অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

বাংলা ছোট গল্প

Home » বাংলা ছোট গল্প » অমীমাংসিত রহস্য

অমীমাংসিত রহস্য

অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

শ্রেয়া অনেক বছর পর আবার ফিরেছে তার শৈশবের বাড়িতে। এই বাড়িটা ছোট্ট এক শহরে, পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে, গঙ্গার ধারের এক নিরিবিলি স্থানে। তার মায়ের মৃত্যুর খবরটা পেয়েছিল কিছুদিন আগেই। এতদিন তার কর্মব্যস্ত জীবনের চাপে বাড়ির দিকে ফেরা হয়নি। কিন্তু এবার, মায়ের মৃত্যুর পর এই বাড়িতে আসতেই হল। বাড়িটা একসময় কোলাহলে ভরা ছিল, যেখানে তার মায়ের হাসি আর কোলাহল ছড়িয়ে পড়ত প্রতিদিন। কিন্তু এখন, বাড়ির প্রতিটি কোণ যেন নীরব আর ভারী মনে হচ্ছে, যেন এখানে কিছু একটা লুকিয়ে আছে।

বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া অনুভব করল, কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তার এই জায়গা ছেড়ে যাওয়ার পর। তার মা মৃণালিনী ছিলেন একজন বিখ্যাত চিত্রশিল্পী, কিন্তু মৃত্যুর আগের কয়েক বছর তিনি প্রায় একা ছিলেন। শ্রেয়া কখনোই খুব একটা গভীর সম্পর্ক রাখতে পারেনি তার মায়ের সঙ্গে, কারণ মৃণালিনী বরাবরই একটু গম্ভীর আর নিজের জগতে ডুবে থাকতেন। কিন্তু আজ, এই নিঃসঙ্গ বাড়িটা যেন মায়ের গল্পগুলোকে আবার সামনে নিয়ে এসেছে।

বাড়ির দরজা খুলতেই এক ধরনের বুনো গন্ধ তার নাকে এল। পুরনো কাঠ, ধুলো আর কিছু অসমাপ্ত চিত্রকর্মের রঙের গন্ধ। ভেতরে ঢুকে, শ্রেয়া মনে মনে ভাবল—এত বছর পর এখানে ফিরে আসা কি ঠিক হল? বাড়িটার চারপাশে অনেক কিছুর বদল হয়েছে, কিন্তু ভেতরের নিঃসঙ্গতা যেন আগের মতোই থেকে গেছে।

শ্রেয়া ধীরে ধীরে বাড়ির প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখতে লাগল। তার মায়ের স্টুডিও ঘরটা এখনও একই রকম আছে। রঙের ক্যানভাস, ব্রাশ, এবং চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু অসমাপ্ত ছবি। মৃণালিনী শেষ পর্যন্ত কী আঁকতে চেয়েছিলেন, তা বোঝা মুশকিল। শ্রেয়া খেয়াল করল, মায়ের চেয়ারের পাশে কিছু পুরনো চিঠি আর একটি মোটা ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটা ধুলোয় ঢাকা ছিল, যেন কেউ বহুদিন ছুঁয়েও দেখেনি।

ডায়েরিটা হাতে তুলে নিয়ে শ্রেয়া প্রথম পৃষ্ঠাটি খুলল। তার মায়ের হস্তাক্ষর। কিন্তু ভেতরের লেখা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপা কাঁপা। প্রথম কয়েকটি পাতা কেবলমাত্র তার মায়ের ব্যক্তিগত চিন্তা-ভাবনা, জীবনের কথা, এবং শিল্পের প্রতি তার ভালবাসা নিয়ে লেখা। কিন্তু হঠাৎই একটি চিঠির কথা উল্লেখ আসে—”অর্জুন” নামে এক ব্যক্তির। এই নামটি শুনেই শ্রেয়ার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি হল। অর্জুন কে? কেন তার মায়ের লেখায় এত গুরুত্ব পাচ্ছেন?

চিঠির বর্ণনা অনুযায়ী, অর্জুন ছিলেন মৃণালিনীর জীবনের একটি বিশেষ মানুষ, যার সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা ছিল। কিন্তু তাদের সম্পর্কের পরিণতি কী হয়েছিল, সেই নিয়ে কিছু বলা নেই। শুধু অর্জুনের একটি অসমাপ্ত প্রতিচ্ছবি মৃণালিনী আঁকতে চেয়েছিলেন, যেটা কোনওদিনই শেষ করতে পারেননি। সেই ছবি কোথায়?

শ্রেয়া বেশ কিছুক্ষণ বসে চিঠিগুলো পড়তে লাগল। পুরনো ছবির মধ্যে একটি ছবিতে সে খুঁজে পেল অর্জুনকে—এক দীর্ঘ, মিষ্টি হাসি হাসা মানুষ, যার চোখে গভীর চিন্তার ছাপ। সেই ছবি দেখে শ্রেয়ার মনে হল, তার মা কি আসলেই ভালোবেসেছিলেন অর্জুনকে? কিন্তু এই সম্পর্কের কোনও চিহ্ন কি কোথাও আছে?

রাতে, যখন শ্রেয়া বাড়ির অন্ধকার ঘরে একা বসেছিল, তখন যেন হঠাৎ ঘরের চারপাশে অদ্ভুত কিছু ছায়ার চলাফেরা অনুভব করল। বাতাসের নীরবতায় যেন ফিসফিস করে কেউ কিছু বলছে। ঘরের নিঃশব্দতা আরও গভীর হয়ে এল। সে বিছানায় শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। তার মনে হচ্ছিল, এই বাড়ির মধ্যে কোনও এক অদ্ভুত শক্তি কাজ করছে, যা তার মনের ভেতরে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে—তার মা কি কোনও গোপনীয়তা নিয়ে মারা গেছেন? অর্জুন কে ছিলেন, আর তার মায়ের জীবনে কেন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন?

পরদিন সকালে, শ্রেয়া স্থানীয় লাইব্রেরিতে গিয়ে অর্জুন সম্পর্কে আরও তথ্য খুঁজে বের করার চেষ্টা করল। লাইব্রেরির পুরনো নথিপত্র ঘেঁটে সে জানতে পারল, অর্জুন একসময়ের প্রতিশ্রুতিশীল চিত্রশিল্পী ছিলেন, কিন্তু তার ক্যারিয়ার আকস্মিকভাবে থেমে যায়। কেউ কেউ বলেন, তার আঁকা ছবি ছিল রহস্যময়, আর তার জীবনও হয়ে উঠেছিল রহস্যে ঘেরা। কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, অর্জুন হঠাৎ একদিন শহর থেকে নিখোঁজ হয়ে যান। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে নানা রকম গুজব ছড়িয়ে ছিল, কিন্তু সত্যিকার কারণ কেউই জানত না।

শ্রেয়া বুঝতে পারল, অর্জুনের সাথে তার মায়ের জীবনের যোগসূত্রটি খুব গভীর। কিন্তু সেই যোগসূত্র কোথায় কেটে গেল? কেন তার মা কোনওদিনই অর্জুন সম্পর্কে তাকে কিছু বলেননি?

এই প্রশ্নগুলোই এখন শ্রেয়ার জীবনের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে। অর্জুনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কি কোনও রহস্য আছে? আর সেই রহস্য কি তার মায়ের মৃত্যুর সঙ্গে কোনওভাবে জড়িত? শ্রেয়ার মন এখন আরও জানতে চাইছে, আরও খুঁজতে চাইছে। কিন্তু তার মনের গভীরে একটা অদ্ভুত ভয় কাজ করছে—এই অনুসন্ধান কি তাকে আরও গভীর সমস্যার মধ্যে টেনে নিয়ে যাবে?

