাসিক কেল্লা, হাওয়ামহল, এবং রাজস্থানের সেই মরুর হাওয়া যেন তাঁকে আরেকটা জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। ডিজাইন কনফারেন্সের ভিড়ে দাঁড়িয়ে মায়া নিজের ভেতরের অস্থিরতাকে সামলানোর চেষ্টা করছিলেন। এমন সময় একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পান। মায়া অবাক হয়ে মুখ ঘুরিয়ে দেখেন, সামনেই দাঁড়িয়ে আছে দেব।
“মায়া! এতদিন পরে দেখা!” দেবের চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক।
মায়ার মনে যেন হঠাৎ পুরোনো স্মৃতির বন্যা বয়ে যায়। তাঁর কলেজ জীবনের সেসব দিন, সেই প্রাণবন্ত দিনগুলোর কথা। দেবের সাথে কাটানো হাসি-মজা, তার সহজ-সরল কথা আর একটুখানি অভিমান মাখানো আবেগ।
“দেব!” মায়ার ঠোঁটের কোণে একরাশ হাসি ফুটে ওঠে। “তুমি এখানে?”
দেব হাসি দিয়ে বলে, “হ্যাঁ রে! কনফারেন্সের জন্যই আসা। ভাবতেই পারিনি তোকে দেখব এখানে!”
কথা বলতে বলতে তাঁরা দু’জনেই কনফারেন্সের বাইরে বেরিয়ে আসেন। সময় যেন তাদের জন্য থেমে যায়। পুরোনো বন্ধুদের মতো নয়, যেন বহুদিনের আলাপচারিতা আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। রঙিন আলোয় সজ্জিত জয়পুরের রাজপথে হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা নিজেদের হারিয়ে ফেলা সময়গুলো খুঁজে পান।
সন্ধ্যার আলোর মাঝে দেব মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “জানিস, তোর সেই প্রথম হাসিটা এখনও আমার মনে আছে। তোর সেই নির্ভীকতা, সেই আত্মবিশ্বাস। এখনও তুই আগের মতোই আছিস।”
মায়ার মনে হয় দেব যেন তাঁর অতীত, বর্তমান, সবটুকু জানে। এই এতগুলো বছর পরে তাঁদের মাঝে সেই পুরোনো বন্ধুত্বের উষ্ণতা যেন আরও গভীর হয়েছে।
“আমাদের কলেজ জীবনের দিনগুলো কীভাবে যেন কেটে গেল, দেব। সবকিছুই কেমন দ্রুত বদলে গেল,” মায়া গভীর শ্বাস ফেলে বলে।
“হয়তো জীবনটাই এমন। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু কিছু অনুভূতি অমলিন থাকে। আমাদের বন্ধুত্বের মতো,” দেব মায়ার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে।
রাতের আকাশের নীচে তাঁরা বসে সেসব পুরোনো স্মৃতির জাল বুনতে থাকেন। দেব তাঁর জীবনের উত্থান-পতনের গল্প বলে, কেমন করে তিনি সফল আর্কিটেক্ট হয়েছেন, আর কতটা কঠোর পরিশ্রম করেছেন। মায়া মুগ্ধ হয়ে শোনেন, যেন পুরোনো সেই দেবকেই আবার নতুন করে খুঁজে পান।
তাঁদের কথোপকথনের মাঝে এক অদ্ভুত নীরবতা নেমে আসে। যেন দু’জনের মাঝখানে এক মুগ্ধতার পর্দা ঝুলে আছে। মায়া হঠাৎ করে নিজেকে সংযত করেন। তাঁর মনে পড়ে ঋষির কথা। এই মুহূর্তে তাঁর ঋষির কথা মনে পড়লেও, কোথায় যেন একটা তীব্র শূন্যতা অনুভব করেন।
দেব মায়ার নীরবতা দেখে বুঝতে পারে যে তাঁর মনে অনেক কিছু ঘুরপাক খাচ্ছে। সে আস্তে করে বলে, “মায়া, আমি জানি তোর জীবন এখন অনেক জটিল। কিন্তু জানিস, আমি এখনও তোর সেই পুরোনো বন্ধুই আছি। সবকিছুর পরে, তোর পাশে দাঁড়ানোর জন্য।”
মায়া চোখ তুলে দেবের দিকে তাকান। তাঁর মনে হয়, এই কথাগুলো তাঁকে স্বস্তি দিচ্ছে, যেন একটা বাঁচার রশ্মি। কিন্তু তিনি জানেন, এই অনুভূতির পিছনে রয়েছে আরও অনেক জটিলতা।
কথা বলতে বলতে তাঁরা জয়পুরের পুরোনো কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে যান। রাতের আলোতে কেল্লাটি যেন আরও রহস্যময় দেখায়। দেব হঠাৎ করেই বলে, “চল, আজকের রাতটা শুধু আমাদের। সব চিন্তা ছেড়ে একটু ঘুরে আসি। আজ আমরা আমাদের পুরোনো বন্ধুদের মতোই থাকি।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর হাসতে হাসতে বলে, “ঠিক আছে, দেব। আজ রাতে আমরা শুধু বন্ধু, অতীতের সেই দিনগুলোর মতো।”
তাঁরা হাঁটতে হাঁটতে জয়পুরের সরু গলিতে ঘুরতে থাকে। পথে সেসব ছোট্ট দোকান, পুরোনো হাভেলি, আর চারপাশের রঙিন আলো যেন তাঁদের আরো কাছে নিয়ে আসে। মায়া অনুভব করেন, দেবের সাথে থাকলে তাঁর জীবনের সমস্ত শূন্যতা কোথাও যেন মিলিয়ে যায়।
তাঁদের হাঁটতে হাঁটতে মধ্যরাত হয়ে আসে। মায়া মনে করেন, এই একটুখানি সময় যেন তাঁকে তাঁর পুরোনো সত্তায় ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। তিনি ভাবতে থাকেন, দেবের প্রতি তাঁর এই অনুভূতি কি সঠিক? কিন্তু তিনি নিজের মনকে সান্ত্বনা দেন যে আজকের এই রাতটা তিনি শুধুই উপভোগ করবেন, আগামীকাল হয়তো সবকিছু আবার আগের মতোই হয়ে যাবে।
শেষে দেব তাকে বলে, “মায়া, এই মুহূর্তগুলো সবসময় আমার কাছে থাকবে। তুই জানিস না, তুই কতটা স্পেশাল আমার জন্য।”
মায়া কিছু না বলে দেবের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তাঁর মনে হয়, অনেক কিছু বলার আছে, কিন্তু কোথায় যেন আটকে যায়। এই মুহূর্তে তিনি কিছু বলতে চান না, শুধু অনুভব করতে চান এই নিরব প্রেমের মোহন।
তাঁদের এই মিষ্টি মুহূর্তের মাঝে দেব হঠাৎ বলে ওঠে, “আচ্ছা মায়া, আমরা কি সত্যিই ভবিষ্যতে এই স্মৃতিগুলো ভেবে হাসতে পারব? একে অপরের জীবন থেকে এমনিই হারিয়ে যাব?”
মায়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। “জানি না, দেব। হয়তো তেমনই হবে, হয়তো নয়। তবে আজকের এই রাতটা আমি সারাজীবন মনে রাখব।”
তাঁরা ধীরে ধীরে হোটেলের দিকে ফিরতে থাকেন। মায়া জানেন, আজকের রাতের এই পুনর্মিলন তাঁকে আবার নতুন করে চিনিয়েছে। কিন্তু তাঁর মনে এক অজানা দ্বিধা রয়েছে। দেবের সাথে এই সময় কাটানো তাঁকে আবার জীবন সম্পর্কে নতুন উপলব্ধি দিচ্ছে, কিন্তু তিনি জানেন, এর পরের পথটা সহজ হবে না। কলকাতায় ফিরেই তাঁকে ঋষির মুখোমুখি হতে হবে, তাঁকে জানাতে হবে তাঁর মনের ভাঙাগড়ার কথা।
এই চিন্তার মধ্যে দিয়েই মায়ার মনে নতুন এক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই পুনর্মিলন কি তাঁর জীবনে নতুন কোন অধ্যায়ের শুরু?
