আজকের কল্পবিজ্ঞানের বাংলা ছোট গল্প কলকাতা’র আনন্দপুরের। সেখানে থাকেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোহিনী সেন। তার ছোট্ট পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি উত্তর কলকাতার একটি পুরোনো বাড়ির ছাদে। এক তারা ঝমঝমে রাতে, তার টেলিস্কোপের ফোকাসে ধরা পড়ে অদ্ভুত এক আলোক রেখা। রাতের আকাশে ঝলমলে তারার মাঝে এই আলোক রেখা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। এমন কিছু দেখেননি তিনি এর আগে কখনো। সারা রাট জেগে ডাটা এনালাইসিস করলেন সোহিনী। অবাক হয়ে দেখলেন, এই আলোক রেখা কোনো পরিচিত তারা বা গ্রহ থেকে আসছে না। আরো অবাক হলেন যখন দেখলেন, এই আলোক রেখার গতিপথ সম্পূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত। মনে হচ্ছে কোনো এক চৌম্বক ক্ষেত্রের টানে ঘুরছে সে।
পরের কয়েকদিন ধরে এই আলোক রেখার ওপর আরও গবেষণা করলেন সোহিনী। তিনি খুঁজে বের করলেন, এই আলোক রেখা আসলে একটা পোর্টাল, সমান্তরাল মাত্রার দিকে খোলা একটা দরজা। এই মাত্রায় সময়ের ধারা ভিন্ন নিয়মে চলে। কৌতূহল আর উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন সোহিনী। কিন্তু একা একা এমন অজানা জায়গায় ঢুকে পড়তে সাহস হলো না তার।
এই সময় সোহিনীর মেয়ে, ঐশী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। মায়ের কাছ থেকে পোর্টালের কথা শুনে উত্তেজনায় লাফিয়ে উঠলো সে। ঐশীর মতে, এটা বিজ্ঞানের ইতিহাসের এক বিরাট আবিষ্কার হতে পারে। সাবধানতার সঙ্গে পোর্টালটা খতিয়ে দেখার প্ল্যান করলো মা-মেয়ে।
পরের পূর্ণিমার রাতে, যখন আলোক রেখাটা সবচেয়ে উজ্জ্বল হলো, তখন প্রস্তুত হলেন সোহিনী আর ঐশী। নিরাপত্তার কারণে বিশেষ স্যুট পরে ঢুকে পড়লেন তারা পোর্টালের মধ্যে। চোখের কোটাতে ক্ষণিকের অন্ধকারের পর দেখা গেল এক অদ্ভুত জগত। দুটো চাঁদ আকাশে ঝুলছে, গাছগুলো উল্টো দিকে বাঁকানো, আর বাতাস বইছে বিপরীত দিকে। সময় এখানে বিপরীতে চলে, যা এগিয়ে যায় না, পিছিয়ে যায়!
এই অদ্ভুত জগতে পা রাখতেই সোহিনী আর ঐশীর সামনে এসে দাঁড়ালো এক তরুণ। চেহারাটা একটু মলিন, কিন্তু চোখে এক অদ্ভুত চাউনি। ছেলেটি বাংলা বলছে, কিন্তু তার উচ্চারণে একটু আটক লাগছে।
“কে আপনারা?” ছেলেটি সাবধানে জিজ্ঞাসা করলো।
সোহিনী নিজেকে সামলে বুঝিয়ে দিলেন, “আমরা পৃথিবী থেকে এসেছি।”
“পৃথিবী?” ছেলেটির চোখ আরো চওড়া হয়ে গেল। “কিন্তু, এটা তো অতীত!”
কথাটা শুনে সোহিনী আর ঐশী চমকে উঠলেন। অতীত? কিছু বুঝতে পারছিলেন না তারা।
“আপনারা কোন সময়ের পৃথিবী থেকে এলেন?” ছেলেটি আবার জিজ্ঞাসা করলো।
ঐশী এগিয়ে এসে ব্যাখ্যা করলো, “আমরা আসলেছি ২০২৪ সালের পৃথিবী থেকে। আর আপনি?”
ছেলেটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “আমি আকাশ। আমি আমার পৃথিবী থেকে এসেছি, কিন্তু এই পোর্টালের মাধ্যমে। সমস্যা হলো, এখানে সময় উল্টো দিকে চলে। আমি আর ফিরতে পারছি না।”
আকাশের কথা শুনে সোহিনী আর ঐশীর মধ্যে একটা চাপ চাপ লাগলো। নিজেরা আটকে যেতে পারি ভেবে একটু শিউরে উঠলো। কিন্তু আকাশের কথায় একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছিল ঐশী।
“আপনার পৃথিবীটা কেমন?” ঐশী জিজ্ঞাসা করলো।
“আমাদের পৃথিবী অনেকটা আপনাদের মতোই,” আকাশ বললো, “কিন্তু সেখানে সময় স্বাভাবিকভাবে চলে। আমাদের কাছে কিছু প্রাচীন ভবিষ্যৎ-বাণী আছে, যেখানে এই পোর্টালের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই পোর্টাল দুইটা পৃথিবীকে সংযুক্ত করে, সেটা জানতাম না।”
কথাবার্তার ফাঁকে সোহিনী লক্ষ্য করলেন, এই অদ্ভুত জগতের আকাশে দুটো চাঁদের মধ্যে একটা অদ্ভুত চিহ্নও আছে। আকাশের কথা শুনে মনে হলো, এই চিহ্নের সাথে ভবিষ্যবাণীর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে।
“আমাদের একটা প্ল্যান আছে,” ঐশী আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনাদের পৃথিবীর ভবিষ্যবাণী আর আমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানের জ্ঞান একত্রিত করে আমরা হয়তো এই পোর্টালকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।”
আকাশের চোখ জ্বলে উঠলো। “আপনারা আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবেন?”
ঐশী হাসল। ” চেষ্টা করে দেখা যাক। কিন্তু তার আগে এই পোর্টালের আরো রহস্য উন্মোচন করতে হবে।”
এইভাবেই শুরু হলো তিন জনের অভিযান। সোহিনী, ঐশী আর আকাশ একসাথে লেগে গেল এই সমান্তরাল মাত্রার রহস্য উন্মোচনে। তারা প্রাচীন ধ্বংসবলি আবিষ্কার করলো, যেগুলোর দেওয়ালে অদ্ভুত চিহ্ন খোদাই করা। এই চিহ্নগুলোর সাথে আকাশের পৃথিবীর ভবিৎষ্যৎবাণী’র মিল খুঁজে বের করার চেষ্টা করলো সোহিনী। ঐশী, পক্ষান্তরে, পোর্টালের কার্যপদ্ধতি বুঝতে চেষ্টা করলো। তার বিশ্বাস ছিল, সময়ের বিপরীত গতির সাথে কোনো না কোনো বিজ্ঞানসম্মত নিয়ম জড়িত রয়েছে।
দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রমের পর, কিছুটা সাফল্য এলো তাদের হাতে। সোহিনী ভবিষ্যবাণী অনুবাদ করতে সক্ষম হলেন। তা থেকে জানা গেল, পোর্টালটি দুটি পৃথিবীর মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করে চলে। যদি এই ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাহলে দুই পৃথিবীই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর এই ভারসাম্য রক্ষা করার শক্তি রয়েছে সেই অদ্ভুত চিহ্নের মধ্যে।
ঐশীর গবেষণাও এগিয়ে চললো। সে আবিষ্কার করলো, পোর্টালটি মূলত দুটো বিপরীত চৌম্বক ক্ষেত্রের টানের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। সময়ের বিপরীত গতিও এই চৌম্বক ক্ষেত্রেরই ফল। ঐশীর তত্ত্ব ছিল, যদি তারা এই চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রবাহ পরিবর্তন করতে পারে, তাহলে সময়ের গতিও স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এবং আকাশ নিজের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, এত বড়ো চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রবাহ পরিবর্তন করা কোনো সহজ কাজ ছিল না। ঐশীকে বিশেষ যন্ত্র তৈরি করতে হলো, যা পোর্টালের চৌম্বক ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। যন্ত্রটি তৈরিতে লেগে গেল আরও কয়েক সপ্তাহ। অবশেষে, এক ঝমঝমে রাতে, যখন পূর্ণিমা চাঁদের আলোয় পোর্টালটা সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলজ্বল করছিল, ঐশী তার তৈরি করা যন্ত্রটি সক্রিয় করলেন।