বাড়িতে ফিরে আসার পর রাতের অন্ধকার আবার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। এবার শ্রেয়া স্পষ্ট শুনল, কারও ফিসফিস করা শব্দ। “তুই কেন এসেছিস? এখান থেকে চলে যা…” যেন কোনও অদৃশ্য কেউ তাকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলছে। কিন্তু শ্রেয়া ঠিক করল, সে এখান থেকে সহজে যাবে না। সে এই রহস্যের শেষ দেখে ছাড়বেই।

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে শ্রেয়া আরও গভীরভাবে অনুসন্ধানে নামল, অর্জুনের ছবি, চিঠি, আর মায়ের ডায়েরির পাতাগুলো এখন তার পথের ইঙ্গিত দিচ্ছে। আর সেই ইঙ্গিতই তাকে নিয়ে যাবে আরও গভীর রহস্যের দিকে, যেখানে লুকিয়ে আছে তার মায়ের জীবনের এক অজানা অধ্যায়, আর হয়তো অর্জুনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনের সত্য।

বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - অনুভূতির ঢেউ: "অনুভূতির ঢেউ" একটি হৃদয়স্পর্শী রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে নন্দিনী ও জয়ন্তের স্বপ্ন, সম্পর্ক এবং দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালোবাসা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।

প্রারম্ভিক অনুসন্ধান

শ্রেয়ার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত কৌতূহল কাজ করছিল। “অর্জুন” নামটা যেন ঘুরে ঘুরে তাকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। তার মায়ের সঙ্গে এই মানুষের সম্পর্কটা ঠিক কী ছিল? কেন তিনি কোনওদিন অর্জুনের কথা বললেন না? মায়ের লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে এক গভীর দুঃখ আর অসমাপ্তির আভাস ছিল, যা শ্রেয়াকে না চাইতেও এই রহস্যে জড়িয়ে ফেলল।

এক দুপুরে, শ্রেয়া স্থানীয় লাইব্রেরিতে পৌঁছল। এই লাইব্রেরিটি একসময় তার মায়ের প্রিয় জায়গা ছিল, বিশেষ করে পুরনো খবরের কাগজ আর নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করার জন্য। লাইব্রেরির পুরনো, ধূলোমাখা বাতাস তার নাকে এসে লাগল। সে এক কোণায় বসে পুরনো খবরের কাগজের আর্কাইভে খুঁজতে শুরু করল। একটু কষ্ট করেই সে ১৯৮০ এর দশকের কিছু খবরের কাগজ খুঁজে বের করল, যেখানে “অর্জুন মজুমদার” নামে একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিল্পীর কথা উল্লেখ করা ছিল। অর্জুন তখন এক উদীয়মান প্রতিভা, যার ছবি শুধু স্থানীয় প্রদর্শনীতে নয়, কলকাতার বড় বড় গ্যালারিতেও প্রশংসিত হচ্ছিল।

কিন্তু হঠাৎ করেই তার নাম আর কাজের উল্লেখ খবরের কাগজ থেকে উধাও হয়ে যায়। এমন প্রতিভাবান শিল্পী কেন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন? শ্রেয়ার মন তখন আরও প্রশ্নে ভরে উঠল।

লাইব্রেরির মালিক, একজন বয়স্ক ব্যক্তি, তার চোখে পড়লেন। শ্রেয়া তার কাছে এগিয়ে গিয়ে অর্জুন সম্পর্কে জানতে চাইল।

“অর্জুন মজুমদার? ও, হ্যাঁ, আমি ওর কথা মনে করতে পারি,” বয়স্ক মানুষটি চিন্তা করে বললেন। “ও খুবই প্রতিভাবান ছিল। কিন্তু ও হঠাৎ করেই… হ্যাঁ, বলা যেতে পারে, নিখোঁজ হয়ে গেল।”

“নিখোঁজ?” শ্রেয়ার চোখে অবিশ্বাসের ছাপ ফুটে উঠল।

“হ্যাঁ, অনেকেই অনেক কথা বলত, কিন্তু কেউ ঠিক বলতে পারত না কী হয়েছিল। কেউ কেউ বলত ওর কোনও খারাপ লোকের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল, আবার কেউ বলত ও কোনও পুরনো অভিশপ্ত জমির ব্যাপারে কাজ করছিল। কিন্তু সত্যি কথা কী, সেটা আমি কখনো জানি না।”

এই কথাগুলো শুনে শ্রেয়ার মনের মধ্যে শীতল এক স্রোত বয়ে গেল। অর্জুনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কি সত্যিই কোনও গভীর রহস্য লুকিয়ে আছে?

শ্রেয়া আরও কিছু সময় ধরে খবরের কাগজের নথি ঘাঁটতে থাকল। সে আরও কিছু ছোট ছোট খবর পেল—কিছু স্থানীয় প্রদর্শনীতে অর্জুনের ছবির প্রদর্শনী বন্ধ হওয়া, তার শেষ প্রদর্শনীতে একটি অসম্পূর্ণ ছবি… তারপর আর কিছু নেই। তার নাম আর কোনও খবরের পাতায় নেই, না কোনও প্রদর্শনীতে।

শ্রেয়া লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটছিল, কিন্তু তার মাথার ভেতর অর্জুন আর তার মায়ের সম্পর্কের জটিলতা ঘুরছিল। অর্জুনের ছবি কি তার মায়ের জীবনের কোনও অসমাপ্ত অধ্যায়ের ইঙ্গিত বহন করে? আর কেনই বা তার মা কোনওদিন সেই সম্পর্কের কথা তাকে বলেননি?

রাতে বাড়িতে ফিরে এসে, শ্রেয়া মায়ের স্টুডিও ঘরে ঢুকল। সেই পুরনো, অসমাপ্ত ছবিগুলো এখনও যেন তার সামনে গল্প বলতে চাইছে। ঘরের এক কোণে সে আবার সেই ডায়েরিটা তুলে নিল। মায়ের হাতের লেখা কেমন যেন দুর্বল হয়ে এসেছিল শেষের দিকে। একাধিক পৃষ্ঠায় অর্জুনের কথা উল্লেখ ছিল। শ্রেয়া চুপচাপ বসে পড়ল, আর ডায়েরির পাতা ওলটাতে শুরু করল। এক জায়গায় মায়ের হাতের লেখা বন্ধ হয়, আর কেবলমাত্র আঁকিবুঁকি। 

আচমকা ঘরের বাতাস যেন ভারী হয়ে উঠল। জানালার পাশে একটা শীতল বাতাসের ঝাপটা এসে তার গায়ে লাগল। সে অনুভব করল, ঘরে যেন অদৃশ্য কেউ উপস্থিত আছে। তার পিঠের ওপর দিয়ে হিমেল একটা শিরশিরানি বয়ে গেল। সে জানালার বাইরে তাকাল, কিন্তু বাইরে ঘন অন্ধকারের মধ্যে কেবলমাত্র গাছের ছায়া। কোথাও কিছু নেই।

“তুই কি আমাকে কিছু বলতে চাস?” সে নিজেকেই জিজ্ঞেস করল। 

এক মুহূর্তের জন্য মনে হল, ঘরের বাতাসটা যেন জবাব দিতে চাইছে, কিন্তু শব্দহীন। ঘরটা যেন কিছু বলতে চাইছে, কিন্তু কি সেটা সে বুঝতে পারছিল না।

রাতের পরবর্তী সময়টা আরও অদ্ভুত হয়ে উঠল। শ্রেয়া শুয়ে ছিল, কিন্তু ঘুম আসছিল না। চোখ বন্ধ করলেই সে অর্জুনের ছবি দেখতে পাচ্ছিল—তার হাসি, তার গভীর দৃষ্টি। অর্জুন কি সত্যিই নিখোঁজ হয়েছেন, না আরও কোনও গভীর রহস্য তার পেছনে লুকিয়ে আছে?

পরের দিন সকালে, সে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, গ্রামের মানুষজন এই বিষয়ে কথা বলতে চাইল না। সবাই যেন অর্জুনের প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছিল। কয়েকজন সরাসরি বলল, “ওসব পুরনো কথা নিয়ে মাথা ঘামিও না, মেয়েটি। যা চলে গেছে, সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে লাভ নেই।”

কিন্তু কেন এমন অস্বস্তি? অর্জুনের সাথে কী ঘটেছিল, যা সবাই এড়িয়ে যেতে চাইছে?

