কলকাতার গ্রীষ্ম ১৯৯২। চৌদ্দো বছরের শ্রেয়ার কাছে এই দিনগুলো একঘেয়েমি ছাড়া আর কিছুই না। পাড়ার দুষ্টু ছেলেদের সাথে আর খেলা হয় না, বই পড়া ছাড়া করার মতো কিছুই নেই। মনের কোণে একটা অস্থিরতা, একটা খোঁজ, কী জানি না, কী হবে বুঝি না। এই সময়টাতেই শ্রেয়ার স্কুলে নতুন ছেলে এলো – অনিরুদ্ধ। দশমের ছেলে, হ্যান্ডসাম, কথামালা। শ্রেয়াকে মুগ্ধ করে ফেলল সে।
অনিরুদ্ধ শ্রেয়ার কাছে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিল। স্কুল ছুটির পর পার্কে দেখা, গল্প, হাসি-ঠাট্টা। শ্রেয়া জানত না, অনিরুদ্ধর মিষ্টি কথার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটা কুৎসিত মতলব। একদিন পার্কে একান্তে পেয়ে অনিরুদ্ধ শ্রেয়ার সাথে এমন কিছু করার চেষ্টা করলো, যা শ্রেয়ার বোধের বাইরে। ঘাবড়ে যাওয়া শ্রেয়াকে সেই অবস্থাতেই দেখে ফেলল নন্দিনী। নন্দিনী ছিল স্কুলের সবচেয়ে জনপ্রিয় মেয়েদের মধ্যে একজন, সাহসী, স্বচ্ছন্দ। অনিরুদ্ধকে ধমকে দিল সে, তারপর হাত ধরে শ্রেয়াকে নিয়ে চলে গেল।
নিরুদ্ধর কাণ্ডে শ্রেয়া কাঁদতে থাকলো। কিন্তু নন্দিনী তখন শ্রেয়ার গালে একটা চুমু খেল। শ্রেয়া অবাক হয়ে গেল। নন্দিনী হাসল, “দেখ, ছেলেদের মতো নাটক করতে হয় না।” এভাবেই শুরু হলো শ্রেয়া আর নন্দিনীর গোপন প্রেম। সেই গ্রীষ্মে দুর্গাপুজার আলো, সারা শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ানো, চোখে চোখ রেখে হাসি, ছুটির দিনগুলোতে নদীর ধারে আড্ডা – সব ছিলো এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর স্বপ্নের মতো।
কিন্তু স্বপ্ন সবসময় স্থায়ী হয় না। নন্দিনী জানতো, তাদের সম্পর্কটা সমাজের চোখে ঠিক নয়। পড়াশোনা, পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি – সবকিছুতেই ব্যস্ত হয়ে গেল নন্দিনী। শ্রেয়ার সাথে দেখা হওয়া কমে গেল। একদিন নন্দিনী এসে বললো, “আমাদের আর দেখা হওয়া যাবে না।” শ্রেয়া ভেঙে পড়লো। প্রথম প্রেমের আঘাতে সে হয়ে গেলো বিধ্বস্ত।
কয়েক বছর কেটে গেল। প্রেমের আর বিরহের খেলায় শ্রেয়া নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাইল না। পড়াশোনায় মন দিল, নতুন নতুন বন্ধু হলো। কলেজ শেষে শ্রেয়ারও স্বপ্ন ছিল বিদেশে যাওয়ার। মার্কেটিং বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে সে নিউ ইয়র্কে চলে গেল।
