রচনা - সুরজিৎ রায় | গল্প পাঠে - পার্থ সারথি ঘোষ | আবহ সংগীত - বুবাই সাহা (মিহান'স প্রোডাকশন হাউস)
ছাদের নিচে নক্ষত্রের আলো
বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
শ্রাদ্ধের আনুষ্ঠানিকতা শেষ। অতিথিরা একে একে বিদায় নিয়েছে। বাড়ির প্রতিটি কোণে যেন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে। বসতবাড়ির ছাদে তিনটি প্রজন্ম বসে আছে—রঞ্জিত বসু, তার পুত্র রাজীব, আর পাঁচ বছরের ছোট্ট রাজেন্দ্র। রাতের আকাশ যেন এক বিশাল ক্যানভাস, যেখানে অসংখ্য তারা মিটমিট করছে।
রাজেন্দ্র তার ছোট্ট আঙ্গুল তুলে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলল, “দাদু, ওই তারা কি আমার মায়ের বাড়ি?”
রঞ্জিত বসু গভীর নিঃশ্বাস ফেলে শান্ত গলায় উত্তর দিল, “হ্যাঁ, তোমার মা এখন আকাশের তারা হয়ে গেছে। তোমার মায়ের সঙ্গে তোমার ঠাকুমাও আছে। তাঁরা দু’জনই ওপর থেকে আমাদের দেখছে।”
রাজেন্দ্র বিস্মিত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “তাহলে মা কি আমাকে দেখছে, দাদু?”
রঞ্জিত একটু হাসল, “হ্যাঁ, দেখছে। তোমার মা চাইছে তুমি ভালো ছেলে হও, রাজু।”
রাজেন্দ্রের ছোট্ট মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। তার চোখে জল জমে উঠছে, কিন্তু সে কাঁদছে না। শুধু এক অদ্ভুত বিস্ময়ে তাকিয়ে আকাশের তারাগুলোর দিকে।
পাশেই চুপচাপ বসে আছে রাজীব। তার মুখে কোনো কথা নেই। তার চোখের দৃষ্টি মেঘলা, যেন কোনো এক অজানা দুনিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মন বারবার স্ত্রীর শেষ মুহূর্তের স্মৃতিতে ফিরে যাচ্ছে। হাসপাতালের শীতল পরিবেশ, স্ত্রীর কম্পমান হাত, আর তার শেষ কথা— “রাজীব, রাজুকে ভালো করে মানুষ করো।”
রঞ্জিত ছেলের দিকে তাকিয়ে বুঝল, এই নিস্তব্ধতা শুধুমাত্র বাড়ির নয়, বরং রাজীবের মনের গভীরের। সে বুঝতে পারছে ছেলের ভেতরে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে জানে না কীভাবে সেই ঝড় থামানো যায়।
রঞ্জিত ধীরে ধীরে বলল, “রাজীব, জানি তোমার মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। তুমি তোমার দায়িত্বের কথা ভুলবে না।”
রাজীব প্রথমে কোনো কথা বলল না। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে বলল, “বাবা, দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু রাজু যখন মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করে, তখন কী বলব? তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তো আরও কঠিন।”
রঞ্জিত কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল, “রাজুকে সত্যি বলতে শেখাও। তার মায়ের স্মৃতি যতটা সম্ভব ধরে রাখতে সাহায্য করো। স্মৃতিগুলোই তো আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন।”
রাজীব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “স্মৃতি তো কেবল কষ্ট দেয়, বাবা।”
রঞ্জিত মাথা নেড়ে বলল, “না, স্মৃতি কষ্ট দেয় না, বরং শক্তি দেয়। আজকের রাতের এই আকাশের তারাগুলো দেখ। এরা আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমাদের প্রিয়জনরা কোথাও না কোথাও আছে। তারা চিরকাল আমাদের সাথে থাকবে। এটাই জীবন।”
রাজেন্দ্র হঠাৎ বলে উঠল, “দাদু, আমি মাকে দেখতে চাই। আমি কেমন করে দেখতে পারব?”
