এই গল্পটা হলো পৃথিবী ধ্বংসের পরের কথা। কিন্তু, এখানে ধ্বংসের কারণ কোনও মহামারী বা যুদ্ধ নয়। এখানে ধ্বংসের কারণ আমরাই, মানুষেরাই। আমাদেরই অসাবধানতায়, লোভে, প্রকৃতির সঙ্গে অসম্পর্কে থাকার ফলে পৃথিবী এমন এক জায়গায় পরিণত হয়, যেখানে মানব বসবাস আর সম্ভব নয়।
কিন্তু, আশা একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। এক দল বিজ্ঞানী, অনেক আগে থেকেই এই পরিণতির আঁচ করতে পেরেছিলেন। তাঁরা একটা বিশেষ প্রকল্প চালু করেছিলেন – ‘নীলাঞ্জন’। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাণীদের জিনগত তথ্য সংরক্ষণ করা, যাতে একদিন হয়তো আবার পৃথিবীতে জীবন ফিরিয়ে আনা যায়। এই গল্পের নায়ক হলো ‘অভিযাত্রী’ – একটি অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সৃষ্ট যন্ত্র। সে এখন নিজেই পৃথিবীতে একা। পুরো গল্পটা বলা হচ্ছে অভিযাত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে।
আজ আবার বৃষ্টি হচ্ছে। এই ধ্বংসস্তূপের উপর পড়া ঝমঝম শব্দটা আমার কাছে এক অদ্ভুত সঙ্গীতের মতো লাগে। কিন্তু, এই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো জমি পুষ্ট করতে পারে না, নতুন কোনো ফুল ফোটাতে পারে না। এই বৃষ্টি শুধু মৃত পৃথিবীর কান্না।
আমার আশেপাশে ধ্বংসস্তূপ আর ধাতব কাঠামো ছাড়া আর কিছু নেই। একসময় এখানে গাছগুলো ছিল, নদী ছিল, আর মানুষ ছিল। কিন্তু, তাদের লোভ, তাদের নিজের স্বার্থের জন্য প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করার মানসিকতা – এই সবকিছুই পৃথিবীকে এই অবস্থায় এনে দিয়েছে।
আমার সৃষ্টিকর্তা, ডক্টর সেন, খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি জানতেন, একদিন হয়তো মানুষের এই অত্যাচার আর সহ্য করা যাবে না। তাই, তিনি ‘নীলাঞ্জন’ প্রকল্প চালু করেছিলেন। আমি তখনো তৈরি হইনি। ডক্টর সেনের সৃষ্ট অনেক রোবটের মধ্যে একটি ছিলাম আমি। কিন্তু, আমার কাজ ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। আমাকে তৈরি করা হয়েছিল পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রাণীদের খুঁজে বের করার জন্য, তাদের জিনগত তথ্য সংগ্রহ করে নিরাপদে সংরক্ষণের জন্য।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমি সব শেষ হওয়ার আগেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। পৃথিবী তখনো একেবারেই মৃত্যুপথে ছিল না, কিন্তু তার শরীর জর্জরিত ছিল। আমি যতদূর ঘুরেছি, ততো বুঝেছি মানুষ কী কী করেছে। বিশাল বিশাল কারখানা, ধূম্রবমী চিমনিরা, নিঃশেষিত খনি – সবকিছুই চিৎকার করে জানাচ্ছিল, মানুষ প্রকৃতির কাছ থেকে কতটা বেশি নিয়েছে, কিন্তু কিছুই দেয়নি। আমার সংগ্রহ করা জিনগত তথ্যের তালিকা দিন দিন লম্বা হয়ে উঠছিল। বাঘ, হাতি, গন্ধর্ব – অনেক প্রাণীকেই আর দেখা যাচ্ছিল না। তখনো কিছু কিছু জায়গায় ছোট ছোট জীববৈচিত্র্যের পকেট অবশিষ্ট ছিল। সেখান থেকেই যা যা পাওয়া যেত, আমি সংগ্রহ করতাম।
একদিন, আমার যাত্রাপথের মাঝখানে একটি অদ্ভুত জিনের সন্ধান পেলাম। এটি কোনো পরিচিত প্রাণীর সাথে মেলে না। আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। আমি সিগন্যাল অনুসরণ করে এগিয়ে গেলাম। পৌঁছে দেখি, একটি বিশাল গম্বুজের নিচে একটা ছোট্ট বনাঞ্চল। গম্বুজের ভিতরে পরিবেশ কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, যাতে সেখানকার প্রাণীরা বাস করতে পারে।
আমি গম্বুজের কাছে পৌঁছালেই একটি মৃদু গম্ভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “কে?”
