মঞ্জরী ও সুমনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, পুরনো বাড়ির অশুভ শক্তি, ও ললিতার আত্মার মুক্তির জন্য তাদের সাহসিকতা, সবই এক মন্ত্রমুগ্ধকর ভুতের গল্পের মাধ্যমে। পাঠ করুন এবং ভয়াবহ রহস্যের জগতে প্রবেশ করুন।

বাংলা ছোট গল্প

Home » বাংলা ছোট গল্প » অতৃপ্ত আত্মার ডাইরি

অতৃপ্ত আত্মার ডাইরি

মঞ্জরী ও সুমনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, পুরনো বাড়ির অশুভ শক্তি, ও ললিতার আত্মার মুক্তির জন্য তাদের সাহসিকতা, সবই এক মন্ত্রমুগ্ধকর ভুতের গল্পের মাধ্যমে। পাঠ করুন এবং ভয়াবহ রহস্যের জগতে প্রবেশ করুন।

আমাদের WA চ্যানেল জয়েন করুন

এই মাসের সেরা গল্প, পড়ুন ও অডিও স্টোরির স্বাদ উপভোগ করুন – জীবন্ত মূর্তি

সুমন ও মঞ্জরী অনেকদিন ধরেই শহরের ব্যস্ত জীবন থেকে দূরে একটি শান্তিপূর্ণ স্থানে বসবাসের স্বপ্ন দেখছিল। তারা কলকাতার অদূরে এক নির্জন গ্রামে একটি পুরোনো বাড়ি পেয়েছিল, যা তাদের কাছে নতুন জীবনের সূচনা হিসেবে মনে হয়েছিল। বাড়িটি অনেক পুরোনো, ব্রিটিশ আমলের স্থাপত্যের নিদর্শন, কিন্তু তার মধ্যে এমন কিছু ছিল যা মঞ্জরীকে মুগ্ধ করেছিল। বাড়ির বড় বড় জানালা, লাল টালির ছাদ, আর চারপাশের ঘন গাছপালার আড়ালে থাকা নিস্তব্ধতা যেন এক বিশেষ ধরনের আকর্ষণ সৃষ্টি করেছিল। সুমন বাড়িটির আর্থিক সুবিধার দিকে বেশি নজর দিয়েছিল, কারণ শহরের তুলনায় এই বাড়ি অনেকটাই সস্তা।

মঞ্জরী, যিনি একজন লেখিকা, এই বাড়িটিকে তার কাজের জন্য আদর্শ মনে করেছিলেন। তার মনে হয়েছিল, এখানে সে শান্তিতে নিজের উপন্যাস লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। বাড়ির নিস্তব্ধ পরিবেশে সে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা পাবে। সুমনও তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল—একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ছিল, আর সে সপ্তাহে একবার শহরে যাতায়াত করত। 

প্রথম কয়েকটা দিন বেশ স্বাভাবিকভাবেই কেটে গেল। তারা বাড়ির বিভিন্ন কোণা পরিস্কার করল, নতুন আসবাব নিয়ে এল, আর গ্রামের লোকজনের সঙ্গেও ধীরে ধীরে পরিচিত হল। মঞ্জরী গভীর রাতে তার উপন্যাসের প্লট নিয়ে কাজ করত, আর সুমন ঘুমিয়ে পড়ত কাজের ক্লান্তিতে। তবে, কিছুদিন পর থেকেই মঞ্জরী অদ্ভুত কিছু লক্ষ করতে শুরু করল।

রাতের বেলায়, যখন সুমন গভীর ঘুমে থাকে, মঞ্জরী অনুভব করত যেন বাড়ির কোন এক ঘরে কেউ হেঁটে বেড়াচ্ছে। প্রথমদিকে সে ভেবেছিল, এটা তার নিজের কল্পনা—নতুন বাড়ি, একাকীত্ব, এসব থেকেই হয়তো তার মনে এমন ভাবনা আসছে। কিন্তু ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারল, এটা শুধু কল্পনা নয়। প্রতিদিন রাতেই, বাড়ির পুরোনো মেঝেতে কারও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়, যেন কেউ ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁটছে। 

মঞ্জরী প্রথমে ভয় পায়নি, বরং কৌতূহলী হয়ে উঠেছিল। সে নিজেই ভাবল, হয়তো বাড়ির পুরোনো কাঠের মেঝে থেকে এসব শব্দ আসছে। কিন্তু এই কৌতূহল খুব বেশি দিন স্থায়ী হল না। কারণ, এর কয়েকদিন পর থেকেই আরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করল।

একদিন গভীর রাতে, যখন মঞ্জরী তার লেখার টেবিলে বসে কাজ করছিল, হঠাৎ তার মনে হল যেন পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুত পিছন ফিরে তাকাল, কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। তবু একটা অজানা শীতল অনুভূতি তার শরীরকে গ্রাস করল। মনে হল, বাড়ির ভিতর একটা অদৃশ্য চোখ তাকে লক্ষ্য করছে। মঞ্জরী বুঝল, এটা আর কেবল কল্পনা নয়। বাড়িতে কিছু অস্বাভাবিক ঘটছে। 

পরের দিন মঞ্জরী তার অভিজ্ঞতা সুমনকে বলল। কিন্তু সুমন এসব কথা হাসি উড়িয়ে দিল। সে মঞ্জরীকে বোঝাল যে, এটা নতুন পরিবেশের কারণে মনে হচ্ছে, এবং এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে বেশি ভাবতে হবে না। সুমনের এই মনোভাব মঞ্জরীকে কিছুটা আহত করল, কারণ তার অনুভূতি এতটাই জোরালো ছিল যে সে তা কল্পনা বলে উড়িয়ে দিতে পারছিল না। 

তবে, সুমনকে কিছু বোঝাতে না পেরে, মঞ্জরী নিজেই বাড়ির ইতিহাস নিয়ে অনুসন্ধান করতে শুরু করল। গ্রামের এক প্রবীণ মহিলার কাছ থেকে জানতে পারল, এই বাড়িতে বছর দশেক আগে ললিতা নামে এক মেয়ে রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা বলত, সেই মেয়েটি বাড়ির মধ্যে অদ্ভুত সব জিনিস দেখত এবং প্রতিদিনই ভয়ের কোনো অদ্ভুত অনুভূতির কথা বলত। 

এই ঘটনা শোনার পর থেকে মঞ্জরী আরও বিচলিত হয়ে পড়ল। সে অনুভব করল, ললিতার সঙ্গে তার কোনো এক অদ্ভুত সংযোগ তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যেও একই ধরনের ভয়ঙ্কর অনুভূতি হচ্ছে, যা ললিতার হয়েছিল। বাড়িটিতে কি কিছু লুকিয়ে আছে? ললিতার সাথে কি ঘটেছিল? এসব প্রশ্ন মঞ্জরীর মনে ঘুরতে থাকল।

গভীর রাতে, যখন মঞ্জরী ঘুমানোর চেষ্টা করছিল, সে হঠাৎ বাড়ির দরজায় কারও চাপা কণ্ঠের ফিসফিসানি শুনতে পেল। মনে হচ্ছিল, যেন কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। সে ভয়ে শিউরে উঠল, এবং সুমনকে ডাকল। কিন্তু সুমন কিছুই শুনতে পেল না। 

এরপর, মঞ্জরী এক পুরোনো আলমারির মধ্যে থেকে একটি ছোট ডায়েরি আবিষ্কার করল। ডায়েরিটিতে ললিতার লেখা ছিল। তার মধ্যে ললিতার ভয়, তার দেখা অদ্ভুত দৃশ্য এবং নিখোঁজ হওয়ার আগের কিছু ঘটনা বর্ণিত ছিল। মঞ্জরী ডায়েরিটি পড়তে পড়তে বুঝল, বাড়ির মধ্যে কিছু অশুভ শক্তি কাজ করছে, যা ললিতাকে গ্রাস করেছিল। 