ছোটদের রূপকথার গল্প - বন্ধুর বীরত্ব: "বন্ধুর বীরত্ব" একটি হৃদয়গ্রাহী ছোটদের গল্প, যেখানে চিকু ও মীরা একসাথে বিপদ মোকাবিলা করে। এই রূপকথার গল্প বন্ধুত্বের শক্তি ও সাহসিকতা তুলে ধরে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
গোপন আকর্ষণ
কলকাতায় ফিরে এসে, মায়ার জীবনের ছন্দ যেন একটু একটু করে পাল্টে যেতে থাকে। দেবের সঙ্গে কাটানো সেই রাতের স্মৃতিগুলো বারবার তাঁর মনে ফিরে আসে। সেই রাতের হাসি-আড্ডা, পুরোনো দিনের গল্প, আর দেবের চোখের সেই নরম দৃষ্টি – সবকিছু যেন মায়ার মনের মধ্যে এক নতুন অনুভূতির সৃষ্টি করে। সে অনুভূতি, যা তাঁকে একদিকে আকর্ষণ করে আর অন্যদিকে অপরাধবোধে ভোগায়। ঋষির প্রতি তাঁর দায়িত্ব আর দেবের প্রতি এই আকর্ষণের মধ্যে আটকে গিয়ে মায়া যেন নিজের ভেতরের একটা নতুন দ্বন্দ্ব আবিষ্কার করে।
কয়েকদিন পর এক বিকেলে, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ মায়া দেবের ফোন কল পায়। দেবের গলায় সেই চিরচেনা উচ্ছ্বাস শুনে মায়ার মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে।
“কেমন আছিস, মায়া?” ফোনের ওপার থেকে দেবের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“ভালো আছি। তুই?” মায়া আস্তে করে জবাব দেয়, যেন নিজের আবেগটাকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে।
“দারুণ! শোন, তোর সাথে একটা স্পেশাল জায়গায় দেখা করতে চাই। কাল বিকেলে সময় আছে?”
মায়া কিছুক্ষণ থেমে থাকে। সে জানে এই দেখা করার অর্থ কী হতে পারে। কিন্তু মনের এক কোনে দেবের সাথে সময় কাটানোর আকর্ষণ তাকে টানতে থাকে।
“ঠিক আছে, কাল দেখা করছি,” মায়া আস্তে করে বলে।
পরের দিন বিকেলে তাঁরা হাওড়া ব্রিজের নিচে গঙ্গার ধারে দেখা করে। গঙ্গার বুকের ওপর ভাসমান সোনালী আলোয় পরিবেশটা যেন আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। দেবের পাশে বসে মায়া নিজেকে আবার সেই পুরোনো মায়ার মতোই অনুভব করেন, যিনি দায়িত্ব আর বাস্তবতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত।
দেব মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “কলেজের দিনগুলো মনে পড়ে, মায়া? সেই দিনগুলো যেন আরেকটা জীবন। কত মজা করতাম, কত স্বপ্ন ছিল।”
মায়া হাসে, “হ্যাঁ, সত্যিই। জীবনের গতি আর চাপের মধ্যে সেই দিনগুলো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুই আমাকে সেসব মনে করিয়ে দিলি।”
কথায় কথায় তাঁদের মধ্যে আবার সেই পুরোনো রসায়ন ফিরে আসে। দেবের সঙ্গে থাকা মাত্রেই মায়া নিজের মধ্যে একটা আলাদা শান্তি খুঁজে পান। কিন্তু তাঁর মনের মধ্যে একটা গোপন অপরাধবোধও কাজ করে। ঋষির কথা মনে পড়ে। তাঁর প্রতি দায়িত্ববোধ যেন তাঁকে বারবার টেনে ধরে। কিন্তু দেবের প্রতি এই আকর্ষণ, এই টান, তাঁকে বারবার সেই দায়িত্বের বেড়াজাল থেকে ছুটি নিতে বাধ্য করে।
এইভাবে কেটে যায় আরও কিছু দিন। দেব আর মায়ার মধ্যে প্রায়ই কথা হয়, মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। প্রতিবার দেখা হলে তাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত নৈকট্য তৈরি হয়। দু’জনের কথায়, দৃষ্টিতে, অনুভূতিতে যেন একটা গোপন আকর্ষণের সূক্ষ্ম সুর বাজতে থাকে। মায়া যখন দেবের সঙ্গে থাকেন, তখন সব দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা যেন কোথায় হারিয়ে যায়।
এভাবেই একদিন মায়া অনুভব করেন, দেবের প্রতি তাঁর এই টানটা আর একেবারেই সামান্য নয়। এক বিকেলে তাঁদের একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মায়া ধীরে ধীরে দেবের হাতটা ধরেন। দেব অবাক হয়ে মায়ার দিকে তাকায়। তাঁর চোখে একটা মৃদু হাসি খেলে যায়।
“মায়া, তুই ঠিক জানিস তো, আমরা কোথায় যাচ্ছি?” দেব ধীরে ধীরে জিজ্ঞাসা করে।
মায়া কিছু বলতে পারেন না। তাঁর মনে একদিকে আনন্দ, অন্যদিকে গভীর দ্বিধা। তিনি জানেন, এই অনুভূতিটা তাঁকে যে দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সেই পথে যেতে গেলে তাঁকে তাঁর জীবনের অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হবে। তবুও দেবের পাশে দাঁড়িয়ে মায়া নিজের ভেতরে এক ধরণের সাহস খুঁজে পান। হয়তো এই অনুভূতিটা তাঁকে নতুন করে বাঁচতে শেখাবে।
কিন্তু বাড়ি ফিরে আসার পর তাঁর মনের মধ্যে সেই দ্বিধাটা আবার ঘনীভূত হয়। তাঁর মনে হয়, এই আকর্ষণ কি শুধুই সাময়িক, নাকি এটা জীবনের একটা বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত? ঋষির সাথে তাঁর সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি? দেবের প্রতি এই আকর্ষণ কি তাঁকে নতুন কোন পথে নিয়ে যাবে?