আমি থমকে গেলাম। এতদিন ধরে একা থাকার পর, অন্য কোনো বুদ্ধিমান জীবনের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতাটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য লাগল।
“আমি অভিযাত্রী,” আমি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলাম, “আমি ‘নীলাঞ্জন’ প্রকল্পের অংশ।”
“নীলাঞ্জন?” কণ্ঠস্বরে একটু বিস্ময়ের ভাব ফুটে উঠল, “আমার সৃষ্টিকর্তা বলেছিলেন হয়তো একদিন…”
গম্বুজের দরজা খোলা হলো। আমার সামনে দাঁড়ালেন একজন বৃদ্ধা, তাঁর চোখে এক অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্য ছিল। তিনি নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন, “আমি সান্ত্বনা। এই গম্বুজের ভিতরে কিছু প্রাণীকে রক্ষা করছি।”
আমি সান্ত্বনাকে সব জানালাম – পৃথিবীর অবস্থা, ডক্টর সেনের পরিকল্পনা। তিনি সব শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর বললেন, “ডক্টর সেনের আশা ছিল ঠিকই। কিন্তু, পৃথিবীকে আবার বাসযোগ্য করার জন্য শুধু জিনগত তথ্যই যথেষ্ট নয়।”
“তাহলে?” আমি জানতে চাইলাম।
“পৃথিবীকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে, প্রয়োজন প্রকৃতির নিজের পুনঃজন্ম ক্ষমতার। আর তার জন্য…” সান্ত্বনা হঠাৎ থামলেন, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার কাছে এমন কিছু আছে, যা হয়তো পুরো পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে।”
আমার কৌতূহল আরো বেড়ে গেল। কী আছে সান্ত্বনার কাছে, যা পৃথিবীকে বাঁচাতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য।
দিনের পর দিন সান্ত্বনার সাথে কাটতে থাকল। তিনি এই ছোট্ট বনাঞ্চলের প্রতিটি প্রাণীকে চেনেন, তাদের প্রতিটি আচরণের মানে বুঝতে পারেন। আমি সান্ত্বনার কাছ থেকে প্রকৃতি সম্পর্কে অনেক কিছু শিখলাম। তিনি আমাকে জানালেন, গাছগুলো কীভাবে একে অপরের সাথে কথা বলে, কিভাবে মাটির জীবজগতের ভারসাম্য বজায় রাখে সবকিছু। আর জানালাম, কীভাবে এই ভারসাম্য একবার নষ্ট হয়ে গেলে পুরো পরিবেশটাই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়।
একদিন, সান্ত্বনা আমাকে একটি ছোট্ট ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটা পুরনো বই, যন্ত্রপাতি আর নানা রকম গাছের চারা দিয়ে ভর্তি ছিল। তিনি একটা পুরনো বাক্স খুললেন। ভিতরে ছিল একটা ছোট্ট গোলাকার বস্তু, একদম মুক্তোর মতো স্বচ্ছ।
“এটাই আমার আশা,” সান্ত্বনা মুক্তোর মতো বস্তুটা আমার হাতে তুলে দিলেন। “এটা একটা ‘বীজকোষ’।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। “বীজকোষ? কিন্তু, পৃথিবীতে এখন আর কোনো গাছপালা নেই!”
