বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকার খালি প্ল্যাটফর্মের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে শেষ ট্রেনটি ক্লান্ত হয়ে স্টেশনে প্রবেশ করেছিল। ইঞ্জিনটি ঝাঁকুনি দেয় এবং হিস শব্দ করে, ডিজেল-দাগযুক্ত তুষার এর চাদর তার ছাদ থেকে বরফের ট্র্যাকের উপর যেন পিছলে পড়ছিল। স্টেশনের ক্যাফের উপরে একটি নির্জন আলোর বাল্ব ঝুলে আছে, রাত্রিকে সেটা যেন অস্বীকার করছে। ছোট পতঙ্গ গুলি আলোকিত স্নোফ্লেক্সগুলির চারপাশে ঘুরছিল। বিশ্রামে যাওয়ার আগে ইঞ্জিনের একটি মাত্র উইন্ডস্ক্রিন-এর ওয়াইপার চরম আক্রোশে ধুলো মাখা কাঁচের ওপর ঝাপ্টা দিয়ে শেষ বারের মতো নড়ে ওঠে।
প্রতিদিনের মতো আজ ও নিলয় ষ্টেশন এর কোনে একটি বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলো। পাশে থাকা পুরোনো গোলাপের গাছটা তার দিকে নুইয়ে পড়ছিল।
না! সে আজ ও আসেনি ।
নিলয়ের গোলাকার মুখে, লালচে গাঁথুনি; বয়স প্রায় ৪৫ এর কাছাকাছি। মাঝারি শারীরিক গঠন, পরনে ময়লা ধূসর রঙের একটি জামা; প্যান্ট টা লম্বায় এতটাই বেশি ছিল যে, সেটা তার জুতোর উপরে পর্শ করছিলো। তার জামার হাতা প্রান্তে উল্টে দেওয়া হয়েছিল, সাবধানতার সাথে সেফটি পিন দিয়ে রাখা হয়েছিল, যেটি তার মায়ের হাতের কাজ ছিল। এই সেফটি পিনটা তার মায়ের শেষ স্মৃতি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিলয় কিছুক্ষণ দূরে কুয়াশা আচ্ছন্ন গ্রামের দিকে তাকিয়ে থাকলো। ওই গ্রামেই তো প্রথম রোজি-র সাথে দেখা হয়েছিল।
স্টেশন এ একটা কালচে বাদামি রঙের ইঁদুর একটি বিস্কুট এর খালি প্যাকেট এর মধ্যে আটকে পড়েছিল তার-ই খস খস শব্দ নীরব প্লাটফর্মে ছড়িয়ে যাচ্ছিলো। ইঁদুরটা প্যাকেটের মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিলনা; ঠিক যেমন নিলয়ের হৃদয় থেকে ‘অপেক্ষা’ মুক্তি পেতে চাইছিল। ২০ টা বছর কেটে গেছে আজ ও সে প্রতীক্ষা করছে তার রোজি -র জন্য।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - শেষ কবিতা: কবিতা, যুদ্ধ, এবং স্বপ্নের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। এই মন ছুঁয়ে যাওয়া বাংলা ছোট গল্প পড়ুন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
পাশে থাকা গোলাপের গাছ-টার দিকে একবার তাকিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে পড়ে নিলয়। পেছন থেকে স্টেশন এর একমাত্র টি-ষ্টল এর করিম চাচা ডেকে ওঠে, “আর কতদিন বাবু, ভুলে যাও দিদিমনি কে!” এই করিম চাচার চায়ের দোকানে কত পুরোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে রোজির সাথে।
বাইরে তখন হালকা উত্তরের বাতাস বইছে ; নিলয়ের গায়ে ওই ময়লা পড়া জামাটা ছাড়া আর কিছু নেই। ও করিম চাচার ডাকে সারা দিয়ে, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো “হুমমম আসছি , তুমি দাড়াও একসাথে বাড়ি ফিরবো। ” কারিমি চাচা ও নিলয় এর বাড়ি ২-৩ টা বাড়ির পার্থক্যে ছিল। করিম চাচা ষ্টল এর দরজাটা বন্ধ করে বলতে শুরু করে , “বাবু তুমি আর কতদিন দিদিমনি -র জন্য অপেক্ষা করবে ? বিয়ে করে ঘর সংসার ও করলে না !,” হটাৎ করিম চাচা র নজর পারলো নিলয়ের পোশাকের ওপর , বললো “তোমার শীত করছে না ?”
নিলয় – এর অপেক্ষার উষ্ণতার কাছে যেন উত্তরের হাওয়া আজ হার মেনেছে। অদূরের জির্নাশায় বায়ুকল টা তার পাখনা নেড়ে যেন নিলয়কে বলতে চাইছে , “আর কত অপেক্ষার রাত !”
বাড়ি ফিরে নিলয় আজ কিছু না খেয়ে শুধু জল খেয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানার পাশের জানালা টা খোলা রেখেছিল। চাঁদের নীলাভ শান্ত আলোটা তার বিছানার অর্ধেকটা দখল করে নিয়েছে। নিলয় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
তার এই একাকিত্ত জীবনে চাঁদের নীলাভ আলোটাই আজ তার শয্যা সঙ্গী।
বালিশের তলা থেকে একটা পুরোনো চিঠি বের করলো নিলয় , সেটি আজ নিলয়ের মতোই ক্লান্ত। খুব সাবধানে নিলয় চিঠি টা হাতে নিয়ে মনে মনে পড়তে লাগলো ; তাতে লেখা আছে ,
“যখন তুমি মনে কর যে আমি তোমাকে নিজের এবং সবকিছুর চেয়ে বেশি ভালোবাসি সে সম্পর্কে তুমি কী মনে কর? এবং… তুমি যখন এই কথাগুলো নিজের কাছে বল তখন তোমার কেমন লাগে? এটা কি একটি উষ্ণ, অস্পষ্ট, মৃদু ভালবাসার মতো নাকি এটা এমন কিছু; যে, আমি তোমার চেয়ে বেশি হতে চাই? এটা কি রাগ, হতাশা, ঘৃণা? এটা কি এমন একটা অনুভূতি যাকে বিস্ফোরিত এবং আঘাত করতে চাওয়া এই মানুষটিকে তোমার কাছে অনেক বেশি বোঝায়?