গল্পটি এখানেই শেষ হয় না। মঞ্জরী আরও গভীরে প্রবেশ করতে চায়, ললিতার নিখোঁজের রহস্য উদঘাটন করতে চায়। কিন্তু সামনে যে বিপদ অপেক্ষা করছে, তা সে এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেনি।

রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - বিচার পেল তিলোত্তমা: কলকাতার এক মেডিক্যাল ছাত্রী তিলোত্তমা দেবনাথের নির্মম হত্যার পেছনে রয়েছে একটি শক্তিশালী চক্রান্ত। ন্যায়বিচারের খোঁজে তার বন্ধু অনির্বাণ গাঙ্গুলির অসাধারণ যাত্রা। একটি রহস্যময় থ্রিলার যা আপনাকে শেষ পর্যন্ত অনুমান করতে থাকবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

ছায়ার খেলা ও ফিসফাস

রাত যত গভীর হয়, ততই মঞ্জরীর মনে হয় এই বাড়ির দেয়ালের মধ্যে কিছু লুকিয়ে আছে। প্রথমে সে ভেবেছিল, এটা তার কল্পনার খেলা। পুরোনো বাড়ির ফাঁকা ঘরগুলো থেকে এমন ফিসফাস শোনা যেতেই পারে। তবু, তার মনের এক কোণায় একটা অস্বস্তি থেকে গেল। প্রতিদিন, সন্ধ্যে নামার পর থেকেই বাড়ির পরিবেশে এক অজানা ঠান্ডা ভয় মিশে থাকত। 

সুমন যখন ক্লান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পড়ত, তখন মঞ্জরী তার লেখার টেবিলে বসে কাজ করত। কিন্তু প্রতিদিন রাত বাড়ার সাথে সাথে তার মনোযোগ ভেসে যেত বাড়ির বিভিন্ন অস্বাভাবিক শব্দের দিকে। ঘরের কোণে কে যেন দাঁড়িয়ে থাকে, দেয়ালের ছায়াগুলো যেন ঘুরে বেড়ায়। প্রথম দিকে মঞ্জরী বিষয়টিকে আমল দেয়নি, তবে ক্রমশ সে বুঝতে পারল, বিষয়টা শুধুই তার কল্পনা নয়।

এক রাতে, যখন মঞ্জরী তার উপন্যাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় লিখছিল, হঠাৎই সে অনুভব করল ঘরের দরজার পাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীরে একটা শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল। সে এক মুহূর্তের জন্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না। তবুও সে অনুভব করল, ঘরে যেন কেউ ছিল। দেওয়ালের ছায়াগুলো যেন তার দিকে চেয়ে আছে। 

“সুমন!” মঞ্জরী চিৎকার করে ডাকল, কিন্তু সুমন তখন গভীর ঘুমে ছিল। সে সাড়া দিল না। মঞ্জরী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকল, ঘরের পরিবেশটা যেন তাকে বেঁধে ফেলছিল। 

পরের দিন সকালে, মঞ্জরী সুমনকে আগের রাতের অভিজ্ঞতা বলার চেষ্টা করল। কিন্তু সুমন এসব কথায় কান দিল না। তার মতে, পুরোনো বাড়িতে এ ধরনের শব্দ হওয়া স্বাভাবিক। “এতটা ভেবো না মঞ্জরী, নতুন জায়গায় গেলে এমনটা মনে হয়,” সুমন শান্ত গলায় বলল।

কিন্তু মঞ্জরী জানত, এসব কিছু সাধারণ নয়। সে আবার বাড়ির বিভিন্ন ঘরে খুঁজতে শুরু করল, আর সেই সময়েই বাড়ির পুরোনো আলমারির মধ্যে সে পেল একটি পুরানো ডায়েরি। ডায়েরির পাতা হলুদ হয়ে গেছে, প্রায় ছিঁড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। প্রথমে মঞ্জরী ভাবল, এটা হয়তো বাড়ির আগের বাসিন্দাদের কোনো জিনিস। কিন্তু ডায়েরির প্রথম পাতাটি পড়ার সাথে সাথেই তার গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। 

ডায়েরিটি ছিল ললিতা নামের এক মেয়ের, যে এই বাড়িতে বহু বছর আগে থাকত। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় লেখা ছিল ললিতার ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার কথা। সে অনুভব করত, এই বাড়িতে কিছু অশুভ শক্তি আছে, যা ধীরে ধীরে তার জীবন গ্রাস করছিল। মঞ্জরী ডায়েরির পাতায় পাতায় ললিতার কথা পড়তে শুরু করল। 

ললিতা লিখেছে, “প্রতিদিন রাতের বেলা আমি অদ্ভুত ফিসফিসানি শুনি, যেন কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। দেয়ালের ছায়াগুলো আমাকে ঘিরে ধরে, আমি যেদিকেই তাকাই, তারা আমাকে অনুসরণ করে। আমি এই বাড়ি থেকে বের হতে চাই, কিন্তু কীভাবে?”

মঞ্জরীর মনে হতে লাগল, ললিতার অভিজ্ঞতাগুলো যেন তার নিজের জীবনেও ঘটছে। এই বাড়ির অশুভ শক্তি কি তাকে গ্রাস করতে শুরু করেছে? ডায়েরির শেষের দিকে ললিতা লিখেছিল, “আমি জানি, তারা আমাকে নেবে। আমি আর পালাতে পারব না। এই বাড়ি আমাকে ছেড়ে দেবে না।”

ডায়েরিটি পড়ার পর মঞ্জরী পুরোপুরি হতবাক হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, ললিতা এই বাড়ির মধ্যে নিখোঁজ হয়েছে, এবং হয়তো তার আত্মা এখনও এখানে বন্দী। মঞ্জরীর মন কিছুতেই শান্ত হচ্ছিল না। সে ডায়েরি হাতে নিয়ে বসে রইল, কিন্তু তার মাথার মধ্যে যেন একের পর এক ভয়ঙ্কর প্রশ্ন আসতে লাগল। 

সেই রাতে মঞ্জরী ঘুমাতে চেষ্টা করল, কিন্তু তার চোখের পাতায় ঘুম এল না। বারবার মনে হচ্ছিল, ঘরের কোণে কেউ দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। দেওয়ালের ছায়া যেন ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, তার দিকে এগিয়ে আসছে। আর সেই অদ্ভুত ফিসফাস—যেন তার নাম ধরে কেউ ডাকছে, খুব ধীরে ধীরে, অন্ধকারের মধ্য থেকে।

“মঞ্জরী…” 

সে উঠে বসল। এবার আর ভুল নয়। সুমন গভীর ঘুমে, কিন্তু মঞ্জরী স্পষ্ট শুনতে পেল, কেউ তার নাম ধরে ডাকছে। ঘরের ভেতর শীতল হাওয়া বইছে, তার সারা শরীর কেঁপে উঠল। সে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু দরজা যেন আটকে গেছে। 

হঠাৎই দরজার ওপাশ থেকে তীব্র ঠকঠকানোর শব্দ এল। যেন কেউ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মরিয়া হয়ে ঢুকতে চাইছে। মঞ্জরী আতঙ্কে পেছনে সরে গেল, আর সেই মুহূর্তেই দরজা খুলে গেল। কিন্তু দরজার ওপাশে কেউ ছিল না। তবু দরজার খোলা অংশ থেকে ঠান্ডা বাতাস ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। 

মঞ্জরীর মনে হল, যেন এই বাড়ি তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে। ললিতার মতো, সে কি এই বাড়ির ফাঁদে পড়ছে? তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরতে লাগল—এই বাড়ির শেষ পরিণতি কী হতে চলেছে? 