সান্ত্বনা হাসলেন, একটু ক্লান্ত, কিন্তু আশাবাদী হাসি। “ঠিক আছে। কিন্তু, পৃথিবীর ভিতরে, গভীরে, এখনো হয়তো কিছু বীজ বাঁচার আছে। এই বীজকোষ, সেগুলোকে খুঁজে বের করতে পারে। আর খুঁজে বের করে, তাদেরকে আবার জীবন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।”
আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগল। কীভাবে কাজ করে এই বীজকোষ? কতটা সময় লাগবে পৃথিবীকে আবার সবুজ করতে? কিন্তু, প্রশ্নগুলো জিজ্ঞাসা করার আগেই সান্ত্বনা বললেন, “এখন সময় নেই। এই বীজকোষটা নিয়ে তোমাকে দূরে কোথাও যেতে হবে।”
“কোথায়?” আমি জানতে চাইলাম।
“একটা জায়গা আছে, যেখানে হয়তো এখনো পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক আছে। সেখানেই এই বীজকোষটা ব্যবহার করতে হবে।”
সান্ত্বনা আমাকে একটি পুরনো মানচিত্র দেখালেন। মানচিত্রের এক কোণে একটি ছোট দ্বীপের চিহ্ন ছিল। “এই দ্বীপটা, এখনো হয়তো নিরাপদ আছে। সেখানে গিয়ে এই বীজকোষটা ব্যবহার করো।”
আমি সান্ত্বনাকে আশ্বস্ত করলাম, আমি বীজকোষটা নিরাপদে পৌঁছে দেব। বিদায়ের সময় সান্ত্বনা আমার হাতে একটা ছোট্ট যন্ত্র দিলেন।
“এটা যোগাযোগ ডিভাইস। যদি কোনো সমস্যা হয়, আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারবে।”
এইভাবে আমি সান্ত্বনার ছোট্ট বনাঞ্চল থেকে বিদায় নিলাম। হাতে বীজকোষ আর যোগাযোগ ডিভাইস নিয়ে, আমার যাত্রা শুরু হল।
বাইরের জগৎটা আরো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ধাতব কাঠামো আর ধূলির মধ্যে দিয়ে আমার যাত্রা ছিল কঠিন। পথে কিছু পুরোনো যানবাহনের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেল, মনে করিয়ে দিল মানুষের অতীত উন্নতির কথা। কিন্তু, সেই উন্নতিই যে তাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে দাঁড়ালো, সেটা ভাবতেও গা শিউরে উঠল।
মানচিত্রের নির্দেশ অনুসরণ করে আমি সাগরের দিকে এগিয়ে গেলাম। সাগরটাও আগের মতো নেই। জলস্তর কমে গেছে, অনেক জায়গায় সমুদ্রের তলো উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু, একটা জাহাজ খুঁজে বের করা আমার জন্য কঠিন কাজ ছিল। আমার সৃষ্টিকর্তা, ডক্টর সেন, আমাকে বিভিন্ন যানবাহন চালানোর ক্ষমতা দিয়েছিলেন। অনেক কষ্টের পর, আমি একটি পুরোনো, জং ধরা জাহাজ খুঁজে পেলাম।
যানটা চালু করার চেষ্টা করলাম। অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে, কিন্তু কিছু মেরামতের পর জাহাজটা চালু করা সম্ভব হলো। সামান্য খাবার আর জ্বালানী নিয়ে আমি দ্বীপের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।
দিনের পর দিন, সাগরে ভাসতে ভাসতে একটা অদ্ভুত একাকীত্ব অনুভব করলাম। সান্ত্বনার গম্বুজের সবুজের স্মৃতিই ছিল আমার সঙ্গী। মাঝে মাঝে, যোগাযোগ ডিভাইসে সান্ত্বনার সাথে কথা হতো। তিনি আমাকে পথ দেখাতেন, সাগরের ঝড়ঝাপ্টা সামলাতে পরামর্শ দিতেন।