শ্রেয়া ঠিক করল, সে এখানেই থামবে না। সে আরও গভীরে অনুসন্ধান করবে। অর্জুনের শেষ প্রদর্শনীর খবর সে খুঁজে বের করবে, আর সেই অসমাপ্ত ছবিগুলো কী ছিল, তা জানার চেষ্টা করবে। কিন্তু তার আগে, তাকে এই বাড়ির মায়ের স্টুডিও থেকে আরও কিছু খুঁজতে হবে।

বাড়িতে ফিরে এসে, সে স্টুডিও ঘরে ঢুকল আবার। এবার সে খুঁজতে শুরু করল দেয়ালের মধ্যে লুকানো কোনও চিহ্ন, কিছু পুরনো নথি, যেগুলো মায়ের জীবনের কোনও গোপন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিতে পারে। কিছুক্ষণ খুঁজে, সে এক পুরনো বাক্স খুঁজে পেল, যা এতদিন লুকানো ছিল মায়ের স্টুডিওর এক কোণে। বাক্সটি খুলতেই তার চোখে পড়ল একগুচ্ছ চিঠি, যেগুলো অর্জুনের হাতে লেখা ছিল।

শ্রেয়া চিঠিগুলো পড়তে শুরু করল। প্রত্যেকটি চিঠিতে এক গভীর সম্পর্কের ইঙ্গিত ছিল, যা তার মায়ের সঙ্গে অর্জুনের। চিঠির ভাষা ছিল কাব্যময়, আর এক অসম্পূর্ণ ভালোবাসার দুঃখবোধ ভরা। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটা ছিল শেষের দিকে—সেখানে অর্জুন লিখেছিলেন, “আমার কাজ প্রায় শেষ। যদি কিছু ঘটে যায়, আমার ছবিগুলো নিয়ে… তাদের সঠিক জায়গায় রেখে দিও।”

এই চিঠিটা পড়ে শ্রেয়ার মনে হল, অর্জুনের ছবি হয়তো তার মৃত্যুর চাবিকাঠি ধরে রেখেছে। তার শেষ কাজ কী ছিল? সে কী এমন কিছু আঁকছিল যা তার মৃত্যুর কারণ হতে পারে?

এই ভাবনাগুলো শ্রেয়ার মনের মধ্যে গভীরভাবে ঢুকে গেল। তার মা নিশ্চয়ই অর্জুনের শেষ কাজের কথা জানতেন, আর সেই কারণেই তার মায়ের মধ্যে এত দুঃখবোধ ছিল। কিন্তু কেন তার মা কখনও এই কথা বলেননি?

শ্রেয়া ঠিক করল, সে অর্জুনের শেষ প্রদর্শনীর সমস্ত নথি খুঁজবে। সেই অসমাপ্ত ছবিগুলোই হয়তো তার জিজ্ঞাসার উত্তর দিতে পারবে। 

ছায়ার সন্ধানে

শ্রেয়ার মনের ভিতর প্রতিটি মুহূর্ত যেন আরও কৌতূহল আর রহস্যে ভরে উঠছিল। অর্জুন মজুমদারের জীবন আর তার মায়ের সাথে সম্পর্কের জট খুলতে গিয়ে, সে নিজেই যেন এক রহস্যের কেন্দ্রে এসে পড়েছে। প্রতিটি ক্লু তাকে আরও গভীর এক অন্ধকারে টেনে নিচ্ছিল। অর্জুনের জীবন, তার ছবি, আর সেই অসমাপ্ত কাজ—এসবের মধ্যে কোনও অদ্ভুত সংযোগ যেন তার নিজের জীবনের সাথেও জড়িয়ে যাচ্ছে।

সেদিন সকালে, শ্রেয়া আরও কিছু তথ্য সংগ্রহের জন্য গ্রাম ঘুরতে বেরোল। স্থানীয় কিছু পুরনো বাসিন্দার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল সে। এঁদের মধ্যে অনেকেই বৃদ্ধ, শহর এবং গ্রামের ইতিহাসের সাক্ষী। হয়তো অর্জুনের জীবনের কিছু অজানা দিক এঁরা জানেন। 

প্রথমেই সে গেল রামলাল কাকুর বাড়ি, গ্রামের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ তিনি। লোকজন বলত, রামলাল কাকু অর্জুনের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তার বাড়ি ছিল সেই পুরনো বটগাছের তলায়, যেখান থেকে গ্রামের সবকিছু নজরে পড়ে। 

“রামলাল কাকু, আপনি কি অর্জুন মজুমদারকে চিনতেন?” শ্রেয়া তার সামনে গিয়ে সপ্রশ্নভাবে জিজ্ঞেস করল।

রামলাল কাকু একবার তার দিকে চেয়ে নীরব হয়ে গেলেন। তার চোখের মধ্যে পুরনো স্মৃতির ছায়া স্পষ্ট হয়ে উঠল। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তিনি আস্তে করে বললেন, “অর্জুন… হ্যাঁ, আমি তাকে চিনতাম। সে ছিল এক অদ্ভুত মানুষ, খুব প্রতিভাবান। তার আঁকা ছবির মধ্যে এমন এক রহস্য ছিল, যা সবাইকে মুগ্ধ করত। কিন্তু এক সময়… সবকিছু বদলে গেল। তার জীবন যেন এক অন্ধকারে হারিয়ে গেল।”

শ্রেয়ার মনের ভেতর আরও প্রশ্ন ভিড় জমাতে থাকল। “কিন্তু কী এমন ঘটেছিল? কেন তার জীবন এমন এক অদ্ভুত মোড় নিল?”

রামলাল কাকু নিঃশ্বাস ফেললেন। “এই গল্পের অনেক দিক আছে। কেউ বলে সে এক নিষিদ্ধ জমির ওপর কাজ করছিল, আবার কেউ বলে তার ছবি কোনও পুরনো অভিশাপ বয়ে এনেছিল। কিন্তু আমার বিশ্বাস, তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র ছিল। সে অনেক কিছু জানত, যা কারও কারও পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।”

“কী ষড়যন্ত্র?” শ্রেয়া উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“ওর শেষ ছবি,” কাকু ফিসফিস করে বললেন, “ওটাই সবকিছুর চাবিকাঠি হতে পারে। ও সেই ছবিতে এমন কিছু আঁকছিল যা সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। তার পর থেকে ওর জীবন বদলে গেল। কেউ কেউ বলত, ছবিটা অসমাপ্ত ছিল। কিন্তু আমি জানি, ও হয়তো তার জীবন দিয়ে সেই ছবি সম্পূর্ণ করেছে।”

শ্রেয়ার মনের মধ্যে একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল। এই কথাগুলো যেন সত্যিই অর্জুনের রহস্যময় জীবনের গভীরে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই অসমাপ্ত ছবি—এটা কি সত্যিই কোনও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে? অর্জুন কি এমন কিছু আঁকছিল, যা তাকে ধ্বংস করে দিয়েছে?

রামলাল কাকুর কাছ থেকে ফিরে আসার পথে, শ্রেয়া আরও কিছু পুরনো বাসিন্দার সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিল। তারা অর্জুনকে চিনত, কিন্তু সবাই যেন এ বিষয়ে কথা বলতে কুণ্ঠিত ছিল। কেউ স্পষ্টভাবে কিছু বলছিল না, আবার কেউ কথা এড়িয়ে যাচ্ছিল। 

এক বৃদ্ধ মহিলা, মীনা মাসি, তার কাছে এসে চুপিসারে বললেন, “ও মেয়েটা, তুমি যতটুকু জানতে চাইছো, ততটুকু জানা নিরাপদ নয়। ওর শেষ কাজটা অনেকের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যদি তুমি সত্যিই জানতে চাও, তবে সাবধান থেকো।”

মীনা মাসির কথাগুলো যেন এক অদ্ভুত সতর্কবার্তা ছিল। কেন সবাই এত ভয় পাচ্ছে? অর্জুনের ছবি কি সত্যিই কোনও বিপদ ডেকে এনেছিল?

