বীরপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর এর প্রকৃতির স্নেহময় কোলে ঢাকা একটি গ্রাম, ঠিক যেন বনফুলের মতো শালবনে খিলখিলাচ্ছে। সেই গ্রামেরই মেয়ে রিয়া, গলায় তার সুরের জাদুকরী। গান তার নিঃশ্বাস, সুর তার সঙ্গী। প্রতি বিশ্বকর্মা পূজোয় বীরপুরের উৎসবের মূল আকর্ষণ রিয়া আর তার গান। এবারো সেই একই আলো ঝলমলে রাতে, রিয়ার গানে ম-ম করে উঠলো গ্রাম।
আকাশে তারার ঝাঁকি, চারপাশে ঢাকের তালে গম-গম করে মাঠ, আর মাঝখানে রিয়া, সাদা চুড়িদার পরে, হাতে একটা একতারা। গান গাইছে সে; গানের ভাষায় আছে, প্রেম, বিরহের, আর আশার কথা।
গ্রামের লোকেরা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। ঠিক সেই সময়, দূরে একটা বাঁশির সুর ভেসে এলো। মিষ্টি, করুণ, মনের গহীনে ডুব দেওয়ার মতো। সবাই চমকে তাকালো চারপাশে। কে এই অচেন সুরের মালিক?
রিয়াও চমকে উঠলো। কখনো এই সুর শোনে নি সে। কিন্তু এই সুর, তার গানের সাথে মিশে যেন এক অপূর্ব সৃষ্টি করলো। মনে হলো তার গান আরও গভীর হলো, আরও ছুঁয়ে গেলো মন। গান শেষ হলো, কিন্তু সেই বাঁশির সুর মনের কোনে একটা সুতোয় টান দিয়ে গেলো রিয়াকে।
পরের দিন, নদীর ধারে একটা বটগাছের তলায় বসে ছিল রিয়া। হঠাৎ, সেই বাঁশির সুর আবার। রিয়া চোখ বুজে শুনতে লাগলো। সুরটা যেন তার মনের কথা বলে যাচ্ছে। চোখ খুলতেই দেখলো, গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে এক ছেলে। চোখে এক অদ্ভুত চমক, মুখে একটা গভীর বিষাদের ছায়া। সেই ছেলেই বাঁশি বাজাচ্ছে।
ছেলেটা এগিয়ে এলো। তার নাম আয়ান। বীরপুরেরই ছেলে, কিন্তু একটু আলাদা। কারো সাথে মিশে না, সব সময় একা থাকে। কয়েকটা বছর আগে এক দুর্ঘটনায় তার পরিবার হারিয়েছে সে। সেই থেকেই তার মধ্যে একটা চাপা দুঃখ।
রিয়া জানতে পারলো, আয়ানের বাঁশি বাজানোর অসাধারণ ক্ষমতা আছে। কিন্তু সে কাউকে বাজিয়ে শোনাবে না। এতদিন নিজের মনের মধ্যেই বন্দী ছিল তার সুর। কিন্তু গতকাল রাতে, রিয়ার গান শুনে, সে যেন নিজের অজান্তেই সুর ছেড়ে ফেলেছিল।
রিয়া আর আয়ানের দেখা হতে শুরু হলো। নদীর ধারে, বটগাছের তলায়, তারাই দু’জন। রিয়া গান গাইতো, আয়ান বাঁশি বাজাতো। তাদের দুজনের সুর মিশে যাচ্ছিল, যেন দুইটা নদী মিশে এক সাগরে মিলিয়ে যাওয়া।
আয়ান রিয়াকে বললো তার অতীতের কথা। কীভাবে দুর্ঘটনায় তার বাবা-মা আর ছোট বোনকে হারিয়েছে। সেই দুঃখের গহ্বরে আটকে গিয়েছিল সে। কিন্তু রিয়ার গান, আর তার সাথে সুর মিশিয়ে বাঁশি বাজানো, তাকে যেন একটা নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিল।
রিয়াও আয়ানকে গল্প করলো তার স্বপ্নের কথা। কীভাবে সে এই ছোট্ট গ্রাম ছেড়ে বড় শহরে গিয়ে গানের দুনিয়ায় নিজের জায়গা খুঁজতে চায়। কিন্তু পরিবারের বাঁধ, আর গ্রামের রীতি-নীতি তাকে আটকে রাখে।
একদিন, পূর্ণিমার রাতে, নদীর ধারে বসে ছিল তারা। আকাশজুড়ে তারার ঝাঁকি, আর নদীর বুকে চাঁদের আলোর রেখা। রিয়া একটা মন খারাপের গান গাইতে শুরু করলো। গানে ছিল বিরহের সুর, মনের অস্থিরতা। আয়ান চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ সে বাঁশি বাজাতে শুরু করলো।