রাজীব রাজেন্দ্রকে নিজের কোলে টেনে নিল। নরম গলায় বলল, “তুমি যখন খুব ভালো কিছু করবে, তখন মা তোমার মনে আসবে। আর যখন খুব মিস করবে, তখন চোখ বন্ধ করে মায়ের কথা ভাববে। দেখবে, মা সবসময় তোমার সাথে আছে।”
রাজেন্দ্র মাথা নেড়ে, “তাহলে এখন থেকে আমি সবসময় ভালো কাজ করব। মা যেন আমাকে দেখে খুশি হয়।”
রঞ্জিতের মুখে এক মুহূর্তের জন্য হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, “এই যে, এটাই তো আমাদের জীবনের আসল কথা। ভালো কাজের মধ্যে দিয়েই আমরা আমাদের প্রিয়জনদের জীবিত রাখতে পারি।”
রাত গভীর হয়। আকাশে তারাগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ছাদের নিস্তব্ধতা যেন তিন প্রজন্মের এক অদৃশ্য বন্ধনে পরিণত হয়। একদিকে রাজেন্দ্র তার মায়ের উপস্থিতি খুঁজছে, অন্যদিকে রাজীব শিখছে জীবনের নতুন অর্থ, আর রঞ্জিত শিখিয়ে চলেছেন শক্তি আর আশার পাঠ।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - প্রাচীরের ওপারে প্রেম: "প্রাচীরের ওপারে প্রেম" একটি হৃদয়স্পর্শী ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য গল্প। বাংলা ছোট গল্পের এই প্রেমের আখ্যান বার্লিন প্রাচীরের পটভূমিতে সাহস, ত্যাগ ও ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
হারানোর স্মৃতি
বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
রাত আরও গভীর হয়েছে। বাড়ির ছাদে শীতল বাতাস বইছে। রঞ্জিত ধীরে ধীরে রাজীবের কাঁধে হাত রেখে বলল, “তোমার মায়ের মৃত্যুর পর আমিও একা হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সময় ভাবতাম, জীবন কীভাবে চলবে? কিন্তু এক সময় বুঝলাম, আমাদের এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য চিরকাল থাকে না। তবে যারা চলে যায়, তারা আমাদের স্মৃতির মধ্যে বেঁচে থাকে।”
রাজীব ফ্যালফ্যাল করে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু লুকাতে চাইলেও পারল না। ছোট্ট রাজেন্দ্র এই সবকিছু বুঝতে না পেরে তার বাবার গালে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “বাবা কাঁদছ কেন? আমি কি খারাপ কিছু বললাম?”
রাজীব তার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল। গলা ভারী হয়ে আসছে। কোনো উত্তর দিতে পারল না।
রঞ্জিত, যিনি জীবনের বহু কঠিন পরিস্থিতি দেখে এসেছে, ধীরে ধীরে বলতে লাগল, “জীবন মানে চলার পথ। কখনও একা, কখনও সবাই মিলে। কিন্তু থামা চলবে না। তোমার ছেলে তোমার ভবিষ্যৎ। তার জন্য তুমি শক্ত হও।”
রাজীব গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “বাবা, তুমি সবসময় তো শক্ত ছিলে। কিন্তু আমি পারছি না। আমার মনে হয়, এই দুঃখ কখনও কাটবে না।”
রঞ্জিত মৃদু হাসল, “আমিও শক্ত ছিলাম না, রাজীব। আমিও ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু আমি একদিন অনুভব করলাম, ভেঙে পড়লে আমাদের প্রিয়জনদের স্মৃতির প্রতি অবিচার করি। তোমার স্ত্রীর স্মৃতিকে তুমি এমনভাবে ধরে রাখো, যা তোমাকে শক্তি দেবে।”
রাজীব কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, “কিন্তু বাবা, সেই শক্তি কোথায় পাব?”
রঞ্জিত আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার স্ত্রীর কাছ থেকে। যখন তুমি খুব অসহায় বোধ করবে, আকাশের দিকে তাকিয়ে তোমার স্ত্রীর কথা ভাববে। দেখবে, তারার মধ্যেই তোমার উত্তর লুকিয়ে আছে।”
রাজেন্দ্র বিস্মিত হয়ে বলল, “তারার মধ্যে উত্তর? কীভাবে?”