বাংলা ছোট গল্প - মুড সুইং : এক যুবক তার প্রেমিকার স্বপ্ন দেখে। তার স্বপ্নের জগতে, তারা এক অন্যরকম ভালোবাসার মধ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু স্বপ্ন শেষ হলে কি তাদের প্রেমের গল্পও শেষ হবে? সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আমি জানি না যে তুমি আমার কাছে এতো স্পেশাল কেন, তবে আমাদের কাটানোর ওই সুন্দর মুহূর্তে আমি তোমাকে সেটা অনুভব করিয়েছি। একটি পুরোনো সম্পর্কে নতুন পদক্ষেপ নেওয়া আমার কাছে একটা বিষ্ময়ের। আমার মনে হয়, আমি এখন তোমার কাছে আমার লজ্জা-র অভাব অনুভব করছি। তোমার সাথে সময় কাটানোর পর থেকে, আমি নিজেকে আরও নতুন করে অনুভব করছি।
যা বলতে চাই তা বলার মতো শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না, তুমি কি আমার অনুভূতি কে আমায় বোঝানোর জন্য সাহায্য করবে? নতুন জীবনের অনুভূতি এখন আমার জীবনে। এই ‘জীবন’ তোমার ভালোবাসার উপহার।
– তোমার জীবন (রোজি)”
নিলয় শেষ ২০ বছর ধরে এই চিঠিটা একবার করে পড়ে বালিশের নিচে খুব সাবধানে রেখে দেয়। জানলার দিকে ফিরে, শুষ্ক নয়নে আকাশের দিকে নিলয় তাকিয়ে থাকে।
২২-২৩ বছর আগে নিলয় কলেজ শেষ করে বাড়ি থেকে অদূরে একটা চায়ের বাগানের কেরানির কাজে যুক্ত হয়েছিল। নিলয়ের মধ্যবিত্ত পরিবার। তখন তার বয়স ২৩ এর মতো। বাড়িতে মায়ের সাথে থাকতো। বাবা-কে শৈশবেই হারিয়েছিল নিলয়। চায়ের বাগানের কাজে একদিন নিলয়কে পাশের গ্রামে যেতে হয়।
পরিকল্পনা মত নিলয় সেদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু ভোরের দিকে বেরিয়েছিল; গ্রাম তা খুব কাছে না হলেও পায়ে হেঁটে যাওয়ার দূরত্বেই ছিল। হাতে দরকারি কাগজপত্র নিয়ে নিলয় রাস্তায় হাঁটা শুরু করলো। রাস্তায় শিশির ভেজা সারি দিয়ে পাশের গাছ গুলো থেকে শিশির বিন্দুর সাথে কয়েকটা ফুল পাতা ও ঝরে পড়ছিল। কিছুদূর পথ চলার পর নিলয় – এর নজর পড়লো গ্রামটির ওপর। গ্রামটি তখন-ও কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। একটা পাইন গাছ কুয়াশার চাদর তা সরিয়ে উঁকি দিয়ে উদীয়মান সূর্যের দিকে তাকিয়ে আছে। এক গ্রামে থাকেন মিস্টার বক্সী ; চায়ের বাগানের পার্টনার। যদিও নিলয় কোনোদিন মিস্টার বক্সী -র বাড়িতে আসেনি, তবুও তার জানত সে ঠিক মিস্টার বক্সী -র বাড়ি খুঁজে নেবে।
নিলয় তখন গ্রামটির খুব কাছে এমন সময় সে শুনতে পেল পায়ের নুপুরের শব্দ পাশের জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে আসছে। খুব কৌতহল বসত নিলয় জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করলো। একটি গাছের আড়াল থেকে শব্দটি ভেসে আসছিল। হালকা ঘন কুয়াশাতে চেহারা টা ঠিক দেখতে না পেলেও নিলয় ওখানে একজন নারীর উপস্থিতি বিদ্যমান; সেটা পরিষ্কার বুঝতে পারছিল। কুয়াশা -র চাদরে মোড়া জঙ্গলে ভোরের সূর্যের কিরণে রোজিকে প্রথম বার দেখল নিলয়।
গোলাপ; সে নিজের সুন্দর সুসজ্জিত, নিজের সুবাসে উন্মত্ত, ভোরের শিশিরে সে স্নান করে, সূর্যের কিরণ তার অলংকার ।
পারেন তার সাদা এম্ব্রোডায়েরি করা সালোয়ার সুট, হালকা গোলাপি রঙের ওড়নাটি বাম কাঁধের ওপর ছাড়ানো আছে, দুধে আলতা গায়ের রং, ঠোঁট দুটি ফুলের পাপড়ির থেকেও কোমল, চোখের পাতায় তখন শিশির বিন্দু লেগে আছে ; হালকা বাদামি ঘন চুল খোঁপা করে বাঁধা আছে। রোজি হটাৎ করে একজন অপরিচিতকে সামনে দেখে মাথা নিচু করে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। কাঁধের ওড়না তা বাম কাঁধ থেকে মাথায় জড়িয়ে নিতে যাবে, ঠিক সেই সময় নিলয় জিজ্ঞেস করলো, “আজ্ঞে! শুনছেন ? আপনিকি এই গ্রামেই থাকেন ?”