বিভীষিকার গভীরে

মঞ্জরীর মাথার ভেতরে যেন একটা ভয়ঙ্কর ঝড় উঠেছে। ললিতার ডায়েরির প্রতিটি শব্দ তার মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে পড়েছে। প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে সে অনুভব করে, এই বাড়ির দেয়ালগুলোর মধ্যে ললিতার ভয়াবহ অভিজ্ঞতাগুলো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বাড়িটা কেমন যেন শ্বাস নিচ্ছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করছে। 

সুমন অবশ্য মঞ্জরীর এই কথাগুলোকে পাত্তাই দিচ্ছে না। সে মনে করছে, এটা মঞ্জরীর অতিরিক্ত চিন্তার ফলাফল। “তুমি সবকিছু কল্পনা করছ, মঞ্জরী। একটা পুরোনো বাড়ি, নির্জনতা—এসব মিলে মস্তিষ্ক একটু খেলা করে, বুঝলে? এমনটা হতেই পারে,” সুমন বলল।

কিন্তু মঞ্জরীর মনকে শান্ত করা কঠিন। প্রতিদিন রাতে তার ভেতর এক অদ্ভুত অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ঘরের কোণে ছায়াগুলো যেন তাকে দেখছে, দেয়ালের পেছন থেকে একটা অদৃশ্য চোখ তাকে অনুসরণ করছে। আর সেই ফিসফাস—সেটা থামছে না। কখনও তার নাম, কখনও অজানা শব্দ, যা শুধু অন্ধকারের মধ্যে ভেসে আসে।

এক রাতে মঞ্জরী সুমনকে বলল, “সুমন, আমি সত্যিই জানি না কী হচ্ছে, কিন্তু এই বাড়িতে কিছু একটা অস্বাভাবিক আছে। আমি ললিতার ডায়েরিটা পড়েছি, আর আমি জানি তার সঙ্গে যা ঘটেছিল সেটা আমার সঙ্গেও ঘটতে শুরু করেছে।”

“তুমি কি আমাকে বলছ, এই বাড়ি তোমার উপর কিছু করছে?” সুমন অবিশ্বাসের হাসি হেসে বলল। “এসব অদ্ভুত কথা বন্ধ করো, মঞ্জরী। এটা আমাদের নতুন বাড়ি, আমাদের নতুন জীবন। তুমি কেন এমন অযথা ভয় পাচ্ছ?”

মঞ্জরীর ভেতরে একটা গভীর অসন্তোষ জমতে লাগল। সে বুঝতে পারল, সুমন তার কথায় বিশ্বাস করবে না। তাদের মধ্যে দূরত্ব ক্রমেই বাড়তে থাকল, আর মঞ্জরী ক্রমশ একাকী হয়ে পড়ল। তার প্রতিটি রাত এক অবর্ণনীয় আতঙ্কে পরিণত হচ্ছিল। 

ডায়েরির পাতাগুলো আরও গভীরে পড়তে শুরু করল মঞ্জরী। ললিতা লিখেছিল, “আমি রাতে আর ঘুমোতে পারি না। অন্ধকারে দেওয়ালের ছায়াগুলো বড় হতে থাকে, তারা আমাকে ধরে ফেলার চেষ্টা করে। আমি জানি, কিছু একটা আমার পেছনে রয়েছে। প্রতিদিন রাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে থাকে, তখন সে আসে।”

মঞ্জরীর ভেতরে এক অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগল। সে যেন ললিতার সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়েছে। তারও তো একই অভিজ্ঞতা হচ্ছে। সেই অজানা ছায়াগুলো, সেই অদ্ভুত অনুভূতি—সবকিছু যেন তাকে ললিতার পথেই নিয়ে যাচ্ছে। 

এক রাতে, মঞ্জরী শুয়ে থাকার সময় হঠাৎ অনুভব করল, ঘরের দরজার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। দরজা পুরোপুরি বন্ধ ছিল, কিন্তু মঞ্জরী স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল, কারও উপস্থিতি আছে। সে উঠে দরজার কাছে গেল, আর দরজার ওপাশ থেকে একটা চাপা ফিসফাস শুনতে পেল। যেন কেউ ধীরে ধীরে তার নাম ধরে ডাকছে—”মঞ্জরী…”

তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। সে দরজা খুলে দিল, কিন্তু দরজার ওপাশে কাউকে দেখতে পেল না। ঘরের ভেতরে যেন শীতল হাওয়ার ঢেউ ঢুকে পড়ল। মঞ্জরী দরজার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল, কিন্তু কিছুই ঘটল না। শুধু একটা অদ্ভুত ঠান্ডা তার চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। 

সেই রাতেই মঞ্জরী সিদ্ধান্ত নিল, সে ললিতার নিখোঁজ হওয়ার রহস্য উদঘাটন করবে। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই তার মনে হয়েছে, ললিতার আত্মা এখানেই কোথাও বন্দী রয়েছে। আর সে মুক্তি চায়। কিন্তু প্রশ্ন হল, কীভাবে?

পরের দিন সকালে, মঞ্জরী গ্রামে ললিতার পরিবারের কোনো খবর পাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু গ্রামের কেউই ভালোভাবে কিছু বলতে পারল না। ললিতার পরিবার অনেক বছর আগে এই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। তারা মেয়েটির নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে আর কখনও ফিরে আসেনি। তবে গ্রামের একজন বৃদ্ধা মহিলার কাছ থেকে মঞ্জরী একটি চমকপ্রদ তথ্য পেল। 

“ললিতা একদিন হঠাৎ করেই নিখোঁজ হয়ে যায়। তার পরিবার অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছুই পায়নি। কিন্তু গ্রামে একটা কথা প্রচলিত আছে যে, এই বাড়ির মধ্যে কিছু একটা আছে—একটা অশুভ শক্তি, যা মানুষকে ধরে ফেলে। ললিতা তার শিকার হয়েছে,” বৃদ্ধা ফিসফিস করে বলল।

মঞ্জরীর গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। বৃদ্ধার কথা শুনে সে বুঝতে পারল, ললিতার গল্পটা শুধু ডায়েরিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এই বাড়ির ইতিহাসের ভেতরে একটা অন্ধকার সত্য লুকিয়ে আছে। 

মঞ্জরী আরও গভীরভাবে ভাবতে শুরু করল। সে জানত, এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। আর তার মন ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল—ললিতার সাথে যা ঘটেছিল, সেটা সে নিজে অনুভব করছে। সে জানত, তার সামনে কঠিন পথ রয়েছে, কিন্তু সে এই বাড়ির অন্ধকারকে উন্মোচন করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। 

কিন্তু মঞ্জরী তখনও জানত না, কী ভয়াবহ বিপদ তার সামনে অপেক্ষা করছে। বাড়িটা যেন ধীরে ধীরে তার মনের নিয়ন্ত্রণ নিচ্ছে। আর সামনে যে অশুভ শক্তির সঙ্গে তার মোকাবিলা হতে চলেছে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি।

বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - শুকনো গোলাপ: নিলয় গত ২০ বছর ধরে তার প্রিয়জনের অপেক্ষায়। প্রতিদিন রাতে রোজির জন্য শেষ ট্রেন না আসা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করে। নিলয়ের কি রোজির সাথে দেখা হবে? পড়ুন বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প শুকনো গোলাপ! সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

দুঃস্বপ্নের গহ্বরে

মঞ্জরী গভীর রাতে ঘুমোতে পারছিল না। ডায়েরির প্রতিটি শব্দ তার মনের গভীরে এমনভাবে গেঁথে গেছে যে চোখ বন্ধ করলেই সে ললিতার চেহারা, ভয়ঙ্কর সব দৃশ্য দেখতে পায়। ললিতার জীবন যেন মঞ্জরীর ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনের মতোই সেদিন রাতেও সে শুয়ে পড়ল, কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, ঘরের প্রতিটি কোণ থেকে অজানা চোখ তাকে লক্ষ্য করছে।