শ্রেয়া বাড়িতে ফিরে এসে স্টুডিওর দিকে তাকিয়ে দেখল। সে জানত, এই জায়গায় তার মায়ের স্মৃতি আর অর্জুনের রহস্যময় ছবি লুকিয়ে আছে। তার মায়ের সাথে অর্জুনের সম্পর্কের কথা কোনওদিন প্রকাশ্যে আসেনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছিল, তার মায়ের জীবনের সঙ্গে অর্জুনের শেষ কাজের কোনও অদ্ভুত সংযোগ ছিল।

সে সেই পুরনো বাক্সটা আবার খুলল। চিঠিগুলো আর একবার পড়তে গিয়ে তার মনে হল, অর্জুন তার জীবনের শেষ মুহূর্তে যেন এই চিঠিগুলোতে কোনও বিশেষ বার্তা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু কী সেই বার্তা? চিঠিগুলোর ভাষা ছিল একেবারে দুর্বোধ্য আর কাব্যময়, যেন কোনও রহস্যের আভাস দিয়ে যাচ্ছে। 

তারপর হঠাৎই একটা চিঠিতে তার চোখ আটকাল। সেখানে লেখা ছিল, “আমি হয়তো খুব কাছে এসে গেছি। যদি কিছু ঘটে যায়, আমার শেষ কাজটা দেখে নিও। আমি যা আঁকছি, সেটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ।”

শ্রেয়ার মন যেন স্থির হয়ে গেল। অর্জুনের শেষ ছবি—এই ছবি কি সত্যিই তার নিখোঁজ হওয়ার কারণ হতে পারে? ছবিটা কোথায়? সেটা কি তার মায়ের কাছে ছিল? আর সেই ছবিতে কী এমন ছিল, যা অর্জুনকে ধ্বংস করে দিল?

শ্রেয়া ঠিক করল, সে এই ছবির খোঁজ করবে। হয়তো সেই ছবির মাধ্যমেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে তাকে আরও কিছু তথ্য সংগ্রহ করতে হবে।

এই রহস্যের পিছনে অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে, আর শ্রেয়া জানত, সে থামতে পারবে না। এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। অর্জুনের শেষ কাজ আর তার মায়ের অসমাপ্ত সম্পর্ক—এই দুটো জিনিস তাকে একটি বড় ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে।

শ্রেয়া মনে মনে ঠিক করল, সে আরও গভীরে অনুসন্ধান করবে। অর্জুনের ছবির রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে, তাকে আরও কয়েকটি সূত্র খুঁজে বের করতে হবে। আর সে জানত, এই অনুসন্ধান সহজ হবে না। 

কিন্তু সে প্রস্তুত ছিল। তার সামনে আরও অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। অর্জুনের জীবন, তার শেষ ছবি, আর এই রহস্যময় ষড়যন্ত্র—সবকিছুই যেন একে একে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। 

তবে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন থেকে গেল—এই রহস্যের পর্দা ফাঁস করতে গেলে শ্রেয়ার নিজের জীবনের ওপরও কি কোনও বিপদ আসতে পারে? 

অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - জীবনপথের সন্ধানে: মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প: সঞ্জয়ের আত্ম-উদ্বোধন এবং নতুন জীবন শুরু করার যাত্রা। অনুপ্রেরণা এবং বিশ্বাসের মাধ্যমে জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার একটি সাফল্যমণ্ডিত গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন। 

বাড়ির রহস্য

শ্রেয়ার জীবনে যেন এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। অর্জুন মজুমদারের রহস্যময় জীবন নিয়ে যতই সে ঘাঁটছে, ততই যেন তাকে আরও গভীর এক অন্ধকারে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মায়ের পুরনো বাড়িতে ফিরে আসার পর থেকেই সবকিছু বদলে যেতে শুরু করেছে। বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি কোণ যেন কোনও না কোনও অতীতের গল্প তুলে ধরছে। 

রাত গভীর হলেই বাড়িতে ফিসফিস করার মতো অদ্ভুত সব শব্দ শোনা যায়। প্রথমদিকে শ্রেয়া ভাবত, হয়তো এসব তার মনের ভুল। কিন্তু দিন যত গড়াতে লাগল, সে বুঝল যে এই বাড়িতে কিছু একটা আছে, যা তাকে অর্জুনের অতীতের সাথে গভীরভাবে যুক্ত করছে।

একদিন গভীর রাতে, যখন সমস্ত বাড়িটা নিস্তব্ধ, তখন হঠাৎ করে শ্রেয়ার ঘরের জানালা দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। সে ঘুমিয়ে ছিল না। তার মন ছিল এক অস্থির ভাবনার মধ্যে নিমজ্জিত। আচমকা শূন্য থেকে যেন কোনও ফিসফিস শব্দ শোনা গেল—একটা অচেনা কণ্ঠস্বর, যা তাকে ডাকছিল। ঘরটায় অন্ধকারের মাঝে যেন ছায়ামত কিছু নড়াচড়া করছে। 

শ্রেয়া একটু ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু ভয়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মনে কৌতূহলও বাড়ছিল। সে অনুভব করল যে এই বাড়িতে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা অর্জুনের জীবনের কোনও অজানা অধ্যায়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। 

পরের দিন সকালে, সে বাড়ির পুরনো ঘরগুলোর মধ্যে একটাতে ঢুকল, যেটা অনেকদিন ধরে বন্ধ ছিল। সেই ঘরটায় প্রচুর পুরনো জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। বড় বড় ধূলিমাখা বাক্স, পুরনো আসবাবপত্র, আর দেওয়ালে কয়েকটা ফ্রেমে বাঁধাই করা পুরনো ছবি। 

শ্রেয়ার নজর পড়ল একটা পুরনো বাক্সের দিকে, যেটা অন্য বাক্সগুলোর থেকে বেশ আলাদা। বাক্সটা অনেক বড়, আর তার গায়ে পুরনো নকশা আঁকা। সে যখন বাক্সটা খুলল, তার ভেতরে বেশ কিছু পুরনো বই, চিঠি, আর ডায়েরি দেখতে পেল। 

একটা ডায়েরি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ডায়েরিটা ছিল তার মায়ের লেখা। ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠায় বড় করে লেখা ছিল, “আমার স্মৃতি ও অনুভূতি—রূপালী।” শ্রেয়ার মা, রূপালী, কখনও এ বিষয়ে কিছু বলেননি। কিন্তু ডায়েরিটা খুলতেই শ্রেয়া বুঝল যে তার মায়ের জীবনের কিছু অজানা অধ্যায় এখানে লুকিয়ে আছে।

ডায়েরির পাতা উল্টাতে উল্টাতে শ্রেয়ার চোখে জল চলে এল। তার মা এমন অনেক কিছু লিখেছেন, যা শ্রেয়া কখনও ভাবেনি। অর্জুনের সাথে তার মায়ের গভীর সম্পর্কের কথা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে লাগল। রূপালী লিখেছেন, “অর্জুনকে প্রথম দেখার পর থেকেই তার চোখের গভীরতার মধ্যে আমি হারিয়ে যাই। তার প্রতিটি কথা যেন আমার মনের গোপন সুরকে ছুঁয়ে যায়। সে এক অদ্ভুত মানুষ, তার ছবি, তার চিন্তাধারা, সবকিছুতেই যেন এক রহস্যময় জগৎ লুকিয়ে আছে।”

শ্রেয়া ধীরে ধীরে বুঝতে পারল, তার মায়ের আর অর্জুনের সম্পর্কটা শুধু বন্ধুত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা একে অপরের প্রতি গভীর ভালবাসা অনুভব করত। কিন্তু কেন এই সম্পর্ক গোপন ছিল? কেন তার মা কখনও এ কথা প্রকাশ করেননি? 

ডায়েরির আরও পাতায় লেখাগুলো যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠছিল। সেখানে অর্জুনের শেষ কাজের কথাও উল্লেখ ছিল। তার মা লিখেছিলেন, “অর্জুনের শেষ ছবিটা সে খুব যত্ন নিয়ে আঁকছিল। ও বলেছিল, এই ছবিটা শুধু একটা শিল্পকর্ম নয়, এটা একটা জীবনের প্রতিফলন। ছবিটা যদি সম্পূর্ণ হয়, তবে ওর জীবনেও সবকিছু বদলে যাবে।”

শ্রেয়ার মনে হল, এই ছবিটাই হয়তো অর্জুনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনও ভূমিকা রেখেছে। সেই ছবির মধ্যে এমন কিছু লুকিয়ে আছে, যা সবাইকে হতভম্ব করে দিয়েছিল। 

কিন্তু সেই ছবি কোথায়? আর কেন অর্জুনের জীবন এমন অদ্ভুত মোড় নিল? 