নিউ ইয়র্কের চাঞ্চল্য, নতুন পরিবেশ, সবকিছুই শ্রেয়াকে মুগ্ধ করেছিল। একদিন একটা আর্ট গ্যালেরিতে ঘুরতে গিয়ে আনিকার সাথে দেখা হলো। আনিকা ছিল একজন সফল ফটোগ্রাফার, সুন্দরী এবং আত্মবিশ্বাসী। শ্রেয়ার সাথে বন্ধুত্ব হলো, তারপর সেই বন্ধুত্ব ভালোবাসায় রূপ নিল।
কিন্তু কিছুদিন পরে শ্রেয়ার মনে সন্দে জাগলো। আনিকা সবসময় অতীতের গল্প করতো। কলেজ জীবনের প্রেমিক, তার সাথে ঘুরে বেড়ানোর ছবি, স্মৃতি – এসব নিয়েই থাকতো সে। শ্রেয়া যখন নিজের অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে চাইতো, আনিকা এড়িয়ে যেত। একদিন শ্রেয়া জিজ্ঞেস করলো, “আমি কি তোমার অতীতের ছায়া?” আনিকার চোখ ছলছলিয়ে উঠলো, “না, তুমি অন্যরকম। কিন্তু আমি পারছি না।” শ্রেয়া বুঝলো, আনিকা এখনও অতীতের প্রেমে আটকে আছে।
এই সম্পর্ক শ্রেয়াকে সুখী করছিল না। একদিন সে আনিকাকে ছেড়ে দিল। নিউ ইয়র্কের একাকীত্বে শ্রেয়ার মনে হলো সে হারিয়ে গেছে। কিন্তু এই একাকীত্বই তাকে নিজেকে খুঁজে ফিরতে সাহায্য করলো। নতুন নতুন লোকজনের সাথে মিশল, নিজের কাজে মন দিল, শহরের নানা কোণায় ঘুরে বেড়াল। এই সময়েই শ্রেয়ার জীবনে এলো দেব।
দেব ছিলেন একজন লেখক। শ্রেয়ার সঙ্গীতের সন্ধানীর একটা বইয়ের প্রচ্ছদ তৈরির কাজে দেবের সাথে দেখা হয়েছিল। দেব ছিলেন শান্ত, গভীর চিন্তাশীল ব্যক্তি। শ্রেয়ার কথাগুলো সে মন দিয়ে শুনতেন। শ্রেয়াও দেবের লেখালেখি, তার জীবন দর্শন – এসব নিয়ে আলোচনা করতে ভালোবাসত।
দেবের সাথে কথা বলতে বলতে শ্রেয়া বুঝতে পারলো, অনিরুদ্ধের কুৎসিত মতলব, নন্দিনীর অস্থায়ী ভালোবাসা, প্রিয়ার দূরত্ব, আনিকার অতীতের বন্দীত্ব – এই সব অভিজ্ঞতা তাকে আজকে এই জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা কী, জীবন কী, আর সে নিজেকে কী চায়। দেবের সাথে থাকতে শ্রেয়া নিজেকে নিরাপদ বোধ করলো। তার মনের গোপন কথা, অতীতের আঘাত, সবকিছু সে দেবের সাথে ভাগ করে নিতে পারলো। দেবও শ্রেয়াকে মন দিয়ে শুনলো, তার অতীতকে বিচার করলো না।
একটা রোম্যান্টিক রাতে, সেন্ট্রাল পার্কে হাঁটার সময় দেব শ্রেয়ার হাত ধরে বললো, “শ্রেয়া, তুমি আমার জীবনের গল্পের শেষ অধ্যায়। তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা না, কিন্তু তুমিই আমার সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা।” শ্রেয়ার চোখে জল এলো। অতীতের প্রেমের ব্যর্থতাগুলোকে মেনে নিয়ে এতো সুন্দর ভালোবাসা পেতে পারে সে, ভাবতেও পারেনি।
