কলকাতার বুকে, শ্মশানের কাছাকাছি, দাঁড়িয়ে ছিল এক প্রাচীন জমিদার বাড়ি। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানলার কাচগুলি ভাঙা, দেওয়ালে ফাটল, আর বারান্দায় ঝুলছিল শ্যাওলা জড়ানো লতাপাতা। এই বাড়িতেই থাকতেন সোমনাথ রায়, এক বিশিষ্ট লেখক, যিনি অতিপ্রাকৃত ঘটনাবলির উপর গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কিন্তু আজ তিনি লেখক নন, একজন সাংবাদিক।
এই রাতে তিনি সোমনাথ রায়ের সাক্ষাৎকার নেবেন, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা শেয়ার করবেন। পুরোনো, কড়কড়ানি লেটারবক্সে দেওয়া একটি চিঠির মাধ্যমে এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়েছিল। চিঠিতে শুধু লেখা ছিল, “আমার গল্প শোনার পরে আপনার লেখায় আরও ভয় জাগবে। নিশীথে আসুন।” নিশ্চিহ্নতা আর ভয়ের এই আমন্ত্রণে সোমনাথের কাছে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - প্রতিচ্ছবি : রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প: শ্রীনিবাসের জীবনে ঘটে যাওয়া অদ্ভুত ঘটনাগুলি নিয়ে লেখা এই গল্পে পড়ুন কিভাবে সে তার জীবন ফিরে পায় এবং এক নতুন অধ্যায় শুরু করে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
রাত ১২টা বাজতেই জরাজীর্ণ বাড়ির কড়া নাড়লেন তিনি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা খুললেন সোমনাথ। কালো কোট পরা, চোখ দুটি গভীর গহ্বরের মতো, চেহারা মৃতের মতো শীতল। কথা না বলেই তিনি সোমনাথকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
বাড়ির ভেতর অসহ্য গন্ধ। আলো নেই, শুধু টর্চের ক্ষীণ আলোয় দেখা যায়, চারপাশে পুরোনো আসবাবপত্র আর ধুলোয় ঢাকা বইপত্র। সোমনাথ একটা চেয়ারে বসলেন, আর সোমনাথ রায় জানলার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর পিছনে ঝড়ের ঝোঁকায় কড়কড়িয়ে কাঁপছিল পুরোনো গাছের ডাল।
“আপনি কি জানতে চান?” সোমনাথ রায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, যেন আঁধার থেকে ডাকা।
“১৯৪৫ সালের সেই ঘটনা…” শুরু করলেন সোমনাথ। কিন্তু কথা শেষ করার আগেই একটা ঠান্ডা হাওয়া সোমনাথের গা বয়ে চলে গেল। মনে হলো, কেউ তাঁর কাঁধে হাত রেখেছে। চমকে ফিরে তিনি দেখলেন, সোমনাথ রায় জানলার কাছে নেই!
টর্চের আলো চারপাশে ঘুরিয়ে দিলেন তিনি। ঘরটা ফাঁকা। শুধু ঝড়ের গোঙানি আর পুরোনো বাড়ির কড়কড়ানি শব্দ। হঠাৎ, জানলার কাচ ভেঙে পড়ার শব্দ। টর্চের আলো ফেলে দেখলেন, জানলার কাছে একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা, কালো কোট পরা, চোখ দুটি অগ্নিশিখার মতো জ্বলছে!
বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - ভাঙা মন, নতুন দিগন্ত : এই রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্পটি ১৯৩০-এর দশকের কলকাতায় এক চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিকের প্রেম, প্রতারণা, এবং সমাজের দ্বন্দ্ব নিয়ে। স্নিগ্ধা ও অনিরুদ্ধের জীবনের সংকট ও পরিবর্তনের এক হৃদয়স্পর্শী কাহিনী। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই, সেই ছায়াটা এক ঝটকায় সোমনাথের দিকে এগিয়ে এলো। টর্চের আলোয় ঠিক কিছু দেখা যাচ্ছিল না, কিন্তু সেই অস্বাভাবিক লম্বা চেহারা আর জ্বলজ্বল চোখ দুটি সোমনাথকে স্তব্ধ করে দিল। নিজের শ্বাস নিতেও ভুলে গেলেন তিনি।
এমন সময়, আরেকটা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ঘরের ভেতর থেকেই। একটা কাঁটা গলা, শোকের আবেগে ভরা কণ্ঠস্বর। “ছাড়ো, ছাড়ো…” শব্দটা বারবার উচ্চারণ করছিল সেই কণ্ঠ।
সোমনাথ চমকে ফিরে তাকালেন। জানলার কাছেই, অস্পষ্ট আলোয় দেখতে পেলেন সোমনাথ রায়কে। কিন্তু, আগের সেই মৃতের মতো চেহারা নেই। চোখ দুটি রক্তাধরা, চেহারা ক্ষীণ ও ভীত। আর তার হাতটা… সেই হাতটা যেন কোন অদৃশ্য শক্তি ধরে রেখেছে!