রঞ্জিত ছোট্ট রাজেন্দ্রকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, “তোমার মায়ের মতো মানুষরা কখনও পুরোপুরি হারিয়ে যায় না। তারা তোমার আশেপাশেই থাকে, শুধু দেখতে হলে মন দিয়ে দেখতে হয়।”
রাজেন্দ্র তার দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি মাকে এখন দেখতে পাব?”
রঞ্জিত হাসল, “একদিন তুমি যখন বড় হবে, তখন বুঝতে পারবে, মা কখনও তোমাকে ছেড়ে যায়নি। তুমি যখন ভালো কিছু করবে, তখন তোমার মায়ের আশীর্বাদ তোমার মাথায় থাকবে। আর তখনই তুমি তাকে দেখতে পাবে।”
রাজীব, এতক্ষণ চুপ করে সব শুনছিল, ধীরে ধীরে বলল, “বাবা, তুমি ঠিক বলেছ। আমার নিজের জন্য নয়, রাজুর জন্য হলেও আমাকে শক্ত হতে হবে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হয়, রাজুকে মায়ের ভালোবাসা আমি কীভাবে দেব?”
রঞ্জিত দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “ওর মায়ের ভালোবাসা তুমি দিতে পারবে না। কিন্তু তুমি তোমার নিজের ভালোবাসা দিয়ে রাজুকে এমনভাবে বড় করো, যাতে সে তার মায়ের মতো একজন ভালো মানুষ হয়। এটাই তার প্রতি ওর মায়ের শেষ ইচ্ছা।”
রাজীব এবার চোখ মুছে বলল, “ঠিক আছে, বাবা। আমি চেষ্টা করব। রাজুকে আমি কখনও হারাতে দেব না।”
রঞ্জিত মৃদু হেসে বলল, “তুমি যখন রাজুকে বড় করতে দেখবে, তখন নিজের মনের ভেতরও নতুন শক্তি পাবে। এই শিশুটি তোমার জীবনের আলোর উৎস।”
রাজেন্দ্র বাবার কোলের দিকে ঝুঁকে বলল, “বাবা, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি কাঁদো না। আমি ভালো ছেলে হব, যাতে মা আমাকে আকাশ থেকে দেখে খুশি হয়।”
রাজীব ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বলল, “তোমাকে ভালো ছেলে হতে হবে, রাজু। তুমিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভরসা।”
রঞ্জিত ছাদের এক কোণে বসে রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। রাত্রির নিস্তব্ধতা যেন নতুন আশা নিয়ে আসে। তারাগুলো জ্বলজ্বল করে উঠে যেন বলতে চায়, “জীবন থেমে থাকে না। স্মৃতিই জীবনের পথচলার প্রেরণা।”
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - মুক্তির দ্বার: "মুক্তির দ্বার" একটি হৃদয়স্পর্শী কল্পবিজ্ঞান গল্প। বন্ধুত্ব, অপরাধবোধ ও মুক্তির সন্ধানে ভ্যালেরিয়ানের যাত্রা নিয়ে এই বাংলা ছোট গল্প পাঠকদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যাবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একাকীত্বের পথ চলা
বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
ছাদের নরম আলোয় চুপচাপ বসে থাকা রাজীবের মনটা হঠাৎ করে কেমন ভারী হয়ে উঠল। স্ত্রীর কথা মনে পড়তে লাগল। অঞ্জনা। তার চঞ্চল হাসি, তার ছোট ছোট কথাগুলো, রাগ করলে ভ্রু কুঁচকানো—সব যেন মনে হচ্ছে কালকের ঘটনা। অথচ দশ দিন হয়ে গেল!
রাজেন্দ্র দাদুর কোলে বসে একমনে তারার দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ তার সরল প্রশ্নে রাজীব যেন চমকে উঠল, “বাবা, মা তো তারা হয়েছে। তারা কি আমাদের দেখতে পায়?”