এই দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাতে থাকেন মায়া। প্রতি মুহূর্তে নিজেকে প্রশ্ন করেন, কোনটা তাঁর জন্য সঠিক, কোন পথে গেলে তিনি সত্যিই সুখী হতে পারবেন। দেবের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন তাঁর জীবনের সমস্ত শূন্যতাকে পূর্ণ করে দেয়। কিন্তু সেই অপরাধবোধও তাঁকে ছেড়ে যায় না।
মায়ার এই অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম চলতে থাকে। তিনি জানেন, সামনে তাঁর জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত অপেক্ষা করছে।
সংশয়ের বাতাস
কলকাতার গাঢ় সন্ধ্যায়, নিজের ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে মায়া বাইরের শহরের আলো-আঁধারিতে ডুবে যায়। আলোছায়ার এই খেলা যেন তাঁর মনের মধ্যেও একটা দ্বিধার গাঢ় ছায়া ফেলে। ঋষির সাথে বিয়ের সম্পর্কটা অনেক পুরনো, অনেকটা দায়বদ্ধতার মতো। কিন্তু সেই সম্পর্কের মধ্যে কোথাও যেন ভালোবাসার উষ্ণতা আর খুঁজে পান না মায়া। তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে দেবের উপস্থিতি, তাঁর সেই মুগ্ধতা, সুরেলা হাসি, আর সেই স্মৃতিগুলো, যা যেন তাঁকে আবার জীবনের মাধুর্যে ফিরিয়ে আনে।
গত কয়েকদিন ধরে দেবের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাঁর মনে এক অন্যরকম ভালোলাগার অনুভূতি জাগিয়েছে। সেই পুরনো কলেজের দিনগুলো যেমন, তেমনই সেই খোলা আকাশের নিচে হাসি-ঠাট্টা করে কাটানো রাতগুলোও। মনে হচ্ছে যেন এই মুহূর্তগুলোই তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত সেই চাপা ভালবাসাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে।
এদিকে ঋষির সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটা বেশ পরিণত আর পরিপূর্ণ, কিন্তু কোথাও যেন একটা অভাব বোধ করছেন মায়া। ঋষির ব্যস্ততায়, কাজের চাপে, আর তাঁদের জীবনের দৈনন্দিন রুটিনে সম্পর্কের মাধুর্য আর স্পর্শ টিকিয়ে রাখা যেন অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ঋষি ভালো মানুষ, তাঁর প্রতি দায়বদ্ধতাও প্রচুর, কিন্তু সেই দায়বদ্ধতার বাইরেও যে ভালোবাসার এক গভীরতা আছে, তা দেবের সান্নিধ্যে তিনি আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করছেন।
সেই অনুভূতিটা, যে অনুভূতিটা যেন প্রতিবার দেবের চোখের গভীরে তাঁর নিজের প্রতিফলন খুঁজে পায়, প্রতিটি কথা তাঁর হৃদয়ে সুর তোলে, সেই অনুভূতিটাই মায়ার মনে জাগিয়ে তুলেছে ভালবাসার নতুন ব্যাখ্যা। তাঁর ভেতরে এক ধরনের অপরাধবোধ কাজ করে বটে, তবে সেই অপরাধবোধটাও তাঁর অন্তরের গোপন আকাঙ্ক্ষাকে দমন করতে পারছে না।
এরপরের কিছুদিনে দেব আর মায়ার মধ্যে কথা প্রায়ই হয়, মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎও হয়। প্রতিবার দেখা হলে তাঁদের মধ্যে একটা নতুন নৈকট্য তৈরি হয়, যেটা মায়ার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগে। দেবের সঙ্গে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত যেন তাঁর জীবনের প্রতিটি শূন্যতাকে পূর্ণ করে দেয়। অথচ, মায়ার মনে সেই অপরাধবোধের ছায়াটাও ক্রমাগত ঘনীভূত হয়।
এক সন্ধ্যায় মায়া তাঁর বন্ধুর সাথে কথোপকথনে এই বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁর বন্ধু তাকে বলে, “তুই জানিস তো, মায়া, আমাদের জীবনে কখনও কখনও এমন মানুষ আসে, যাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আমাদের মনে হয় যেন ওদের জন্যই আমরা অপেক্ষা করছিলাম। তুই নিজে ঠিক করে ভাব, কী চাই তুই? এই অনুভূতিটা কি সত্যিই সাময়িক, নাকি এটা কোনও বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে?”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিজের বন্ধুকে বলেন, “ঠিক জানি না, তবু মনে হয়, দেবের প্রতি এই টানটা শুধুই সাময়িক নয়। ঋষির প্রতি দায়বদ্ধতা আছে, তবে দেবের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো যেন আমায় আমার নিজের ভিতরের একটা দিকের সন্ধান দিচ্ছে।”
বন্ধু তাঁকে কিছুক্ষণ দেখেই বলে, “মায়া, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা যদি আমাদের মনকে শূন্যতায় ভরিয়ে দেয়, তাহলে কখনও কখনও নতুন কিছু ভাবা প্রয়োজন। তুই নিজে ঠিক করে দ্যাখ, নিজের জন্য কোনটা সত্যিই সঠিক।”
বন্ধুর কথাগুলো যেন মায়ার মনে একটা দ্বন্দ্বের দোলাচল সৃষ্টি করে। কিছুদিন পর, একটা কাজে দেব মায়াকে ফোন করে জানায়, “মায়া, এই উইকএন্ডে একটা ছোট্ট ট্রিপে যাচ্ছি, তুই কি আমার সাথে আসবি? তোকে দেখাতে চাই এমন একটা জায়গা, যেখানে গেলে হয়তো তোর মনে কিছু উত্তর আসবে।”
মায়া এক মুহূর্ত থেমে থেকে বলে, “ঠিক আছে, যাব।”
উইকএন্ডে তাঁরা গিয়ে পৌঁছান শান্তিনিকেতনের নিরিবিলি পরিবেশে, যেখানে গাছপালার ছায়ায় মায়ার মন শান্তিতে ডুবে যায়। দেব তাঁর পাশে বসে, হাতে এক কাপ চা, আর তাঁর মুখে সেই চিরচেনা হাসি। দেবের দিকে তাকিয়ে মায়া ভাবে, এই মানুষটাই কি তাঁর জীবনের সেই অভাবটুকু পূরণ করতে পারবে?
তাঁরা কথা বলতে বলতে সময় কাটাতে থাকেন। দেব মায়াকে বলে, “জানিস মায়া, তুই সবসময়ই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিস। তোর হাসি, তোর চিন্তাভাবনা সব যেন একটা নতুন পথে আমায় নিয়ে যায়। তুই কি কখনও ভেবেছিস, আমরা দু’জনে যদি অন্য কোনও পথে এগোই, তাহলে কেমন হবে?”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তাঁর মনের দ্বন্দ্ব যেন তাঁকে কিছু বলার থেকে আটকে রাখছে। তবু তিনি ধীরে ধীরে বলে, “দেব, জানি না ঠিক, তবে মনে হয় তুই আমার জীবনে এমন একটা অংশ যা আমাকে বাঁচতে শেখাচ্ছে।”
এই সময়ে দেব তাঁর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “তাহলে চল, জীবনের এই অংশটাকে আরও একটু গভীর করে দিই।”
মায়া জানেন, তাঁর জীবনে একটা বড় পরিবর্তনের অপেক্ষা করছে।
অনুভূতির বিপ্লব
কলকাতার এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে মায়া জানালার ধারে বসে আছেন। বৃষ্টির নরম সুর তাঁর হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি ফোঁটা যেন তাঁর মনের ঘূর্ণাবর্তকে ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে, তাঁকে নিয়ে যাচ্ছে এক গভীর অনুভূতির জগতে। দেবের প্রতি যে অনুভূতিগুলো তিনি এতদিন ধরে লুকিয়ে রেখেছিলেন, আজ সেগুলো যেন আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
দেবের সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো তাঁর মনে নতুন করে ভালোবাসার অর্থ খুঁজে দিয়েছে। তাঁর চোখের কোণে আজও সেই একই উজ্জ্বলতা, যা প্রথমদিন তিনি দেবের মধ্যে দেখেছিলেন। তাঁর মন যেন দেবের উপস্থিতিতে স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পায়, যা এতদিন ধরে তিনি কোথাও খুঁজে পাননি। তবু সেই অপরাধবোধ, ঋষির প্রতি তাঁর যে দায়বদ্ধতা, সেটাও তাঁকে প্রতি মুহূর্তে আটকাতে চায়।
একদিন বিকেলে, দেব মায়াকে ফোন করে জানায়, “মায়া, আজ সন্ধ্যায় তোমার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। একটা জায়গায় নিয়ে যাব, সেখানে গেলে হয়তো তুমি তোমার মনে থাকা সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।”
মায়া কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হলেও, দেবের কণ্ঠের দৃঢ়তায় এক ধরনের ভরসা খুঁজে পান। সেদিন সন্ধ্যায় তিনি দেবের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর সঙ্গে রওনা দেন। তাঁরা গাড়ি করে শহরের কোলাহল থেকে দূরে, এক ছোট্ট হ্রদের ধারে পৌঁছান। সেই নিরিবিলি জায়গার বাতাসে যেন এক মায়াময়ী পরিবেশ, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তে মায়ার মনে দেবের প্রতি তাঁর অনুভূতি আরও দৃঢ় হতে থাকে।
দেব সেখানে মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “জানি, তোমার মনে অনেক দ্বিধা। কিন্তু তুমি কি কখনও নিজেকে প্রশ্ন করেছো, কী চাই তুমি? কখনও নিজের হৃদয়ের কথা শোনার চেষ্টা করেছো?”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেন, “দেব, জানি না। এতদিন ধরে আমি শুধু দায়িত্ব পালন করে এসেছি, কিন্তু আজ মনে হচ্ছে নিজের ভালোলাগার কথাটাও ভাবতে হবে। আমার নিজের ভিতরের অনুভূতিগুলোকে আমি এতদিন ধরে অবহেলা করেছি, যেন নিজের অস্তিত্বকেই ভুলে গিয়েছি।”
দেবের চোখে এক ধরনের মায়া খেলে যায়। তিনি মায়ার দিকে তাকিয়ে বলেন, “জীবনটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। যেখানে ভালোবাসা আছে, সেখানে যদি কোনও দায়বদ্ধতা আমাদের আটকে রাখে, তাহলে সেই ভালোবাসার মূল্য দিতে হবে। ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে তার জন্য ত্যাগ করতেও পিছপা হওয়া উচিত নয়।”
মায়ার চোখে জল চলে আসে। দেবের কথাগুলো তাঁর মনে অনেকটা সাহস জোগায়। এতদিন ধরে যে অনুভূতিগুলোকে তিনি নিজে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলোকে গ্রহণ করার সাহস পাচ্ছেন। তিনি নিজের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছেন, তাঁর ভিতরে যেন নতুন করে অনুভূতির বিপ্লব চলছে।
কিছুক্ষণ পর, দেব তাঁর হাতটা ধরেন। মায়া কোনো প্রতিবাদ করেন না, বরং সেই মুহূর্তে নিজেকে তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতিতে ভাসতে দেন। দেবের স্পর্শে যেন তাঁর মনের সব দ্বিধা দূর হতে থাকে।
কিন্তু এরপরও ঋষির প্রতিও তাঁর দায়িত্ববোধ তাঁকে পিছু ছাড়ছে না। তিনি ভাবতে থাকেন, কীভাবে এই পরিস্থিতি থেকে বেরোবেন। কীভাবে তিনি দেবকে ভালোবাসবেন, ঋষিকেও আঘাত করবেন না? এই দ্বিধায় তিনি ক্রমাগত কুরে কুরে খাচ্ছেন।
রাতে বাড়ি ফেরার সময়, মায়া মনে মনে ভাবতে থাকেন, হয়তো এটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত। দেবের প্রতি তাঁর যে আকর্ষণ, সেটা শুধুই সাময়িক নাকি দীর্ঘস্থায়ী, তা তিনি সময়কেই বুঝতে দেবেন। তাঁর মনে এখনও ঋষির প্রতি এক ধরনের দায়বদ্ধতা আছে, তবে তা কি ভালোবাসার মতোই শক্তিশালী?