“কে আপনি?” সোমনাথ প্রশ্ন করলেন, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর কাঁপছিল।
“আমি…” সোমনাথ রায় কথা বলতে চাইলেন, কিন্তু হঠাৎ ঘরের আলো নিভে গেল। চারপাশে অন্ধকার। শুধু ঝড়ের ঝোঁক ও ছায়ামূর্তিগুলোর নাচ। সোমনাথ টর্চ জ্বালাতে চাইলেন, কিন্তু তার হাত কাঁপছে।
একটা ঠান্ডা হাত তার বাহু ধরলো। চিৎকার করতে গেলেন সোমনাথ, কিন্তু কোন শব্দ বের হলো না। সেই হাতটা তাকে টানতে শুরু করলো, জানালার দিকে।
“না…না…” সোমনাথ কিছু বলতে চাইলেন, কিন্তু ঠোঁট দুটো কাঁপছিল শুধু। সেই অদৃশ্য শক্তির টানে টানে জানলার কাছে এসে পড়লেন তিনি। নিচে অগাধ অন্ধকার।
এমন সময়, আবার সেই কাঁটা গলা কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, “ভাই, না…!” কিন্তু সেই আওয়াজটাও থেমে গেলো হঠাৎ।
সোমনাথ আর সহ্য করতে পারলেন না। সর্বশক্তি দিয়ে একটা ঢাক দিয়ে ফেললেন সেই অদৃশ্য হাতটা। ছোট্ট একটা চিৎকার শোনা গেলো, তারপরই সোমনাথ নিজেকে ছুঁড়ে ফেললেন জানলার বাইরে।
কিন্তু পড়লেন না। একটা শক্ত অ้อม বাহু তাকে ধরে ফেললো। চোখ খুললেন সোমনাথ। সামনে দাঁড়িয়ে আছেন সোমনাথ রায়, কিন্তু আগের মতো শীতল চেহারা নেই। চোখ দুটি জলজল করছে, মুখ ক্ষীণ ও শোকার্ত।
“দৌড়ান,” শুধু এটুকু বললেন সোমনাথ রায়। “এখানে থাকবেন না…” তারপরই ধাক্কা দিয়ে সোমনাথকে বাড়ির বাইরে ρεύণের মতো ছুটতে বাধ্য করলেন।
সোমনাথ আর পিছনে ফির
নিশীথের নিস্তব্ধতায় ছুটে চললেন সোমনাথ। শ্বাস ফেলার কষ্ট, ঝড়ের গোঙানি, আর নিজের কাঁপা পা ছাড়া আর কিছুই টের পাচ্ছিলেন না তিনি। বাড়িটা কবে পেরিয়ে এলেন, বুঝতেই পারলেন না।
বাংলা ছোট গল্প - ছত্রিশ বছর পর : ৩৬ বছর পর বৃদ্ধাশ্রমে দেখা স্বামীর! ক্ষমা চাইল না সে, কিন্তু শেষ নিঃশ্বাসে হাতটা ধরেছিল। জেনে নিন এই মর্মস্পর্শী বাংলা গল্পের মাধ্যমে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একটু দূরে রাস্তার আলো দেখতে পেয়ে সেদিকেই ছুটলেন। পৌঁছেই একটা গাছের তলায় লুটিয়ে পড়লেন। হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে তাকালেন। সেই জমিদার বাড়িটা আর নেই। নিশ্চিন্ত হওয়ার আগেই চমকে উঠলেন।
একটা ছেঁকা গন্ধ, যেন পচা মাংসের। আর তার সঙ্গে একটা ফিসফিসানি শব্দ, “ভাই, ভাই…”
সোমনাথ আর থাকতে পারলেন না। আবার নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন। ছুটলেন রাতের অন্ধকারে, কোথাও না জেনে, শুধু দূরে যেতে চাইছিলেন।
পা ভারী হয়ে উঠছিল, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু পিছনে ফিরে তাকানোর সাহসও ছিল না। হঠাৎ, একটা হাত তার কাঁধে পড়ল।
চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই একটা মৃদু কণ্ঠস্বর শুনলেন, “কী হলো বাবা? কোথায় যাচ্ছেন এ রাতে?”
চোখ খুললেন সোমনাথ। সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন রিক্সাওয়ালা। তার মুখে একটা সহানুভূতির ছাপ।
সোমনাথ কিছু বলতে পারলেন না। শুধু হাত বাড়িয়ে রিক্সা-য় উঠে পড়লেন। “যেখানে ইচ্ছে, নিয়ে যান,” বললেন তিনি, কণ্ঠটা কাঁপছিল।
রিক্সাওয়ালা কিছু না বলে চালাতে শুরু করলেন। সোমনাথ পিছনে ফিরেও তাকালেন না। কিন্তু সেই ফিসফিসানি শব্দটা, “ভাই, ভাই…” যেন এখনও কানে ভাসছে।
রাত কেটে গেলো। সকালে, নিজের ফ্ল্যাটে এসে শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলেন সোমনাথ। কিন্তু সেই রাতের ঘটনাগুলো তাঁকে ঘিরে রেখেছে। সোমনাথ রায়ের কথা শেষ হলো না, কী
ঘটনা ঘটেছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, তাও জানতে পারলেন না। কিন্তু একটা জিনিস জানেন, নিশীথের নিমন্ত্রণটা তাঁর জন্য ছিল এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। আর সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে এমন কিছু দেখিয়েছে, যা হয়তো তিনি কখনও ভুলতে পারবেন না।