রাজীব উত্তর দিতে পারল না। রঞ্জিত ধীরে ধীরে বলল, “তারা দেখতে পায় কি না জানি না। তবে আমরা যদি ভালো থাকি, তারা খুশি হয়।”
এই কথাগুলো শুনে রাজীবের চোখের কোণে জল চিকচিক করতে লাগল। সে মাথা ঘুরিয়ে নীরবে চোখের জল মুছল।
রঞ্জিত হালকা স্বরে বলল, “জীবন থেমে থাকে না, রাজীব। আমি জানি, তোমার মায়ের মৃত্যুর পর আমারও একইরকম মনে হয়েছিল। একা থাকার ভয়, অনিশ্চয়তা, সবকিছু একসাথে। কিন্তু জীবনের এই পথে আমাদের চলতেই হয়।”
রাজীব ফিসফিসিয়ে বলল, “বাবা, আমি ভাবতাম অঞ্জনা সবসময় আমার পাশে থাকবে। আমাদের জীবন অনেক সুন্দর ছিল। কিন্তু কেন এমন হলো?”
রঞ্জিত একটু সময় নিয়ে উত্তর দিল, “জীবন আমাদের কাছে অনেক কিছু নিয়ে আসে, আবার কেড়ে নিয়ে যায়। আমরা সেটা আটকাতে পারি না। তোমার মায়ের মৃত্যুর পর আমি যখন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিলাম, তখন একটাই কথা নিজেকে বলেছিলাম—যদি আমি শক্ত না হই, তাহলে তুমি কীভাবে শক্ত হবে?”
রাজেন্দ্র কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “দাদু, তখন তুমি কী করেছিলে?”
রঞ্জিত হেসে বলল, “আমি তোমার বাবাকে মানুষ করেছি। তোমার বাবা তখন ছোট ছিল। আমি জানতাম, আমাকে তার জন্যই বাঁচতে হবে। তাই আমি সব দুঃখ দূরে সরিয়ে তাকে বড় করেছি।”
রাজীব নিচু গলায় বলল, “বাবা, তুমি কীভাবে এত কিছু সামলেছিলে? আমি তো মনে হয় পারব না। রাজেন্দ্রের দিকে তাকালে বারবার অঞ্জনার কথা মনে পড়ে।”
রঞ্জিত কাঁধে হাত রেখে বলল, “আমার কাছে একটা কথাই ছিল—তোমার মা তোমাকে রেখে গেছে আমার দায়িত্বে। আজ তোমার দায়িত্ব রাজেন্দ্র। তুমি যদি ভেঙে পড়ো, তাহলে সে কার কাছে যাবে?”
রাজেন্দ্র সরল গলায় বলল, “বাবা, তুমি ভেঙে পড়ো না। আমি বড় হয়ে মাকে খুঁজে আনব।”
রাজীবের চোখ ভিজে উঠল। সে রাজেন্দ্রকে জড়িয়ে ধরে বলল, “না, বাবা। তোমার মাকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। কিন্তু আমরা তার কথা সবসময় মনে রাখব, ভালোবাসব। তুমি আমার কাছে একমাত্র উপহার, যা মা রেখে গেছে।”
রঞ্জিত নরম গলায় বলল, “তোমার মনের মতো সঙ্গী পেয়েছিলে, সেটা অনেক বড় ব্যাপার। আমি জানি, তাকে হারানো সহজ নয়। কিন্তু সেও চাইত তুমি আর রাজেন্দ্র যেন ভালো থাকো। তাই নিজের দায়িত্বটা ঠিকভাবে পালন করো। তুমি দেখবে, জীবনের পথ আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।”
রাজীব কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে রইল। তার বাবার কথাগুলো যেন অন্তরের গভীরে পৌঁছে গেল। সে মাথা নত করে বলল, “বাবা, তুমি ঠিক বলছ। আমি রাজেন্দ্রের জন্য আবার নতুন করে জীবন শুরু করব।”
রঞ্জিত হাসল, “এটাই তো চাই। আমরা কেউই এখানে চিরকাল থাকব না। কিন্তু আমরা যা রেখে যাই, সেটা আমাদের প্রজন্মকে গড়ে তোলে। তাই নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখো।”
ছাদের নরম বাতাসে যেন এক নতুন দৃঢ়তা ভেসে বেড়াল। রাজেন্দ্র তার বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়ল। রাজীব একবার তার সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বাবা, আমি রাজেন্দ্রের জন্য সবকিছু করব। ও যেন জীবনে মায়ের অভাব বোধ না করে।”