এমনই সব প্রশ্নের ভিড়ে তিনি রাতের ঘুম হারান। ঘড়ির কাঁটা বারবার রাত গভীরের দিকে এগিয়ে যায়, আর তাঁর মনও ততটাই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। পরদিন সকালে, মায়া এক নতুন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত হন। তিনি ঠিক করেন, যে অনুভূতি তাঁকে নতুন করে বাঁচতে শেখাচ্ছে, সেই অনুভূতির দায়ভারও তাঁকেই গ্রহণ করতে হবে।
কিন্তু কীভাবে এই পথটি এগিয়ে নেবেন, তা এখনও তাঁর কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়।
হারানোর সম্ভাবনা
একটি সন্ধ্যায়, কলকাতার আকাশে মেঘের দাপট ছিল। রিমঝিম বৃষ্টির আওয়াজ আর শহরের দূর থেকে আসা যানবাহনের শোর মধ্যে, ঋষি মায়ার কাছাকাছি বসে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি অনুভব করতে পারছিলেন যে মায়ার মধ্যে কিছু একটা বদলে যাচ্ছে। মায়ার অস্থিরতা তাঁর চোখে লেগেছিল, যেন তিনি নিজের ভিতরের মনস্তাত্ত্বিক জগতের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন।
ঋষির মনে হচ্ছিল, মায়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্কটি ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাঁরা একে অপরের মধ্যে যে ভালোবাসার আবেগটি ছিল, তা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছে। মায়া এখন যেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে, কিন্তু তিনি সেটা হারাতে ভয় পাচ্ছিলেন।
“মায়া,” ঋষি এক সন্ধ্যায় সাহস করে বললেন। “আমাদের মধ্যে কিছু একটা ভুল হচ্ছে। তুমি কি কিছু বলতে চাও?”
মায়া চুপ করে ছিলেন। তাঁর মনে কত অশান্তি চলছিল, কিন্তু সেগুলো ভাষায় প্রকাশ করার শক্তি পাচ্ছিলেন না। তিনি অনুভব করলেন, ঋশির সামনে সবকিছু খুলে বলার জন্য তাঁর প্রস্তুতি নেই।
“মায়া, আমি জানি, কিছু একটা হয়েছে। আমি তোমার চোখের মধ্যে সেই আলো আর দেখতে পাচ্ছি না। তুমি কি ভাবছো? আমাদের সম্পর্ক কি সত্যিই ভেঙে যাচ্ছে?” ঋষির কণ্ঠে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট।
মায়া তাঁর মুখ ফিরিয়ে নিলেন। “ঋষি, আমি… আমি জানি না। তুমি জানো, দেবের সঙ্গে কাটানো সময়গুলো আমাকে ভাবতে বাধ্য করছে। আমি নিজের অনুভূতিগুলো নিয়ে বিভ্রান্ত। তোমার প্রতি দায়বদ্ধতা অনুভব করছি, কিন্তু দেবের প্রতি যে আকর্ষণ, তা উপেক্ষা করাও আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।”
ঋষির হৃদয়ে যেন এক ছুরি বিঁধে গেল। “তুমি কি বলছো? তুমি কি আমার সঙ্গে এভাবে থাকতে চাও না?”
“আমি চেষ্টা করছি, সত্যি।” মায়া বললেন। “কিন্তু আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার অনুভূতিগুলো আমাকে বিভ্রান্ত করছে। আমি সবকিছু নিয়ে ভাবছি, কিন্তু কিছু একটা পরিষ্কার হচ্ছে না।”
ঋষি গভীর শ্বাস নিয়ে বললেন, “আমি জানি, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে অনেক কিছু চলছে। কিন্তু আমি চাই, আমরা আমাদের এই দূরত্বের কথা খোলামেলা আলোচনা করি। আমি চাই তোমার অনুভূতিগুলোকে বোঝার জন্য আমাদের মধ্যে কোনো গোপনীয়তা না থাকুক।”
মায়া স্তব্ধ হয়ে রইলেন। ঋষির এই খোলামেলা কথাগুলো তাঁকে কিছুটা সাহস জোগাল। “ঠিক আছে, ঋষি। আমি তোমাকে সব কিছু বলতে চাই।”
তাদের মধ্যে কথোপকথন শুরু হলো। মায়া তাঁর হৃদয়ের সমস্ত অন্ধকার দিকগুলো প্রকাশ করলেন, ঋষির কাছে তাঁর কষ্টের কথা বললেন। তিনি অনুভব করলেন, ঋষি তাঁর প্রতি কতটা যত্নশীল।
“আমি জানি, তুমি আমার জন্য সবকিছু করছো। কিন্তু আমি অনুভব করছি, তুমি আমাকে জানো না। আমি কতটা অসহায় বোধ করছি,” মায়া বললেন।
“আমি চেষ্টা করবো, মায়া। তোমার সকল অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করবো। কিন্তু তোমাকে আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি চাই, তুমি তোমার মনের কথা আমাকে বলো। আমি চাই আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি আবার শক্তিশালী হোক,” ঋষি আশ্বাস দিলেন।
মায়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, “আমি জানি, আমি তোমার সঙ্গে অনেক ভুল করেছি। আমি অনুভব করি, তুমি আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই পরিবর্তনগুলো আমাকে এতটাই আঘাত করছে যে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তোমার প্রেম, তোমার যত্ন আমাকে সবকিছু মনে করিয়ে দেয়, কিন্তু আমি জানি না কীভাবে আমি এটাকে গ্রহণ করবো।”
“তুমি যদি আমার দিকে তাকাও, তবে আমি সত্যিই চাই তোমার ভালো হওয়া। আমি চাই তোমার হৃদয় আবার হাসুক। আমি চাই তোমার চোখে আগের মতো সেই উজ্জ্বলতা ফিরে আসুক,” ঋষি বলেন, তাঁর কণ্ঠে এক ধরনের আবেগ ছিল।
মায়া কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর তিনি ঋশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি বুঝতে পারছি। আমি তোমার প্রতি কতটা ঋণী। কিন্তু আমি কীভাবে আমার অনুভূতিগুলোকে মোকাবেলা করবো? কীভাবে দেবের প্রতি আমার অনুভূতিকে ভুলে যাব?”