কথাটা শুনে রোজি কেমন হকচকিয়ে গেল। গ্রামের তরুণী, এই স্বভাবতই স্বাভাবিক। সে ফিরে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো “হ্যা!”
– আমি মিস্টার বক্সী -এর বাড়িতে যাবো, আমাকে একটু রাস্তাটা দেখিয়ে দেবেন।
রোজি কথাটা শুনে কয়েক সেকেন্ড এর জন্য কি একটা ভেবে বললো, “আমার সাথে আসুন। ” নিলয় এর আগে যে কোনোদিন সুন্দরী মেয়ে দেখেনি বা তাদের সঙ্গে পরিচিত হয়নি সেটা বললে ভুল হবে। কিন্তু রোজি আলাদা, রোজি কে দেখার পর নিলয়ের শিরদাঁড়া থেকে ঠান্ডা রক্ত বইতে শুরু করেছিল , হৃদপিন্ড অস্থির হয়ে উঠেছিল। সামনের জঙ্গলটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিলো। সে শুধু রোজিকে ছাড়া কাউকে দেখতে পাচ্ছিলনা। হাঁটুর নিচে পা-টা অসাড় হয়ে যাচ্ছিলো।
গ্রামে পৌঁছতে এখনও মিনিট ১০-১৫ এর রাস্তা। রোজি কোনো ভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে; বললো , “আপনি কি চায়ের বাগান থেকে এসেছেন ?” নিলয় বললো, “হ্যা!” ওরা হাঁটতে শুরু করলো। রোজি সামনে ছিল, তার এক দেড় হাত দূরে নিলয় আসছিলো। নিলয় মনে মনে ভাবলো, মিস্টার বক্সী ধনী, চায়ের বাগানের মালিক , তাই এক গ্রামে উনাকে চেনা কারুর পক্ষে অস্মভব নয়। ১-২ মিনিট হাঁটার পর রোজি জিজ্ঞাসা করলো , “আপনি চায়ের বাগানে কিসের কাজ করেন ?”
– “আজ্ঞে! আমি কেরানি। আমি কি আপনার নামটা জানতে পারি? যদি আপনি কিছু মনে না করেন !” কথাটা নিলয় কিছুটা ভয় কিছুটা কৌতূহল সুরেই জিজ্ঞেস করলো।
– “আপনি আমার নাম জেনে কি করবেন ? আপনি যে কাজটা করতে এসেছেন ওই দিকেই খেয়াল রাখুন, অপরিচিতদের সাথে আমি বেশি কথা বলতে ভালোবাসিনা।” রোজির কোথায় কিছুটা বিরক্ত ছিল।
নিলয় কিছুটা হকচকিয়ে গেল , মনে মনে ভাবলো, এই ভাবে কোন অপরিচিত মেয়েকে তার নাম জিজ্ঞেস করাটা উচিত হয়নি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো “আজ্ঞে ! আমি খুবই দুঃখিত। আমাকে ক্ষমা করবেন। ”
প্রায় ৫-৭ মিনিট হাঁটার পর ওরা মিস্টার বক্সীর বাড়িতে পোঁছালো। বাইরের ঘরে একটি চেয়ার দেখিয়ে নিলয় কে বসতে বললো আর সে প্রায় দৌড়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। প্রায় মিনিট পাঁচেক পারে বাড়ির একজন কাজের লোক একটা প্লেট চা, বিস্কুট আর এক গ্লাস জল নিয়ে এলো। নিলয়ের সামনে রাখা টেবিল এ রেখে বললো, “আপনি একটু চা – জল খেয়ে নিন, বাবু আসছেন “
মিনিট দশেক পর মিস্টার বক্সী এলো, পরনে একটা ঘন নীল রঙের সিল্কের নাইট গ্রাউন , মুখে সাহেবি কায়দায় ধরা পাইপ , এক হাতে একটা ইংরেজি খবরের দৈনিক। নিলয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “হ্যালো! ইয়ং ম্যান ! গুড মর্নিং ! হাউ আর ইউ টুডে ?” বলেই সামনে রাখা অন্য একটা চেয়ারে বসে পাইপ টানতে লাগল। নিলয় উঠে দাঁড়িয়ে, একটু থতমত খেয়েই বললো, “হ্যা ! আজ্ঞে গুড মর্নিং ! আমি ভালো আছি , স্যার আপনি কেমন আছেন ?, অনেক দিন আপনি বাগানে আসেননি !” মিস্টার বক্সী বললো, “আমি এখন বেশির ভাগ সময় কলকাতায় থাকি। পেপার গুলো দাও, আমাকে আবার দুপুরের ট্রেন এ কলকাতা বেরোতে হবে। “
মিস্টার বক্সী, কাগজ গুলো হাতে নিয়ে সই করতে লাগলো। কাগজ গুলো সই করার পর, ঘরের ভেতরের দিকে ডাক দিয়ে বললো, “রোজি, আমার চেক বুক টা নিয়ে এস”। ২ মিনিটের মধ্যে রোজি হাতে একটা চেক বুক নিয়ে মিস্টার বক্সীর হাতে দিয়ে মাথা নিচু করে চলে গেল। নিলয় একবার রোজির দিকে তাকাতে চেয়েছিল, কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। কিন্তু রোজির পায়ের নুপুরের শব্দ নিলয়ের শিরা-উপশিরায় রক্ত প্রবাহের তীব্রতা এনেছিল। মিস্টার বক্সী সই করা কাগজ গুলো এবং একটা ৩ লক্ষ টাকার চেক নিলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো , “তুমি এখন থেকে বাগানে যাবে তো?”