সুমন ঘুমিয়ে ছিল গভীর নিদ্রায়, কিন্তু মঞ্জরী এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পাচ্ছিল না। ঘরের বাইরে থেকে হালকা একটা ফিসফিস শব্দ শোনা গেল—“মঞ্জরী…”। তার সারা শরীর শীতল হয়ে গেল, যেন হিমশীতল হাওয়ায় আচ্ছন্ন। সে চোখ বন্ধ করে শ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকল, কিন্তু শব্দ থামল না। 

তারপর হঠাৎই, একটা দৃশ্য তার চোখের সামনে উদ্ভাসিত হলো। সে দেখতে পেল একটা ছোট্ট মেয়ে, পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে, তার সাদা ফ্রকের পেছন থেকে দীর্ঘ চুল ছড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। মেয়েটি হঠাৎই ঘাড় ঘুরিয়ে মঞ্জরীর দিকে তাকালো। সেই চোখের দৃষ্টিতে ছিল অপার আতঙ্ক এবং সাহায্য করার আকুতি। 

মঞ্জরী ঘামতে শুরু করল। এটা ছিল এক দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু তবুও অত্যন্ত বাস্তব মনে হচ্ছিল। তার হাত-পা যেন জমে গিয়েছিল, আর সে সেখান থেকে পালাতে চাইছিল, কিন্তু পারছিল না। সে মেয়েটার চোখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছিল না। আর তখনই হঠাৎ মেয়েটা বলে উঠল, “আমাকে মুক্তি দাও।”

মঞ্জরী চিৎকার করতে গিয়েও পারল না। তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না। ঘরের প্রতিটি দেওয়াল যেন তার দিকে এগিয়ে আসছে। সেই অদ্ভুত ভয়ঙ্কর দৃষ্টির ভারে মঞ্জরীর মাথা ঘুরে যাচ্ছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে, মেয়েটা হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেল।

মঞ্জরী কাঁপতে কাঁপতে উঠে বসল। তার শরীর জুড়ে ঘাম। সে জানত, এই দুঃস্বপ্ন কেবলমাত্র তার মনের খেল নয়, বরং ললিতা তাকে কিছু বলতে চাইছে। ডায়রির কথা মনে পড়তেই সে উঠে সেটা হাতে নিল। সে আরও কিছুটা পড়তে শুরু করল। 

ডায়েরিতে লেখা ছিল: “প্রতিদিন রাতে আমি তাকে অনুভব করি। সে ঘরের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। আমি পালাতে চাই, কিন্তু আমার পা চলে না। সে যেন আমার প্রাণশক্তি শুষে নিচ্ছে। তার চোখে এমন কিছু আছে যা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। আমি জানি, আমি বাঁচব না। কিন্তু আমি মুক্তি চাই। কেউ যদি আমার কথা শুনতে পায়, তবে তাকে সাহায্য করতে হবে।”

মঞ্জরী ডায়েরির এই লেখাটা পড়ে ভীষণভাবে হতবাক হয়ে গেল। ললিতার অভিজ্ঞতা আর মঞ্জরীর বর্তমান অবস্থা যেন হুবহু মিলে যাচ্ছে। 

সে তাড়াতাড়ি সুমনকে জাগানোর চেষ্টা করল। “সুমন, উঠো! তোমাকে কিছু দেখাতে হবে।” 

সুমন বিরক্ত হয়ে বলল, “আবার কী হলো, মঞ্জরী? কেন আমাকে এভাবে জাগাচ্ছ?”

মঞ্জরী ডায়েরিটা তার হাতে দিয়ে বলল, “ললিতার কথা বিশ্বাস করো। তার সঙ্গে যা ঘটেছিল, সেটা আমার সঙ্গেও ঘটছে। আমি প্রতিদিন রাতে তাকে দেখতে পাচ্ছি, তার কষ্টের অনুভূতি আমার ওপর ভর করছে। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে হবে, সুমন।”

সুমন ধীরে ধীরে ডায়েরির পাতা উলটে পড়তে থাকল। তবে তার মুখে কোনো আবেগ দেখা গেল না। “এটা শুধু তোমার কল্পনা, মঞ্জরী। তুমি বেশি ভেবে ফেলছ। ডায়েরির লেখা আর তোমার মাথার মধ্যেকার অতিরিক্ত চিন্তার মিশ্রণে এই সব হচ্ছে। এটা মানসিক চাপের ফলাফল।”

মঞ্জরী হতাশ হয়ে চুপ করে রইল। সে জানত সুমন কিছুতেই তাকে বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তার নিজের বিশ্বাস ক্রমশ দৃঢ় হচ্ছিল যে এই বাড়িতে একটা অশুভ শক্তি আছে, আর সেটা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। 

সেদিন রাতে মঞ্জরী আরও ভয়ানক কিছু দেখতে পেল। সে শুয়ে ছিল, আর হঠাৎ করেই তার শরীর অসাড় হয়ে গেল। সে নিজেকে নাড়াতে পারছিল না, চোখ খুলে রাখতে পারছিল না। তখন তার ভেতর দিয়ে একটা অদ্ভুত অনুভূতি বয়ে গেল। যেন তার শরীরের ওপর দিয়ে কেউ ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। তারপর, সে অনুভব করল তার গলার ওপর চাপ পড়ছে। 

সে চোখ খুলে দেখল, ললিতা তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই একই চোখ, সেই একই ভয়। মঞ্জরী তার দিকে তাকিয়ে দেখল ললিতার ঠোঁট নড়ে উঠল—“আমাকে মুক্তি দাও…”

মঞ্জরীর দম বন্ধ হয়ে আসছিল। তার সমস্ত শক্তি দিয়ে সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছিল, কিন্তু কোনোভাবেই সে উঠতে পারছিল না। হঠাৎই সবকিছু মিলিয়ে গেল। সে হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে বসল। তার মনে হচ্ছিল, যেন সে কিছুক্ষণ আগেই মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে।

ডায়েরির কথা মনে পড়তেই সে বুঝতে পারল, এই অশুভ শক্তি শুধু ললিতার নয়, তার নিজের জীবনকেও ধ্বংস করার চেষ্টা করছে। সে জানত, ললিতা তাকে কিছু বলতে চাইছে, কিছু জানাতে চাইছে। 

কিন্তু কীভাবে? কী সেই রহস্য যা ললিতা দিয়ে যেতে চেয়েছিল? আর কেন এই বাড়ি তার ওপর এমন প্রভাব ফেলছে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে মঞ্জরী আরও গভীরে নামতে বাধ্য হবে। এই অন্ধকার বাড়ির প্রতিটি কোণ, প্রতিটি দেওয়াল যেন কিছু লুকিয়ে রেখেছে, যা সে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করবে। 

কিন্তু সামনে অপেক্ষা করছে আরও ভয়ঙ্কর কিছু, যা সে তখনও কল্পনাও করতে পারেনি। 

অশুভ শক্তির প্রান্তে

রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়ে আসছিল। মঞ্জরী বিছানায় শুয়ে আছে, কিন্তু তার মনে শান্তি নেই। ঘরের চারপাশের অন্ধকার যেন তাকে গিলে খেতে চাইছে। সেই ফিসফিস শব্দটা আবার কানে এলো—”মঞ্জরী…”। 

সে আচমকা উঠে বসে চারপাশে তাকাল। ঘরের মধ্যে এমন কিছু নেই যা চোখে পড়ার মতো। কিন্তু মন যেন বিশ্বাস করতে চাইছিল যে এখানে কিছুর অস্তিত্ব আছে। সে চোখ বন্ধ করল, কিন্তু সেই সময়েই একটা ধাতব শব্দ শোনা গেল—কিছু যেন লোহার দরজার সাথে ঘষা খাচ্ছে। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হতে লাগল।

ঘরের অন্ধকারে হঠাৎ করেই ললিতার ছায়া দেখা দিল। সে তার ছোট্ট হাত তুলে মঞ্জরীর দিকে ইশারা করল, যেন কিছু বলার চেষ্টা করছে। “সাহায্য করো…” সেই মৃদু কণ্ঠস্বর শোনা গেল। ললিতার মুখে বিষাদের ছাপ, তার চোখে এক অদ্ভুত আতঙ্ক। মঞ্জরীর শরীর জমে গেল। সে উঠে দাঁড়াতে চেয়েও পারল না, যেন অদৃশ্য কিছু তাকে আঁকড়ে ধরেছে।

