কলকাতার ঝাঁকড়া গলির কোণে, পুরোনো এক বাড়ির অন্ধকার কোঠাছাতায় লুকিয়ে ছিলেন সোনামণি। বাইরে ব্রিটিশ সৈন্যদের দাপটমাণ চলাচল, গোলাগুলির শব্দ আর চিৎকারে কলকাতার বুক কাঁপছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুন জ্বলে উঠেছে চারদিকে, আর সোনামণি তার বাবার সাথে এই নিরাপদ আশ্রয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এই অন্ধকার আর নিঃসঙ্গতা তাঁর সহ্য হচ্ছিল না। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল তাঁদের নিজস্ব জমিদার বাড়ি, ঈষৎ হলুদ রঙের দেওয়াল, আর বিশাল বারান্দা জুড়ে ঝুলানো ঝাড়বাতি।
একদিন বিকেলে বাবা ঘরে ঢুকে দেখল, সোনামণি এক কোণায় মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, সে দেওয়ালের একটা ফাটলের দিকে চেয়ে আছে। সেই ফাটলের ওপাশটা ছিল পাশের জমিদার বাড়িটা। সোনামণি ফিসফিস করে বললেন, “বাবা, ওখানে একটা মেয়ে আছে! সে বসে বসে কিছু একটা আঁকছে।” বাবা তখন আর একটু সাবধানে সেই ফাটল দিয়ে দেখল। সত্যিই, একটা কিশোরী মেয়ে বসে আছে। সামনে একটা কাঠের খাতা আর রঙের বাটি। বাবা সোনামণিকে সাবধান করে বলল, “এসব নিয়ে কারো সাথে কথা বলবি না। ব্রিটিশদের সমর্থক ওরা।”
কিন্তু সোনামণির মনটা অজান্তেই টান পড়ে গেল সেই মেয়েটির দিকে। প্রতিদিন সেই ফাটল দিয়ে সেই মেয়েকে দেখত। মেয়েটির নাম ছিল লীলা, সে জমিদারের এক আত্মীয়া মেয়ে। সেই সময় লীলা আঁকা হচ্ছিল বর্ষা জলের পরের প্রকৃতির ছবি। সবুজের সমারোহ, আকাশে মেঘের খেলা আর পাখির কিচিরমিচির – সোনামণি যেন সেই ছবির মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলত। এইভাবে আঁকা আর ফাটলের ফাঁক দিয়ে দু’জনের একটি নিঃশব্দ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। লীলা তার আঁকার মধ্যে রাখত গোপন বার্তা, যাতে সোনামণি বুঝতে পারত বাইরের অবস্থা, স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপথ। অন্যদিকে, সোনামণি লীলাকে গান শোনাত। তাঁর বাবার কাছে থাকা বাঁশির সুর, আর নিজের গলায় গাওয়া স্বদেশ ভক্তির গান লীলাকে মুগ্ধ করত।
একদিন লীলা তার আঁকা ছবিতে একটা অদ্ভুত জিনিস রাখল। ছবিতে ছিল একটা নৌকা, আর সেই নৌকায় বসে কয়েকজন লোক। তাঁদের মধ্যে একজনের হাতে ছিল বাঁশি। সোনামণি বুঝতে পারলেন, এটা তাঁর বাবা আর তিনি নিজে। নিচে ছোট্ট করে লেখা ছিল, “নদীর ওপাশে নিরাপদ আশ্রয় আছে”। সোনামণি চমকে উঠল। সে জানত না, লীলা তাদের এই গোপন আস্তানা জানে। কিন্তু কীভাবে? মনে মনে ভাবল, হয়তো বাইরে থেকে কোনো ইঙ্গিত পেয়েছে। কিন্তু এই ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে কি না, সেটা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল সোনামণি।
এদিকে লীলাও অস্থির হয়ে পড়ল। কারণ, পরের দিনই ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁর বাড়িতে হানা দেবে, এমন খবর তিনি জানতে পেরেছে। সোনামণিদের বাড়ি সম্পর্কে সেই খবরই হয়তো ব্রিটিশদের কানে পৌঁছে গেছে। লীলা জানত না, সোনামণিদের পালিয়ে যেতে হবে, নাকি তাঁরাই ধরা পড়বে। এই চিন্তায় রাত জাগল লীলা।
পরের দিন সকালে সোনামণি ফাটল দিয়ে দেখল, লীলা তাঁর আঁকা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে চিন্তার ছায়া। হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝিয়ে দিল, বাইরে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সোনামণি বুঝতে পারল, কিছু একটা বিপদ আছে।