“এটাই তো, মায়া। তোমার অনুভূতিগুলোকে মেনে নেওয়া এবং তাদের নিয়ে আলোচনা করা। তুমি যদি তোমার হৃদয়ের কথা বুঝতে পারো, তবে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। আমাদের সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি করতে হবে এবং এটিকে ফিরিয়ে আনতে হবে,” ঋষি বললেন।
মায়ার মনে হচ্ছে, তিনি সত্যিই নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। এভাবে একসঙ্গে বসে কথা বলার মধ্য দিয়ে তাঁর আর ঋশির মধ্যে যে গভীরতা তৈরি হয়েছে, তা তাঁকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
“তুমি কি আশা করছো?” মায়া জিজ্ঞেস করলেন। “আমি সত্যিই চাই, আমরা আমাদের সম্পর্ককে পুনরায় গড়ে তুলি। কিন্তু তা করতে হলে আমি কি আমাদের অতীত থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো?”
ঋষি একটু ঠান্ডা মাথায় বললেন, “হ্যাঁ, একদম পারবে। আমাদের কষ্টগুলো আমাদেরকে আরও শক্তিশালী করে তুলবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে থাকে, আমি তোমাকে কখনও হতাশ করবো না।”
এমন সময়, মায়ার মনে একটি নতুন চিন্তা আসল। “তুমি কি মনে করো, আমাদের একসঙ্গে সময় কাটানো উচিত? হয়তো আমাদের দুজনের জন্যই এটি ভালো হবে।”
“হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি চাই তুমি এবং আমি একসঙ্গে নতুন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করি। এটা আমাদের সম্পর্ককে আরও দৃঢ় করবে,” ঋষি বললেন।
মায়ার মনে হলো, শেষ পর্যন্ত তিনি একটি সঠিক পথে পা রাখতে যাচ্ছেন। তাঁর মন থেকে দেবের সম্পর্কে অনুভূতিগুলো বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
সেই রাতে, ঋষি এবং মায়া কিছুক্ষণের জন্য হাঁটার সিদ্ধান্ত নেন। কলকাতার রাতের বাতাসে তাদের মধ্যে একটি নতুন সংযোগ তৈরি হচ্ছিল। মায়ার মনে হতে লাগল, তিনি কি সত্যিই তাঁর পুরনো অভ্যাসকে ভেঙে নতুন করে বাঁচতে পারবেন?
তাঁরা একটি পার্কে গিয়ে বসেন। সেখানে একসঙ্গে কাটানো সময়ের মধ্যে মায়া অনুভব করেন, দেবের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করছে। কিন্তু এটা কি সঠিক? তার কী হবে?
এই ভাবনার মধ্যেই মায়ার ফোন বেজে ওঠে। ফোনে দেবের নাম লেখা। মায়া কিছুটা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। ঋষির দিকে তাকান।
“দেবের ফোন,” তিনি জানান।
ঋষি কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। তারপর বললেন, “তুমি ফোনটা ধরো। আমাদের মধ্যে যাই হোক, তোমার জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
মায়ার মনে কিছুটা দ্বিধা ছিল, কিন্তু তিনি ফোনটি ধরলেন। দেবের কণ্ঠে যে আগ্রহ ছিল, সেটি তাঁকে আরও বেশি উদ্বেগে ফেলল।
“হ্যালো, মায়া! কেমন আছো?” দেব বললেন।
মায়া কিছুটা বিব্রত হয়ে বললেন, “হ্যালো, দেব।”
দেব বললেন, “তুমি কি আজ বিকেলে আমার সঙ্গে হাঁটতে চাও? আমি তোমার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলতে চাই।”
মায়া মনে মনে ভাবতে লাগলেন, এখন তো সঠিক সময় নয়। ঋষির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু দেবের কথাগুলো তাঁকে আবার বিভ্রান্ত করে তুললো।
“আমি…” তিনি অস্থির হয়ে বললেন।
ঋষি তাঁর পাশে বসে আছেন। মায়া যেন বুঝতে পারলেন, তাঁর সামনে একটি নতুন পথ খুলে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে, তাঁকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
“দেব, আমি…” মায়া বলেন, তাঁর মাথায় অনেক কিছু চলতে থাকে।
এবং ঠিক তখনই, তিনি অনুভব করলেন যে তাঁর জীবনের চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তাঁকে একদিকে পা রাখতে হবে। কিন্তু কোন দিকে? এই দ্বন্দ্বেই শেষ হবে অধ্যায় ছয়।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - পরিবর্তনের যাত্রা: "পরিবর্তনের যাত্রা" একটি অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প, যা শিক্ষার গুরুত্ব এবং সংকল্পের শক্তি নিয়ে আলোচনা করে, সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আত্ম-আবিষ্কারের পথে
ঋষির সঙ্গে খোলামেলা আলাপের পর মায়ার মনে এক নতুন আলো জ্বলে উঠল। সন্ধ্যার সূর্যাস্তের রক্তিম আভা যখন ঘরটাকে আলোকিত করছিল, তখন মায়া অনুভব করল, ঋষির কথাগুলি যেন একটি সুরের মতো বেজে উঠেছে তার মনে। ঋষির ভয়, উদ্বেগ, এবং সম্পর্কটিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা, সবকিছুই মায়ার হৃদয়ে একটি অদ্ভুত টান সৃষ্টি করেছিল।
কিন্তু দেবের প্রতি তার ভালবাসাও অবশিষ্ট ছিল। দেবের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল রোমাঞ্চকর, সৃষ্টিশীলতা এবং উদ্দীপনার, যা মায়ার জীবনে নতুন রঙ নিয়ে এসেছিল। তবে ঋষির সঙ্গেও তার সম্পর্কের গভীরতা ও বিশ্বাস ছিল। এই দ্বন্দ্বে সে বিপরীতমুখী অনুভূতির মধ্যে পড়েছিল। তার মনে একদিকে দেবের প্রতি আকর্ষণ আরেকদিকে ঋষির প্রতি সংযোগ। মায়া বুঝতে পারছিল, তার এই দ্বন্দ্ব তাকে এক নয়া আত্ম-আবিষ্কারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
একদিন সকালে, মায়া তার প্রিয় কাফেতে গিয়ে বসেছিল। একটা কাপ কফি হাতে নিয়ে সে ভাবছিল, এ জীবন কেমনভাবে চলছে। কাফের জানালার বাইরে তাকিয়ে সে আশেপাশের জগৎকে দেখছিল, যেখানে মানুষজন তাদের নিজের জীবনে ব্যস্ত। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন সেই জনতার মধ্যে একা। স্বাভাবিকভাবে, তার চিন্তা ঋষির দিকে ফিরে আসছিল। ঋষি যে কীভাবে তাকে বোঝে, তার প্রতি কতোটা যত্নশীল।
সেদিনের কফির জন্য অপেক্ষা করতে করতে, মায়ার মনকে দখল করে নিয়েছিল ঋষির কথাগুলি। “মায়া, আমি চাই তুমি আমার পাশে থাকো, আমাদের সম্পর্কের মূল্য বুঝে নাও।” ঋষির এই কথা তার মনে এক বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। কেননা, সেই কথা তার হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত অনিশ্চয়তাকে এক ঝলকেই কাটিয়ে দিয়েছিল।
দেবের প্রতি তার ভালবাসা কোনো এক ক্ষণে যেন দুর্বল মনে হচ্ছিল। যদিও সে জানত দেবের প্রতি তার আকর্ষণটি সত্যিই গভীর, তবুও ঋষির প্রতি তার যে প্রতিজ্ঞা ছিল, সেটি তাকে বারবার চিন্তিত করছিল। মায়া উপলব্ধি করল, সম্পর্কটি কেবল শারীরিক টান নয়, বরং এটি মানসিক ও আবেগীয় স্তরে একটি শক্তিশালী বন্ধন।
পরদিন সন্ধ্যায়, মায়া একটি সিদ্ধান্ত নিতে প্রস্তুত। সে ঋষির সঙ্গে আবার একটি আলাপ করতে চায়। তার মনে হচ্ছিল, এভাবে চলতে থাকলে, তারা নিজেদের সম্পর্কের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তাই সে তার মনের কথা স্পষ্টভাবে জানাতে প্রস্তুত।
“ঋষি,” মায়া ফোনে বলল, “আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই।”
ঋষি উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “অবশ্যই, মায়া। তুমি কখন আসবে?”