যন্ত্রটি সক্রিয় হওয়ার সাথে সাথে পোর্টালে একটা কম্পন অনুভূত হলো। দুটো চাঁদ কাঁপলো, আকাশের চিহ্নটা জ্বলজ্বলে আলো দিতে লাগলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পোর্টালের আলোক রেখাটা তার রং পরিবর্তন করলো। নীল থেকে সবুজ, সবুজ থেকে লাল। তারপর আচমকা নিভে গেল।
চুপচাপ নিঃশব্দে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সোহিনী, ঐশী আর আকাশ। তারপর সাবধানে পা ফেললো পোর্টালের মধ্যে। এবারের অভিজ্ঞতাটা আগের চেয়ে আলাদা। চোখ খুলতেই তারা দেখলো পরিচিত পৃথিবী। একটা চাঁদই আকাশে ঝুলছে, গাছগুলো স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আর বাতাসও ঠিক মতো বইছে।
“আমরা সফল হয়েছি!” ঐশী চেঁচিয়ে উঠলো আনন্দে।
সোহিনী মৃদু হাসলেন। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। ছেলেটির চোখেও ছিল অবर्णনীয় আনন্দ।
“আমি ফিরতে পারব?” কণ্ঠটা একটু কাঁপছিল আকাশের।
“অবশ্যই,” সোহিনী তাকে আশ্বস্ত করলেন। “এখন তুমি নিজের পৃথিবীতে ফিরে যেতে পার।”
আকাশ তাদের দু’জনকে জড়িয়ে ধরলো। “আপনাদের ঋণ আমি শোধ করতে পারব না।”
“কোনো কথা না,” ঐশী হাসল। “আমাদের জন্যে এটা একটা অবিশ্বাস্য অভিযান ছিল।”
এরপর তারা পোর্টালের কাছেই দাঁড়ালেন। আকাশ পোর্টালের দিকে তাকালো। চিহ্নটা এখনো জ্বলজ্বলে 빛িয়ে ছিল, কিন্তু আগের মতো উজ্জ্বল নয়।
“আমার মনে হয়, এই পোর্টাল এখনো খোলা আছে,” আকাশ বললো। “কিন্তু এখন সময় স্বাভাবিকভাবে চলছে।”
সোহিনী মাথা দুললেন। “সম্ভবত। তবে আমাদের আর ঢোকার ঝুঁকি নেওয়া ঠিক হবে না।”
আকাশ একটা গভীর শ্বাস নিল। “আমি বুঝেছি।”
তারপর সে পোর্টালের দিকে এক শেষ নজর দিল। “আমি ফিরব। আমাদের জ্ঞান আর প্রযুক্তি নিয়ে ফিরব। হয়তো একদিন আমরা দুই পৃথিবীর মধ্যে একটা সেতু তৈরি করতে পারব।”
সোহিনী আর ঐশী একে অপরের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখেই ছিল আশার ঝিলিক।
“অবশ্যই পারবে,” সোহিনী বললেন। “এই গল্প শেষ হয়নি।”
আকাশ হাত নেড়ে বিদায় জানালো। তারপর সে সাহস নিয়ে পোর্টালের মধ্যে ঢুকে গেল।
পোর্টালটা আবার জ্বলজ্বলে আলো দিয়ে জীবন্ত হয়ে উঠলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আলো কমে গেল এবং চিরতরে নিভে গেল।
সোহিনী আর ঐশী চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এই অভিজ্ঞতা তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। তারা জানত, এটা শুধু একটা গল্পের শেষ নয়, বরং নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলা।
রাতের আকাশে তারা জ্বলজ্বলিয়ে জ্বলিয়ে জ্বলছিল। এই মহাবিশ্বের কোথাও হয়তো আরো কোনো সমান্তরাল মাত্রা লুকিয়ে আছে, অপেক্ষা করছে আবিষ্কার হওয়ার জন্য।
ঐশী আর সোহিনী পোর্টালের নিভে যাওয়া আলোর দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। চারপাশে ছিল নিবিড় রাত। ঊর্ধ্বাকাশে তারার ঝিলিক। এই অভিযান তাদের মধ্যে এক অসাধারণ বন্ধন তৈরি করেছে। মা-মেয়ের সম্পর্কের বাইরে, এখন তারা সহযাত্রী, রহস্যের সাক্ষী।
ফেরার পথে ঐশী মাকে জিজ্ঞাসা করল, “আমরা কি আকাশকে আর দেখতে পারব?”