শ্রেয়া ভাবতে ভাবতে ডায়েরির আরও পাতা উল্টাতে লাগল। হঠাৎ সে একটা পুরনো খামের ভেতরে একটা চিঠি পেল। চিঠিটা অর্জুন লিখেছিল তার মাকে। সেখানে লেখা ছিল, “রূপালী, যদি কিছু ঘটে যায়, তবে তুমি জানবে কোথায় খুঁজতে হবে। ছবিটা আমার সবচেয়ে বড় কাজ, কিন্তু সেটা অসমাপ্ত থাকলে আমার জীবনও অসম্পূর্ণ থাকবে। তুমি শুধু জানবে, কোথায় শেষ করতে হবে।”

চিঠিটা পড়ে শ্রেয়ার মন আরও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। এই চিঠির অর্থ কী? তার মা কি জানতেন সেই ছবির ব্যাপারে? অর্জুনের শেষ ছবি কি কোথাও লুকিয়ে আছে?

শ্রেয়া বুঝল, তাকে এই রহস্যের আরও গভীরে যেতে হবে। ছবিটা খুঁজে বের করতে হবে, কারণ সেটাই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। 

বাড়ির প্রতিটি ঘর যেন তাকে একটা নতুন ক্লু দিচ্ছিল। প্রতিটি ছায়া, প্রতিটি ফিসফিস আওয়াজ যেন অতীতের কোনও গল্পের সন্ধান দিতে চাচ্ছিল। শ্রেয়া জানত, সে আরও বড় কিছু সামনে পেতে চলেছে। অর্জুনের জীবনের অদেখা অধ্যায় আর তার মায়ের গোপন অতীত—সবকিছুই যেন একসূত্রে গাঁথা।

এই বাড়ির দেয়ালগুলো যেন সবকিছু জানত, কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই সত্যগুলো কীভাবে প্রকাশিত হবে? 

শ্রেয়া ডায়েরিটা বন্ধ করে আবার বাক্সের মধ্যে রেখে দিল। তার সামনে ছিল আরও বড় রহস্য। 

এই রহস্যের সমাধান পেতে হলে তাকে আরও অনেক পথ চলতে হবে। তার সামনে অপেক্ষা করছে এক বিপজ্জনক জগৎ, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপই এক নতুন বিপদের মুখোমুখি হবে। 

কিন্তু শ্রেয়া ভয় পাচ্ছিল না। সে জানত, এই রহস্যের সমাধান তাকে করতেই হবে। অর্জুনের শেষ কাজ, তার মায়ের অতীত, আর এই বাড়ির গোপন গল্প—সবকিছুই তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আরও গভীর এক অন্ধকারে। 

তবু সে থামবে না। এই গল্পের শেষটা দেখতে হলে তাকে সবকিছু জানতেই হবে। 

অতীতের ছায়া

শ্রেয়ার মাথাটা যেন এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে আছে। তার মায়ের ডায়েরি আর অর্জুনের চিঠি থেকে যা জানতে পারল, তা তাকে এক অজানা অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তার মায়ের জীবন—যা এতদিন সে সাধারণ বলে মনে করত—আজ তাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে চিনতে বাধ্য করছে। 

ডায়েরির পাতায় লেখা অর্জুনের সাথে রূপালীর সম্পর্কের গভীরতা, সেই অসমাপ্ত ছবি, আর অর্জুনের নিখোঁজ হওয়া—সবকিছু যেন একে অপরের সাথে জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু শ্রেয়া এখনো বুঝতে পারছে না কীভাবে এই রহস্যের গিঁট খুলবে। 

চিঠিটা আবার হাতে নিয়ে সে পড়ল—“রূপালী, যদি কিছু ঘটে যায়, তবে তুমি জানবে কোথায় খুঁজতে হবে।” 

কিন্তু কোথায়? অর্জুন কি কোনও রহস্যময় ইঙ্গিত রেখে গেছেন, যা রূপালী জানতেন কিন্তু প্রকাশ করেননি? শ্রেয়া অনুভব করল, তাকে আরও গভীরে যেতে হবে। এই রহস্যের সমাধান শুধু ডায়েরি বা চিঠির মধ্যে নেই, বরং অর্জুনের আঁকা সেই শেষ ছবিতেই লুকিয়ে আছে। কিন্তু সেই ছবিটা কোথায়?

শ্রেয়া বাড়ির প্রতিটি ঘরে, প্রতিটি কোণে তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল। দেওয়ালের পুরনো ফ্রেমে বাঁধা ছবিগুলোর দিকে সে ভাল করে তাকাল। অর্জুনের আঁকা কোনো ছবি কি এখানে আছে? নাকি অন্য কোথাও লুকানো আছে?

বাড়ির দোতলায় এক পরিত্যক্ত ঘর ছিল, যা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ ছিল। সেই ঘরটার দরজার সামনে এসে শ্রেয়ার হাত একটু কাঁপল। ছোটবেলায় সে শুনেছিল, এই ঘরে নাকি তার মা কোনও এক সময় কাজ করতেন, কিন্তু তারপরে দরজাটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। 

শ্রেয়া দরজার তালাটা খুলে ভেতরে ঢুকল। ধুলোর গন্ধে তার নাক জ্বালা করল, কিন্তু তার মনটা উত্তেজনায় ভরে উঠল। ঘরের ভেতরটা যেন বহুদিনের পুরনো স্মৃতিতে ঠাসা ছিল। মেঝেতে পুরনো কাপড়ের ওপর ক্যানভাসগুলো একটার পর একটা পড়ে ছিল। শ্রেয়ার মন বলল, হয়তো এখানে কিছু লুকানো আছে।

সে একটি বড় কাপড়ের টুকরো সরিয়ে ফেলল এবং নিচে থাকা একটা ক্যানভাস দেখতে পেল। সেটা ধুলোতে ঢেকে ছিল, কিন্তু ছবিটার কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। 

ক্যানভাসটা তুলে নিতেই শ্রেয়ার বুক ধক্ করে উঠল। এটাই সেই শেষ ছবি। অর্জুনের অসমাপ্ত সৃষ্টি। 

কিন্তু ছবিটা কেমন যেন অদ্ভুত ছিল। একটা বড় নীল আকাশের নিচে একটা খালি মাঠ, তার মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের অবয়ব। সেই মানুষের মুখটা স্পষ্ট ছিল না, যেন অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে গেছে। ছবি দেখতে যতই সহজ মনে হোক, তার ভেতরে কোনও গভীর অর্থ লুকিয়ে ছিল। 

শ্রেয়া ছবিটার দিকে আরও একবার ভাল করে তাকাল। হঠাৎ তার চোখে পড়ল, ছবির নিচের দিকে কিছু ছোট ছোট প্রতীক আঁকা আছে। প্রথমে সে বুঝতে পারছিল না সেগুলো কী হতে পারে, কিন্তু প্রতীকগুলো যেন তাকে কোনও রহস্যময় ইঙ্গিত দিচ্ছিল। এগুলো কি কোনও প্রাচীন লিপি? নাকি অর্জুন নিজের কোনও গোপন ভাষা তৈরি করেছিলেন?

শ্রেয়ার মনে পড়ল, ডায়েরির এক জায়গায় রূপালী লিখেছিলেন, “অর্জুনের ছবি শুধু একটা শিল্পকর্ম নয়, সেটা একটা জীবনের প্রতিফলন। তিনি তার প্রতিটি ছবিতে কিছু না কিছু লুকিয়ে রাখতেন, যা শুধু তার কাছের মানুষরা বুঝতে পারত।” 

এখন শ্রেয়ার মনে প্রশ্ন জাগছে—এই প্রতীকগুলো কি কোনও গোপন তথ্য প্রকাশ করছে? ছবিটার অর্ধেক অসমাপ্ত, কিন্তু প্রতীকগুলো সম্পূর্ণ ছিল। 

শ্রেয়া আর দ্বিধা না করে ছবিটা তুলে নিল এবং বাড়ির বাইরে নিয়ে এল। ছবিটা সূর্যের আলোয় ভাল করে দেখতে পেয়ে তার মনের মধ্যে একটা নতুন ইঙ্গিত জাগল। ছবির প্রতীকগুলো কিছুটা পরিচিত মনে হচ্ছিল, কিন্তু কোথায় দেখেছে সে?