কয়েক বছর পরে শ্রেয়া আর দেব বিয়ে করলো। বিয়ের পরেও তাদের সম্পর্কটা আগের মতোই স্নেহ ও বোঝাপড়ায় ভরা থাকলো। মিউজিয়ামে ঘুরে বেড়ানো, নতুন জায়গায় ভ্রমণ, শান্ত সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে আড্ডা – এসব ছোট ছোট জীবনযাপনই তাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করলো।
একদিন বৃষ্টির দিনে বারান্দায় চা খেতে খেতে শ্রেয়া দেবকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি কখনও ভাবো না, আমার অতীতের সম্পর্কগুলো…?” দেব শ্রেয়ার হাত ধরে বললো, “শ্রেয়া, তোমার অতীত তোমাকে তুমি করেছে। তোমার অভিজ্ঞতাগুলোই তো আজকে আমার সাথে থাকতে চেয়েছে। আমি তোমাকে পুরোপুরি চাই, তোমার অতীত সহ।”
শ্রেয়া দেবের চোখের দিকে তাকালো। হঠাৎ করেই তার মনে হলো, নন্দিনীর স্পর্শ, প্রিয়ার আলিঙ্গন, আর আনিকার হতাশার দৃষ্টি – এই সবকিছুই তাকে আজকে দেবের পাশে এনে দাঁড় করিয়েছে। এই সব অভিজ্ঞতাগুলো তাকে ভালোবাসা বুঝতে শিখিয়েছে, আর নিজেকে খুঁজে ফিরতে সাহায্য করেছে। শ্রেয়া দেবকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি যেখানে আছি, ঠিক জায়গায় আছি।”
কিছু বছর পর, নিউ ইয়র্কের ঝমঝমে রাস্তায় হাঁটছিলেন শ্রেয়া আর দেব। শ্রেয়ার কোলে ছিল তাদের দুই বছরের মেয়ে আনন্দিতা। দেব ছোট্টিকে কাঁধে তুলে বললো, “কী রে আনন্দিতা, নিউ ইয়র্ক দেখতে ভালো লাগছে?” আনন্দিতা হা হা করে হাসলো।
শ্রেয়া দেবের দিকে তাকালো। তার চোখে এখনও সেই আগুন, সেই গভীরতা আছে। কিন্তু তার চুলগুলোতে এখন সাদা ছোঁয়া লেগেছে। শ্রেয়ারও চেহারায় সময়ের ছাপ পড়েছে, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে আছে আগের মতোই স্নেহ ও স্বপ্ন।
একটা কফি শপের সামনে এসে দেব বললো, “কী রে, ঢুকে এক কাপ কফি খাব?” শ্রেয়া হাসলো, “চলো।”
কফি শপের ভেতরে ঢুকে একটা কোণার টেবিল নিয়ে বসলো তারা। আনন্দিতাকে একটা খেলনা দিয়ে দেব শ্রেয়ার হাত ধরে বললো, “শ্রেয়া, মনে আছে কত বছর আগে এই শহরে এসেছিলে?”
শ্রেয়া মাথা নাড়লো, “কী বোঝা, হাজার বছর!” দুজনেই হাসলো।
দেব আবার বললো, “তখন তুমি একা ছিলে, হারিয়ে গিয়েছিলে বলে মনে হচ্ছিল। আর এখন…”
শ্রেয়া দেবের কথা আটকালো, “আর এখন আমি খুঁজে পেয়েছি। নিজেকে, তোমাকে, আর আমাদের পরিবারকে।”
দেব শ্রেয়ার গালে একটা চুমু খেলো। কফি শেষ করে বাইরে বেরোলো তারা। নিউ ইয়র্কের সন্ধ্যা নেমে এসেছে। আকাশে তারা জ্বলে উঠেছে। শ্রেয়া আনন্দিতাকে জড়িয়ে ধরলো।