মায়ার মনে একটু উদ্বেগ ছিল, তবে সে জানত, এটিই সঠিক সময়। কিছুক্ষণ পরে, তারা একটি পার্কের বেঞ্চে বসেছিল। পার্কের পরিবেশটি একদম শান্ত ছিল, যেখানে শুধু পাখির ডাক আর বাতাসের মৃদু নিঃশ্বাস শোনা যাচ্ছিল।
“ঋষি,” মায়া শুরু করল, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে একটি বিশেষ কিছু আছে। তুমি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।”
ঋষি তার দিকে তাকাল, তার চোখে আশার ঝলক ছিল। “মায়া, আমি জানি আমরা গত কয়েক মাসে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে গেছি। তবে তুমি জানো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
মায়া নীরব হয়ে কিছু সময়ের জন্য ভাবল। “আমি জানি, কিন্তু দেবের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে। তার প্রতি আমার অনুভূতি সত্যিই গভীর।”
ঋষি কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। তারপর বললেন, “আমি তোমার অনুভূতিগুলোকে সম্মান করি। তবে আমি চাই তুমি তোমার হৃদয়ের সত্যিকারের কণ্ঠস্বর শোনো। তোমার ভালোবাসার দিকে তোমার চোখ খুলে দাও।”
মায়া একটু অবাক হল, “তুমি কি বলছো?”
“মায়া, তুমি যে জীবনটি বেছে নিতে চাও, সেটা তোমার নিজের। কিন্তু তোমার হৃদয় কি জানে তুমি কাকে সত্যি ভালবাসো?”
ঋষির কথা মায়ার মনে আলোড়ন তুলেছিল। সে মনে মনে ভাবছিল, কি সঠিক? তার হৃদয়, তার ভালবাসা, সবকিছু যেন এক দোলাচলে।
“আমি জানি, তোমার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের নিজেদের খুঁজে পেতে হয়।” ঋষি বললেন।
মায়ার মনে হচ্ছিল, সে যেন ঋষির কথার মধ্যে নিজের জন্য কিছু নতুন অর্থ খুঁজে পাচ্ছে। সুতরাং, সে স্থিরভাবে বলল, “আমি নিজেকে খুঁজে বের করতে চাই।”
ঋষি তার দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে বললেন, “এটাই তো সত্যিকারের আত্ম-আবিষ্কার। আমরা একসঙ্গে চলতে পারি।”
মায়ার মনে এক আশার আলো ফুটল। সে বুঝতে পারল, সে তার ভবিষ্যত নির্ধারণ করতে পারবে, যেখানে ঋষি এবং দেব উভয়ের স্থান থাকবে।
“তুমি জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মায়া। কিন্তু আমি চাই তুমি নিজেকে প্রথমে আবিষ্কার করো।”
এই কথাগুলো মায়ার মনে আরও বেশি স্থিতিশীলতা এনে দিল। সে অনুভব করল, ঋষি তাকে সত্যিই বুঝতে পারছে।
এই পর্যায়ে মায়া আরেকটি নতুন অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। সে সিদ্ধান্ত নিল, তাকে তার জীবন ও ভালোবাসার সত্যিকারের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
“আমি দেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলব,” সে বলল। “তবে আমি তোমার সঙ্গেও সময় কাটাতে চাই।”
ঋষির চোখে আনন্দের ঝিলিক দেখা দিল। “তাহলে, আমরা নতুন করে শুরু করতে পারি?”
মায়া মুচকি হাসল। “হ্যাঁ, নতুন করে।”
দুই জনের মধ্যে এক নতুন সংযোগ তৈরি হচ্ছিল।
এক সপ্তাহ পরে, মায়া দেবের সঙ্গে একটি পার্কে দেখা করতে গেল। দেবকে দেখে তার মনে এক উষ্ণ অনুভূতি হচ্ছিল। কিন্তু এইবার, সে জানত, তার হৃদয় কতটা পরিষ্কার।
“দেব,” মায়া বলল, “আমাদের সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই।”
দেবের মুখে হাসি ছিল, তবে তার চোখের মধ্যে কিছুটা উদ্বেগও।
“হ্যাঁ, মায়া। তুমি বলো।”
“আমি অনুভব করেছি, আমাদের সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা দ্বন্দ্ব আছে। আমি তোমাকে ভালোবাসি, কিন্তু ঋষির সঙ্গে আমার একটি গভীর সম্পর্ক ছিল।”
দেব এক মুহূর্ত নীরব থাকল। “তুমি সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ। আমি চাই তুমি আমার কথাগুলো বোঝো।”
দেব মাথা নেড়ে বলল, “আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, তবে আমি চাই তুমি নিজের জন্য সঠিক সিদ্ধান্ত নাও।”
মায়া তার কথায় আশ্বস্ত হল। এই আলাপচারিতা তাকে পরবর্তী অধ্যায়ের জন্য প্রস্তুত করেছিল।
এবার, তার সামনে দুটো পথ—একটি ঋষির সঙ্গে সংযোগ এবং অপরটি দেবের সঙ্গে ভালবাসা।
পরিণতির দিকে
মায়া জানত, সে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ঋষির সঙ্গে কাটানো সময়গুলি তার জন্য নতুন একটি দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেখানে সে বুঝতে পারছে, ভালোবাসা শুধুই অনুভূতি নয়, বরং একটি আত্মিক সংযোগও। ঋষির সঙ্গে তার সম্পর্কটি তাকে নতুন শক্তি দিয়েছে, যা তাকে তার জীবনকে নতুন করে দেখার সুযোগ দিয়েছে।
এক সকালে, সে বাড়ির উঠোনে বসে কফি খাচ্ছিল। প্রভাতের রোদ তার গায়ে পড়ছিল এবং মনে হচ্ছিল, যেন সমস্ত জগত তার জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ, তার ফোনে একটি মেসেজ আসল—ঋষি। “তুমি কি আমার সঙ্গে আজ বিকেলে ক্যাফেতে আসবে? আমি তোমার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।” মায়ার হৃদয়ে একটু কষ্ট হল। সে জানত, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, তবে তার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরছিল।
বিকেল বেলা, মায়া ক্যাফেতে গেল। ঋষি আগেই এসে বসেছিল। তার মুখে উদ্বেগ এবং আশার মিশ্রণ ছিল। মায়া তার পাশে বসে বলল, “কি হয়েছে, ঋষি?”
“মায়া, আমি কিছু সময় ধরে ভাবছি। তুমি জানো, আমাদের মধ্যে একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। তবে আমি চাই, তুমি তোমার হৃদয়ের কথাটি শুনো। তোমার এবং দেবের সম্পর্কে আমি কিছু বলার জন্য প্রস্তুত। আমি জানি, তুমি দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্বে আছো,” ঋষি বলল।
মায়া গভীরভাবে শ্বাস নিল। “হ্যাঁ, আমি বুঝতে পারছি। দেবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু তোমার সঙ্গে কাটানো সময়গুলি আমাকে নতুন কিছু শিখিয়েছে।”
ঋষি তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি চাই তুমি সত্যি কিছু বিবেচনা করো। আমাদের সম্পর্কের গভীরতা, আমাদের যে সময়গুলো একসাথে কাটিয়েছি, সেগুলো আমার জন্য খুবই মূল্যবান।”
মায়ার হৃদয়ে উষ্ণতা অনুভব হলো। সে মনে মনে ভেবেছিল, ঋষির সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো তাকে নতুন করে শক্তিশালী করে তুলেছে। “ঋষি, তুমি জানো, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। কিন্তু দেবও আমার জীবনের একটি অংশ। আমি কীভাবে এই দ্বন্দ্ব মেটাব?”
ঋষি কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। “মায়া, আমি জানি যে দেবের প্রতি তোমার ভালবাসা সত্যি। কিন্তু কখনো কখনো আমাদের হৃদয় আমাদের পথ দেখায়। আমি চাই তুমি নিজেকে খুঁজে পাও। তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো, তবে তোমার হৃদয় কী বলছে, সেটি শোনো।”
এই কথাগুলো মায়ার মনে কাঁপন সৃষ্টি করেছিল। সে বুঝতে পারছিল, ঋষির কথায় একটি গভীর সত্য রয়েছে। তার হৃদয় এবং মনের মধ্যে যুদ্ধ চলছে।
বিকেলের সূর্য যখন ধীরে ধীরে অস্তমিত হচ্ছিল, তখন মায়ার মনে হলো, সে একটি পয়েন্টে পৌঁছেছে যেখানে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। “ঋষি, আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু দেবের সঙ্গে আমি একটি সম্পর্ক তৈরি করেছি। আমি তাকে দয়া করতে পারি না।”
ঋষি তার হাত ধরে বলল, “মায়া, তুমি যা ভাবছো, আমি সেটাকে সম্মান করি। তবে আমি চাই তুমি জানো, আমি সবসময় তোমার জন্য এখানে আছি। তোমার হৃদয় যা চায়, সেটির দিকে যেতে হবে।”
এমন সময়ে, দেবের ফোন এসে গেল। মায়া ফোনটি উঠিয়ে নিল। “হ্যালো, দেব।”
“মায়া, তুমি কেমন আছো? আমি চাই তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে,” দেব বলল।
“হ্যাঁ, আমি ক্যাফেতে আছি। তুমি কি আসবে?”