– “আজ্ঞে, হ্যা !” নিলয় মাথা তুমি উত্তর দিল।
– “ঠিক আছে, তুমি এখন এস, আমাকে রেডি হতে হবে কলকাতার জন্য”
নিলয় “okay” বলে কাগজগুলি এবং চেকটাকে সাবধানে ব্যাগ এ রেখে মিস্টার বক্সীর বাড়ি ছাড়লো। নিলয় বাগানে যাওয়ার জন্য কিছুদূর হেঁটে বাস স্ট্যান্ড এ বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। মিনিট পাঁচেক পর একটি বাস এলো। বসে উঠে নিলয় জানলার পাশে একটি সিট্ এ বসে রোজির মুখটা মনে করতে লাগলো।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - রক্ত ও কবিতা: ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প। পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে দুই শত্রু যোদ্ধার মধ্যে কবিতার লড়াই। বাংলা ছোট গল্পে ইতিহাস ও সাহিত্যের মেলবন্ধন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
প্রথম দর্শনে প্রেম কি সত্যি? এই প্রশ্নটি নিলয়ের কাছে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। ঘটনাটির দুটি ভিন্ন সংস্করণ রয়েছে। একটিতে, একজন ব্যক্তি প্রথম দর্শনেই অপরিচিত ব্যক্তির সাথে গভীর প্রেমে পড়ে এবং অন্যটিতে, দুটি লোকের হৃদয় একে ওপারের প্রতি স্নেহময় হওয়ার আগে এটি আরও সময় এবং মিথস্ক্রিয়া নেয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় সংস্করণে একজন যুবক, যে প্রথম নজরে কোনো নারীর শারীরিক আকর্ষণে আকর্ষিত হয়ে তার সাথে গভীর প্রেমে পড়ে। এই তত্ত্বের দ্বিতীয় সংস্করণটি পরামর্শ দেয় যে প্রথম দর্শনে প্রেম হল মিলন প্রক্রিয়ার একটি অভিযোজিত প্রতিক্রিয়া। যদিও একজন ব্যক্তির প্রতি শারীরিক আকর্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি অন্য ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব এবং বিশ্বাস যে আপনি তাদের পছন্দ করেন যা সংযোগটিকে এত শক্তিশালী করে তোলে। এটা কোন আশ্চর্যের বিষয় নয় যে আমরা প্রথম দর্শনেই এইভাবে অনুভব করি।
এর পর কেটে গেছে কয়েটা দিন, এই কয়েটা দিন নিলয়ের মাথায় শুধু একটা প্রশ্ন খুব মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিলো, “রোজি কি মিস্টার বক্সীর মেয়ে ?”
একদিন বাগানের অফিসে বসে নিলয় কাজ করছিলো, বেলা ১২ -টার দিকে রোজি বাগানের অফিস-এ এলো, নিলয় একমনে অফিসার খাতা-পত্র নিয়ে ব্যাস্ত ছিল।
– “আজ্ঞে ! শুনছেন ?” – একটা বিরল কিন্তু পরিচিত নারী কণ্ঠস্বর শুনে নিলয় খানিকটা অন্যমনস্ক হয়ে সামনের দিকে তাকালো।
একি দেখছে নিলয় , শেষ কয়েক দিনের একটা প্রশ্নের উত্তর এর সাথে নিজের হৃদয়ের প্রেমের অনুভূতি তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
নিলয় একটি চেয়ার টেনে রোজির কাছে নিয়ে এলো , ও ওকে বসতে ইশারা করলো। নিলয় এখন পুরোপুরি বাকরুদ্ধ। হৃদয়ের অনুভূতি এবং অজানা প্রশ্ন গুলি জট পাকিয়ে নিলয়ের কণ্ঠস্বর কে আবদ্ধ করে রেখেছে। কোনমতে নিলয় নিজেকে সামলে নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে। রোজির দিকে তাকিয়ে বলে , “আপনি এখানে ! স্যার পাঠিয়েছেন ?”
– “না! আমি নিজে থেকেই এসেছি , আমার বাড়িতে ভালো লাগছিলো না তাই চায়ের বাগান – ঘুরতে এলাম। সেদিন আমি আপনাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম, আজ আপনি আমাকে বাগান ঘুরিয়ে দেখাবেন। যদি আপনার হাতে সময় থাকে এবং কোনো অপ্পত্তি না থাকে।”
হাতে যে খুব সময় ছিল এটা বললে ভুল হবে , নিলয় বললো আমাকে ১০-১৫ মিনিট সময় দিন আমি একে হিসাব টা শেষ করে আপনাকে বাগান দেখতে নিয়ে যাবো। ততক্ষণ আপনি আমাদের অফিস ঘুরে দেখতে পারেন।” কথাটা বলেই নিলয় একটু তাড়ার সাথেই কাজ শুরু করলো।
রোজি নিলয়ের দিকে তাকিয়ে দেখছিলো; ঘন মাঝারি লম্বা মাথার চুল, পরনে একটা জামা ও ফুল প্যান্ট। পায়ে চামড়ার চটি জুতো। ২৩-২৪ বছরের একে যুবক খুব দায়িত্তর সাথে একে বাগানের হিসেবে নিকেশ এ ব্যস্ত। রোজির কাছে এই বয়সের এই ব্যস্ততা একটু অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো।