দূরের একটা গীর্জার ঘণ্টা বাজলো। শ্রেয়া মনে মনে ভাবলো, যে পথ ধরে সে এসেছে, সেই পথই তাকে আজকে এই সুখের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। প্রথম প্রেমের আঘাত, অস্থায়ী সম্পর্ক, একাকীত্ব – এসব সবই ছিল তার জীবনের অংশ। আর এই অংশগুলোই তাকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা কী, জীবন কী, আর ‘আমি যেখানে আছি, ঠিক জায়গায় আছি।’
নিউইয়র্কের ঝমেঝমে রাস্তা তখনো জেগে আছে, ঠিক শ্রেয়ার মনের মতো। দেব আর আনন্দিতা বাড়ি ফিরে গেছে। কিন্তু শ্রেয়ার ঘুম আসছে না। বারান্দায় বসে শহরের আলোকঝলকানি দেখতে থাকল সে। মনে পড়ে গেল কলেজ জীবনের প্রথম বন্ধুবান সোমকে। সোম ছিল ঠিক তার উল্টো। শান্ত, নিভৃত, বই পড়া আর গান শোনা ছাড়া কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু সোমের সাথে থাকতে একটা অদ্ভুত শান্তি পেতো শ্রেয়া।
একদিন সোম শ্রেয়াকে বলেছিল, “শ্রেয়া, তুমি নিজের মতো করে বাঁচো। ভুল হতে পারে, পথ হারিয়ে যেতে পারো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জায়গায় পৌঁছবে।”
শ্রেয়া জানালায় হেলান দিয়ে নিজের চিন্তাভাবনাগুলোকে খতিয়ে দেখল। অনিരുদ্ধের কুৎসিত মতলব, নন্দিনীর অস্থায়ী ভালোবাসা, প্রিয়ার বিচ্ছেদ, আনিকার অতীতের বন্দীত্ব – এসব সব অভিজ্ঞতা তাকে কষ্ট দিয়েছে, ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ঠিক এই অভিজ্ঞ্যতাই তাকে শিখিয়েছে সত্যিকারের ভালোবাসা চেনা, নিজের মনের গভীরতা খুঁজে বের করা।
একটি গভীর শ্বাস নিয়ে ভাবলো, সোম ঠিকই বলেছিল। সে নিজের মতো করেই বাঁচার চেষ্টা করেছে। ভুল করেছে, আঘাত পেয়েছে, কিন্তু ঠিক জায়গায় পৌঁছেছে। দেবের পাশে, আনন্দিতাকে কোলে নিয়ে।
হঠাৎ করেই ইচ্ছা হলো সোমকে একটা ফোন করা। কত বছর পর! কী খবর তার? ফোনটা হাতে নিয়ে কন্টাক্ট লিস্ট খুঁজতে লাগলো শ্রেয়া। অনেক খোঁজার পরে পুরনো একটা নম্বর পেল। মনে মনে একটু দ্বিধা থাকলেও, ফোনটা কানে লাগালো।
কয়েকটা রিং এর পরে একটা ক্লান্ত কিন্তু আশ্বস্ত কণ্ঠ শোনা গেল, “হ্যালো?”
“সোম?” অবিশ্বাসের সুরে বললো শ্রেয়া।
“হ্যাঁ, কে?”
“আমি শ্রেয়া।”
এবার অবাক হওয়ার পালা সোমের। এত বছর পর, হঠাৎ করেই শ্রেয়ার ফোন!
“শ্রেয়া?” সোমের কণ্ঠে অবাক চমক। অনেকটা জল এসে গেল সময়ের ফাঁকে। এত বছর পর, হঠাৎ এই ফোন কল! কী বলবে, কী জিজ্ঞেস করবে, বুঝতে পারছিল না সে।
“হ্যাঁ, সোম,” শ্রেয়ার কণ্ঠে একটু কাপুনি। নিউ ইয়র্কের রাতের আলোয় ছেয়ে থাকা আকাশের দিকে চোখ রাখলো সে। “কী খবর তোর?”