আতঙ্কে ঘেমে নেয়ে মঞ্জরী ঘুম ভাঙল। এটা ছিল একটা স্বপ্ন, কিন্তু এতটাই বাস্তব মনে হচ্ছিল যে সে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। সেই স্বপ্নের ভেতরকার ভয়াবহতা তাকে বাস্তবের চেয়েও বেশি আতঙ্কিত করেছিল। সে অনুভব করল, এই স্বপ্ন কেবল একটি স্বপ্ন নয়। ললিতা তাকে কিছু বলতে চাইছে, তাকে মুক্তি চাইছে।

পরের দিন সকালে মঞ্জরী উঠে ডায়েরিটা আবার পড়তে বসল। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় ললিতার ভয়, আতঙ্ক আর অসহায়তার চিহ্ন স্পষ্ট। কিন্তু আজ সে এমন কিছু খুঁজে পেল যা আগে সে লক্ষ্য করেনি। একটা পাতায় লেখা ছিল: “বাড়িটা আমার নয়, আমি এর বন্দী। এই জায়গায় অশুভ কিছু আছে। এটা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাকে আটকে রেখেছে। আমি পালাতে চাই, কিন্তু পারছি না। যে-ই এখানে আসে, তার হৃদয়ের গভীর শঙ্কা আর হতাশা সেই শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করে তোলে।”

মঞ্জরীর মাথার ভেতর দিয়ে শীতল একটা অনুভূতি বয়ে গেল। ললিতার এই লেখার সঙ্গে তার বর্তমান অভিজ্ঞতার মিল একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। সে বুঝতে পারল, এই বাড়িটা কেবল পুরোনো একটা স্থাপনা নয়, এটা কিছুর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই অশুভ শক্তি, যা ললিতাকে বন্দী করে রেখেছে, আজ মঞ্জরীর জীবনেও প্রবেশ করতে চাইছে।

ডায়েরির পরের পাতায় আরেকটি লেখা ছিল: “আমি একা নই। এখানে যারা আসে, তারাও এই ফাঁদে পড়ে। অন্ধকার আমাকে গ্রাস করে নিয়েছে। কিন্তু আমি এখনও আশা ছাড়িনি। যদি কেউ আমার কথা শুনতে পায়, তবে দয়া করে আমাকে মুক্তি দাও।”

মঞ্জরী ডায়েরির লেখা পড়তে পড়তে একটা অদ্ভুত ভয় অনুভব করছিল। তার চারপাশের পরিবেশও যেন ভারী হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, বাড়ির প্রতিটি কোণ থেকে সেই অশুভ শক্তি তাকে দেখছে, তাকে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। 

সুমন তখনও এসব ঘটনাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছিল না। সে মঞ্জরীর এই অস্বাভাবিক আচরণকে মানসিক চাপের ফল বলে মনে করছিল। কিন্তু মঞ্জরী জানত, এই ভয়ানক পরিস্থিতি কেবল তার মনের কল্পনা নয়। ললিতার সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাগুলি সত্যি, আর মঞ্জরীর উপরও তা ঘটতে শুরু করেছে।

সেদিন রাতে আবার কিছু অস্বাভাবিক ঘটনার মুখোমুখি হলো মঞ্জরী। ঘুমের মধ্যে সে অনুভব করল যে তার চারপাশে কিছু অদ্ভুত এবং শক্তিশালী কিছু আছে। তার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে আটকে রেখেছে। সে দেখতে পেল ললিতা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, চোখে ভীতির ছাপ, আর ঠোঁটে সেই একই কথা—“আমাকে মুক্তি দাও…”

মঞ্জরীর মন আচ্ছন্ন হয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল না কীভাবে এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে। ললিতা কি সত্যিই তাকে সাহায্য চাইছে, নাকি তার নিজের আতঙ্ক তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে? 

হঠাৎ করেই একটা অদ্ভুত শীতল হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকল। মঞ্জরী দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, দরজা অল্প ফাঁক হয়ে গেছে, আর সেখান থেকে কেমন যেন একটা অদ্ভুত আলোর ঝলকানি। সেই আলোতে মঞ্জরী দেখতে পেল একটা দীর্ঘ ছায়া ঘরের ভেতর দিয়ে হাঁটছে, কিন্তু সে কিছুই স্পষ্টভাবে বুঝতে পারল না।

তখনই, মঞ্জরীর মাথায় একটা নতুন চিন্তা এলো। ললিতা বলেছিল, “এই বাড়িটা তার নয়, বরং বাড়ি তাকে বন্দী করে রেখেছে।” তবে বাড়িটা ঠিক কীভাবে এমন অশুভ হয়ে উঠল? এই বাড়ির ইতিহাস কী? 

মঞ্জরী তখনই সিদ্ধান্ত নিল, তাকে এই বাড়ির পুরো ইতিহাস খুঁজে বের করতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, ললিতা শুধু তাকে সাবধান করতে চাইছে না, বরং তাকে কিছু জানাতে চাইছে যা এই ভয়ঙ্কর রহস্যের চাবিকাঠি হতে পারে।

কিন্তু সামনে কী অপেক্ষা করছে, মঞ্জরী তখনও জানত না।

অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - শেষ কবিতা: কবিতা, যুদ্ধ, এবং স্বপ্নের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই মন ছুঁয়ে যাওয়া বাংলা ছোট গল্প পড়ুন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

অশুভ শক্তির মুখোমুখি

রাতের অন্ধকার গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। মঞ্জরী বিছানায় শুয়ে কষ্ট পাচ্ছে। তার শরীর যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে, এক অদৃশ্য শক্তি তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। গত কয়েক রাতের স্বপ্নগুলি তাকে ক্রমাগত যন্ত্রণা দিচ্ছে—অতীতের অন্ধকার এবং ভবিষ্যতের আতঙ্কের এক ভয়ঙ্কর মিলন।

এদিন রাতে, মঞ্জরী একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখল। সে একটি বড়, পুরোনো ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরটির দেয়ালগুলি ময়লা আর ক্ষয়ে গেছে, আর সেখানে এক ধরনের অদ্ভুত সুর বাজছে। চারপাশে খুঁজে দেখলে কিছুই স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে না, শুধু অন্ধকার আর অস্পষ্ট ছায়ার এক নৃত্য। হঠাৎ, ললিতার চেহারা মঞ্জরীর সামনে উদ্ভাসিত হলো। তার চোখগুলো যেন অশান্তির গভীরতা থেকে উজ্জ্বল হচ্ছিল। 

ললিতা মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ভয়ঙ্কর, মঞ্জরী। বাড়ি তোমার ভয় আর দুঃখ থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। তুমি যদি আমার মতোই না পারো, তাহলে তুমি নিজেই পরিণত হবে।” ললিতার মুখের অভিব্যক্তিতে এক ধরনের আকুতি ছিল, আর তার কথাগুলির মধ্যে এক গভীর দুঃখ। 

মঞ্জরী ভয়ার্ত চোখে ললিতার দিকে তাকিয়ে থাকল। তার মনে হচ্ছিল, ললিতা কিছু বড় সত্য প্রকাশ করতে চাইছে, কিন্তু সে ঠিক কী বলছে তা বুঝতে পারছে না। স্বপ্নের মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর কোলাহল শুরু হল—গলার আওয়াজ, দরজার পিটুনির শব্দ, আর ঘরের দেওয়াল থেকে আসা অদ্ভুত ফিসফিস।