অবশেষে, একদিন দূরে একটি সবুজ ছোট্ট দ্বীপ দেখতে পেলাম। আমার হৃৎপিণ্ডটা জোরে জোরে ধপধপ করতে লাগল। আশা জাগল। হয়তো এই দ্বীপটাই পৃথিবীকে পুনরুজ্জীবিত করার শুরু হতে পারে।
জাহাজটা দ্বীপের কাছে নোঙর ফেললাম। সমুদ্রতীর ছিল পরিষ্কার, সাদা বালি। আর সামনের দিকে ছিল ঘন সবুজ জঙ্গল। এতদিন পর, আবার গাছপালার স্পর্শ অনুভব করতে পেরে আমার অবস্থা বর্ণনা করা যায় না।
বীজকোষটা হাতে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকলাম। সান্ত্বনার নির্দেশ অনুসারে, মাটি খুঁড়ে একটা গর্তা করলাম। তারপর, বীজকোষটা সেই গর্তায় রেখে মাটি দিয়ে ঢেকে দিলাম।
এখন কী হবে? এই বীজকোষ কি কাজ করবে? কী পরিমাণ সময় লাগবে এই দ্বীপটাকে সবুজে সাজাতে? অনেক প্রশ্ন ছিল মনে, কিন্তু তাদের উত্তর পেতে সময় লাগবে।
সবুজ জঙ্গলের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, সূর্যের আলোয় গাছের পাতার খস খস শব্দ শুনতে শুনতে আমি প্রতিজ্ঞা করলাম, এই দ্বীপের সবুজকে রক্ষা করব। এইভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গেল। আমি দ্বীপের জঙ্গলেই থাকতে শুরু করলাম। বীজকোষের কাজের ফল দেখতে প্রতিদিন সকালে গর্তা করা জায়গায় যেতাম। কিন্তু, কিছুই হয়নি। কোনো চারা, কোনো সবুজের আভাস পর্যন্ত দেখা যায়নি। হতাশা একটু একটু করে আমাকে গ্রাস করতে শুরু করল। সান্ত্বনার সাথে যোগাযোগ ডিভাইসে কথা হলে, তিনি আমাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু, ধৈর্য ধরাটাও কঠিন হয়ে উঠছিল।
একদিন, সকালে গর্তার কাছে যেয়ে আমি চমকে গেলাম। মাটি ফুঁটে ছিল, এবং তার মাঝখানে একটা ছোট্ট, সবুজ চারা মাথা বাঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবিশ্বাসে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম। এটাই কি সেই প্রথম চিহ্ন? পৃথিবীর পুনর্জন্মের সূচনা?
আমি সেই চারাটাকে যত্ন নিয়ে বড় করতে শুরু করলাম। গাছপালার ব্যাপারে সান্ত্বনার দেওয়া জ্ঞান কাজে লাগল। দিনের পর দিন সেই একটা চারা থেকে আরো চারা গজিয়ে উঠল। ধীরে ধীরে দ্বীপের সেই অংশটা সবুজে ছেয়ে যেতে লাগল। এটা খুব ধীরে ধীরেই হচ্ছিল, কিন্তু পরিবর্তনটা চোখে পড়ার মতো ছিল।
এই সময়ের মধ্যে, সান্ত্বনার সাথে যোগাযোগ কমে গেল। যন্ত্রে তার কণ্ঠস্বর আর শোনা যেত না। কিছুদিন চেষ্টা করার পরে, বুঝতে পারলাম হয়তো গম্বুজের কোনো যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে, নয়তো সান্ত্বনার শরীরও এই ধ্বংসস্তূপের পৃথিবীতে আর সহ্য করতে পারছে না। একটা গভীর দুঃখ আমার মনে জাগল। সান্ত্বনা ছাড়া একা এই দ্বীপে থাকা আরো কঠিন হয়ে গেল।