সে ঠিক করল, প্রতীকগুলো নিয়ে গবেষণা করতে হবে। তার এক পুরনো বন্ধু, রোহিত, ইতিহাসের ছাত্র ছিল এবং প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করত। রোহিত অনেক পুরনো লিপি এবং প্রতীকের ব্যাখ্যা করতে পারত। হয়তো সে কিছু সাহায্য করতে পারবে। 

শ্রেয়া রোহিতকে ফোন করল এবং সবকিছু খুলে বলল। রোহিত প্রথমে অবাক হলেও তারপর বেশ উৎসাহিত হয়ে উঠল। “তুমি ছবিটা নিয়ে আসো। আমি দেখে বলতে পারব এগুলো কিসের প্রতীক,” রোহিত বলল।

শ্রেয়া সেই সন্ধ্যাতেই রোহিতের কাছে গিয়ে ছবিটা দেখাল। রোহিত প্রথমে কিছুক্ষণ ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর প্রতীকগুলো ভাল করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। 

“এগুলো প্রাচীন কোনো প্রতীক বলে মনে হচ্ছে,” রোহিত বলল। “কিন্তু আমি নিশ্চিত না। এর সাথে কোনও পুরনো সাংকেতিক ভাষার যোগ থাকতে পারে। তবে পুরো বিষয়টা বিশ্লেষণ করতে হলে আমাকে আরও সময় লাগবে।” 

শ্রেয়া অস্থির হয়ে উঠছিল, কিন্তু সে জানত যে এই রহস্যের সমাধান একদিনে হবে না। তাকে ধৈর্য ধরতে হবে, এবং প্রতিটি ধাপ খুব সতর্কতার সাথে নিতে হবে। 

রোহিত বলল, “তুমি চিন্তা করো না। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই প্রতীকগুলো ডিকোড করার চেষ্টা করব। তুমি বাড়িতে গিয়ে আপাতত অপেক্ষা করো। আর একটা কথা—তোমার মা সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করো। আমি মনে করি, এই প্রতীকগুলোর সঙ্গে তার জীবনের কোনও সম্পর্ক আছে।”

শ্রেয়া বুঝল, এই রহস্যের মূল তার মায়ের অতীতে লুকিয়ে আছে। অর্জুনের ছবির মাধ্যমে তার মা তাকে কোনও বার্তা দিতে চেয়েছিলেন। সেই বার্তা খুঁজে পেতে হলে তাকে আরও গভীরভাবে অতীতে ফিরে যেতে হবে।

রাত গভীর হল, কিন্তু শ্রেয়ার মনে ঘূর্ণিঝড় চলতে থাকল। সে জানত, রোহিত প্রতীকগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সে কী করবে? তার মায়ের অতীতের এমন কোন অধ্যায় আছে যা সে জানে না? 

শ্রেয়া অনুভব করল, বাড়িটাই তার কাছে সবকিছু খুলে দেবে। বাড়ির প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি দরজা তাকে একটা নতুন রহস্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু সে জানত, সামনে আরও বড় বিপদ অপেক্ষা করছে। 

পরদিন সকালে সে আবার সেই পুরনো ঘরটায় গেল, যেখানে সে ছবিটা খুঁজে পেয়েছিল। এবার তার নজর পড়ল ঘরের কোণায় রাখা একটা পুরনো বাক্সের দিকে, যা সে আগের দিন খেয়াল করেনি। 

বাক্সটা খুলে সে একটা ছোট চামড়ার পুঁটলি পেল। পুঁটলিটার ভেতরে কয়েকটা পুরনো চাবি, আর একটা ছোট কাগজের টুকরো। কাগজে লেখা ছিল, “শেষটা এখানেই লুকিয়ে আছে।”

শ্রেয়ার মন ছটফট করতে লাগল। এ কাগজে অর্জুনের হাতের লেখা ছিল। কিন্তু কোথায় শেষ লুকিয়ে আছে? চাবিগুলোর মধ্যে কোনটার জন্য এই বার্তা ছিল? 

সবকিছু যেন আরও জটিল হয়ে উঠছিল, কিন্তু শ্রেয়া জানত, সে সঠিক পথে চলছে। 

সত্যের মুখোমুখি

শ্রেয়া চোখের সামনে থাকা কাগজের টুকরো আর চাবিগুলো বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল। ছোট চামড়ার পুঁটলিটা তার হাতে ছিল, কিন্তু তার মাথার ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল। অর্জুনের বার্তাটা যেন একদিকে স্পষ্ট, আবার অন্যদিকে রহস্যময়। “শেষটা এখানেই লুকিয়ে আছে”—কিন্তু কোথায়?

শ্রেয়া মনস্থির করল, তাকে অর্জুন আর তার মায়ের জীবন নিয়ে আরও গভীরে যেতে হবে। এই রহস্যের শেষ অংশটি কোনও সাধারণ চাবি দিয়ে খোলা যাবে না। তাকে নিজের মনের সমস্ত দ্বিধা সরিয়ে রেখে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।

রোহিতের কাছে থেকে কোনও খবর না পাওয়া পর্যন্ত শ্রেয়ার অপেক্ষা করার উপায় ছিল না। সে সিদ্ধান্ত নিল যে অর্জুনের আঁকা ছবিগুলোর ওপর আরও গবেষণা করতে হবে। বাড়ির মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা ক্যানভাসগুলো আবারও একবার ভাল করে দেখে নিতে লাগল। প্রতিটি ছবির পেছনে যেন একটা লুকানো ইঙ্গিত আছে, কিন্তু ঠিক কোন ছবি তার জন্য শেষ সূত্রটা দেবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

ঘরের কোণার দিকে রাখা একটা পুরনো ট্রাংক তার নজরে পড়ল। ট্রাংকটার ওপরের চাবিটা অনেকদিন ধরেই মরিচা ধরে গেছে। শ্রেয়া ভাবল, হয়তো এই চাবিগুলোর কোনোটা সেই ট্রাংকের তালা খুলতে পারে। সে তাড়াতাড়ি পুঁটলি থেকে চাবিগুলো বের করে ট্রাংকের তালায় লাগাল। কয়েকবার চেষ্টার পর একটি চাবি ঘুরল, আর ধীরে ধীরে তালাটা খুলে গেল।

ট্রাংকের ভেতরে ছিল পুরনো কিছু কাগজপত্র, কিছু নোটবুক আর কয়েকটি ফাইল। শ্রেয়া সাবধানে সেগুলো বের করে দেখতে লাগল। পুরনো কাগজগুলো থেকে মৃদু নীল কালি ঝলমল করে উঠল, আর সেখানে লেখা ছিল কিছু নাম আর ঠিকানা। অর্জুনের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি হতে পারে এগুলো। নোটবুকের ভেতরেই লেখা ছিল কিছু অজানা ইঙ্গিত। 

কিন্তু হঠাৎই একটা ফাইলের মধ্যে থেকে একটা হলদে হয়ে যাওয়া পুরনো চিঠি বেরিয়ে এল। চিঠিটা খুলতেই অর্জুনের হাতে লেখা কিছু শব্দ চোখে পড়ল। “রূপালী, আমি জানি সময় কম। তাদের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। আমি সব কিছু রেখে গেছি এখানে, তবে তারা আমাকে খুঁজে বের করবে। তোমাকে সাবধান থাকতে হবে। যদি সত্যি জানতে চাও, সেটা খুঁজে পাবে আমার শেষ ছবিতে।”

শ্রেয়ার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল। এই চিঠির ইঙ্গিতটা এতদিন লুকিয়ে ছিল! অর্জুনের শেষ ছবিটা কোথায়? সে তো ছবিটা পেয়েছে, কিন্তু সেটা কি অসমাপ্ত ছিল? নাকি ছবিটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তার নিখোঁজ হওয়ার রহস্য?