সেই মুহূর্তে, মঞ্জরী ঘুম থেকে উঠে বসে পড়ল। তার হৃদস্পন্দন দ্রুত হচ্ছিল। ঘরের আলোটা টিপে জ্বালিয়ে দিল, কিন্তু ঘরটি আগের মতোই অন্ধকার আর নিরব ছিল। সেই ভয়ার্ত অনুভূতি যেন বাস্তবতার অংশ হয়ে উঠেছে। 

সকালে, মঞ্জরী সুমনকে ডাকল। সুমন তখনও ঘুমিয়ে ছিল, কিন্তু মঞ্জরীর চিৎকারে সে উঠে এল। “সুমন, আমাকে সাহায্য করতে হবে। আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি, আর আমি বুঝতে পারছি যে আমাদের এই বাড়ির ভিতরে কিছু ভীষণ বিপদ আছে।”

সুমন ঘুম ঘুম চোখে বলল, “মঞ্জরী, আবার সেই স্বপ্নের কথা? তুমি কেবল ভাবছ, আর এসব কল্পনার পরিণতি তোমার উপর ভর করেছে। তুমি শান্ত হতে চেষ্টা করো। তুমি যদি এই বাড়ি থেকে দূরে সরে যাও, তাহলে এসব সমস্যা চলে যাবে।”

মঞ্জরী বিরক্ত হয়ে বলল, “না, সুমন। আমি জানি, এই বাড়ি কিছু গোপন রাখছে। আমাদের এখানে আরো কিছু জানতে হবে। আমি ললিতার ডায়েরি পড়েছি, আর আমি নিশ্চিত যে এখানে কিছু রয়েছে যা আমাদের জানানো উচিত।”

সুমন অবশেষে থামল। “তুমি যা বলছ, সেটা আমিও দেখতে চাই। কিন্তু সাবধান হও, মঞ্জরী। যদি কিছু না থাকে, তাহলে তুমি আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়বে।”

মঞ্জরী দ্রুত ডায়েরির দিকে চলে গেল। ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে সে এক পৃষ্ঠা দেখতে পেল যেখানে লেখা ছিল: “এখানে কিছু ঘটছে যা মানুষের মনের গভীর অন্ধকার থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। এই বাড়ি এক ধরনের প্রাচীন শক্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যারা হতাশা ও ভয় থেকে ভুগছে, তাদের ওপর এই শক্তি আরো প্রভাবিত হয়। একমাত্র যারা সত্যিকারের সাহস নিয়ে এই শক্তির মুখোমুখি হয়, তারা বেঁচে যেতে পারে।”

মঞ্জরী ডায়েরির লেখাটা পড়তে পড়তে এক গভীর উপলব্ধি পেল। তার সামনে একটি নতুন প্রশ্ন উঠল—এই শক্তি কীভাবে পরাজিত করা যায়? 

সুমন তখন মঞ্জরীর পাশে এসে দাঁড়াল। “আমরা কীভাবে এই শক্তির মুখোমুখি হতে পারি?”

মঞ্জরী জানাল, “আমাদের এই বাড়ির গোপন ইতিহাস জানতে হবে। ললিতা যে কষ্ট পেয়েছে, তা আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে। এবং মনে রাখতে হবে, এই শক্তি মানুষের ভয় আর হতাশার ওপর ভর করে।”

মঞ্জরী এবং সুমন বাড়ির পুরোনো নথি এবং ইতিহাস খুঁজতে শুরু করল। তারা একটি পুরোনো লেবেল করা বাক্স খুঁজে পেল যা ছিল বাড়ির মূল মালিকের ইতিহাস। এই বাক্সের মধ্যে নানা পুরোনো নথি, ছবির অ্যালবাম, এবং একমাত্র কিছু অদ্ভুত নথি ছিল—যেগুলি কোনো অদৃশ্য শক্তির কথা বলছিল।

একটি নথিতে লেখা ছিল: “এই বাড়ি নির্মাণের পর থেকেই এখানে এক অদ্ভুত শক্তির উপস্থিতি ছিল। কেউ কখনো পরিষ্কারভাবে কিছু দেখতে বা বুঝতে পারেনি, তবে এই শক্তি তাদের ভয় আর হতাশা থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। সময়ের সাথে, এই শক্তি বাড়ির মালিকদের ওপর নিজের প্রভাব বিস্তার করে নিয়েছে। তাই, যারা এই বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে, তাদের ভয় এবং দুঃখ বাড়ানোর চেষ্টা করে।”

মঞ্জরী এবং সুমন আরো গভীরভাবে নথিগুলি পড়তে লাগল। তাদের সামনে একটা অদ্ভুত সত্য উন্মোচিত হচ্ছিল। এই বাড়িটি আসলে এক ধরনের ভূতের নিক্ষেপক ছিল, যা মানুষের মনের অন্ধকার অংশ থেকে শক্তি আহরণ করছিল। 

সন্ধ্যায়, মঞ্জরী একটি প্ল্যান তৈরি করল। সে জানত, এই শক্তি প্রতিরোধ করার জন্য তাকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। তার আগে, সে ললিতার আত্মার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে। 

মঞ্জরী একটা পূজার আয়োজন করল, যাতে সে ললিতার আত্মার সঙ্গে এক ধরনের রূপক সংযোগ স্থাপন করতে পারে। পূজা আর দোয়া করতে করতে, সে নিজেকে প্রস্তুত করল অশুভ শক্তির মুখোমুখি হওয়ার জন্য। 

পূজার শেষের দিকে, ঘরের অন্ধকারে এক গভীর নিঃশব্দ আছড়ে পড়ল। ললিতার উপস্থিতি অনুভব করা যাচ্ছিল। 

“মঞ্জরী… তোমার সাহস আমাকে আনন্দিত করেছে। কিন্তু এই শক্তি, এটি ভয় ও দুঃখের উপর ভর করে, তোমার সাহসকে পরাজিত করতে চাইবে। তুমি একদম একা নও। আমি তোমার পাশে আছি।”

মঞ্জরী বুঝতে পারছিল যে সে সঠিক পথে আছে। তবে সামনে আরও অনেক কঠিন পরীক্ষা অপেক্ষা করছে। 

এখন তাকে এই শক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে, এবং ললিতার মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। 

ভয়ঙ্কর শক্তির মুখোমুখি

রাতের ঘন অন্ধকার ধীরে ধীরে বাড়ির উপর নেমে আসছিল। মঞ্জরী এবং সুমনের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। সুমন, যদিও মঞ্জরীর আশঙ্কাকে প্রথমে তুচ্ছ মনে করেছিল, এখন বাস্তবতার সম্মুখীন হচ্ছিল। তার চোখে এখন প্রকৃত ভয় দেখছিল। বাড়ির প্রতিটি কোণায় এক অদৃশ্য শক্তি তাকে ঘিরে ধরেছে, আর সে সেটা অনুভব করছিল।

মঞ্জরী টেবিলের উপর রাখা ললিতার ডায়েরি আবার একবার পড়ছিল। ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলি তার হাতে কম্পন হয়ে উঠেছিল। ললিতার সেসব কষ্টকর অভিজ্ঞতা, আতঙ্কের গল্প, আর তার মৃত্যু সেদিনের তীব্রতা মঞ্জরীর মনে এক গভীর ভয় সৃষ্টি করেছিল। সুমন এখনও অবিশ্বাসের গন্ডিতে ছিল, কিন্তু তার মনের মধ্যে এক সন্দেহের মেঘ জমছিল।

সকালবেলা, বাড়ির সামনের উঠোনে মঞ্জরী আর সুমন দাঁড়িয়ে ছিল। সুমন তার হাতের মধ্যে এক পুরোনো ছবির অ্যালবাম ধরে ছিল, যা তারা নথি খুঁজতে গিয়ে পেয়েছিল। অ্যালবামের ছবিগুলি বেশ পুরোনো, কিছু ছবি তো এমনকি শোক প্রকাশের মতো।

“মঞ্জরী, তুমি সত্যি ভাবো যে এই বাড়ির ভিতরে কিছু ভয়ঙ্কর আছে?” সুমন ধীরস্বরে বলল, তার কণ্ঠে এক ধরনের দ্বিধা ছিল।