মিনিট সাতেক পর নিলয় হিসাবের খাতা টা বন্ধ করে রোজির দিকে তাকিয়ে বললো , ‘চলুন।’ চায়ের বাগানের ভেতরএ ওরা পাশাপাশি হাঁটছিল ও একে ওপরের সম্পর্কে জানছিল। সম্পর্কের দুরত্ত ক্রমশই কম হচ্ছিলো। একটা সময় রোজি নিলয়-এর দিকে উদ্দেশ্য করে বললো, “আপনি আমাকে, আপনি বলে ডাকবেন না, তুমি ডাকটাই ভালো লাগবে!” নিলয় উত্তরে বললো, “বলতে পারি শুধু একটা শর্তে, যদি তুমি আমাকেও ‘তুমি’ বলে ডাকো” রোজি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তাদের এই কথোপকথন-এ নিলয় জানতে পারে যে, রোজির মা মিস্টার বক্সীর বাড়িতে কাজ করে , সেদিন যে নিলয় কে চা – জল দিয়েছিলো, ওই হল রোজির মা। আর সেই সূত্রেই রোজি ওর মায়ের সাথে মিস্টার বক্সী দের বাড়িতে থাকে। ওদের নিজের বাড়ি আসাম এ। নিলয়ের মতো রোজি ও তার বাবা ক শৈশবেই হারিয়েছে। কাকু জেঠুরা সব সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে মা ও মেয়ে কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। তখন রোজির বয়স মাত্র ২ বছর। মামা দের সাথে সেই ভাবে কোনো যোগাযোগ নেই। বাবা মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল হয়তো সেই কারণে। নিলয় নিজেও এই একই পরিস্থিতির সাথে নিজেকে জুড়তে পারছিলো। ভালবাসার রহস্য হল সহানুভূতি। প্রেমময় উদারতার ভিত্তি হল স্নেহ, সহানুভূতি, সহনশীলতা, খোলামেলাতা, গ্রহণযোগ্যতা এবং অন্য মানুষের জন্য উদ্বেগ। এর অর্থ হল বিচার, সমালোচনা বা নিন্দা না করে নিজের হৃদয়ের অন্তত একটি অংশ অন্য মানুষের কাছে খুলে দেওয়া। যা অন্য ব্যক্তির অনুভূতি এবং চাহিদা কে প্রশংসা এবং স্বীকার করে।
এই ভাবে কয়েকটা মাস কেটে গেল, দুজনের অনুভূতি ও একে ওপরের প্রতি আকর্ষণ অভিযোজিত হয়ে পরিণতির দিকে এগোচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন ৭ দিনের ম্যালেরিয়া তে নিলয়ের মা মারা যায়। নিলয় স্ববাবটাই খুব একা হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে নিলয়ের আপন বলতে রোজি ছাড়া আর কেউ ছিল না। একদিন স্টেশনের করিম চাচার চায়ের দোকানে নিলয় রোজিকে বলেই ফেলে, “আমার জীবনের শূন্যতা কি তুমি পূরণ করতে পারবে ? তুমি কি আমার হৃদয়ের অস্তিরতা কে শান্ত করতে পারবে ?” নিলয়ের মা গত হায়ার পর নিলয়ের প্রতি রোজির স্নেহ ও সহানুভূতি অনেকটা বেশি হয়ে উঠেছিল। এটাই স্বাবাবিক মানবিক স্বভাব। নিলয়ের কথা শুনে রোজি কিছুক্ষণ কাপ করে থাকলো ; নিলয় তখন-ও রোজির হাত ধরে বসে আছে। রোজির কয়েক ফোটা চোখের জল নিলয়ের হাতের ওপর পারলো।
প্রাগ সন্ধ্যের স্টেশন তা তখন থম-থমে, একটা ছোট ধুলোর ঝড় রেল লাইন এ পড়ে থাকা ধুলো-কাগজ-কয়েকটা শুকনো পাতা নিয়ে উড়ে দূরে চলে গেল। এদিকে চায়ের স্টলে বসে থাকা সদ্য যৌবনে পা দেওয়া এক ২৪ বছরের যুবক তার উত্তরের অপেক্ষায়। স্টলের বাসনের শব্দে মুহূর্তের নীরবতা ভঙ্গ হল। রোজি চোখের জল মুছে মুখে একটা নিশ্চিন্তের হাসি হেঁসে বললো, “আমি তো তোমারই ছিলাম, আছি এবং সারা জীবন থাকবো। “
করিম চাচা পাস দিয়ে যাচ্ছিলো, রোজির কথাটা সে শুনেছিল, সে একটু হেঁসে বললো , ” বাবু-দিদিমনি তোমাদের বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্ন কর কিন্তু। ” রোজি কথাটা শুনে লজ্জায় দৌড়ে ষ্টল থেকে বেরিয়ে গেল। গোধূলির লাল আকাশটা আজ প্রেমের রঙে রঙ্গিন। নিলয়ের জীবন থেকে ধীরে ধীরে শূন্যতার কালো মেঘ দূরে সরে যাচ্ছে।
নিঃশর্ত প্রেমের ধারণাটি একটি খুব গভীর এবং মৌলিক প্রয়োজন থেকে উদ্ভূত হয় যে, সমস্ত মানুষকে নিঃশর্তভাবে ভালবাসতে হবে। মানুষ যখন প্রেমে পড়েন তখন সে উপর ব্যক্তির সাথে পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং সহানুভূতির একটি বন্ধন ভাগ করে নেয় এবং সেই বোঝাপড়া এবং সহানুভূতি অপরিবর্তিত থাকে যেকোনো পরিস্থিতিতে।