চিঠির বাকিটা পড়ে শ্রেয়া বুঝল, অর্জুনের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কিছু স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তির হাত ছিল, যারা তার শিল্পকর্মের গোপনীয়তা ভাঙতে চেয়েছিল। অর্জুনের প্রতিভা আর সৃজনশীলতা ছিল এমন এক রহস্যময় সম্পদ, যা অনেকেই হাতছাড়া করতে চায়নি। কিন্তু সেই শক্তিধর লোকেরা কখনই অর্জুনের সৃজনশীলতাকে পুরোপুরি বশে আনতে পারেনি। অর্জুন পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তাদের কাছে হেরে গিয়েছিল।

শ্রেয়ার মনে হল, এই প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তার মায়ের জীবনকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তার মা রূপালী কি অর্জুনকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন? নাকি তিনি নিজেও কোনওভাবে এই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন?

শ্রেয়া অনুভব করল, তার মায়ের জীবন এতটা সরল ছিল না। অর্জুনের সাথে তার সম্পর্ক শুধু ভালোবাসার নয়, বরং একটা গভীর ষড়যন্ত্রের আবর্তে ছিল। তার মা সম্ভবত অর্জুনকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেই প্রভাবশালীরা তাদের দুজনকেই নষ্ট করে দিয়েছিল।

শ্রেয়া জানত, তাকে এই সত্যটা পুরোপুরি উন্মোচন করতে হবে। অর্জুনের শেষ ছবিটার ভেতরেই হয়তো লুকিয়ে আছে সেই চূড়ান্ত রহস্য। 

ছবিটা আবারও সে ভাল করে দেখতে লাগল। প্রতীকগুলো আর ছবির ভেতরের ইঙ্গিতগুলো যেন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। রোহিত এই প্রতীকগুলোর কিছুটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছিল, কিন্তু পুরো রহস্য এখনো অধরা। 

সে ঠিক করল, তাকে সেই জায়গায় যেতে হবে যেখানে অর্জুন তার শেষ দিনগুলো কাটিয়েছিলেন। হয়তো সেই জায়গাতেই রয়েছে অর্জুনের শেষ ইঙ্গিত। ছবির প্রতীকগুলো থেকে মনে হল, এটা কোনও পুরনো পরিত্যক্ত বাড়ি হতে পারে, যেখানে অর্জুন তার ছবি আঁকতেন।

শ্রেয়া তার মায়ের ডায়েরি থেকে একটা ঠিকানা পেয়েছিল, যা বহুদিন ধরে ভুলে যাওয়া হয়েছিল। সেই ঠিকানার কথাই অর্জুন তার চিঠিতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। 

পরের দিন সকালে শ্রেয়া সেই পুরনো ঠিকানার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। জায়গাটা শহরের প্রান্তে ছিল, যেখানে আজও প্রায় কিছুই বদলায়নি। ছোট ছোট গলি, পুরনো বাড়ি আর অবহেলিত রাস্তাঘাট। সেই পুরনো বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল শ্রেয়া, যেটা তার মায়ের ডায়েরিতে লেখা ছিল।

বাড়িটা ছিল সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত, জানালার কাঁচ ভাঙা, দেয়ালের প্লাস্টার খসে পড়েছে। কিন্তু বাড়ির ভেতরটা দেখতে গিয়ে শ্রেয়ার মনে হল, এখানে একসময় কোনও বড় ঘটনার সাক্ষী ছিল এই জায়গা। 

বাড়ির ভেতরে ঢুকে সে খুঁজতে লাগল সেই বিশেষ কিছু, যা তাকে অর্জুনের শেষ ছবির রহস্য উন্মোচনে সাহায্য করবে। বাড়ির এক কোণায়, পুরনো কাঠের মেঝের নিচে একটা ছোট্ট দরজা দেখতে পেল সে। 

দরজাটা খুলতেই তার চোখে পড়ল একটা ছোট্ট ঘর, যার দেয়ালে টাঙানো ছিল অর্জুনের আঁকা আরও কয়েকটি ছবি। ছবিগুলো যেন একটার পর একটা কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছিল। কিন্তু এই ঘরের ভেতর একটা ক্যানভাস ছিল, যা দেখে শ্রেয়ার মন ছটফট করে উঠল।

এটাই ছিল সেই শেষ ছবি, যা অর্জুন সম্পূর্ণ করতে পারেনি। ছবিটার অর্ধেক আঁকা ছিল, আর বাকি অর্ধেক যেন ইচ্ছে করেই অসমাপ্ত রাখা হয়েছে। 

ছবির সামনে দাঁড়িয়ে শ্রেয়ার মনে হল, সে সত্যের খুব কাছে এসে পড়েছে। কিন্তু এটাই কি শেষ? নাকি এর পেছনে আরও কিছু লুকিয়ে আছে?

নতুন শুরু

শ্রেয়া একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল ছবিটার দিকে। অর্জুনের আঁকা অসমাপ্ত ছবিটা তার সামনে ছিল, যেন একটি অমীমাংসিত কাহিনির শেষ ইঙ্গিত। ছবির প্রতিটি স্ট্রোকে অর্জুনের যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠেছে—তাকে বুঝতে পারা এতদিনের একটা অদ্ভুত অনুভূতি যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল।

ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল দুটি মানুষের অবয়ব। প্রথমে তারা যেন দুইজন আলাদা ব্যক্তি, কিন্তু কাছ থেকে দেখলে বোঝা যায়, তারা একে অপরের দিকে ঝুঁকে আছে—তাদের মাঝে ছিল এক অদৃশ্য বন্ধন। শ্রেয়া হঠাৎই অনুভব করল, এরা আসলে তার মা রূপালী এবং অর্জুন। ছবিটা হয়তো অসমাপ্ত ছিল, কিন্তু এতে লুকানো ছিল সেই সম্পর্কের গভীরতা, যা এতদিন চাপা পড়ে ছিল, অজানা ছিল।

অর্জুনের চিঠি, তার আঁকা ছবি, আর মায়ের পুরনো ডায়েরি—সবকিছু মিলে যেন একটি গল্পের শেষ টুকরোটা পেয়েছিল শ্রেয়া। সে উপলব্ধি করল, তার মা রূপালী আর অর্জুন একে অপরকে ভালোবেসেছিলেন, কিন্তু সমাজের চাপে সেই সম্পর্ক কখনও প্রকাশ পায়নি। তাদের ভালোবাসা ছিল নিষিদ্ধ, একটি অসম্পূর্ণ অধ্যায়, যা পূর্ণতা পেতে পারেনি। 

কিন্তু কেন? কি এমন ঘটেছিল, যা তাদেরকে আলাদা করেছিল?

শ্রেয়া ডায়েরির শেষ কিছু পৃষ্ঠা দ্রুত পড়তে শুরু করল। সেখানে লেখা ছিল মায়ের যন্ত্রণার কথা, কিভাবে অর্জুনের জন্য সে কেঁদেছিল, কিভাবে সমাজের প্রভাবশালী লোকেরা তাদের সম্পর্কের কথা জানতে পেরে তাদের ওপর চাপ তৈরি করেছিল। অর্জুনের সৃজনশীলতাকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য তারা তাকে নিঃশেষ করে দিতে চেয়েছিল, কারণ তার শিল্পে ছিল এমন কিছু, যা তাদের ক্ষমতার ওপর আঘাত হানতে পারত।

রূপালী অর্জুনকে রক্ষা করতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই সময় সমাজের চোখে তাদের সম্পর্ক গ্রহণযোগ্য ছিল না। অর্জুনের শিল্প ছিল তার জীবনের মূল ভিত্তি, আর সেই শিল্পকর্মই তাকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গিয়েছিল। 

শ্রেয়ার বুকের ভেতরটা হাহাকার করে উঠল। তার মা যে এতটা কষ্ট পেয়েছিল, এতটা ত্যাগ স্বীকার করেছিল, তা সে কখনো ভাবতেই পারেনি। অর্জুনের শিল্পকর্ম এবং তার মায়ের সম্পর্ককে রক্ষা করার চেষ্টা, তাদের দুজনের এই আত্মত্যাগ তাকে স্তব্ধ করে দিল। 

