বাংলার মাটি কাঁপছিল সেদিন। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ জ্বলে উঠেছিল চারদিকে, যেন এক প্রলয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়। আমি, অগ্নি, সিপাহী বাহিনীতে নব্য-নিযুক্ত, এই ঝড়েরই একটা ক্ষুদ্র কণা। আমাদের দল ঝাড়ের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিলাম। চারপাশে গোলাগুলির ঝাঁঝি, ব্রিটিশ সৈন্যদের চিৎকার, আর নিজেদের বন্দুকের গর্জন ছাড়া কোনো শব্দই শোনা যাচ্ছিল না। হঠাৎ, আমাদের কাপ্তেন নির্দেশ দিলেন থামতে।
আমরা সবাই বিস্ময়ে চোখা তাকালাম। থামার কী মানে? যুদ্ধের মাঝখানে থামা? কিন্তু কাপ্তেনের মুখে ছিল এক অদ্ভুত গম্ভীরতা। আমরা চোখ রাখলাম দূরের রাস্তায়। সেখানে, ধুলোয় ঢাকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন দুইজন অফিসার। একজন আমাদের বাঙালি সিপাহী, অন্যজন কোন বিদেশী।
“ও তো আকবর সাহেব!” আমাদের দলের বীরেন ফিসফিসিয়ে বলল। “আর ওর পাশে…?”
“তুর্কি অফিসার,” কাপ্তেন নিশ্চিত করলেন। “যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।”
এক মুহূর্তের জন্য যেন পৃথিবী ঘুরে দাঁড়াল। যুদ্ধবিরতি? এই রক্তক্ষয়ের মাঝখানে, এই বিশ্বাসঘাতকদের সাথে? মনে জ্বলে উঠল রাগ, অভিমান। কিন্তু কাপ্তেনের শাসনে চুপ থাকতে বাধ্য হলাম।
দুই অফিসার এগিয়ে এলেন। ব্রিটিশ অফিসারের গায়ের ইউনিফর্মটা রক্তে লাল। তুর্কি অফিসারের চোখে একটা অস্বাভাবিক শান্তি ছিল। তার মুখে তুর্কি ভাষায় কিছু বললেন আকবর সাহেব। পরে, বাংলায় অনুবাদ করলেন, “যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানাচ্ছেন তাঁর সুলতান। নিরপরাধ মানুষের আর কত রক্তপাত? চলুন, শান্তির পথে হাঁটা যাক।”
আমাদের দলের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। কেউ সমর্থন করছিল, কেউ বিরোধ। আমি চুপ করেই দেখছিলাম তুর্কি অফিসারটিকে। লম্বা চেহারা, নীল চোখ, আর গায়ে একটা অদ্ভুত শান্তির ছোঁয়া। তাঁর চোখে এ যুদ্ধের বর্বরতা যেন ছিল না। মনে হল, তিনিও হয়তো এই রক্তপাতের বিরুদ্ধেই।
কিন্তু আমাদের কাপ্তেনের জবাব ছিল নির্মম। “যুদ্ধ থামবে না। যতদিন না ব্রিটিশ সরকার আমাদের দেশ ছেড়ে যায়, ততদিন লড়াই চলবে।”
তুর্কি অফিসার মাথা নীচু করলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছু না বলে, আকবর সাহেবের
সাথে ঘুরে দাঁড়ালেন। চলে যাওয়ার আগে, একবার পিছনে ফিরে তাকালেন আমাদের দিকে। তাঁর নীল চোখে একটা অসহায়ের ভাব ছিল, যেন এই যুদ্ধের বীভৎসতায় তিনিও মর্মাহত।
তিনি চলে যাওয়ার পর, আবার শুরু হল গোলাগুলির বর্ষণ। কিন্তু সেই ক্ষুদ্র বিরতির মধ্যে একটা বীজ জন্ম নিয়েছিল আমার মনের মাঝে। যুদ্ধের মাঝখানেও কি শান্তির সম্ভাবনা থাকতে পারে? তুর্কি অফিসারের কথায়, তাঁর সুলতানের আহ্বানে একটা আশার আলো দেখেছিলাম। যুদ্ধের এই নৃশংসতা চিরকাল থাকবে না তো? একদিন কি শান্তি আসবে না?