সেদিন নিলয় অফিস থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়েছিল, রোজির সাথে গত ২-৩ দিন দেখা হয়নি, এটা খুবই স্বাভাবিক ছিল। অফিস থেকে বেরিয়ে বাস-স্ট্যান্ড এ বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল; এমন সময় সে দেখলো রোজি হেঁটে ওর কাছেই আসছিল। সবে সন্ধ্যে হয়েছে। তাই দূরে থাকলেও চিনতে অসুবিধা হচ্ছিলনা। নিলয় জিজ্ঞেস করলো “তুমি এখানে এই সময়?” রোজি উত্তরে বললো, “পাশের গ্রামে ওর এক স্কুল ফ্রেন্ড এর বিয়ে ওখানে যাওয়ার জন্যই এসেছে।” হটাৎ করে বৃষ্টি শুরু হল। এই অঞ্চলে হটাৎ বৃষ্টি কোনো নতুন বিষয় ছিল না। নিলয় ছাতাটা খুলে; রোজি ও সে ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে থাকলো। মিনিট খানেক পর নিলয় বললো, “আজ মনে হয় না বৃষ্টি কমবে, তুমি বরং বাড়ি ফিরে যাও।” রোজি কথাটা শুনে বললো, “না! তার চেয়ে বরং তোমার বাড়িতে যাই, একটু পরে বৃষ্টি কমলে দুজনে একসাথে বিয়ে বাড়িতে যাবো।” এতক্ষনে বাস-ও চলে এসেছে দুজনে বসে উঠে নিলয়ের বাড়ির পথে রহনা দিল।
মানুষ কি প্রেমে আসক্ত হতে পারে? হ্যাঁ এটা সত্য. সেই মুহুর্ত্তে তারাও আসক্তির কাছে নিজেরাই অজান্তেই পরাজিত হয়েগিয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে তারা নিজেদের কাছে একজন প্রেমিক – প্রেমিকার চেয়ে বেশি কিছু হয়ে উঠেছে। প্রেমের আসক্তি প্রাথমিক প্রেমের উচ্ছ্বসিত পর্যায়ের জন্য একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষাও আনতে পারে, কিন্তু তারা বাসে একটা সিটে পাশাপাশি বসে হাতে-হাত রেখে ওই মুহূর্তে সেটি কল্পনাও করতে পারছিলনা।
ঘর টা খুলে নিলয় রোজি কে ভেতরে আসতে বললো। ছোট বাড়ি ভেতরে একটি খাটের ওপর রোজিকে বসতে বললো। নিলয় মোমবাতিটা জ্বালিয়ে পশে থাকা টেবিল এর ওপরে রাখলো। আর একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে নিলয় রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। রোজি এই প্রথমবার নিলয়ের বাড়িতে , স্ববাবটাই সে এদিক সেদিক তাকিয়ে ঘরটা দেখতে লাগলো। অল্প কিছুক্ষনের মধ্যে নিলয় দুটো চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে এল। রোজির দিকে একটা চায়ের কাপ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “২-৩ দিন তোমার কোনো খাবার নেই যে! আমায় ছেড়ে থাকতে পারলে?” বাইরে তখনও বৃষ্টি চলছে। রোজি নিলয়ের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে একটা লজ্জা জড়ানো প্রেমের দৃষ্টিতে নিলয়ের দিকে তাকালো। দুজনের চা খাওয়া শেষ হওয়ার পর চা কাপ দুটি টেবিল এর ওপর রেখে রোজি জানলার কাছে বাইরের বৃষ্টি দেখতে লাগল; নিলয়ও রোজির পশে দাঁড়িয়ে থাকল। বাইরের বৃষ্টির সাথে সাথে দুজনের হৃদস্পন্দন ও শরীরে রক্ত প্রবাহের গতি ক্রমবর্ধমান ছিল। ওই সময় পশে একটা কালো বেড়াল রোজির পায়ের ওপর দিয়ে হটাৎ করে চলে গেল, রোজি ভয় জড়ানো স্বরে চিৎকার করে নিলয়কে জড়িয়ে ধরলো। এই চারিত্রিক লক্ষণ মস্তিষ্কে প্রেম এবং কামনাকে সক্রিয় করে যার ফলে নিজেকে হারিয়ে ফেলার ইচ্ছা, শারীরিক চাহিদার তীব্র অনুভূতি হয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা এই শক্তিশালী আবেগগুলির জন্য প্রাথমিক ভাবে শারীরিক আগ্রহ দেখায় যা উভয় ক্ষেত্রে সংযুক্তি, নিরাপত্তা, স্বত্ব এবং গ্রহণযোগ্যতা -কে প্রমান করে।
সে রাতটা রোজি নিলয়ের কাছেই থেকে গিয়েছিল, পারে দিন সকালে রোজি যখন ঘুম থেকে ওঠে তখন তার মনে এক লজ্জা-ভয়-আনন্দের এক মিশ্র অনুভূতি ছিল। তবে সর্বপরি সে নিজেকে পরিপূর্ণ অনুভব করছিল , সবকিছু মিলিয়ে তার শরীর ও মন খুব শান্ত ও শীতল ছিল। বাইরে এখন বৃষ্টি বন্ধ, সূর্য উঠেছে আশে পাশের গাছ গুলি নতুন হয়ে হাঁসছে, বাইরের পৃথিবী যেন এক নতুন জীবনের আগমনে নিজেকে সাজিয়ে তুলছে। নিলয় রোজিকে একটা রিক্সায় তুলে অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।