এর মধ্যেই বাবা ঘরে ঢুকে পড়ল। তাঁর হাতে একটা খাম। খাম খুলে পড়তে দেখলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এক গোপন বার্তা। তাঁদের দ্রুতই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সোনামণি মাকে ডাকল। মা তখন জিনিসপত্র গোছানো শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু সোনামণির মনটা ছিল অস্বস্তিতে। লীলার চিন্তাভাবনা তাঁকে কামড়ে ধরেছিল।
কিছুক্ষণ চিন্তা করে সোনামণি বাবাকে বলল, “বাবা, আমি একটা কাজ করতে চাই।” বাবা চমকে তাকাল। এই অবস্থায় কোনো ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না, সেটাই ছিল তাঁর চিন্তা। কিন্তু সোনামণি তাঁর মনের কথা বলল। লীলা কীভাবে তাঁদের গোপন আস্তানা জেনেছে, আর তাঁদের পালিয়ে যেতে হবে, এই খবরটা লীলাকে জানানোর জন্য। বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর সোনামণির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু সাবধানে যেতে হবে।”
সোনামণি দেওয়ালের ফাটল দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে তাকাল। লীলা সেখানে ছিল না। হঠাৎ দূরে একটা আলোর ঝলকানি দেখল। বারবার ঝলকানি দিচ্ছে। সোনামণি বুঝতে পারল, লীলা তাঁকে ডাকছে। সাবধানে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লেন সোনামণি। বাড়ির উঠোনে একটা পুরোনো গাছের নিচে গিয়ে দেখেন, লীলা দাঁড়িয়ে আছে।
দু’জনে খুব কম সময়ের মধ্যেই কথা বললেন। লীলা জানাল, ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের বাড়িতে হানা দিয়েছে। তবে, সোনামণিদের আশ্রয়ের কথা জানতে পারেনি। কিন্তু এখুনি শহর ছেড়ে চলে যাওয়া জরুরি। লীলা তাদের পালানোর পথ দেখিয়ে দেবে।
কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই বিপত্তি। সামনেই ব্রিটিশ সৈন্যদের একটা দল। পালানোর কোনো রাস্তা নেই। লীলা চট করেই সোনামণিকে নদীর ধারে নিয়ে গেল। সেখানে একটি পুরনো, জরাজীর্ণ মাছুয়া দেখিয়ে দিল। লীলা জানত, মাঝেমধ্যে এ নৌকাটি নদীর ওপারে মাছ ধরতে যায়। কিন্তু আজ নৌকাটি নেই।
লীলা হতাশ হয়ে গেল। কিন্তু সোনামণি হাল ছাড়ল না। সে মনে করল, বাবা যে বাঁশির সুরে গান গাইত, সেই সুর হয়তো নৌকার মাঝিকে ডাকতে পারবে। সাবধানে বাঁশি বের করল সে। বাবার শেখানো সুরটি বাজাতে শুরু করল। নিঃশব্দে, কিন্তু মধুর সুর নদীর বুকে ছড়িয়ে পড়ল।
একটু পর, দূর থেকে একটা আলোর রেখা দেখা গেল। আস্তে আস্তে আলোটি কাছে আসতে থাকল। দেখা গেল, সেই পুরোনো মাছুয়া নৌকাটিই। নৌকার বয়স্ক এক মাঝি, সোনামণিদের দেখে অবাক হয়ে গেল। কিন্তু সোনামণির বাঁশির সুর শোনা মাত্রই তিনি বুঝে গেল, বিপদে আছে তারা। কোনো কথা না বলে, সোনামণি, লীলা আর সোনামণির বাবাকে নৌকায় তুলে নিল মাঝি। নদীর বুকে ভাসতে থাকা নৌকায়, তারা নিজেদের ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিল।
রাতের অন্ধকারে নদী পেরিয়ে গেল তারা। নদীর ওপাশে ছিল একটা ছোট্ট গ্রাম। সেখানেই সোনামণিদের নামিয়ে দিল মাঝি। গ্রামের লোকজন তাদের আশ্রয় দিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের আঁচ এ গ্রামেও পৌঁছেছে। সোনামণির বাবা সেখানকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে যোগাযোগ করল। লীলাও তাদের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিল। তার আঁকা ছবিগুলো এখন বিপ্লবের প্রচারে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কয়েক মাস পরে, স্বাধীনতা এলো। সোনামণি, তাঁর বাবা আর লীলা – তিনজনে ফিরে এল কলকাতায়। লীলা এখন আর জমিদার বাড়িতে থাক না। স্বাধীন ভারতে নতুন জীবন শুরু করেছে সে। সোনামণি লেখিকা হল। তার লেখায় ফুটে উঠল সেই সময়ের গল্প, লীলা আর তাঁর বাঁশির সুরের গল্প, মৃদু গানের রহস্যের গল্প।