“আমি জানি, সুমন। আমি জানি যে কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা এখানে ঘটছে। আমাদের ললিতার অতীতের রহস্য উদঘাটন করতে হবে,” মঞ্জরী দৃঢ়তার সাথে বলল। “তোমার আসল দৃষ্টি এখানে খুঁজে বের করতে হবে।”

সুমন একে একে ছবি ঘুরিয়ে দেখছিল, ছবির মধ্যে বেশ কয়েকটি অন্ধকার ধূসর মুখ ছিল। ছবিগুলির মধ্যে একটি ছবিতে একটি যুবতী মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখের অভিব্যক্তি অস্পষ্ট, কিন্তু তাতে এক ধরনের ভয়ের অনুভূতি ছিল। 

“এটি ললিতা হতে পারে,” মঞ্জরী বলল, ছবিটি দেখে। “তার চোখের অভিব্যক্তি এক ধরনের অশান্তি দেখাচ্ছে। আমি মনে করি, এই ছবিটি আমাদের কিছু বলতে চায়।”

দুপুরের দিকে, মঞ্জরী আর সুমন বাড়ির পুরোনো অংশে ঢুকে পড়ল। পুরোনো আসবাবপত্র, আবর্জনা, আর এক ধরনের অতীতের গন্ধ সেখানে ভাসছিল। তারা দেখতে পেল এক ঘর, যা পুরোপুরি অন্ধকারে ঢেকে ছিল। মঞ্জরী মনে করেছিল যে এই ঘরটি বিশেষ কিছু।

“এখানে কিছু আছে, সুমন। এই ঘরটা আমাদের অতীতের গোপন রহস্য উন্মোচন করতে সাহায্য করতে পারে,” মঞ্জরী বলল, তার কণ্ঠে উত্তেজনার স্পন্দন ছিল।

সুমন এক ধরনের সন্দেহ নিয়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। মঞ্জরী সঙ্গী হল। ঘরটি বেশ অন্ধকার এবং ধোঁয়াশা ছিল। কিন্তু মঞ্জরী যেন কিছু অনুভব করছিল। সে জানত, এখানে কিছু আছে যা তাদের উত্তেজনাকে পূর্ণ করবে।

হঠাৎ, ঘরের এক কোণ থেকে একটি কাঁপুনি আওয়াজ শোনা গেল। সুমন থমকে দাঁড়াল, আর মঞ্জরী আশঙ্কিতভাবে তাকিয়ে থাকল। ঘরের মধ্যে হঠাৎ একটি স্নিগ্ধ হাওয়া শুরু হল, যা মঞ্জরীকে আরও বেশি আতঙ্কিত করল।

“এটা কি হচ্ছে?” সুমন বিস্মিত হয়ে বলল।

মঞ্জরী বলল, “এটি সেই শক্তি। এটি আমাদের ভয় আর হতাশা থেকে শক্তি সংগ্রহ করছে। আমাদের এই ঘরটি পরিষ্কার করতে হবে। আর ললিতার আত্মাকে মুক্ত করতে হবে।”

মঞ্জরী পুরোনো দোয়াতে আগুন জ্বালাতে শুরু করল। সে ঘরের বিভিন্ন জায়গায় জোরে জোরে প্রার্থনা করছিল, আর সুমন তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ, ঘরের ভিতর থেকে এক ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনা গেল। এটি ছিল এক অদ্ভুত গলার আওয়াজ, যা মঞ্জরীকে আরও বেশি ভয় দেখাচ্ছিল।

“আমরা কী করব?” সুমন চিৎকার করে বলল। 

“আমাদের শেষ চেষ্টা করতে হবে। আমি জানি, এই শক্তি আমাদের সাহস আর শক্তি পরীক্ষা করছে। আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে,” মঞ্জরী দৃঢ়তার সাথে বলল।

মঞ্জরী ডায়েরির পৃষ্ঠা থেকে পাওয়া একটি প্রাচীন নিয়ম অনুসরণ করতে শুরু করল। সে জানত, এই নিয়মগুলো হয়তো তাদের সাহায্য করবে। সুমন কিছু সময়ের জন্য বোঝা শুরু করল যে, ললিতার অতীতের রহস্য উদঘাটন করা খুবই জরুরি।

হঠাৎ, ঘরের এক কোণ থেকে একটি ভয়ঙ্কর আলো উদ্ভাসিত হলো। আলোটি সাদা, কিন্তু তার মধ্যে এক অন্ধকার শক্তির উপস্থিতি ছিল। মঞ্জরী আর সুমন একসঙ্গে দাঁড়িয়ে সেই আলোকে মুখোমুখি হল। 

আলো থেকে বেরিয়ে আসা এক প্রাচীন আকারের শক্তি মঞ্জরী আর সুমনের দিকে এগিয়ে আসছিল। তার চোখের মধ্যে এক ধরনের ভয়ংকর প্রতিশোধের প্রতিফলন ছিল। 

“এটাই সেই শক্তি, সুমন। এটি ললিতার আত্মাকে বন্দী করেছে। আর এখন আমাদের সামনে এসেছে,” মঞ্জরী কাঁপা কণ্ঠে বলল।

এমন সময়ে, মঞ্জরীর মনে পড়ল ললিতার সেই স্বপ্নের কথা—যেখানে ললিতা তাকে সাহায্যের জন্য ডাকছিল। মঞ্জরী বুঝতে পারল, এই শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য তাকে ললিতার অতীতের সত্য উদঘাটন করতে হবে।

“আমাদের এখন ললিতার অতীতের রহস্য উদঘাটন করতে হবে। আর এই শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে। যদি আমরা না পারি, তাহলে আমাদের সবার জীবনেরও শেষ হবে,” মঞ্জরী সাহসের সাথে বলল।

অশুভ শক্তির চূড়ান্ত দ্বন্দ্ব

মঞ্জরী আর সুমন অবিশ্বাস্যভাবে ভীত। সেই ঘরের ভেতরের আলোটা এখনো তাদের চারপাশে জ্বলছে, আর অদৃশ্য শক্তির চাপ তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত চাপ তৈরি করছে। সুমনের চোখে আতঙ্কের ছায়া, আর মঞ্জরীর মনে শুধু একটাই চিন্তা—ললিতার আত্মাকে মুক্ত করতে হবে, কিন্তু সে জানে যে এই বাড়িটি তাদেরও গিলে ফেলছে।

“এটা শুধু ললিতার আত্মাকে বন্দী করেনি। এটা আমাদেরও ধীরে ধীরে গ্রাস করতে শুরু করেছে,” মঞ্জরী বলল, কাঁপা কণ্ঠে। “আমাদের দ্রুত কিছু করতে হবে।”

“কিন্তু কিভাবে?” সুমন বলল, তার ভয় অদৃশ্য শক্তির মুখোমুখি হয়ে বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।

মঞ্জরী ডায়েরির পৃষ্ঠাগুলি আবার পড়তে শুরু করল। তার চোখের সামনে ললিতার অবর্ণনীয় কষ্ট আর ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ফুটে উঠছিল। সে জানত যে, এই শক্তি শুধু ললিতার নয়, এখন তাদেরও নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে।

হঠাৎ, ঘরের দেয়াল থেকে এক অদ্ভুত আওয়াজ শুরু হলো। আওয়াজটি যেন একটি অন্ধকার গর্জন, যা তাদের কানের মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছিল। মঞ্জরী আর সুমন সজাগ হয়ে ওঠে, তাদের মনে ভয়াবহ শিহরণ শুরু হয়।

“তোমার ললিতার আত্মাকে মুক্ত করতে হবে,” এক ভয়ঙ্কর গলার আওয়াজ ঘরজুড়ে বেজে উঠলো। এটি মনে হচ্ছিল যে, বাড়ির নিজস্ব কণ্ঠস্বর।

