ছত্রিশ বছর পর, বৃদ্ধাশ্রমের সেই নিস্তব্ধ কক্ষে সোমনাথকে দেখে আমার চোখ অবাক বিস্ময়ে কপালে উঠে গেল। একসময়ের সোম, সেই রূপবান, কর্মদক্ষ সোমনাথ কি এই অসহায় মানুষটি হতে পারে? এক কোণে চুপটি করে বসে আছে সে। চোখ দুটি নিথর, যেন অন্ধকারের জগতেই হারিয়ে গেছে সে সব স্বপ্ন।
আমাদের বিবাহ হয়েছিল চল্লিশ বছর আগে। ভালোই ছিল সংসার। যৌথ পরিবার, সবার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক। আমাকে সবাই স্নেহ করত। কিন্তু বিবাহের দু’বছর পর সন্তান না হওয়ার জন্য শুরু হল শ্বশুরবাড়ির চাপ। পরীক্ষার রিপোর্ট এসে নিশ্চিত হল, মা হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপর থেকে শুরু হল শ্বশুরবাড়ির থেকে কথা শোনানো। সব সহ্য করেছিলাম, কারণ আমার সোম আমার পাশে ছিল। কিন্তু সুখের ধারা তো সব সময় থাকে না। আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। সন্তানের চাপে সোমনাথও আমার থেকে দূরে সরে যেতে লাগল। মনে মনে ভাবতাম, হয়তো বেদনায় সে এমনটা করছে।
বাবার বাড়িতে কিছুদিন গেলে পরিস্থিতি শান্ত হবে, এমন আশায় গেলাম। সোমনাথকে যখন বাবার বাড়িতে যাবার কথা বললাম, কোনো সাড়াশব্দ নেই। আগে বাবার বাড়ি যাবার কথা বললে তার মুখ কালো হয়ে যেত, এবার কোনো রকম বিকার নেই।
বাবার বাড়িতে যাওয়ার তিন দিন পরেই একটা কোরিয়ার এলো। খুলে দেখি, সোমনাথের নতুন বিবাহের রেজিস্ট্রেশন আর আমাদের ডিভোর্স পেপার। চিঠি আর কাগজটা হাতে নিলে মাথাটা যেন ঘুরে গেল। বুঝতে পারলাম, সবকিছুই আগে থেকেই পরিকল্পিত। আমি বাড়ি থেকে বেরোলেই এই কাজটা সারা। যে মানুষের জন্য এত কষ্ট সহ্য করেছিলাম, ছেড়ে চলে গেল সেই মানুষটিকে আর কী দোষ দেওয়া! ডিভোর্স পেপারে সই করে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর আর দেখা হয়নি, কথাও হয়নি। সম্পর্কটা নিজেই ছেঁড়ে ফেলেছিলাম।
ঐতিহাসিক কথাসাহিত্য বাংলা ছোট গল্প - ষড়যন্ত্রের জালে : এই বাংলা ছোট গল্পে 1930-এর দশকের কলকাতার পটভূমিতে এক তরুণী, সোনালিনী, এবং তার প্রেমিক, বসন্তলালের জীবনের দ্বন্দ্ব ও ষড়যন্ত্রের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বসন্তলাল একজন বিপ্লবী, এবং সোনালিনী তাকে সতর্ক করার পর, তাদের জীবন এক নতুন মোড় নেয়। সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
মাঝে মাঝে মনে হতো, আমার মতো সন্তানহীনা, স্বামীত্যাগীনা মানুষের বেঁচে থাকার দরকারটা কি? কিন্তু এক সময় বুঝলাম, নিজের জন্য না হলেও অন্যদের জন্য বাঁচতে হবে। আমার মতো নির্যাতিতাদের জন্য বাঁচতে হবে। পরিচয়হীন ছেলেমেয়েদের জন্য বাঁচতে হবে। ছেড়ে ফেলা মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, পরিবারের ভুলের জন্য আঘাতপ্রাপ্তদের জন্য কাজ করবো। অতীত ভুলে একদিন নিজের পরিশ্রমে গড়ে তুলেছি নিজেকে। গড়েছি অनाথ আশ্রম, বৃদ্ধাশ্রম।
সেই ভাবনার স্রোত ভেঙে দিল সোমনাথের একটা কাঁপা কণ্ঠের ডাক, “কে আছেন?”
আমি সজোরে ঘুরে দাঁড়ালাম। সোমনাথ চোখ বন্ধ করে শুনছিল। অন্ধকারে তার অসহায়তা আরো বেশি করে চোখে পড়ল। আমি গলা চাপা গলায় বললাম, “আমি, সোনা।”
এক মুহূর্ত চुप থাকার পর সে আবার ডাকল, “সোনা? তুমি?” তার কণ্ঠে অবিশ্বাসের মুর।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। অন্ধকারেও যেন তার শীর্ণ হাতটা খুঁজে পেলাম আমার হাত। হাতটা ধরে বললাম, “হ্যাঁ সোম, আমিই।”
“এত বছর পর, কেন এলে?” তার কথায় একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ মিশে ছিল।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - কোয়ান্টাম সময় সেতু : কল্পবিজ্ঞান গল্প: তিনজন বন্ধু সময় ভ্রমণ করে ১৭৫৭ সালে যান এবং কালো গর্তের যুদ্ধের সাক্ষী হন। ব্রিটিশ ও বাঙালি বাহিনীর সংঘর্ষের মাঝে তারা ইতিহাস, সাহস ও বীরত্বের গল্প খুঁজে পান। সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
আমি চুপ করে রইলাম। কী বলব ঠিক জানিনা। ৩৭ বছরের পুরনো ক্ষোভ, অভিমান এক নিমেষে ঝরে পড়বে না। কিন্তু এই অসহায় মানুষটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, হয়তো সেই মানুষটাকে আমি ভুল বুঝেছিলাম।
অবশেষে বললাম, “আমার আশ্রমের একজন কর্মী জানাল তুমি এখানে আছো। তাই দেখা করতে এলাম।”
সোমনাথ কিছু বলল না। একটু পরে বলল, “তুমি ভালো আছো?”