রিয়ার গানের সাথে মিশে যাওয়া তার সুর ছিল যেন এক অভিশাপ্ত মনের মুক্তির আহ্বান। সেই রাতে, রিয়ার গান আর আয়ানের বাঁশি মিশে তৈরি করলো এক অমনোরতি সুর। এক সুর যা ছুঁয়ে গেলো তাদের দুজনের আত্মাকে।
গান শেষ হলো। চারপাশে একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তারপর, সহসা আয়ান এগিয়ে এসে রিয়ার হাত ধরলো। চাঁদের আলোয় ঝলমলে তার চোখে দেখলো সে রিয়ার প্রতি গভীর একটা স্নেহ। আর রিয়াও, সেই চোখে নিজের মনের আকাশ দেখতে পেল।
এই নিঃশব্দ কথায়, চাঁদের সাক্ষীতে, তাদের প্রেমের সূচনা হলো। প্রথম প্রেমের সঙ্কোচ, দৃষ্টির বিনিময়, হাত ধরা—সবকিছুই যেন নতুন করে উপলব্ধি করছিল তারা।
পরের দিন, গ্রামের সম্মানিত মানুষ, বাবলুদা, রিয়ার বাড়িতে এলেন। রিয়ার বিয়ের কথা নিয়ে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু রিয়া মুখ ফিরিয়ে নিল। সে জানতো, গ্রামের ছেলে, মেয়েমানুষের শিল্প চর্চাকে মেনে নেবে না , এমন ছেলের সাথে তার জীবন গড়া সম্ভব নয়।
কিন্তু বাবলুদা হেসে বললেন, “মেয়ে, তুই ঠিক জানিস না। আজকে যে ছেলের কথা বলছি, সে অজিতের ছেলে, সোমনাথ। সে ঠিক অন্য ছেলেদের মতো না। সে শহরে পড়াশোনা করেছে, আর আর্টের কাজ করে।”
রিয়া অবাক হয়ে গেল। সে জানতোই না, গ্রামে এমন ছেলেও আছে। বাবলুদা আরো বললেন, “তুমি ছেলেটিকে দেখ, তারপর সিদ্ধান্ত নাও।”
রিয়ার মনে প্রশ্ন জাগল। কে এই সোমনাথ? তার কি বাঁশিওয়ালা আয়ানের সাথে কোন সম্পর্ক আছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সে আযানের সাথে দেখে করতে গেল।
রিয়ার পা চলল বটগাছের দিকে। আজ সে আয়ানকে সব খুলে বলতে চায়। তার মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ঝড়ের মতো উথাল পাথাল করছে। একদিকে আছে তার গানের স্বপ্ন, শহরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, অন্যদিকে আছে আয়ানের সুর, সেই সুর যা তার মনের গহীনে ঢুকে মনকে দুমড়ে মুচড়ে দেয় দেয়।
আয়ানকে দেখতে পেল সে বটগাছের তলায় বসে। রিয়া আয়ানকে সোমনাথের কথাটা বলতে গিয়ে আযানের চোখ দেখে থিম গেল, আজ তার চোখে সেই আগুন নেই। বরং চোখ দুটো খালি খালি, মুখ থমথমে। রিয়া জানতে চাইল, “কী হয়েছে আয়ান?”
আয়ান মাটির দিকে তাকিয়ে বললো, “রিয়া, তুমি হয়তো জানো না, কিন্তু সোমনাথ আর আমি একই মানুষ।”
রিয়ার মাথাটা যেন ঘুরে গেল। সোমনাথ, যাকে বাবলুদা বিয়ে দেখাতে আসছিলেন, সেই সোমনাথই আয়ান! এতদিন, সে জানতোই না, যে ছেলের সাথে তার মনের গোপন কথাগুলো সুরের মাধ্যমে ভাগ করে নিচ্ছে, সেই ছেলেই তার বিয়ের প্রস্তাব পাচ্ছে!
“কিন্তু কেন?” জিজ্ঞাসা করলো রিয়া, গলা কাঁপছে।
আয়ান গল্প করলো, কীভাবে দুর্ঘটনার পর সে এতটাই ভেঙে গিয়েছিল যে, তার পুরোনো পরিচয়, সোমনাথ নামটা পর্যন্ত মুছে ফেলেছিল। শুধু একটা বাঁশি আর তার সুর থেকে খানিকটা সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু রিয়ার গান, তাদের দুজনের সুরের মিলন, তাকে যেন আবার জীবনে ফিরিয়ে এনেছে।
রিয়া বুঝতে পারলো। সে নিজেই আয়ানকে, সোমনাথকে আবার খুঁজে দিয়েছে। কিন্তু এখন তার কি করা উচিত?