তারপর ১০-১২ দিন কেটে গেছে। এর মধ্যে নিলয়ের সাথে রোজির ২-৩ বারের বসে দেখা হয়নি। একদিন চায়ের বাগানে কাজ করতো এক মালি এসে নিলয় কে একটা চিঠি দিয়ে বললো, “বাবু, রোজি দিদিমনি, আপনার জন্য পাঠিয়েছেন।” নিলয় চিঠিটা খুলে একবার পড়ল, তার পর অগোছালো ভাবে কিছু একটা ভেবে চিঠিটা বুক পকেটে রেখে অফিসের কাজ করতে শুরু করল। ২ দিন রবিবার ছিল , পূর্ব পরিকল্পনা মত বেলা ১২ তার সময় নিলয় স্টেশন এ করিম চাচার দোকানে রোজির জন্য অপেক্ষা করছিল। দুপুর ১ টায় আপ আসাম এক্সপ্রেস টা ছাড়বে তারই তোড়জোড় চলছে স্টেশন এ । ট্রেন টা স্টেশন এ দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকের ব্যস্ততা যেন নিলয়ের অপেক্ষা কে ছাড়িয়ে গেছে। ট্রেন টা ছাড়তে আর কয়েক মিনিট বাকি আছে , এমন সময় এক চিৎকার এর শব্দের দিকে নিলয়ের চোখ গেল। এক মধ্য বয়স্ক দম্পত্তি রোজি-র দুহাত ধরে ট্রেন এর দিকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, যাদের সাথে রোজির মা ও ২ জন ৩০-৩৫ বছরের যুবক ছিল। নিলয় কিছু বুঝে ওঠার আগে রোজির মা ওই দুজনের দিকে উদ্দেশ্যে করে বলে, “এই সেই ছেলেটা, যার জন্য আজ আমাকে এই দিন দেখতে হচ্ছে”। যুবক দুজন নিমেষের মধ্যে নিলয় কে ধরে মারতে শুরু করলো। স্টেশন এর মধ্যে তখন একটা নাটকীয় পরিস্থিতি। রোজি , কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে বলছে, “ওকে মেরো না! ওকে মেরো না!”। করিম চাচা ও স্টেশন এর ১-২ জন ছুতে এসে নিলয় কে ওদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। রোজিকে ততক্ষনে ট্রেন এ তুলে দিয়েছে ওরা, ট্রেন ও প্রায় ছাড়ার মুহুর্ত্তে। জানলা দিয়ে শুধু রোজির হাতটা দেখা যাচ্ছিল। ট্রেন স্টেশন থেকে ছেড়ে যাচ্ছে , করিম চাচা নিলয় ক মাটি থেকে তুলে একটা বেঞ্চের ওপর বসিয়ে জল দিচ্ছে। ট্রেনটা যখন স্টেশন ছেড়ে যাবে তখন ই রোজি শেষ চেষ্টায় একবার জানলার দিকে এসে চিৎকার করে নিলয়ের দিকে হাত নেড়ে বললো, “আমি তোমার-ই থাকবো— নিল—য়— ! আমি এক–দিন ঠিক ফিরে— আসবো—, ঠিক এখানেই— তোমার কাছে— ফিরে আসব— !” ট্রেন টা স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। নিলয় ঠায় ওই বেঞ্চে নির্বাক হয়ে বসে থাকল।
আজ ৪৫ বছরের নিলয় প্রতিদিনের মত স্টেশন এ ওই একই বেঞ্চে বসে আছে। শেষ ট্রেন টা এখন ও আসেনি। আজ চারিদিকে ঘন কুয়াশা ঠিক মত কিছু দেখা যাচ্ছে না শীত ও পড়েছে। করিম চাচা একটা চায়ের গ্লাস হাতে নিয়ে নিলয়ের দিকে বাড়িয়ে বললো, “বাবু আমি আমার ৭৫ বছর বয়সে অনেক মানুষ দেখলাম, কিন্তু তোমার মত দেখিনি।” নিলয় চায়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে; চায়ে চুমুক দিল। পাশে একটা ফেরিয়ালার রেডিও তে গান বাজছিল, “লাগ্ যা গলে, কি ফির এ হাসিন রাত হো না হো। ” মিনিট ১৫ পরে ট্রেনটি স্টেশন এ এলো। শনিবারের রাতের ট্রেন এ ভিড় একটু বেশি থাকে রোজকারের তুলনায়। যাত্রীরা এক এক করে স্টেশন ছেড়ে বেরিয়ে যায়। নিলয় বেঞ্চে বসে থাকে, করিম চাচা দোকানের দিকে চলে যায়, এই সময়টাই কিছু যাত্রী চা খেতে আসে। ট্রেনটির শেষ থেকে ২ তো বগি আগের একটা বগি থেকে একটা ২০-২১ বছরের মেয়ে ট্রেন থেকে নামলো, হাতে তার একটা ব্যাগ। পরনে তার সাদা রঙের এম্ব্রয়েডারি করা সালোয়ার সুট, তার ওপর একটা লাল রঙের সোয়েটার, হালকা গোলাপি রঙের ওড়নাটা মাথায় ও গায়ে ঘোমটা করে জড়ানো। সে ট্রেন থেকে নেমে একটু ইতস্তত ভাবে করিম চাচার চায়ের দোকানে এল , এসে করিম চাচার দিকে উদ্দেশ্যে বললো , “আজ্ঞে! শুনছেন ? এখানে করিম চাচা বলে আপনি কাউকে চেনেন ?” শেষ খরিদ্দারের কাছ থেকে চায়ের দামটা নিয়ে হাতে খালি চায়ের গ্লাস টা তুলে করিম চাচা ফিরে তাকালো। ফিরে তাকাতেই করিম চাচার হাত থেকে গ্লাস টা পরে গেল। খুব বিস্ময় ও চিৎকারের সাথে বলে উঠলো, “রোজি দিদিমনি তুমি ফিরে এসেছো , বা-বু দিদি–মনি এসে—ছে— , বা—বু দিদি-মনি এসে—–ছে—” বলে নিলয়ের দিকে দৌড়ে গেল। মেয়েটি কিছু একটা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু সে করিম চাচার বর্তমান আবেগপূর্ণ অবস্থা দেখে চুপ করে ওখানে দাঁড়িয়ে থাকল।
নিলয় করিম চাচার ডাকে প্রায় পাগলের মত ছুটতে ছুটতে দোকানটার দিকে হাঁটে লাগল। পায়ে চপ্পল টা পড়তে সে ভুলে গেছে , গায়ের শালটা অর্ধেক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। করিম চাচার দোকানে এখন ৩ জন একে ওপরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ২০ বছরের পুরোনো সব প্রতীক্ষার আবাসন আজ , স্টেশন এ দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনটি সামনের কুয়াশার বুক চিরে কারসেড-এর দিকে এগিয়ে চলেছে, যাত্রা পথের ক্লান্তির অবসানের গন্তব্স্থল হল এই কারসেড।