সোহিনী একটু হেসে বললেন, “বিজ্ঞানের অজানা পথে এখনো অনেক কিছুই লুকিয়ে আছে। হয়তো কোনোদিন আমাদের আবিষ্কার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছবে, যেখানে দুই পৃথিবীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হবে।”
ঐশীর চোখ জ্বলে উঠলো, “আমরা সেই চেষ্টা করবো, ঠিক না মা?”
“অবশ্যই,” সোহিনী সায় দিলেন। “আকাশ ঠিকই বলেছে। এই গল্পের শেষ এখানে নেই। এটা নতুন সম্ভাবনার সূচনা।”
পরের কয়েক মাস ঐশী আর সোহিনী পোর্টালের গবেষণায় নিজেদের আটকে দিলেন। আকাশের দেওয়া তথ্য ও নিজেদের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তারা চেষ্টা করলেন পোর্টালের রহস্য আরো উন্মোচন করতে। তারা জানত, সমান্তরাল মাত্রার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারলে বিজ্ঞানের জগতে তোলপাড় সৃষ্টি হবে। কিন্তু পথটা সহজ ছিল না। প্রচলিত বিজ্ঞানের ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করতে প্রমাণের দরকার ছিল।
একদিন গবেষণা চলাকালীন, ঐশীর নজর পড়লো এক পুরনো, বাংলা বিজ্ঞানের গ্রন্থে। সেখানে ছিল একটি অদ্ভুত চিহ্নের উল্লেখ, যেটা ঠিক সোহিনী পোর্টালের কাছে দেখা চিহ্নের মতোই। গ্রন্থে বলা ছিল, এই চিহ্ন হাজার বছর আগে ভারতীয় ঋষিরা আবিষ্কার করেছিলেন। এটি মহাবিশ্বের গভীরে লুকিয়ে থাকা আরো মাত্রার দিকে নির্দেশ করে।
এই আবিষ্কারে সোহিনী আর ঐশী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। পুরনো গ্রন্থের তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে সমান্তরাল মাত্রার ধারণা আরো জোরদার হয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা এই তথ্য বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের সঙ্গে শেয়ার করলেন।
কয়েক মাসের মধ্যে, ঐশী আর সোহিনীর গবেষণা আন্তর্জাতিক স্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করল। বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই গবেষণাকে সামনে নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করলো। সোহিনী আর ঐশী হয়ে উঠলেন সমান্তরাল মাত্রার গবেষণার প্রথম সারিতে।
এর কয়েক বছর পর, আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় একটি বিশাল প্রকল্প চালু হলো। বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা মিলে তৈরি করলেন একটি কৃত্রিম পোর্টাল। ঐশী এবং সোহিনী, তাদের গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের স্বীকৃতি হিসেবে, এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব পেলেন। বছরের পর বছর গবেষণা ও পরীক্ষার পর, অবশেষে একটি স্থिर পোর্টাল সৃষ্টি করা গেল। পৃথিবীর ইতিহাসে এই মুহূর্তটি বিজ্ঞানের এক বিরাট জয় হিসেবে চিহ্নিত হলো।
নির্ধারিত দিনে, পৃথিবীর বিশিষ্ট বিজ্ঞানীরা, রাষ্ট্রপ্রধানরা আর গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। উত্তেজনা ছিল চরমে। সোহিনী, ঐশীর পাশে দাঁড়িয়ে, এক অভিभावকের মতো গর্ব অনুভব করছিলেন। ঐশী, এখন এক বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী, শেষ মন্ত্র জপ করে সক্রিয় করলেন কৃত্রিম পোর্টালটিকে।