রঞ্জিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মা যেখানে আছে, সে নিশ্চয়ই খুশি হবে। তারা হয়ে যারা চলে যায়, তারা আমাদের শক্তি হয়ে থাকে। জীবনে যত বাধাই আসুক, আমরা এগিয়ে যাব।”
রাতের আকাশে তারাগুলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিন প্রজন্মের একে অন্যকে নিয়ে এগিয়ে চলার দৃঢ়তা যেন তারাগুলোর মাঝেই খুঁজে পাওয়া গেল।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - মৃত্যুর হাসি: "মৃত্যুর হাসি" একটি রহস্যময় ভুতের গল্প যেখানে দুই ভাইবোনের সাহস, মায়ের আত্মার আশীর্বাদ, ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই আপনাকে টানবে। পড়ুন এই বাংলা ছোট গল্প, যা ভয় ও আবেগে ভরা। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
নতুন দিনের প্রতিশ্রুতি
বাংলা ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
রাত ক্রমশ গভীর। চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। রাজেন্দ্র দাদুর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। তার নিঃশ্বাসের মৃদু আওয়াজ যেন একমাত্র শব্দ, যা এই নির্জনতার মাঝে শোনা যাচ্ছে। রঞ্জিত বসু আকাশের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
“তারা হয়ে চলে গেছে যারা, তারা আমাদের দেখে। তারা চায় আমরা যেন ভালো থাকি।”
রাজীব চোখ মেলে বাবার দিকে তাকাল। বাবার মুখে এক অদ্ভুত শান্তি। এই কথাগুলো যেন তার বুকের ভেতর কোথাও গিয়ে বাজল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বলল, “বাবা, তারা কি সত্যিই আমাদের দেখে?”
রঞ্জিত একটু হেসে বলল, “এটা বিশ্বাসের বিষয়, রাজীব। আমি জানি না তারা সত্যিই আমাদের দেখে কি না। কিন্তু এটা জানি, তাদের কথা মনে রেখে আমরা যদি ভালো থাকি, তারা আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকে।”
ভোরের প্রথম আলো ছাদে ছড়িয়ে পড়ছে। পাখিদের কলরব শুনে মনে হচ্ছে, তারা নতুন দিনের আনন্দ ঘোষণা করছে। রাজীব ধীরে ধীরে ঘুমন্ত রাজেন্দ্রকে কোলে তুলে নিল। ছেলের নরম মুখের দিকে তাকিয়ে তার ভেতরটা অদ্ভুত এক ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধে ভরে গেল।
“বাবা,” রাজীব মৃদু স্বরে বলল, “আমি রাজেন্দ্রকে মানুষ করার জন্য সবকিছু করব। সে তার মাকে পাবে না, কিন্তু সে আমাদের ভালোবাসায় বড় হবে।”
রঞ্জিত গভীর সন্তুষ্টির সঙ্গে ছেলের দিকে তাকাল। তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি। সে বলল, “এটাই তো চাই, রাজীব। জীবন মানে একা পথ চলা নয়। সঙ্গী না থাকলেও, দায়িত্ব আমাদের সঙ্গী হয়ে ওঠে। আর দায়িত্বের মধ্যেই জীবনের আসল আনন্দ লুকিয়ে থাকে।”
রাজীব চোখ মুছতে মুছতে বলল, “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, সত্যিই আমি পারব। রাজেন্দ্রকে ভালোভাবে মানুষ করব, তার মধ্যে এমন কিছু গড়ে তুলব, যা তার মা চাইত।”
রঞ্জিত হেসে বলল, “তোমার মা যেমন তোমাকে গড়ে তুলেছিল, তেমনি তুমি রাজেন্দ্রকে গড়ে তুলবে। এটা জীবনের একটা চক্র, রাজীব। আমরা যেমন আমাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে শিখেছি, তেমনি রাজেন্দ্র একদিন তোমার কাছ থেকে শিখবে।”
রাজেন্দ্র হঠাৎ নড়ে উঠল, চোখ আধখোলা। মিষ্টি গলায় বলল, “বাবা, সকাল হয়ে গেল? আমরা কি এখন খেলতে যাব?”
