আকাশ ঘনঘন করছে ঝড়ের বাতাসে। বজ্রপাতের আলোয় মাঝেমধ্যে উঁকি মারছে এই জরাজীর্ণ, একতলা বাড়ির ভাঙা জানালার ফাঁক দিয়ে। ভেতরে আঁধার, মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় সামান্য একটা ঘেরাট সৃষ্টি হয়েছে মেঝেতে। তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি আমি, সোহম। কীভাবে এখানে এসে পড়লাম, তা ঠিক মনে নেই। মনে আছে শুধু, একটা ঘন কুয়াশার মধ্যে হাঁটছিলাম, আর হঠাৎ এই ঘরে এসে পড়েছি।
চারপাশটা খুঁজতে লাগলাম কোনও রাস্তা, কোনও দরজা। হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে টানতে ঠেকলাম একটা শক্ত কিছুতে। হাত বুলিয়ে বুঝলাম, একটা পুরনো, কাঠের দরজা। খুশির ঢেউ এলো মনে। বেরোতে পারব, এই আটকে থাকা থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু দরজাটা না খোলা যাচ্ছে। জোরে জোরে ঠেলা দিলাম, কিন্তু কোনও লাভ নেই। হঠাৎ, চোখ আটকে গেল দেওয়ালে একটা সবুজ রঙের, নীল নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বল করা তীরের চিহ্ন। এক্সিট সাইন।
মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। এক্সিট সাইন আছে, মানে এটা নিশ্চয়ই কোনও রাস্তায় খুলবে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। মোমবাতির আলোয় একটু একটু করে এগোতে থাকলাম, চোখ রাখলাম এক্সিট সাইনের দিকে। মনে মনে ভাবছিলাম, এই ঘরটা কতটা বড়ো হবে! হঠাৎ একটা জায়গায় এসে থামতে বাধ্য হলাম। এক্সিট সাইনটা আর নেই।
আঁতকে উঠে চারপাশটা খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও নেই। দেওয়ালে হাত বুলিয়ে খুঁজলাম, কিন্তু সেই সবুজ রঙের, নীল নিয়ন আলোও আর নেই। একটা অস্বস্তি গা কাঁটা দিয়ে উঠল। মোমবাতির আলোটাও কেমন কমে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। ঘরটা যেন আরও অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎ, শুনলাম একটা খড় খড় শব্দ। মনে হলো, কোনও একটা ছোটো প্রাণী দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে চলছে। কিন্তু, এই ঝড়ের রাতে কোন প্রাণী বাইরে থাকবে? আর শব্দটা যেন আমার ঠিক পাশেই হচ্ছে। শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠল। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।
এই অসহ্য অন্ধকারে, এই অজানা শব্দে, আর সেই হারিয়ে যাওয়া এক্সিট সাইনে একটা অস্বাভাবিক ভয় চেপে ধরেছে আমাকে। মনে হচ্ছে, কেউ একজন আমার খেলা দেখছে। এই ঘরটাই যেন একটা ফাঁদ, আর আমি সেই ফাঁদে আটকা পড়েছি।
মোমবাতির আলোটা আরও কমে এসেছে। শেষের দিকে। আর মাত্র কয়েকটা ঝাপটায় নিভে গেল মোমবাতিটা। চারপাশে এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। চোখ বন্ধ করেও কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু ঝড়ের ঝোঁকায় বাড়ির কড়াকড় শব্দ আর মাঝেমধ্যে বজ্রপাতের গর্জন। হাত বাড়িয়ে সামনের দিকে টানলাম, কোনও কিছু ধরার আশায়। হঠাৎ, আঙুল ছুঁয়ে ফেললো একটা নরম, ঠাণ্ডা জিনিস। শিউরে উঠলাম। মনে হলো, চুল। লম্বা, ভেজা চুল।