দিনের পর দিন, যুদ্ধ চলতেই থাকল। আমরা প্রতি মুহূর্ত মৃত্যুর সাথে সাথি হয়ে বাঁচছিলাম। কিন্তু তুর্কি অফিসারের মুখের সেই শান্তি আমার মনে থেকে গেল। রাতের অন্ধকারে, যখন যুদ্ধের কোলাহল থামত, তখন সেই নীল চোখের ছবি ভেসে উঠত আমার সামনে। মনে হত, তিনি হয়তো আমাদের মতোই স্বাধীনতা চাইছেন তাঁর দেশের জন্য। কিন্তু দুই দেশের রাজনীতির জের এই সাধারণ মানুষের ওপরই পড়ে।
একদিন, যুদ্ধের মাঝে একটা গুঞ্জন শোনা গেল। বলা হচ্ছে, ব্রিটিশ সৈন্যদের কাছে গোলাবারুদ ফুরিয়ে এসেছে। খবরটা আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল আমাদের বাহিনীতে। সবার মুখে জয়ের আশা। কিন্তু আমার মনে একটা অশান্তি ছিল। যুদ্ধ জিতলেও কি সত্যিই স্বাধীনতা আসবে? না কি এই জয়ের পেছনে লুকিয়ে আছে আরো কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ?
রাতে, আকাশে তারার ঝলমলে আলোয় তাকিয়ে ভাবছিলাম, যুদ্ধের পরের দুনিয়াটা কেমন হবে? হঠাৎ, আমাদের দলের একজন সৈন্য ছুটে এসে খবর দিল, “ব্রিটিশ সৈন্যরা পালিয়ে যাচ্ছে!”
আমরা সবাই উল্লাসে চিৎকার করে উঠলাম। বহুদিনের লড়াই, অগণিত রক্তপাতের পর, এই মুহূর্তটার জন্যই তো আমরা অপেক্ষা করছিলাম। সকালে আমরা দেখতে পেলাম, যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে গেছে ব্রিটিশ সৈন্যরা। আমাদের জয়! কিন্তু এই জয়ের মাঠেও পড়ে রয়েছে অসংখ্য সৈন্যের লাশ। তাদের চোখে জমেছে মৃত্যুর শোক, কিন্তু তাদের মৃত্যু কি সার্থক হল?
কিছুদিন পরে, আমি জানতে পারলাম আকবর সাহেবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, তিনি বিদ্রোহীদের সাথে যোগাযোগ করছিলেন। এই খবরে আমার মনটা ভেঙে গেল। তিনি কি সত্যিই বিদ্রোহীদের সাহায্য করছিলেন? নাকি তিনি চেয়েছিলেন এই যুদ্ধ থামাতে।
কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। বিদ্রোহের আগুন ধীরে ধীরে নিভে যেতে লাগলো। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা আসেনি। ব্রিটিশরা নতুন বাহিনী নিয়ে ফিরে এলো আর বিদ্রোহকে আরো নির্মমভাবে দমিয়ে দিল। আমি বন্দী হলাম। জেলে থাকাকালীন সময়ে, আকবর সাহেবের মামলার কথা শুনতাম। তাঁকে যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টার জন্যই বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো।
আমি জেলে থাকাকালীনই একদিন দেখা হলো এক বৃদ্ধ তুর্কি দম্পতির সাথে। তারা আকবর সাহেবের পরিবারের লোকজন ছিলেন। তাদের চোখের পানিতে দেখলাম এক অসহায় বাবার শোক। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, আকবর সাহেবের সুলতান এই বিদ্রোহের বিষয়ে অবগত ছিলেন না। তিনি কেবল এই অনর্থক যুদ্ধ থামাতে চেয়েছিলেন।
এই কথা শুনে আমার বুকটা এমনি জ্বলে উঠলো। আকবর সাহেবের পরিবারের এই দুঃখ, এই যুদ্ধের বর্বরতা, সব মিলে আমার মনে একটা প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল। এই যুদ্ধের ইতিহাস লিখবো। লিখবো সেই তুর্কি অফিসারের শান্তির আহ্বান, লিখবো লাখো লাখো মানুষের বলিদান, লিখবো এই যুদ্ধের নিরর্থকতা। যাতে হয়তো কোনোদিন আর এমন ঘটনা না ঘটে।
বছরের পর বছর কেটে গেল। জেল থেকে মুক্তি পেলাম আমি। কিন্তু মনের জেলে আটকে ছিল সেই যুদ্ধের স্মৃতি। লেখার টেবিলে বসে কলম ধরলাম। লিখে গেলাম সেই ঘূর্ণিঝড়ের চোখের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের অভিজ্ঞতা। লিখে গেলাম আকবর সাহেবের নীল চোখের শান্তি, যুদ্ধের মাঝেও যেটা ছিল এক আশার আলো।
আমার লেখা বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলো। মানুষ জানতে পারলো সেই যুদ্ধের গল্প, সেই তুর্কি অফিসারের প্রচেষ্টার কথা। হয়তো আমার লেখা এই যুদ্ধের পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে পারল না, কিন্তু কম করেছে মানুষের মনের কঠিনতা। যুদ্ধের বর্বরতার বিরুদ্ধে জাগিয়েছে একটা প্রশ্ন। হয়তো কোনোদিন এই প্রশ্নই শান্তির পথ খুলে দেবে।