“আমি ঠিক আছি,” একটু সামলে নিয়ে বললো সোম। “তুই কেমন আছিস? এত বছর পর…”
“আমিও ভালো আছি,” হাসি ফুটে উঠলো শ্রেয়ার ঠোঁটে। “বিবাহিত, একটা মেয়ে আছে।”
“বিবাহিত!” আবার অবাক সোম। শ্রেয়ার জীবনে এত ঘটনা ঘটে গেছে, তার কিছুই জানে না সে।
“হ্যাঁ,” শ্রেয়া আরও একটু গল্পে ঢুকলো। দেবের সাথে দেখা, তাদের সম্পর্ক, আনন্দিতার জন্ম – সবকিছুই একটু একটু করে সোমকে জানালো।
“খুব ভালো লাগলো শুনে,” মৃদু কণ্ঠে বললো সোম। “তোকে সব সময় সুখী থাকতে দেখতে চাই, শ্রেয়া।”
“আমি সুখী,” শ্রেয়া স্বীকার করলো। “কিন্তু জানিস, সোম, এই সুখটা পেতে গেলে অনেক পথ চলতে হয়েছে। অনেক ভুল, অনেক আঘাত।”
“জানি,” সোম নিবিড় কণ্ঠে বললো। “কিন্তু ঠিক এই পথটাই তো তোকে এখানে এনেছে। তোকে শিখিয়েছে, ভালোবাসা কী, জীবন কী।”
শ্রেয়া হাসলো। সোমের কথাগুলো ছুঁয়ে গেল মনে। “ঠিক বলেছিস। আর তোর কথাটাও মনে আছে। নিজের মতো বাঁচতে হবে।”
“কী কথা?”
“কলেজের সময় বলেছিলি, নিজের মতো বাঁচতে হবে, ভুল হতে পারে, পথ হারিয়ে যেতে পারি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের জায়গায় পৌঁছব।”
একটু থেমে শ্রেয়া আবার বললো, “ঠিক তাই হয়েছে, সোম। নিজের মতো করে বাঁচার চেষ্টা করেছি। ভুল করেছি, কষ্ট পেয়েছি, কিন্তু এখন ঠিক জায়গায় আছি।”
একটু চুপ করে থাকলো দুজনেই। এত বছর পরের এই আচমকা ফোন কলে জেগে উঠেছিল অতীতের স্মৃতি। কিন্তু বর্তমানের জীবনে দুজনেই অনেকটা এগিয়ে গেছেন।
“আমার খুব ভালো লাগলো তোকে ফোন করা, সোম,” শ্রেয়া আবার কথা বললো।
“আমারও,” সোমের কণ্ঠেও একটু আনন্দ ধরা পড়লো। “কখনও নিউ ইয়র্কে এলে জানিয়ো। দেখা হবে।”
“নিশ্চয়ই,” শ্রেয়া উত্তর দিল। “আচ্ছা, তোকে আর একবার ফোন করবো।” বিদায় জানিয়ে ফোনটা কাটলো।
নিউ ইয়র্কের রাতের আকাশ এখন আরও প্রশান্ত লাগলো শ্রেয়ার চোখে। সোমের সাথে এই কথা বলার মধ্যে সে যেন নিজের অতীতের একটা অংশকে আবার খুঁজে পেল। এই অভিজ্ঞতা তাকে আরও একবার বোঝালো, জীবন একটা যাত্রা। এই যাত্রাপথে নানা রকম মানুষের সাথে দেখা হয়, নানা রকম সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিছু সম্পর্ক স্থায়ী হয়, কিছু মুহূর্তের। কিন্তু প্রতিটি সম্পর্কই জীবনে একটা না একটা শিক্ষা দেয়।
এই রাতে শ্রেয়া বুঝতে পারলো, অনিরুদ্ধের প্রতারণা, নন্দিনীর ভালোবাসার স্পর্শ, প্রিয়ার সাথে দূরত্ব, আনিকার অতীতের বন্দীত্ব – এসব সবই ছিল তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই অভিজ্ঞতাগুলো তাকে শিখিয়েছে ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, একাকীত্ব, সবকিছুই জীবনেরই একটা অংশ। আর এই সব অংশগুলো মিলেই সে হয়ে উঠেছে আজকের শ্রেয়া।
দেব ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় এসে দেখলো শ্রেয়া এখনও জেগে আছে। “কী হলো, ঘুম আসছে না?”
