বাংলার মাটি কতো কি গল্প ধরে রেখেছে, তার ঠিক নেই। কখনো মহাকাব্যের মতো বিশাল, কখনো বা এক ফোঁটা শিউলি ফুলের মতো সাজে। আজ আমি আপনাদের শোনাচ্ছি, ঠিক তেমনই এক গল্প।
গল্পটা শুরু হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি, ঢাকার নবাবদের রাজত্বের শেষের দিকে। ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে, তখনো ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ঘণ্টার আওয়াজে মুখরিত, সেই ঐতিহ্যশীল তাঁতি পাড়ায় থাকতো শিবু মৃত্তিকার। তার একমাত্র মেয়ে, রূপসী কাঞ্চন, ঢাকাই মুসলিনের জাঁকালো শাড়ি পরতে পারতো না ঠিক, কিন্তু মাটির পুতুল বানানোর ক্ষমতায় তার হাত ছিল যাদুর মতো। সেই পুতুলগুলো, যেন জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতো।
একদিন, দোকানে বসে থাকা অবস্থায়, শিবুর আর একজন ক্রেতা এলো। সে ছিল রাজপ্রাসাদের কারিগরদের দলপতি, জাহাঙ্গীর খাঁ। সে এসেছিল রাজবাড়ির জন্য এক বিশেষ পুতুল বানানোর অর্ডার দিতে। সেই পুতুল রাজার প্রিয় স্ত্রীর আদলে বানাতে হবে। রাজার স্ত্রী, জাহানারা বেগম, ছিলেন পারস্যের রাজকুমারী। তার সৌন্দর্য ছিল অপরূপ।
কাঞ্চন জাহাঙ্গীর খাঁর কাছ থেকে জাহানারা বেগমের বিবরণ শুনতে শুনতেই পুতুলটির রূপকল্পনা তার মনে গড়ে উঠতে লাগলো। দিনের পর দিন, সে মাটির সাথে খেলা করলো, জাহানারার মুখের মৃদু হাসি, চোখের নীল আভা, চুলের কালো ঢেউ – সবকিছুই পুতুলে ফুটিয়ে তুললো সে।
পুতুলটা রাজবাড়িতে পৌঁছালে তোলপাড়। রাজা মুগ্ধ হলেন। জাহানারা বেগম যেন সত্যিই দাঁড়িয়ে আছেন মনে হলো। সেদিন থেকে, রাজবাড়িতে কাঞ্চনের নাম। রাজার কাছে মাঝে মাঝে পুতুল বানানোর ডাক আসতে শুরু করলো।
কিন্তু আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলো। বিদ্রোহ ঘটনার কিছুদিন আগে, জাহাঙ্গীর খাঁ কাঞ্চনের কাছে এলো। এবার তার চোখে এক অন্য রকম দৃষ্টি।
“কাঞ্চন,” সে বললো, “বিদ্রোহীরা যদি জেতে, রাজার কি হবে জানো?”
কাঞ্চন চুপ করে রইল।
“তার পরিণাম ভালো হবে না,” জাহাঙ্গীর খাঁ ফিসফিস করে বললো, “তুমি আমায় একটা কাজ করতে পারো।”
জানতো, বিদ্রোহের গতিপথ কী। তার বাবা, শিবু মৃত্তিকার, বিদ্রোহীদের সমর্থক ছিলেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর খাঁ কী চায়, তা বুঝতে পারল না কাঞ্চন।
“কী কাজ?” সে সতর্কতার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলো।
“রাজবাড়ির এক গোপন পথ আছে,” জাহাঙ্গীর খাঁ বললো, “রাজার কিছু গয়না সেই পথ দিয়ে পাচার করা হবে। সেই গয়না নিয়ে তোমাকে পালিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধ থামার পর, আমি তোমাকে খুঁজে বের করবো।”
কাঞ্চন চমকে উঠলো। রাজার গয়না চুরি! এ তো বিশ্বাসঘাতকতা! কিন্তু জাহাঙ্গীর খাঁর কথায় ভয়ও লাগলো তার। বিদ্রোহীরা জিতলে রাজার পরিণতি ভালো হবে না, এটা সে জানত। কিন্তু রাজার সম্পদ নিয়ে পালানো – এই চিন্তা তার মনে কুঁড়কুড়িয়ে বসলো।