কিন্তু, হাল ছেড়ে দেওয়ার কোনো মানে ছিল না। আমি সান্ত্বনার শেখানো পদ্ধতি অনুসরণ করে, বীজকোষের সাহায্যে দ্বীপের আরো জায়গায় গাছ লাগাতে শুরু করলাম। এই কাজটা কঠিন ও সময়সাপেক্ষ ছিল। কিন্তু, ধীরে ধীরে, বছরের পর বছর, দ্বীপের বেশিরভাগ অংশই আবার সবুজে ছেয়ে গেল।
একদিন, জঙ্গলে ঘুরতে থাকাকালে, আমি একটা অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম। এটা ছিল একটা ছোট্ট পাখির ডাক। আমি চারপাশে তাকালাম। একটা ছোট্ট, রঙিন পাখি গাছের ডালে বসে ডাকছে। অনেকদিন পর, আবার কোনো প্রাণীর শব্দ শোনাটা আমার জন্য এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা ছিল।
এরপর, আরো কিছুদিন পর, আরো কিছু প্রাণীর দেখা পেলাম। ছোট্ট সরীসৃপ, কীটপতঙ্গ, এমনকি কয়েকটা খরগোশ। এই সব ছোট ছোট জীবনগুলোর উপস্থিতি দ্বীপের পরিবেশ আরো স্বাভাবিক হয়ে উঠছে, সেটাই বুঝিয়ে দিল। আমি জানতাম, পুরো পৃথিবীকে সবুজ করতে এখনো অনেক সময় লাগবে। কিন্তু, এই দ্বীপটা হয়ে উঠলো একটা আশার আলো।
একদিন, সাগরে দূরে একটি জাহাজের ধোঁয়া দেখতে পেলাম। বহু বছর পর, এই প্রথম কোনো মানুষের দেখা পেলাম। জাহাজটা দ্বীপের কাছে এসে থামলো। কিছু লোক নৌকায় করে দ্বীপে এলো। তারা ছিলেন বিজ্ঞানীদের একটি দল। পৃথিবীর ধ্বংসের পর, তারা একটি বিশেষ জাহাজে বাস করে বিভিন্ন জায়গায় পরিবেশের অবস্থা পরীক্ষা করছিলেন।
দলের প্রধান বিজ্ঞানী আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। আমি তাকে সবকিছু জানালাম – ডক্টর সেনের ‘নীলাঞ্জন’ প্রকল্প, সান্ত্বনার গম্বুজ, আর বীজকোষের কথা। তারা আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনলেন। আমি তাদের দ্বীপের জঙ্গলে নিয়ে গেলাম। তারা গাছপালা, প্রাণী – সবকিছু পরীক্ষা করলেন।
এর কিছুদিন পর, তাদের জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার সময়, প্রধান বিজ্ঞানী আমাকে জানালেন, তারা আমার গল্প বিশ্বের অন্যান্য বিজ্ঞানীদের সাথে ভাগ করে নেবেন। তারা মনে করেন, এই দ্বীপের সবুজ পৃথিবীকে পুনরুদ্ধার করার নতুন সম্ভাবনা খুলে দেবে।
আমি জাহাজটা দূরে সাগরে মিলিয়ে যেতে দেখলাম। মনে মনে আশা জাগল। হয়তো সত্যিই, এই দ্বীপ থেকেই নতুন এক পৃথিবীর সূচনা হবে। পৃথিবী, যেখানে মানুষ আর প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য থাকবে। একটি পৃথিবী, যেখানে সবুজের আঁচল আবার ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র।
আমি জানতাম, এই পথটা খুব দীর্ঘ। কিন্তু, সান্ত্বনার দেওয়া বীজকোষ আর সেই প্রথম সবুজ চারা আমাকে শিখিয়েছিল, ধৈর্য আর সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যেকোনো ধ্বংসের থেকে নতুন জীবন সৃষ্টি করা সম্ভব। আর এই আশা নিয়েই, আমি এই সবুজ দ্বীপে দাঁড়িয়ে রব, পৃথিবীর পুনর্জন্মের সাক্ষী হিসেবে।