শ্রেয়া দেবের দিকে ফিরে হাসলো, “না, একটা পুরনো বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল।”
দেব শ্রেয়ার পাশে এসে দাঁড়ালো। “কে?”
“কলেজ জীবনের এক বন্ধু।” দেবের কাঁধে মাথা রেখে শ্রেয়া সোমের সাথে কথাবার্তাটা একটু একটু করে বলে দিল।
দেব মন দিয়ে শোনলো। তারপর বললো, “ভালো”
শ্রেয়া চমকে তাকালো, “কী বলছো?”
দেব হাসলো, “কী আর, তোর বন্ধুর নাম সোম, তাই ভাবলাম হয়তো প্রোগ্রামিং নিয়ে আলোচনা করছিলে।”
শ্রেয়াও হেসে ফেললো। “না, প্রোগ্রামিং নয়। কথাই বলছি, আমার মনে হচ্ছে এই ফোনটা করা দরকার ছিল।”
দেব শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরলো, “নিশ্চয়ই দরকার ছিল। আর তোর অতীত নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি তোকে পুরোপুরি চাই, তোর অতীত সহ।”
শ্রেয়া দেবের চোখের দিকে তাকালো। চোখের কোনে একটা জলের রেখা। কিন্তু সেই জলের মধ্যে ছিল স্নেহ, বিশ্বাস, আর জীবনের সব অভিজ্ঞতাকে মেনে নেওয়ার দৃঢ়তা।
“আমি যেখানে আছি, ঠিক জায়গায় আছি
শ্রেয়ার মনের সেই কথাটা শেষ না হতেই দেব তার কপালে একটা চুমু খেলো। “এই কথাটা আর কখনও বলতে দিও না,” কথায় হাসি মিশিয়ে বললো সে। “তুমি এখন আমার সাথে আছো, আর আমি তোমার। এটাই সবচেয়ে ঠিক জায়গা।”
শ্রেয়ার ঠোঁটেও একটা হাসি ফুটে উঠলো। হ্যাঁ, দেব ঠিকই বলেছে। এখন আর অতীতের পথ খোঁজার দরকার নেই। অতীতের ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, আঘাত – সবকিছুই তাকে আজকের শ্রেয়ায় পরিণত করেছে। এই অভিজ্ঞতাগুলোকে সঙ্গী করেই সে এখন দেবের পাশে, আনন্দিতাকে কোলে নিয়ে সুখে আছে।
কয়েকদিন পরে সোমের একটা ইমেল এলো। নিউ ইয়র্কে আসার কথা লিখেছে। শ্রেয়ার মনে আনন্দে ঝমঝমি জাগলো। অনেক বছর পরের এই দেখা হবে বিশেষ।
দিন যত এগিয়ে এলো, শ্রেয়ার মনে একটা অস্থিরতা জাগলো। কী বলবে সোমকে? কীভাবে শুরু করবে কথা? কিন্তু দেখা হওয়ার পর সব চিন্তা উধাও হয়ে গেল।
পুরনো দোস্তের মতোই আলিঙ্গন, হাসি, গল্প। কলেজ জীবনের অতীত স্মৃতিগুলো নিয়ে আড্ডা। কিন্তু একটা সময় কথার ফাঁকে সোম জিজ্ঞেস করলো, “শ্রেয়া, তুমি কি কখনও…”
শ্রেয়ার চোখে চোখ রেখে সে কথাটা শেষ করতে পারলো না। শ্রেয়া বুঝলো সে কী বলতে চাইছে।
“না, সোম,” শ্রেয়ার কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো সে, “তোমার মতো কোনো অনুভূতি ছিল না। আমরা ভালো বন্ধু ছিলাম, ঠিক আছে।”