আলোক রেখার ঝলকানির মাঝে, কৃত্রিম পোর্টালটি সক্রিয় হলো। ঠিক যেমনটি দেখেছিলেন আনন্দপুরের ছাদে, সেই রাতে। সকলেই মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
একটি ক্ষণিকের নিঃশব্দতা ভাঙলো যখন পোর্টালের মধ্যে থেকে একটা আলোক রেখা বেরিয়ে এলো। ধীরে ধীরে, সেই রেখা থেকে একটা মানুষের আকৃতি স্পষ্ট হয়ে উঠলো। লম্বা চুল, উজ্জ্বল চোখ – এক যুবতী, তার হাতে ছিল একটা অদ্ভুত যন্ত্র।
সে এগিয়ে এলো পোর্টাল থেকে। সবার সামনে দাঁড়িয়ে সে মাথা নীচু করলো।
“আমি আকাশের বোন, অন্বেষা।” সে মৃদু স্বরে বললো। “আমরা আপনাদের সাথে যোগাযোগের অপেক্ষায় ছিলাম।”
কক্ষপথে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহগুলি এই মুহূর্তের লাইভ সম্প্রচার করছিল। পৃথিবী জুড়ে মানুষ গাড়ির হর্ন, তালি আর চিৎকারে উদযাপন করছিল। সমান্তরাল মাত্রার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের মধ্য দিয়ে মানব সভ্যতা এক নতুন যুগে পা দিল। আর এই গল্পের শুরু হয়েছিল কলকাতার ছাদে, এক জ্যোতির্বিজ্ঞানীর টেলিস্কোপের ফোকাসে ধরা অদ্ভুত আলোক রেখার মাধ্যমে। সোহিনী আর ঐশীর অভিযান, তাদের বৈজ্ঞানিক জেদ – সব মিলে এনে দিল এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
আকাশের বোন অন্বেষা এগিয়ে এলো ঐশীর দিকে। তার হাতে থাকা যন্ত্রটি ঐশীকে দেখিয়ে বললো, “আমাদের পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা এই যন্ত্রটি তৈরি করেছেন। এটি আপনাদের পৃথিবীর কৃত্রিম পোর্টালের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছে। এখন আমরা দুই পৃথিবীর মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগ ও যাতায়াত সম্ভব।”
ঐশী হাত বাড়িয়ে নিল যন্ত্রটি। ঠান্ডা ধাতব স্পর্শ অনুভব করল সে। চোখ বন্ধ করে সে যন্ত্রটির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করল। কিছুক্ষণ পর, তার মনে হল যেন অন্য একটা মন তার মনের সাথে যোগাযোগ করছে। তথ্যের একটা ঝড় য়ে তার মাথায় ঢুকে গেল – অন্বেষা এবং তার দলের বিজ্ঞানের অগ্রগতি, তাদের সংস্কৃতি, তাদের চ্যালেঞ্জ।
ঐশী চোখ খুলল। জানালো সবাইকে, “এটি একটি অনুবাদ যন্ত্র। এটা আমাদের দু’পক্ষের মধ্যে সরাসরি কথোপকথন সম্ভব করবে।”
পরবর্তী কয়েকটা দিন পৃথিবী উৎসবে মুখরিত ছিল। বিজ্ঞানীরা দু’পৃথিবীর মধ্যে জ্ঞান ও তথ্য আদান-প্রদান করতে শুরু করলেন। অন্বেষা এবং তার দল পৃথিবীতে অতিথি হিসেবে থাকল। তারা পৃথিবীর প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের সঙ্গে ম মিশে গেল। অন্যদিকে, ঐশীকেও আমন্ত্রণ জানানো হলো তাদের পৃথিবীতে।
এক সপ্তাহ পর, বিদায়ের আগের রাতে, ছাদে দাঁড়িয়ে সোহিনী ঐশীকে জড়িয়ে ধরলেন। গর্ব ও আবেগ মেশানো কণ্ঠে বললেন, “এতদূর আসতে পারবে ভাবিনি কখনো।”
ঐশী হাসল, “আমার মনে হয়, এটা শুধু শুরু, মা। সমান্তরাল মহাবিশ্বের আরো অনেক রহস্য আমাদের অপেক্ষায় আছে।”
সোহিনী মাথা দুললেন। তার চোখে ছিল স্বপ্নের ঝিলিক।
পরের দিন, অন্বেষা ঐশীকে নিয়ে ঢুকলো কৃত্রিম পোর্টালের মধ্যে। আলোক রেখার ঝলকানির মাঝে তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। পৃথিবীতে নতুন যুগের সূচনা হয়েছিল। এখন আর তারা ছিল না একা এই বিশাল মহাবিশ্বে। আরো অনেক অজানা জগতের দরজা খুলে গিয়েছিল তাদের সামনে।