রাজীব হেসে বলল, “হ্যাঁ রাজু, সকাল হয়ে গেছে। আমরা সবাই মিলে এখন সুন্দর একটা দিন কাটাব। কিন্তু তার আগে একটু আরাম করো।”
রাজেন্দ্র আবার চোখ বুজল। রঞ্জিত এবার একটু গভীর স্বরে বলল, “তোমার ছেলের চোখে দেখো, রাজীব। ওর প্রত্যেকটা হাসি, প্রত্যেকটা কথা তোমার শক্তি হয়ে উঠবে। তুমি শুধু নিজের দায়িত্বটা পালন করো। দেখবে, জীবনের বাকি সব জিনিস আপনাআপনি ঠিক হয়ে যাবে।”
রাজীব মৃদু হেসে বলল, “তোমার কথাগুলো ঠিক যেন মন্ত্রের মতো কাজ করে, বাবা। আমি মনে করেছিলাম, অঞ্জনা চলে যাওয়ার পর সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আজ বুঝলাম, নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য অনেক কিছু বাকি আছে।”
রঞ্জিত আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার মাও চাইত, তুমি যেন সুখে থাকো। আর রাজেন্দ্রকে দেখে মনে হয়, সে তোমার জীবনের নতুন অধ্যায়। এই অধ্যায়টা লিখতে হবে যত্ন করে, ভালোবাসা দিয়ে।”
সূর্যের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। রঞ্জিত নিজের ছেলেকে বলল, “চলো, এবার নিচে যাই। নতুন দিন শুরু হয়েছে। কাজও শুরু করতে হবে। জীবন তো থেমে থাকে না। আমাদেরও থেমে থাকা ঠিক নয়।”
রাজীব রাজেন্দ্রকে কোল থেকে নামিয়ে হাত ধরে দাঁড়িয়ে গেল। ছেলের ছোট্ট হাতটা ধরে তার মনে হল, এই পথচলা সহজ হবে না, কিন্তু অসম্ভবও নয়।
রঞ্জিত ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, “রাজীব, তোমার মা আর অঞ্জনা আমাদের মধ্যে বেঁচে আছে। তারা আমাদের কাজ আর ভালোবাসায় জীবিত থাকবে। আমরা যদি সুখী থাকি, তাদের আত্মাও শান্তি পাবে।”
রাজীব হাসি মাখা মুখে বলল, “তোমার কথা আমি মনে রাখব, বাবা। আজ থেকে আমার নতুন জীবন শুরু হলো। রাজেন্দ্র আর তোমার জন্য আমি নিজের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব।”
রঞ্জিত মৃদু হেসে বলল, “এটাই তো চাই। জীবন মানে পথচলা। এই চলার পথে যারা আমাদের সঙ্গে ছিল, তাদের স্মৃতি আর ভালোবাসাই আমাদের পথ দেখাবে।”
ছাদের ওপরে সূর্যের আলো আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিন প্রজন্ম—দাদু, বাবা আর ছেলে—একসঙ্গে নতুন দিনের আলোয় নিজেদের পথ খুঁজে নিল। যে ছাদ একসময় শোকের বোঝা নিয়ে নত হয়েছিল, সেখানে এখন নতুন আশা আর ভালোবাসার গল্প লেখা হচ্ছে।
জীবনের পথ কখনো মসৃণ নয়। কিন্তু ভালোবাসা আর দায়িত্ব সেই পথকে চলার যোগ্য করে তোলে। রঞ্জিত, রাজীব আর রাজেন্দ্র, তিনজনেই বুঝে গেল, একসঙ্গে থাকলে কোনো দুঃখই অতিক্রম করা অসম্ভব নয়।