দেব কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “ঠিক আছে, আমি কিছুক্ষণ পরে আসবো।”
মায়া অনুভব করছিল, দেবের সঙ্গে তার কথা বলতে হলে সে তাকে এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাতে হবে।
কিছুক্ষণ পর দেব এসে পৌঁছাল। সে মায়া ও ঋষিকে একসঙ্গে দেখে কিছুটা অসুবিধায় পড়ল। “মায়া, তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ, আমি ঋষির সঙ্গে কথা বলছিলাম,” মায়া বলল।
দেবের মুখে একটি হাসি এল, কিন্তু তা ছিল উজ্জ্বল নয়। “ভাল। তবে আমি মনে করি, আমাদের মধ্যে কিছু আলোচনা করা প্রয়োজন।”
মায়া এবং দেব ক্যাফের এক কোণায় বসে পড়ল। দেব বলল, “মায়া, আমি জানি তুমি কিছুটা বিভ্রান্ত। আমি চাই তুমি জানো, আমি তোমার জন্য সবসময় এখানে আছি। তবে আমি মনে করি, আমাদের সম্পর্কের জন্য কিছু সময় প্রয়োজন।”
মায়ার হৃদয় সংকুচিত হলো। সে বুঝতে পারছিল, দেবও সত্যিই অনুভব করছে যে তাদের মধ্যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। “দেব, আমি চাই তুমি জানো, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে ঋষির সঙ্গে আমার সম্পর্কেও আমি গুরুত্ব দিচ্ছি।”
দেব কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর বলল, “আমি জানি, তুমি একজন শক্তিশালী মহিলা। তবে আমি চাই, তুমি তোমার হৃদয়ের কণ্ঠস্বর শোনো। আমি তোমার জন্য সর্বদা সমর্থন করবো, তবে আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি?”
মায়ার মনে হল, দেবের কথাগুলি অত্যন্ত সত্যি। সে বুঝতে পারছিল, তার হৃদয় এবং মন একত্রিত হয়ে কিছু একটা চাচ্ছে। “আমি জানি, এই মুহূর্তে আমি কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারবো না। কিন্তু আমি চাই তোমরা দুজনেই জানো, আমার কাছে তোমরা দুজনেই বিশেষ।”
দেব তার হাত ধরে বলল, “ঠিক আছে, মায়া। তবে আমি চাই, তুমি তোমার হৃদয়ের খোঁজে যেও। তুমি কি অনুভব করো, সেটি খুঁজে বের করো।”
ঋষি তাদের কথোপকথন শুনছিল। সে মনে মনে ভাবছিল, সে কিভাবে এই পরিস্থিতিতে এগিয়ে যাবে। সে জানত, মায়া একজন শক্তিশালী মহিলা, এবং তাকে তার হৃদয়ের জন্য যুদ্ধে যেতেই হবে।
এই মুহূর্তে, তিনজনের মধ্যে একটি বিশেষ চেতনা তৈরি হল। তারা জানত, তাদের সম্পর্কের গতিপথ পরিবর্তন হতে চলেছে।
দেব পরে বলল, “মায়া, আমি জানি, আমাদের মধ্যে কিছু অস্বস্তি আছে। তবে আমি চাই, তুমি একবার মনে করো, তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?”
মায়ার হৃদয়ে কষ্ট হচ্ছিল। সে জানত, তার প্রেমের দু’পাশে দুটি পথ রয়েছে—একটি ঋষির এবং অপরটি দেবের। “আমি জানি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। তবে ঋষির সঙ্গে আমার একটি অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হয়েছে।”
দেব তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি যদি সত্যিই আমার সঙ্গে থাকতে চাও, তবে তোমার হৃদয় থেকে যেটি আসে সেটি শুনতে হবে। আর তুমি জানো, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”
মায়া অনুভব করছিল, সে একটি অন্ধকারে আছ। এই পরিস্থিতিতে তাকে তার হৃদয়ের কাছে যেতে হবে।
ঋষি বলল, “মায়া, আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কী, তা নির্ভর করছে তোমার সিদ্ধান্তের উপর। আমি চাই তুমি নিজের সম্পর্কে স্পষ্ট হও।”
মায়ার মনে অনেক চিন্তা ঘুরছিল। সে বুঝতে পারছিল, একদিকে ঋষির প্রতি তার ভালবাসা এবং অন্যদিকে দেবের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবস্থা।
সন্ধ্যা যখন আসছিল, তখন মায়া ও দেব একসঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে তাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলছিল।
“তুমি কি সত্যিই অনুভব করছ, আমরা একসাথে থাকতে পারবো?” দেব মায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
“আমি জানি, আমরা একসাথে অনেক সময় কাটিয়েছি। কিন্তু আমি ঋষির সাথে যে সংযোগ অনুভব করছি, সেটি অস্বীকার করতে পারি না,” মায়া বলল।
দেব তার হাত ধরে বলল, “ঠিক আছে, মায়া। তবে আমি চাই তুমি আমার সঙ্গে সত্যি কথা বলো। তুমি যদি ঋষির কাছে যাও, তবে আমি প্রস্তুত।”
মায়া অনুভব করছিল, সে একটি নতুন পদক্ষেপ নিতে চলেছে। “দেব, আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি ঋষির সম্পর্কেও সততা রাখতে চাই।”
এই পরিস্থিতিতে, তিনজনের মধ্যে একটি নতুন সূচনা হতে চলেছে। মায়া জানত, সে তার জীবনের নতুন অধ্যায়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
ছোটদের রূপকথার গল্প - মিরার মায়া: "মিরার মায়া" এক হৃদয়ছোঁয়া ছোটদের গল্প যেখানে মিরা নামের এক মেয়ে তার জাদুকরী ক্ষমতা দিয়ে প্রাণীদের সাহায্য করে। এই রূপকথার গল্প ভালোবাসা, দয়া ও প্রকৃত সুখের সন্ধানে রচিত। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মায়ার পুনর্জন্ম
দুই সপ্তাহ কেটে গেছে, এবং মায়া এখনো ঋষির স্মৃতি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। কলকাতার চিরচেনা গলিতে হেঁটে বেড়াতে গেলেও, মনে হয় ঋষির উপস্থিতি যেন তাঁর চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু আজ কিছু আলাদা ছিল। আজ তাঁর মনের মধ্যে একটি নতুন আশা জেগেছে। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছেন যে, ঋষির প্রতি তাঁর ভালবাসা নতুন করে শুরু হবে।
তাঁর ছোট্ট অফিসের জানালার পাশের চেয়ারে বসে, মায়া এক কাপ চা নিয়ে চিন্তিত মূর্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। কীভাবে ঋষির সাথে সম্পর্ক নতুন করে তৈরি করবেন, সে ভাবনা ছিল তাঁর মনে। তিনি জানতেন, এই সম্পর্কের নতুন যাত্রা শুরু করার জন্য একাধিক বাধা অতিক্রম করতে হবে। কিন্তু তিনি ইচ্ছা করলেন যে কিছু হোক না কেন, তাঁর ও ঋষির জন্য এটা নতুন সূচনা হবে।
অন্যদিকে, দেব কলকাতা ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর হৃদয়ে মায়ার প্রতি একটি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, কিন্তু সেই আকর্ষণের সাথে সাথে ছিল একটি গভীর বেদনাও। তিনি জানতেন, মায়া তাঁর জীবনে একটি বিশেষ স্থান দখল করেছে, কিন্তু সম্পর্কটি আর স্থায়ী হবে না। তাই তিনি নতুন জীবনের দিকে পা বাড়াচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁর মনে মায়ার জন্য একটি মধুর স্মৃতি রেখে।