সোম একটু হেসে মাথা নীচু করলো। “হ্যাঁ, বন্ধু।”
কথার ফাঁকে একটু চুপ করে থেকে সে আবার বললো, “শ্রেয় জানিস, তোমার ফোনটা পেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম। এত বছর পর, হঠাৎ…”
“আমি জানি, সোম,” শ্রেয়া মাঝপথে কথাটা কেড়ে নিল। “আমিও খুশি হয়েছি। তোমার সাথে কথা বলে মনে হলো, আমার একটা অংশ খুঁজে পেলাম।”
সোম হাসলো, “আমিও তাই ভাবছি।”
এরপর আরও একটু আড্ডা হলো। পুরনো গান, পুরনো স্মৃতি। বিদায়ের সময় সোম বললো, “শ্রেয়া, খুব ভালো লাগলো আজ। আবার দেখা হবে।”
“নিশ্চয়ই,” শ্রেয়াও বললো।
সোম চলে যাওয়ার পর শ্রেয়া একটা গভীর শ্বাস নিল। এই দেখাটা তার মনে একটা আশ্বস্তি, অতীতের অনুভূতিগুলোকে স্বীকার করে নেওয়া, সোমের সাথে সব ঠিক রেখে আবার দেখা হওয়া – এই অভিজ্ঞতা আরও একবার শেখালো জীবন কতটা জটিল আবার কতটা সুন্দর।
শ্রেয়া বাড়ি ফিরলো। দেব আর আনন্দিতা বসরুমে খেলছিল। দেব দেখে শ্রেয়াকে জড়িয়ে ধরলো, “কী খবর, দেখা হলো?”
শ্রেয়া মাথা নাড়লো, “হ্যাঁ, অনেক ভালো লাগলো।”
সে দেবের কোলে বসে সোমের সাথে দেখা হওয়ার কথাটা বলতে লাগলো। কী কথা হয়েছে, কী কী স্মৃতি মনে পড়েছে, সবকিছুই খুলে বললো।
দেব মন দিয়ে শুনলো, তারপর বললো, “জানিস, আমি খুশি যে তুমি গেলে। অতীতের সাথে মিটমাট লাগানোটাও জরুরি।”
শ্রেয়া দেবের গালে একটা চুমু খেলো, “আমিও তাই ভাবছি।”
এরপর আনন্দিতাকে কোলে নিয়ে খেলা শুরু হলো। হাসি, খুনসুট, ছোট্ট মেয়েটির বাচ্চামি নিয়ে ঘর ভরে গেল।
রাতে শোবার সময় শ্রেয়া দেবকে জড়িয়ে ধরে বললো, “জানিস, আজকে মনে হচ্ছে আমি সত্যিই সুখী। পুরোপুরি সুখী।”
দেব শ্রেয়ার কপালে একটা চুমু খেলো, “আমি জানি। আমি তো তোমাকে সব সময় সুখী রাখার চেষ্টা করবো।”
শ্রেয়া চোখ বন্ধ করলো। হ্যাঁ, সে সুখী। নিখুঁত, পূর্ণ সুখ। অনিরুদ্ধের প্রতারণা, নন্দিনীর ভালোবাসা, প্রিয়ার বিচ্ছেদ, আনিকার অতীতের বন্দীত্ব – এসব সব অভিজ্ঞতাই তাকে এখানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
শ্রেয়ার ঝরে পড়া চোখের পাতার আড়ালে ভেসে উঠলো একটা হাসি। সেই হাসি বলছিল, ‘আমি যেখানে আছি, ঠিক জায়গায় আছি।’ এই জায়গাটা – দেবের পাশে, আনন্দিতাকে কোলে নিয়ে, নিজের অতীতকে স্বীকার করে নিয়ে – এটাই তার সবচেয়ে সুখের জায়গা।