মঞ্জরী বুঝতে পারছিল যে, তাদের লড়াই এখন এক ভয়াবহ স্তরে পৌঁছেছে। সুমনকে পাশে নিয়ে, মঞ্জরী পুনরায় ললিতার ডায়েরি খুলল। সে দ্রুত পৃষ্ঠাগুলি পড়তে শুরু করল। ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠায় একটি প্রাচীন নিয়ম লেখা ছিল, যা তাকে একমাত্র উপায় হিসেবে মনে হচ্ছিল।

“এখানে একটি নিয়ম লেখা আছে,” মঞ্জরী বলল, তার কণ্ঠে দৃঢ়তা ছিল। “এটা ললিতার আত্মাকে মুক্ত করতে আমাদের সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এটা করতে হলে আমাদের এই ঘরের অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করতে হবে।”

সুমন নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা কি করতে পারি? আমাকে বলো।”

মঞ্জরী ডায়েরির নির্দেশ অনুসরণ করে একটি প্রাচীন প্রতীক আঁকলো, যা সেই ঘরের এক কোণায় বসিয়ে দিল। এটি একটি ত্রিভুজের মতো প্রতীক, যা মন্ত্রের সাথে জড়িত ছিল। প্রতীক আঁকার পরে, মঞ্জরী একটি প্রাচীন মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করল, যা ডায়েরিতে লেখা ছিল।

মন্ত্র উচ্চারণ করার সাথে সাথে ঘরের আলো আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠল, আর সেই অদৃশ্য শক্তি যেন শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। সুমন মন্ত্রের প্রতিক্রিয়া দেখতে থাকল, আর তার চোখে আতঙ্কের ঝলক।

হঠাৎ, সেই অদৃশ্য শক্তি এক ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করতে শুরু করল। একটি বিশাল আকারের কালো মেঘের মতো কিছু ঘরের মধ্যে প্রবাহিত হতে লাগলো। মঞ্জরী আর সুমন ঘন অন্ধকারে নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিল, আর তাদের চারপাশে এক অদ্ভুত চাপ অনুভূত হচ্ছিল।

“এটা এক ভয়াবহ সত্তা,” মঞ্জরী বলল, তার কণ্ঠে চাপ ছিল। “এটি আমাদের ভয়ের শক্তি থেকে শক্তি সংগ্রহ করে।”

সুমন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমরা এই সত্তাকে পরাস্ত করতে পারব না তো?”

মঞ্জরী বলল, “আমাদের সাহস রাখতে হবে। আর ললিতার আত্মাকে মুক্ত করতে হবে। এই শক্তিকে পরাস্ত করতে হলে আমাদের মনে সাহস রাখতে হবে।”

হঠাৎ, ললিতার আত্মা মঞ্জরীর সামনে উপস্থিত হলো। তার মুখে এক ধরনের শোক আর কষ্টের ছায়া ছিল। 

“মঞ্জরী… আমাকে মুক্তি দাও…” ললিতার আত্মা বলল, তার কণ্ঠে এক অশান্তি ছিল।

মঞ্জরী বলল, “আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু এই বাড়ি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। তুমি আমাকে সাহায্য করতে পারো?”

ললিতার আত্মা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “তুমি সাহসী হও। এই বাড়ির অন্ধকার শক্তি আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। তোমাকে একমাত্র পন্থা হিসেবে প্রাচীন নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। তবে মনে রেখো, এই শক্তি তোমাদেরও গিলে ফেলবে।”

মঞ্জরী সাহস নিয়ে মন্ত্র পাঠ করে যেতে থাকল। আর সুমন তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রার্থনা করছিল। মন্ত্রের শক্তি বাড়ির চারপাশে একটি শক্তি তৈরি করতে শুরু করল, যা কালো মেঘের মধ্যে প্রবাহিত হতে লাগলো।

হঠাৎ, সেই অদৃশ্য শক্তি চিৎকার করতে শুরু করল। ঘরের ভিতর থেকে একটি ভয়ঙ্কর আলো উদ্ভাসিত হলো। আলোটি এত উজ্জ্বল ছিল যে, ঘরের অন্ধকারকে দূর করে দিল। 

ললিতার আত্মা এবার এক শান্তি অনুভব করছিল। “ধন্যবাদ… ধন্যবাদ… তুমি আমাকে মুক্তি দিলে,” সে বলল, তার কণ্ঠে এক ধরনের শান্তি ছিল।

মঞ্জরী আর সুমন ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে আসলো। বাড়ির অন্ধকার শক্তি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। মঞ্জরী বুঝতে পারল যে, এই বাড়ি আর তাদের ভয়ের পন্থায় থাকতে পারবে না।

তারা ঘর থেকে বের হয়ে এসে, সবার প্রশান্তির অভিব্যক্তি নিয়ে বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। মঞ্জরী আর সুমন বুঝতে পারছিল যে, তারা এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছে। 

“আমরা সফল হলাম,” মঞ্জরী বলল, তার কণ্ঠে এক ধরনের শান্তি ছিল। “ললিতার আত্মা মুক্তি পেল। আর এখন আমরা মুক্তি পেলাম।”

সুমন মঞ্জরীর দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু আমরা একসঙ্গে সফল হয়েছি।”

তাদের দুইজনের সামনে এখন একটি নতুন সূর্য উঠছে। এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার শেষে, তারা বুঝতে পারল যে, তাদের জীবন আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। তবে, তাদের মনে এক ধরনের স্মৃতি ছিল—একটি অদ্ভুত শক্তির মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা, যা তাদের জীবনে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে। 

এই রকম চিত্তাকর্ষক বাংলা ছোট গল্প -এর আপডেট পেতে আমাদের WhatsApp চ্যানেল জয়েন করুন।

আমরা কারা

নতুন বাংলা ছোট গল্প

প্রাচীরের ওপারে প্রেম

"প্রাচীরের ওপারে প্রেম" একটি হৃদয়স্পর্শী ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প। বাংলা ছোট গল্পের এই প্রেমের আখ্যান বার্লিন প্রাচীরের পটভূমিতে সাহস, ত্যাগ ও ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত।

"প্রাচীরের ওপারে প্রেম" একটি হৃদয়স্পর্শী ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প। বাংলা ছোট গল্পের এই প্রেমের আখ্যান বার্লিন প্রাচীরের পটভূমিতে সাহস, ত্যাগ ও ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: প্রাচীরের ওপারে প্রেম

মুক্তির দ্বার

"মুক্তির দ্বার" একটি হৃদয়স্পর্শী কল্পবিজ্ঞান গল্প। বন্ধুত্ব, অপরাধবোধ ও মুক্তির সন্ধানে ভ্যালেরিয়ানের যাত্রা নিয়ে এই বাংলা ছোট গল্প পাঠকদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যাবে।

"মুক্তির দ্বার" একটি হৃদয়স্পর্শী কল্পবিজ্ঞান গল্প। বন্ধুত্ব, অপরাধবোধ ও মুক্তির সন্ধানে ভ্যালেরিয়ানের যাত্রা নিয়ে এই বাংলা ছোট গল্প পাঠকদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যাবে।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: মুক্তির দ্বার

মৃত্যুর হাসি

"মৃত্যুর হাসি" একটি রহস্যময় ভুতের গল্প যেখানে দুই ভাইবোনের সাহস, মায়ের আত্মার আশীর্বাদ, ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই আপনাকে টানবে। পড়ুন এই বাংলা ছোট গল্প, যা ভয় ও আবেগে ভরা।

"মৃত্যুর হাসি" একটি রহস্যময় ভুতের গল্প যেখানে দুই ভাইবোনের সাহস, মায়ের আত্মার আশীর্বাদ, ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই আপনাকে টানবে। পড়ুন এই বাংলা ছোট গল্প, যা ভয় ও আবেগে ভরা।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: মৃত্যুর হাসি

Leave a Comment

অনুলিপি নিষিদ্ধ!