বছরের পর বছর কাটলেও, আকবর সাহেবের চোখের সেই শান্তি আমার মনে দাগ কাটে রেখেছে। লেখক হিসেবে খ্যাতি এলেও, একটা অপূর্ণতা থেকেই যেতে চাইত না। আকবর সাহেবের পরিবারের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছিলাম। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারি, তাঁর ছেলে ইউসুফ, একজন তরুণ লেখক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। তুরস্কে যুদ্ধবিরোধী সাহিত্যের এক নক্ষত্র তিনি।
একদিন, ইউসুফের একটা চিঠি পেলাম। সেখানে লেখা ছিল, তিনি শিগগিরই ভারতে আসছেন। তাঁর বাবার কাহিনী নিয়ে আরো জানতে চান, সেই যুদ্ধের স্মৃতি স্পর্শ করতে চান। চিঠি শেষে লিখেছিলেন, “আমার বিশ্বাস, যুদ্ধের মাঝেও শান্তির কথা বলা, মানবতার কথা বলা – এটাই সত্যিকারের বীরত্ব।”
ইউসুফের আগমনের খবরে মনটা আনন্দে ভরে উঠল। তাঁর সাথে দেখা হলো কলকাতার একটা ঐতিহাসিক কফি হাউজে। চা খেতে খেতে আমি তাঁকে সেই যুদ্ধের কথা, আকবর সাহেবের চেষ্টার কথা, সব খুলে বললাম। ইউসুফ মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। চোখে ছিল বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
কথার ফাঁকে ইউসুফ বললেন, “আবার কখনো যুদ্ধ না হোক, এটাই আমাদের সবার প্রার্থনা। কিন্তু যুদ্ধ হয়ই যদি, তখন যেন মানুষের মনে একটু হলেও শান্তির আশা জাগে। সেই আশার আলো জ্বালানোর জন্যই লেখকের কলম, কবির কবিতা।”
তাঁর কথা শুনে আমার মনে হলো, হয়তো আমরা দুইজন, দুই দেশের লেখক, যুদ্ধের নৃশংসতার মাধ্যমে, শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে পারব। ইউসুফের সাথে সেদিন ঠিক হলো, আমরা একসাথে একটি বই লিখবো। সেই বইয়ে থাকবে যুদ্ধের কথা, কিন্তু থাকবে মানবতার কথাও। থাকবে আকবর সাহেবের মতো মানুষের শান্তির আহ্বান, যা হয়তো একদিন যুদ্ধের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়কে থামিয়ে দিতে পারবে।
কিছু মাস পরে, আমাদের লেখা যৌথ বইটি প্রকাশিত হল। “ঘূর্ণিঝড়ের চোখে, শান্তির স্বপ্ন” এই ছিল বইটির নাম। বইটি দুই দেশেই ব্যাপক সাড়া ফেললো। ভারতে, বিদ্রোহের ইতিহাসে আকবর সাহেবের অবদান উঠে এলো আলোকে। তুরস্কে, যুদ্ধবিরোধী সাহিত্যের ধারায় নতুন মাত্রা যোগ করলো এই বই।
ইউসুফের সাথে আমার বন্ধুত্ব আরো গভীর হল। আমরা দুজনে মিলে বিভিন্ন দেশে ঘুরে বক্তৃতা দিতাম, যুদ্ধের বর্বরতা ও শান্তির গুরুত্ব নিয়ে কথা বলতাম। একদিন, আমরা দুইজন নিমন্ত্রিত হলাম তুরস্কের এক বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে। সেখানে, বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সামনে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও তার ভয়াবহ পরিণতির কথা তুলে ধরলাম।
আমাদের বক্তৃতা শেষে, একজন বয়স্ক জার্মান অধ্যাপক মঞ্চে এসে আমাদের অভিনন্দন জানালেন। তিনি বললেন, “আপনাদের লেখা, আপনাদের কথা – এটাই আশার আলো। যুদ্ধের ক্ষত সারাতে লাগে সময়, কিন্তু শান্তির পথে এগিয়ে যেতে হবে। আর সেই পথে আপনারা দুইজন, দুই দেশের লেখক, হয়ে উঠলেন আলোকবর্তিকা।”
অধ্যাপকের কথা শুনে, ইউসুফের চোখে এবং আমার চোখেও জল এসে গেল। হয়তো আমরা যুদ্ধ ঠেকাতে পারিনি, কিন্তু শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। হয়তো কোনোদিন, কোথাও কোনো যুদ্ধ লাগলে, আমাদের লেখা, আমাদের গল্প, কোনো এক যুবকের মনে শান্তির বীজ বপন করবে। হয়তো সেই যুবকই হবেন ভবিষ্যতের শান্তির দূত। এই আশায়, আমরা দুইজন, লেখক অগ্নি ও লেখক ইউসুফ, চলতে থাকলাম শান্তির পথে, কলমের সাহায্যে যুদ্ধের ঘূর্ণিঝড়কে থামানোর অবিরাম চেষ্টায়।