“আমি কী করবো, আয়ান?” জিজ্ঞাসা করলো রিয়া, চোখে জল এসে গেল।
আয়ান হাত বাড়িয়ে রিয়ার হাত ধরলো। “রিয়া, আমি জানি তুমি গানের দুনিয়াতে যেতে চাও। আমি তোমাকে থামাতে পারব না। কিন্তু যদি আমাকে একটু সুযোগ দাও, তাহলে আমিও তোমার সাথে আসতে চাই। আমার আর্টের মাধ্যমে তোমার গানকে আরো সুন্দর করে তুলতে চাই।”
রিয়া আয়ানের হাত চেপে ধরলো। সে দেখলো আয়ানের চোখে আবার সেই আগুন জ্বলে উঠেছে।
এটা সহজ হবে না, রিয়া জানত। গ্রামের রীতি-নীতি, পরিবারের বাঁধ, সবকিছুই তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেই রাতে, চাঁদের সাক্ষীতে যে অমনোরতি সুর তাদের দুজনকে এক করেছিল, সেই সুরের টান তাকে ছেড়ে দেওয়া যায় না।
রিয়া সিদ্ধান্ত নিল। সে বাবলুদাকে সব খুলে বলবে। সে আয়ানের মানে, সোমনাথের সাথে শহরে যাবে। সে তার গানের স্বপ্নের পাশাপাশি, আয়ানের সুরের সঙ্গী হবে।
দিন কয়েক পরে, গ্রামের পঞ্চায়েত বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেল। রিয়ার সিদ্ধান্তে সবাই চমকে গেল। বাবলুদা চুপ করে শুনলেন রিয়ার আর আয়ানের গল্প। তারপর হাসিমুখে বললেন, “মেয়ে, দেখেছি তোমার সাহস। সোমনাথের নতুন পরিচয়, নতুন স্বপ্নের সাথে তোমার গানের যাত্রাটা খুব সুন্দর হবে।”
বাঁধাধরা কিছু থাকলেও, পরিবারের সম্মতি পেলো রিয়া আর আয়ান। শহরে যাত্রার আগের রাতে, নদীর ধারে একবার শেষবারের মতো বসলো তারা। আকাশে তারার ঝাঁকি ঠিক আগের মতোই ঝলমলে, কিন্তু এবার তাদের মনে আশা আর উত্তেজনা।
রিয়া একটা নতুন গান গাইলো, ভবিষ্যতের স্বপ্নের গান। আয়ান বাঁশি বাজিয়ে তার সাথে সুর মিশিয়ে দিলো। এবারের সুরে ছিল আশা, নতুন জীবনের প্রতিশ্রুতি।
পরের সকালে, গ্রামবাসীর আশীর্বাদ নিয়ে রিয়া আর আয়ান ছেড়ে চললো বীরপুর। শহরে যাত্রাপথে, রিয়া ভাবলো, এটা সহজ হবে না। নতুন জীবন, নতুন লড়াই। কিন্তু তার পাশে আছে আয়ান, আর তাদের দুজনের অমনোরতি সুর। এই সুর তাদের হাত ধরে চলবে, গানের আর আঁকার ছবিতে ভরপুর জীবনের দিকে।
বছরের পর বছর কেটে গেল। রিয়া একজন স্বনামধন্যা গায়িকা হয়ে উঠলো। আর আয়ানের আর্টওয়ার্ক, রিয়ার গানের সাথে মিশে, নতুন মাত্রা পেলো। তাদের যাত্রা ছিল কঠিন, কিন্তু তাদের প্রেম আর সৃজনশীলতা তাদের সামনে এগিয়ে যেতেই সাহায্য করলো।
একদিন, এক বিশাল কনসার্ট হলে গান গাইছে রিয়া। হাজার হাজার দর্শকের মাঝেও তার চোখ খুঁজে ফেললো আয়ানকে। সে দর্শকদের মাঝে বসে ছিল, হাতে একটা ছোট্ট বাঁশি। রিয়ার প্রতি গর্ব আর স্নেহের দৃষ্টি তার চোখে।
গান শেষ হলো। তালি আর চিৎকারের ঢেউয়ে কেঁপে উঠলো কনসার্ট হল। সেই সময় রিয়া মঞ্চের পাশেই দেখলো আয়ানকে দাঁড়িয়ে। তার হাতে ছিল একটা ফুলের তোড়া।
“এই গানটা তোমার জন্য, আয়ান,” রিয়া মৃদু হেসে বললো। আয়ান ফুলের তোড়াটা রিয়ার হাতে দিয়ে বললো, “এই সুরটাও তোমার জন্য, রিয়া।”
এই ছিল তাদের অমনোরতি সুরের গল্প। দুইটা আত্মার মিলন, গানের আর আঁকারের মাধ্যমে। এই সুর চলতে থাকলো, বছরের পর বছর, তাদের জীবনে, তাদের গানে, তাদের শিল্পে।