চিৎকার করতে গিয়েও কোনও শব্দ বের হলো না। গলা শুকিয়ে গিয়েছে। আবারও ছোঁয়া লাগলো আঙুলে, এবার কপালে। একটা ঠাণ্ডা, ভেজা হাত। জীবন্ত মানুষের হাতের মতোই ঠিক। চিৎকার করার চেষ্টা ছেড়ে দিলাম। আর কিছু করারও নেই। শুধু কাঁপছিলাম অন্ধকারে, অজানা ভয়ের চাপে; এই অবস্থায় হঠাৎ একটা শব্দ ভেসে এলো কানে। খুব কাছেই, যেন আমার কানের কাছেই। একটা ফিসফিসানি। কিন্তু, সেই ফিসফিসানিটা বোঝা যাচ্ছে না। কোনও ভাষা নয়, শুধু অস্পষ্ট শব্দগুলো কানে আসছে, বারবার বলে চলেছে, “এখানে থাকো…”
শব্দটা শুনে আরও বেশি ভয় পেয়ে গেলাম। মনে হলো, পা দুটো আর মাটিতে নেই, ভাসছি। কীভাবে বাঁচব, কোন পথে বেরোব, এসব কিছুই আর ভাবা যাচ্ছে না। শুধু সেই ফিসফিসানিটা বারবার কানে আসছে, “এখানে থাকো…”
হঠাৎ, আবারও একটা ঝলক। বজ্রপাতের আলোয় এক মুহূর্তের জন্য ঘরটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সেই আলোয় দেখতে পেলাম, আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে একটা মূর্তি। একটা বৃদ্ধার মেয়ে, জীর্ণশীর্ণ শরীর, চোখ দুটো অন্ধকার, কিন্তু মুখে একটা অদ্ভুত হাসি।
আলোটা নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও জোরে ফিসফিসিয়ে উঠল সে, “এখানে থাকো…” এবার তার শব্দটা আর অস্পষ্ট নয়, পরিষ্কার, কিন্তু সেই কথাতেই একটা অমানবিক শীতলতা ঢুকে গেল আমার মেরুদণ্ডে।
জানি না, আর কতক্ষণ এই অন্ধকারে, এই ভয়ের সাথে লড়াই করতে পারব। শুধু মনে হচ্ছে, এই জীবনে আর কোনওদিন আলো দেখতে পাব না, এই অন্ধকার, এই ভয়, আর এই ফিসফিসানিই হবে আমার শেষ।
অজ্ঞান হয়ে পড়ার ঠিক আগে, মনে হলো, সেই বৃদ্ধার মেয়ের শরীরটা কেমন যেন কুঁজো হয়ে যাচ্ছে, তার হাত দুটোও ধীরে ধীরে হাড় পাঁজড়ে রূপান্তরিত হচ্ছে। আর সেই ফিসফিসানিটাও আর থাকলো না, তার জায়গায় ভেসে এলো একটা নির্মম হাসি, একটা শিকার পাওয়ার আনন্দে ভরা হাসি।
আমি যখন ঘুম থেকে জাগলাম, চোখ খুললাম সূর্যের আলোয়। কিন্তু চেনা ঘর নয়। চারপাশটা জঙ্গল। একটা প্রাচীন, বিশাল গাছের তলায় পড়ে আছি। গাছের গায়ে লেখা রয়েছে অদ্ভুত কিছু চিহ্ন, দেখে কোনও ভাষা বলে মনে হয় না। সারা গায়ে ব্যথা, মাথা যেন চিড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর ঘরটা, সেই বৃদ্ধা মেয়ে, সেই ফিসফিসানি – সব কিছুই যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
হঠাৎ, একটা শব্দ। একটা ঝিরিঝির শব্দ। মাথার উপরে তাকিয়ে দেখি, একটা বড়ো কাক ঘুরছে। কিন্তু এই কাকটার চোখ দুটো ঠিক মানুষের মতোই লাল। আর সেই চোখ দিয়ে সে আমাকেই দেখছে, একটা অদ্ভুত কৌতূহল নিয়ে।
মনে মনে ভাবলাম, স্বপ্ন নাকি সত্যি, তা আর ঠিক বুঝতে পারছি না। কিন্তু একটা জিনিস জানি, এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে না পারলে, হয়তো সেই ভয়ঙ্কর রাত্রি আরও ভয়ঙ্কর একটা শেষে এসে পৌঁছবে।