“আছি।”
“আমার খবর নিতে এসেছো?”
“না, শুধু দেখা…” কথাটা শেষ করতে পারলাম না।
এবার সে জোরে শ্বাস ফেলল। “তোমার সাথে দেখা করার কোনো ইচ্ছা ছিল না আমার। তবে তুমি এসেছো, ভালো লেগেছে।”
আমার চোখে জল এসে গেল। হয়তো সে আমাকে ক্ষমা চাইবে না, হয়তো সে আমাকে ভুল বুঝেছে। কিন্তু এই বৃদ্ধ বয়সেও আমার সঙ্গের একটুখানি আশা সে রাখে, তাও কম কি!
আমি ঢোঁক গেলাম। কথার ফাঁকে একটা কর্মী ঢুকে পড়ল। জানাল, বিকেলের জলখাবারের সময় হয়েছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সোমনাথের হাতটা ছেড়ে দেওয়ার আগে সে আবার বলল, “আবার আসবে?”
“হ্যাঁ, আসবো।”
আমি বেরিয়ে এলাম বৃদ্ধাশ্রম থেকে। মনে মনে ভাবছিলাম, সোমনাথের সাথে হয়তো আর দেখা হবে না। হয়তো এইটুকু দেখাই শেষ।
কিন্তু পরের দিন ফের গেলাম। আর তারপর আরো গেলাম। সোমনাথের সাথে কথা বলতাম। অতীতের কথা কখনো আলোচনা হতো না। অন্ধকার জগতে বসে থাকা মানুষটিকে একটু আলো দেবার চেষ্টা করতাম। গল্প বলতাম, গান গাইতাম। হয়তো সে আমাকে ক্ষমা করতে পারেনি, কিন্তু আমি নিজেকে ক্ষমা করেছি, ছেড়ে ফেলা অভিমানগুলোকে ছেড়ে দিয়েছি।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - ফুলঝাড়ির নিশির ডাক : ভুতের গল্প: এক ভৌতিক গ্রামের রহস্যময় ঘটনা, হারিয়ে যাওয়া মেয়ে, অপূর্ণ ইচ্ছা, এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমা ও শান্তির গল্প। বাংলা গল্প। সম্পুর্ন্য গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একদিন সোমনাথ আমাকে জানাল, তার ছেলে বিদেশ থেকে ফিরছে। খুব খুশি হয়েছিলাম। ছেলে ফিরলে হয়তো সোমনাথকে নিয়ে বাড়ি চলে যাবে, এই আশাও ছিল মনে মনে। কিন্তু ছেলে এসে দেখা করল ঠিকই, কিন্তু বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা প্রকাশ করল না। বরং বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ ভালো বলেই মন্তব্য করল।
ছেলে চলে যাওয়ার পর সোমনাথ একটু উদাস দেখাচ্ছিল। আমি তার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী হয়েছে?”
“কিছু না,” সে উত্তর দিল, “ছেলে এসেছিল, ভাবলাম হয়তো…”
কথাটা শেষ না করেই চুপ হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারলাম তার মনের অবস্থা।
“ছেলেদের জীবনে নিজেদের কাজ, পরিবার, সব আছে। সব সময় বাবা-মাকে নেওয়াটা সম্ভব না,” বললাম আমি।
সোমনাথ মাথা নীচু করে বলল, “হয়তো তাই। কিন্তু একটু আশা ছিল।”
আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম, “আশা রাখো। হয়তো পরে…”
কথাটা শেষ না করেই থেমে গেলাম। জানি না কেন, মনে মনে মনে হচ্ছিল, হয়তো আমারই দেখাশোনা করতে হবে সোমনাথের।
এরপর প্রতিদিনের মতোই দেখা হতো আমাদের। একদিন সকালে বৃদ্ধাশ্রমের কর্মী এসে জানাল, সোমনাথ অসুয়ে। আমি ছুটে গেলাম তার কাছে। বিছানায় শুয়ে আছে, চোখ দুটি বন্ধ। তার হাতটা ধরলাম। শীতল লেগেছে।
“সোম, কেমন আছো?”
একটু চেষ্টা করে সে চোখ খুলল। “সোনা…”
কথার মধ্যে ক্লান্তি আর বার্ধক্যের ছাপ। আমি তার পাশে বসে তাকে এক গ্লাস জল খাইয়ে দিলাম।
দিন কয়েক অসুখে থাকার পর এক সকালে ঘুমের মধ্যেই সোমনাথ চলে গেল। শেষ নিঃশ্বাসে আমার হাতটা চেপে ধরেছিল সে।
আমি কাঁদিনি। কষ্ট পেলাম, কিন্তু কষ্টের চেয়ে মনের মধ্যে একটা শান্তি নেমে এল। সে চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার শেষ মুহূর্তে আমি তার পাশে ছিলাম। হয়তো সে আমাকে ক্ষমা করেনি, কিন্তু আমি জানি, সে একা হয়নি তার শেষ দিনগুলোয়।
সোমনাথের মৃত্যুর পর আমি আমার আশ্রমের পাশেই একটা ছোট্ট মন্দির বানিয়েছি। প্রতিদিন সকালে সেখানে গিয়ে ফুল দিই, আর কথা বলি… হয়তো সে শুনতে পাচ্ছে না, কিন্তু মনে হয়, আমার কথার স্রোত তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে কোনো এক অজানা পথে।