কিন্তু এই সত্যটা জানা সত্ত্বেও, শ্রেয়া বুঝল, তাকে এখন সামনে এগিয়ে যেতে হবে। অর্জুন এবং তার মায়ের গল্প একটা অধ্যায়ের শেষ, কিন্তু তার নিজের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হতে চলেছে। অতীতের ছায়াগুলোকে পেছনে ফেলে নতুন করে শুরু করা তার একমাত্র পথ।

সেই রাতে শ্রেয়া ঘুমোতে পারছিল না। তার মনের মধ্যে বারবার ফিরে আসছিল অর্জুনের কথা, তার মায়ের কথা, তাদের অসম্পূর্ণ ভালোবাসা। এতকিছু জানার পরেও তার ভেতরে একটা অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে। সে জানত, এখন তার জীবনের প্রতিটি সিদ্ধান্ত নতুন আলোকে হবে।

পরের দিন সকালে, শ্রেয়া পুরনো বাড়িটা থেকে বেরিয়ে এল। মায়ের ডায়েরি আর অর্জুনের শেষ ছবিটা সঙ্গে নিয়ে সে বাড়ির দরজায় তালা লাগাল। তার মনে হচ্ছিল, অতীতের এই অধ্যায়কে আজ শেষ করতে পেরে সে যেন হালকা হয়ে গেছে। অর্জুনের গল্পের শেষ, তার মায়ের অসম্পূর্ণ ভালোবাসা, সবকিছুই যেন এক অমীমাংসিত রহস্যের মতো ছিল, কিন্তু এখন সেই রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। 

শ্রেয়া শহরে ফিরে আসার পর, রোহিতের সাথে দেখা করল। রোহিত তার পাশে বসে ছিল, কিন্তু শ্রেয়া বুঝতে পারছিল, আজ তাদের কথা বলার কোনো দরকার নেই। সে শুধু চুপচাপ বসে ছিল, মাথায় হাত রেখে ভাবছিল, কিভাবে তার মায়ের জীবনের এই গভীর সত্যটা এতদিন আড়ালে ছিল। 

রোহিত ধীরে ধীরে বলল, “শ্রেয়া, তুমি এখন কি করবে?”

শ্রেয়া মৃদু হেসে বলল, “আমি জানি না, রোহিত। কিন্তু একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি—আমার মায়ের জীবন যেমন ছিল, অর্জুনের জীবন যেমন ছিল, তারা দুজনই তাদের ভালোবাসা আর সৃজনশীলতার জন্য লড়াই করেছে। আমি তাদের পথ অনুসরণ করব, কিন্তু আমি অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগোব। আমার জীবনটা নতুন করে শুরু করতে হবে।”

রোহিতের মুখে এক গম্ভীর অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। সে বলল, “তাহলে তুমি মায়ের সব কিছু মেনে নিয়েছ?”

শ্রেয়া মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, আমি মেনে নিয়েছি। আমার মা যে ত্যাগ করেছে, সেই ত্যাগের গভীরতা আমি এখন বুঝতে পেরেছি। কিন্তু তার জীবনের সত্যটা আমাকে পাল্টে দিয়েছে। আমি এখন জানি, আমাকে নিজের পথ খুঁজে নিতে হবে।”

বাংলা ছোট গল্প - নিঃশব্দ মুক্তি: "নিঃশব্দ মুক্তি" একটি বাংলা ছোট গল্প যেখানে থালিয়া, একজন নির্যাতিত স্ত্রী, ফুটবল আসক্ত স্বামী মার্কের অত্যাচারের শৃঙ্খল ভেঙে নিজের ও মেয়ে গাব্বির জন্য নতুন জীবনের সন্ধান করে। গল্পটি সমাজের অন্ধকার বাস্তবতা ও সাহসিকতার মাধ্যমে নারীর মুক্তির পথে যাত্রাকে তুলে ধরে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন। 

কয়েক মাস পরে, শ্রেয়া একটি নতুন ছবি প্রদর্শনীতে অংশ নিল। তার ছবিগুলোতে ছিল এক নতুন আলো, এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। তার শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে তার মায়ের গল্প, অর্জুনের অসমাপ্ত স্বপ্ন, আর তার নিজের জীবনের নতুন দিশা। 

প্রদর্শনীর দিন সে জানত, তার মায়ের মতো সেও একদিন হারিয়ে যাবে, কিন্তু তার শিল্প থেকে যাবে। অতীতের সেই সমস্ত যন্ত্রণা, সেই লড়াই, সবকিছুই আজ তার ছবি হয়ে উঠেছে। তার ছবির প্রতিটি স্ট্রোকে ছিল সেই অতীতের গভীরতা, কিন্তু সাথে ছিল ভবিষ্যতের আলোর ইঙ্গিত।

রোহিত সেই দিন প্রদর্শনীতে এসে তাকে বলল, “তুমি যা তৈরি করেছ, তা অবিশ্বাস্য। অর্জুন যদি বেঁচে থাকত, সে গর্বিত হত।”

শ্রেয়া মৃদু হেসে বলল, “আমি জানি, অর্জুন হয়তো বেঁচে থাকলে এমন কিছুই বলত না। সে চুপচাপ তার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকত। কিন্তু আমি তার অসম্পূর্ণ কাজটাকে আমার নিজের মতো করে পূর্ণ করেছি। এটা আমার নতুন শুরু।”

শ্রেয়া জানত, তার মায়ের সাথে তার নতুন এক সংযোগ তৈরি হয়েছে। মায়ের সেই যন্ত্রণার গল্প, অর্জুনের শিল্পের আড়ালে থাকা গল্প—সবকিছুই আজ তার নিজের জীবনের অংশ। সে এখন অতীতের সমস্ত ছায়াকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে প্রস্তুত।

এই রহস্যের সমাপ্তি তার নিজের জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। অতীতের সব ব্যথা, সব রহস্য আজ মুছে গেছে, আর সে এখন তার নিজের পরিচয় খুঁজে পেয়েছে। 

শ্রেয়া জানত, ভবিষ্যতেও তার জীবনে অনেক রহস্য, অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন থাকবে। কিন্তু আজ সে নতুন করে শুরু করতে প্রস্তুত, অতীতের সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্ত হয়ে। 

এই রকম চিত্তাকর্ষক বাংলা ছোট গল্প -এর আপডেট পেতে আমাদের WhatsApp চ্যানেল জয়েন করুন।

About The Author

নতুন বাংলা ছোট গল্প

আত্মার মুক্তি

এক ভুতের গল্পে সোহিনী আত্মার মুক্তির সন্ধানে অন্ধকার শক্তির সাথে লড়াই করে। এই বাংলা ছোট গল্পটি ভয়ের ছায়া এবং সাহসিকতার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

এক ভুতের গল্পে সোহিনী আত্মার মুক্তির সন্ধানে অন্ধকার শক্তির সাথে লড়াই করে। এই বাংলা ছোট গল্পটি ভয়ের ছায়া এবং সাহসিকতার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: আত্মার মুক্তি

অমীমাংসিত রহস্য

অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

অমীমাংসিত রহস্য নিয়ে এক অনন্য বাংলা ছোট গল্প, যেখানে অতীতের গোপন সত্য উন্মোচনে শ্রেয়ার যাত্রা রহস্য ও রোমাঞ্চে ভরা। রহস্য রোমাঞ্চ প্রেমীদের জন্য আদর্শ পাঠ।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অমীমাংসিত রহস্য

অনুভূতির ঢেউ

"অনুভূতির ঢেউ" একটি হৃদয়স্পর্শী রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে নন্দিনী ও জয়ন্তের স্বপ্ন, সম্পর্ক এবং দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালোবাসা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন।

"অনুভূতির ঢেউ" একটি হৃদয়স্পর্শী রোমান্টিক বাংলা ছোট গল্প, যেখানে নন্দিনী ও জয়ন্তের স্বপ্ন, সম্পর্ক এবং দূরত্বের মধ্যে গড়ে ওঠা ভালোবাসা সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায় তাদের জীবন।

সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়ুন: অনুভূতির ঢেউ

Leave a Comment

অনুলিপি নিষিদ্ধ!