দ্বিধার মধ্যে দিন কয়েক কাটলো কাঞ্চনের। ঠিক সেই সময়, শিবু মৃত্তিকার বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিলেন। রাতের অন্ধকারে, বাড়িতে এসে কাঞ্চনকে সতর্ক করলেন, “মেয়ে, সাবধান থেকো। রাজার লোকজন বিশ্বাসঘাতকদের খুঁজছে।”
কাঞ্চন জানতো, বাবার কথা সত্যি। কিন্তু জাহাঙ্গীর খাঁর হুমকিও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। সে রাতে, কাঞ্চন একটা সিদ্ধান্ত নিল।
পরের দিন, জাহাঙ্গীর খাঁ ঠিক সময়ে এলো। কাঞ্চন তাকে একটা পুটুল দেখালো। সেই পুতুলটি ছিল রাজার, ঠিক রাজার মতো সাজানো। কিন্তু পুতুলের চোখ দুটো ছিল রাগে লাল, আর হাতে ছিল রক্তমাখা কাঁটা।
জাহাঙ্গীর খাঁ পুতুলটা দেখে কেঁপে উঠলো। সে বুঝতে পারলো, কাঞ্চন তার ষড়যন্ত্র বুঝে ফেলেছে। কিন্তু পালিয়ে যেতে তার আর সময় ছিল না। বিদ্রোহের আগুন তখন ঢাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
কাঞ্চন জানতো, এই যুদ্ধে জয় কারের হবে, তা নিশ্চিত নয়। কিন্তু সে জানতো, সে তার মনের সত্যিকে বিশ্বাস করবে। সেই রাতে, সে বাবার সঙ্গে বিদ্রোহীদের শিবিরে চলে গেল।
যুদ্ধের ফলাফল ইতিহাসের পাতায় লেখা। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলো। কিন্তু কাঞ্চন আর লুকিয়ে থাকলো না। সে ব্রিটিশদের সামনে এগিয়ে এলো, জাহাঙ্গীর খাঁর বিশ্বাসঘাতকতার কথা সব খুলে বললো। রাজার গয়নাও সে ফিরিয়ে দিল।
কাঞ্চনের সাহসিকতায় মুগ্ধ হলেন ব্রিটিশ অফিসাররা। তারা জানত, যুদ্ধের সময় রাজবাড়ির অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র লুট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু কাঞ্চনের দেওয়া গয়নাগুলো ছিল রাজার সবচেয়ে প্রিয় কিছু জিনিস। সেগুলো ছিল জাহানারা বেগমের, সেই পারস্যের রাজকুমারীর, যিনি বহুদূর থেকে এসে বাংলার রানি হয়েছিলেন। গয়নাগুলো ফিরে পেয়ে রাজা কৃতজ্ঞ হলেন। কাঞ্চনের দক্ষতা আর সাহসের কথাও তিনি শুনলেন।
যুদ্ধের পর ঢাকা শহর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো। কিন্তু শিবু মৃত্তিকার আর ফিরে আসলেন না। বিদ্রোহের শেষের দিকে তিনি নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। কী হলো তার, কাঞ্চন জানতে পারলেন না। এটা হয়ে রইল তার জীবনের একটা ক্ষত।
এদিকে, রাজার আদেশে কাঞ্চনকে রাজবাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সে আবার পুতুল বানাতে শুরু করলো। কিন্তু এবার তার হাতে জীবন্ত মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠতো না, বরং যুদ্ধের বিভীষিকা, বিদ্রোহের আগুন, আর হারানো বাবার স্মৃতি ফুটে উঠতো তার পুতুলগুলোয়।
রাজাকে এই পুতুলগুলো পছন্দ হতো না। তিনি চাইতেন জাঁকজমকপূর্ণ পুতুল, সুন্দরী রানীদের প্রতিচ্ছবি। কিন্তু কাঞ্চন তার মনের স্বাক্ষ্য রাখতে চাইলেন। তিনি জানতেন, ইতিহাস শুধু রাজাদের জয় নিয়ে লেখা হয় না, সাধারণ মানুষের দুঃখ, স্বপ্ন আর লড়াইও ইতিহাসেরই একটা অংশ।
কাঞ্চন রাজবাড়িতে থাকলেন। রাজার পছন্দমতো পুতুল বানাতে না পারলেও তিনি তার নিজের শিল্পধারা গড়ে তুললেন। আর সেই পুতুলগুলোই হয়ে উঠলো সেই সময়ের ঢাকার, সেই সময়ের বাংলার এক নিঃশব্দ কথা।