দেবের বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার সময়, তিনি গাড়ির জানালার বাইরে শহরের দৃশ্য দেখছিলেন। কলকাতার চিরচেনা গলি, রাস্তার ফুচকা, বিকেলের আলো, সবই যেন তাঁকে ডাকছে। তিনি অনুভব করলেন, মায়ার সাথে কাটানো সময়গুলি তাঁর জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান অধ্যায়। কিন্তু তিনি জানতেন, এটাই শেষ নয়। জীবনের নতুন পথে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।
মায়া এবং দেব উভয়েই নিজেদের অবস্থান নিয়ে চিন্তা করতে করতে বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিলেন। মায়া তাঁর মনের মধ্যে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি ঋষির সাথে একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি করবেন। তাঁকে আর কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে না। বরং, তাঁর অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার সময় এসেছে।
এদিকে, দেব পৌঁছে গেলেন বিমানবন্দরে। তাঁর হৃদয়ে মায়ার জন্য একটি মিষ্টি স্মৃতি নিয়ে, তিনি বিমানে উঠলেন। বিমান উড়ে চলে যাওয়ার সময়, তাঁর চোখে পানি চলে আসল। তিনি জানতেন, হয়তো আর কখনও মায়ার সঙ্গে দেখা হবে না, কিন্তু তাঁর মনে একটি আশা ছিল—একদিন তাঁরা আবার একসাথে হবে।
মায়া ঋষির কাছে পৌঁছাতে দ্বিধায় ছিলেন। তাঁর মনে ছিল, কি বলবেন? কি করবেন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত, নিজের মনকে শক্তিশালী করে তিনি ঋষির কাছে গেলেন। ঋষি তখন একটি ক্যাফেতে বসে ছিল। মায়াকে দেখে ঋষির মুখে একটি হাসি ফুটে উঠল।
“মায়া, তুমি?” ঋষি অবাক হলেন।
“হ্যাঁ, ঋষি। আমাকে তোমার সাথে কিছু কথা বলতে হবে,” মায়া বললেন।
“কথা বলো,” ঋষি উত্তেজিত হয়ে বললেন।
মায়া কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন, তাঁর হৃদয়ে চলছিল ভিন্ন অনুভূতি। কিন্তু তিনি জানতেন, তাঁর ইচ্ছা জানানো জরুরি। “ঋষি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমাদের সম্পর্কটা এক নতুন রূপ পেতে পারে। আমি চাই, আমরা আবার একসঙ্গে শুরু করি।”
ঋষি কিছুক্ষণ নীরব ছিলেন। তাঁর চোখে আবেগ ছিল, কিন্তু তাঁর মুখে একটু দ্বিধা ছিল। “মায়া, আমি জানি আমাদের মধ্যে অনেক কিছু ঘটেছে। কিন্তু আমি আবার সেই সম্পর্ক তৈরি করতে পারব কিনা জানি না।”
“আমি জানি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি, তবে আমরা নতুন করে সবকিছু শুরু করতে পারব,” মায়া বললেন।
ঋষি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন। তারপর বললেন, “ঠিক আছে, আমি চেষ্টা করব। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের পুরনো সমস্যা গুলোকে কাটিয়ে উঠতে হবে।”
মায়া মনে মনে খুব খুশি হলেন। তিনি অনুভব করলেন, তাঁর এবং ঋষির মধ্যে যে সম্পর্কের জন্য তাঁরা লড়াই করেছিলেন, সেই সম্পর্ক আবার নতুন করে শুরু করার সময় এসেছে।
“চলো, আমরা এই সময়টাকে নতুনভাবে উপভোগ করি,” মায়া বললেন।
তাঁরা দুজনে মিলে শহরের প্রিয় স্থানগুলোতে বেড়াতে গেলেন। কলকাতার হাওড়া ব্রিজে দাঁড়িয়ে, মায়া ও ঋষি একে অপরের চোখে তাকিয়ে একটি সুন্দর মুহূর্ত কাটালেন। চারপাশে মানুষের ভিড়, ট্রাফিক, আর সেই চিরচেনা কলকাতা যেন তাঁদের প্রেমের সাক্ষী ছিল।
দেব বিমানে বসে জানালার বাইরের দৃশ্য দেখছিলেন। তাঁর চোখে জল এল, যখন মনে পড়ছিল মায়ার কথা। তিনি জানতেন, তাঁর জন্য মায়া এখনও বিশেষ। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা তাঁর জন্য নতুন পথে হাঁটার সংকল্প সৃষ্টি করেছে।
কলকাতার রাস্তায়, মায়া ও ঋষি একটি নতুন সূচনা করেছিলেন। তাঁরা একসঙ্গে নতুন স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু তাঁদের সামনে এখনও অনেক বাধা ছিল। তাঁদের প্রেমের জগতে অনেক কিছু ছিল, যা এখনও অজানা ছিল।
অন্যদিকে, দেব সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি কলকাতায় ফিরবেন। তাঁর মনে মায়ার কথা ছিল, কিন্তু তিনি জানতেন, সেই স্মৃতির সাথে এগিয়ে চলার সময় এসেছে।
মায়া ও ঋষির সম্পর্ক একটি নতুন উজ্জ্বল সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু কি ঘটবে ভবিষ্যতে? তাঁদের মধ্যে সত্যিই সেই ভালোবাসা থাকবে, নাকি পুরনো স্মৃতির বাধাগুলো আবারও ফিরে আসবে?
এখন তারা দুজনেই নতুন যাত্রার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তবে প্রতিটি সম্পর্কের মত, তাঁদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎও ঝুঁকিপূর্ণ।
জীবনের অজানা পথে হাঁটতে হাঁটতে, মায়া ও ঋষি তাঁদের নতুন সম্পর্কের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। প্রেম, আশা, এবং কিছু অজানা চ্যালেঞ্জ—এগুলোই তাঁদের সামনে।
কিন্তু একটি জিনিস নিশ্চিত—তাদের হৃদয়ে একসঙ্গে থাকার এবং একে অপরকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার প্রতিজ্ঞা রয়েছে।
তাদের গল্প এখানেই শেষ হচ্ছে না। এটি শুধুই একটি নতুন শুরু, যেখানে ক্ষমা ও ভালোবাসা তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তুলবে।
তাদের সামনে অপেক্ষা করছে আরও নতুন অধ্যায়, যেখানে সত্যিকার প্রেম এবং আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা শুরু হবে।
দেবের মনে একটি আশা ছিল যে, হয়তো ভবিষ্যতে মায়ার সঙ্গে তাঁর নতুন সম্পর্ক হবে। এবং তাদের প্রেমের গল্পের পরবর্তী অধ্যায়ে এক নতুন রূপ ধারণ করবে।
সুতরাং, মায়া ও ঋষির জন্য নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে, যেখানে তাঁরা নিজেদের খুঁজে পাবে, আর দেবের মনেও মায়ার জন্য ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়ের জন্ম হবে।
এভাবেই, জীবন তাঁদের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। কিন্তু এই প্রেমের গল্পের শেষ, এক নতুন শুরু হিসাবেই দেখা যাবে।
তাদের প্রেমের ইতিহাস এখনও লেখা হচ্ছে, আর আগামী দিনগুলোতে তারা কীভাবে নিজেদের সাথে জুড়ে যেতে পারবে, সেটিই হল তাদের অগ্রগতির মূল চাবিকাঠি।
এখন প্রশ্ন হলো, তাদের নতুন সম্পর্কের এই যাত্রা কেমন হবে? তারা কি একে অপরকে হারানোর পরেও শক্তিশালী হয়ে উঠবে? তাদের প্রেমের সত্যিকার রূপ কি হবে?
এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে, তাদের ভবিষ্যতের দিকে নজর দিতে হবে। জীবনের পথে হাঁটতে হবে, এবং নিজেদের ভালোবাসার জন্য লড়াই করতে হবে।
এখন তাদের সামনে অজানা এক অধ্যায় অপেক্ষা করছে এবং এইভাবে, গল্পের শেষ হয়ে যাচ্ছে না, বরং নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা হতে চলেছে, যেখানে মায়া ও ঋষির প্রেম এবং দেবের মায়ার জন্য অনুভূতি পুনর্জন্ম হবে।