এদিকে নিলয় ২০ বছর আগেকার রোজিকে সামনে দেখছে একই রূপ-রং, ৩ জনের চোখে জল। ৫-৭ মিনিট এইভাবে কেটে গেল। নিলয় এখন হাঁটুতে ভর করে মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটি কোনো মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করলো , “আপনার নাম কি নিলয়?” নিলয় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। মেয়েটি আবার বলতে শুরু করলো , “আমার নাম সেঁজুতি, রোজি আমার আমার মা।”
– “তোমার মা কোথায় ?” বলেই নিলয় এদিক ওদিক দেখতে লাগল; রোজি কথাটা শুনে জলভরা চোখে কাঁপা কাঁপা হাতে ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে নিলয়ের হাতে দিল; তাতে লেখা,
“তুমি যখন এই চিঠিটি পড়বে, তখন আমি আর অদূরের আকাশে চির নিদ্রায় নিদ্রিত। দূর থেকে আকাশের তারা হয়ে তোমাদের প্রতি আমার প্রেম ও স্নেহভরা ভালোবাসা দিয়ে যাবো। সেদিন আমি যখন আমার শরীরে আমাদের সন্তানের অনুভূতি প্রথম অনুভূতি পাই, তখন আমি একটা ভয়-ও-আনন্দের অনুভূতি নিয়ে আমার মাকে আমাদের ব্যাপারে সবকিছু জানাই, মা তখন কিছু বলে নি। আমি পরের দিন তোমাদের বাগানের মালির হাতে তোমাকে একটা চিঠি পাঠাই। আশা করি তুমি সেদিন চিঠিটা পেয়েছিলে। রবিবারে যেদিন আমাদের দেখা করার কথা ছিল, তার আগের দিন রাতে আমার বড় মামা-মামী ও মামাদের বাড়ির পাস থেকে ২ জন আসে আমাকে আসামে নিয়ে যাওয়ার জন্য। মা-ই মিস্টার বক্সী ক দিয়ে আসামে টেলিগ্রাম করিয়েছিল। আমাকে ওরা প্রথমে আমাদের সন্তান নষ্ট খুব জোরাজুরি করে। কিন্তু আমি তা করিনি। ২-৩ দিনের মধ্যে একজন ৪৫ বছরের বিপত্নীক এর সাথে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয় ।
সেঁজুতি তখন আমার গর্ভে। মনে একটা পাপ বোধ ও মামাদের প্রতি ঘৃণা নিয়ে আমার আরেকটা জীবন শুরু হয়। কিছু মাসের পর সেঁজুতি এই পৃথিবীতে আসে। তারপর শরীর ও মনের টানাপড়েনে কেটে গেছে অনেক বছর, আজ জীবনের অন্তিম সময়ে এসে আমি আমার মেয়েকে তার প্রকৃত বাবার কাছে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছি। সেঁজুতি কে তুমি একজন বাবার ভালোবাসা দিও। আমায় ক্ষমা কর।”
নিলয় এতক্ষন একটা চেয়ারে বসে ছিল, সে চেয়ার থেকে উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না। সেঁজুতি হাতে ভর দিয়ে নিলয় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। সেঁজুতি ব্যাগ থেকে একটা মাটির হাঁড়ি বের করে বললো, “বাবা ! মায়ের শেষ ইচ্ছা তুমি তার এই অস্তিভস্ম নিজের হাতে গঙ্গায় বিসর্জন কর।” নিলয় ওটা হাতে নিয়ে পাশে থাকা টেবিল এর ওপর রেখে সেঁজুতি কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। দুজনে নিজেদের কে কোনো ভাবে সামলে বাইরের একটা বেঞ্চে নিলয় আর সেঁজুতি বসে থাকল। সেঁজুতি নিলয়ের কাঁধে মাথা রেখে এক ব্যথিত হৃদয়ে দূরের গ্রামের দিকে তাকিয়ে আছে। নিলয়ের কোলে রোজির অস্তিভস্ম-এর মাটির হাড়িটা তাতে একটা লাল কাপড় খুব যত্নে বাঁধা আছে। পাশের গোলাপের গাছটা আজ যেন একটু বেশিই নিলয়ের কোলের দিকে নুইয়ে পড়েছে। গাছটা থেকে একটা শুকনো গোলাপ নিলয়ের পাশে পড়ল। আজ সব অপেক্ষার অবসান। শরীর আজ বয়স ও অপেক্ষার ভারে ক্লান্ত। হৃদয়টা আজ থমথম-এ। কিছুক্ষণ এই ভাবে বসে থাকার পর নিলয় – সেঁজুতি আর করিম চাচা স্টেশন ছাড়লো। নিলয়ের এখন এক নতুন পরিচয়ের সাথে তার মেয়ের হাত ধরে বাড়ির পথে হাঁটছে করিম চাচা পেছনে হাঁটছিল।
ভালবাসার গোপন রহস্য হল; ভাল এবং মন্দের লড়াইয়ে না জড়িয়ে স্নেহপূর্ণ হৃদয়ে ভালোবাসার ক্ষমতা। এটা করা খুব সহজ নয়। এর জন্য প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং শৃঙ্খলা লাগে। নিজে যত বেশি এই ধরনের উদারতার অনুশীলন করবেন তত বেশি করে উপলব্ধি করতে পারবেন যে, নিজে যেটা উজাড় করে দিচ্ছেন, সেই দয়া ফিরে আসার কোনো প্রত্যাশাই যেন আপনি না করেন। দয়া মানে নিঃশর্তভাবে গ্রহণ করা এবং ভালবাসা।