কলকাতার রবীন্দ্র সদনের আর্ট গ্যালেরি জুড়ে উৎসবের আমেজ। সোহম, উদীয়মান এক শিল্পী, তার নতুন সৃষ্টি ‘অমর প্রেমের ক্যানভাস’ উন্মোচনের অপেক্ষায়। ক্যানভাসে দুটি মূর্তি, নিবিড় আলিঙ্গনে জড়িয়ে, চোখে অপার ভালোবাসা আর নিষ্ঠার ছায়া। যেন একই ক্যানভাসে বন্দী হয়েছে সময়ের স্রোত।
অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে অঞ্জলি, সাহিত্যের ছাত্রী, স্বপ্ন আর কল্পনায় মাতোয়ারা এক তরুণী। শিল্পের প্রতি তার গভীর অনুরাগ। গ্যালেরিতে ঢোকার সাথে সাথেই তার দৃষ্টি আটকে যায় ‘অমর প্রেমের ক্যানভাস’-এ। ক্যানভাসে ফুটে ওঠা নিবিড়তা, চোখে চোখ রাখা ভালোবাসা, সবকিছুই তাকে কার্যত মুগ্ধ করে ফেলে।
কিছুক্ষণ পরেই সোহমের সঙ্গে তার আলাপ হয়ে যায়। ক্যানভাসের গভীরতা, প্রেমের ব্যাখ্যা – নানা বিষয়ে আলোচনা গড়িয়ে যায়। অজান্তে নিজের অতীতের প্রেমের ব্যথাও অঞ্জলি ভাগ করে ফেলে সোহমের সঙ্গে। আর সোহমও তার কাছে খুলে বলেন অবিশ্বাসের কষাঘাতে ভাঙা তার প্রেমের গল্প।
একে অপরের গল্প শোনার ফাঁকে, কখন যে তাদের মধ্যে একটা আন্তরিক বন্ধন গড়ে উঠেছে, বুঝতেই পারেনি। কিন্তু অতীতের আঘাত, নতুন সম্পর্কে জড়ানোর ভয় – সবকিছুই যেন তাদের দূরে রাখতে চায়। সোহমের কাছে অতীতের প্রতারণা, অঞ্জলির কাছে নিজের স্বপ্ন নিয়ে অবিশ্বাস – এই দুই দ্বন্দ্ব তাদের প্রেমের পথে বাধা সৃষ্টি করে।
কিন্তু, প্রতিদিনের আলাপ, শিল্প ও সাহিত্যের আলোচনা তাদের দূরত্ব কমিয়ে দেয়। সোহমের কাছে অঞ্জলি পড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, সোহম অঞ্জলির কাছে তুলে ধরে ভ্যান গোঁয়ের চিত্রকর্ম। তাদের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পান। দু’জনেই নিজেদের স্বপ্নের পথে চলতে চান, কিন্তু একইসঙ্গে খুঁজছেন ভালোবাসার সহায় ও সঙ্গ।
একদিন, অঞ্জলি গ্যালেরিতে এসে দেখেন সোহম নতুন একটি চিত্র আঁকছে। কৌতূহল জাগে তার মনে। ক্যানভাসে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে অঞ্জলির প্রতিচ্ছবি।
রক্তিমা মেশানো কেশগুলি, চোখে সাহিত্যের গভীরতা, আর ঠোঁটে ঈশান মৃদু হাসি – অঞ্জলি যেন ক্যানভাসে জীবন্ত হয়ে উঠছিলেন। সোহমের প্রতিটি তুলিতে ফুটে উঠছিল তাঁর অঞ্জলিকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি – প্রশংসা, মমতা, আর গভীর ভালোবাসা। অঞ্জলি নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে আহত। কখনও তাকে কেউ এভাবে দেখবে, সে বুঝতে পারেনি।। চোখে জল এসে গেল।
“কখন এ আঁকলে?” অঞ্জলি, কণ্ঠ স্বর গম্ভীর।
সোহম তুলি নিচে রেখে হাসলে। “আজকেই। তোমাকে দেখছিলাম, আর তুলি চলছিল।”
“কিন্তু…” অঞ্জলি থামল। “তুমি কি জান, আমি কি চাই? আমার স্বপ্ন?”
“আমি তোমাকে জানতে চাই,” সোহম বললেন, তার চোখে আন্তরিকতা ঝলমল করছিল। “তোমার স্বপ্ন, তোমার আশা, তোমার ভয় – সবকিছুই জানতে চাই।”
এই কথায় অঞ্জলির চোখের জল আর আটকানো যায় না। সোহমের কাছে এসে দাঁড়াল। চোখের জল মুছে দিতে সোহম হাত বাড়াল, কিন্তু আবার থামল। অঞ্জলি নিজের হাত বাড়িয়ে সোহমের হাত ধরল। সেই স্পর্শে দু’জনেরই শরীর কেমন জানি কাঁপল।
“আমি লেখিকা হতে চাই,” অঞ্জলি কাঁপা কণ্ঠে বলল। “কিন্তু আমার পরিবার আমার স্বপ্নকে সমর্থন করে না। ওরা চায় আমি নিরাপদ পেশার পথ বেছে নেই।”
“আমিও শিল্পী হতে চেয়েছিলাম,” সোহম তাঁর অতীতের কথা বলতে শুরু করল। “কিন্তু প্রতারণা আর অবিশ্বাস আমাকে ভেঙে দিয়েছিল। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর, কেমন যেন নতুন করে শুরু করার ইচ্ছা জাগে।”
রাতের আঁধার গভীর হতে থাকল। গ্যালেরির আলো নিভিয়ে দেওয়ার সময় হয়ে গেল। কিন্তু দু’জনেই সেদিকে খেয়াল দিলেন না। একে অপরের হাত ধরে কথা বলতে থাকল। অতীত নিয়ে, স্বপ্ন নিয়ে, ভবিষ্যৎ নিয়ে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে দুটি চোখের মিলন, অভিব্যক্তিহীন হাসি – সবকিছুই যেন বলছিল, দু’টি আত্মা একে অপরের খোঁজ পেয়েছে।
পরের কয়েকদিন, অঞ্জলি আর সোহম প্রতিদিন গ্যালেরিতে দেখা করত। শিল্প নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করত। একে অপরের স্বপ্নের গুরুত্ব বুঝত। সোহম, অঞ্জলির লেখা পড়ত আর তার মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা খুঁজে পেত। অঞ্জলি, সোহমের চিত্রকর্মের গভীরতা অনুভব করত, বুঝত।
এক সন্ধ্যায়, সোহম অঞ্জলিকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে এক নির্জন নদীর তীরে। সূর্য অস্ত হচ্ছে, আকাশ জুড়ে আগুন লাল রঙ ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর স্রোত শান্ত, যেন জগতের সব কোলাহল থেমে গেছে।
“এখানে এলাম কেন?” অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল।
সোহম হাসলেন, “চারপাশের শান্তি উপভোগ করতে করতে। এখানে শান্ত আছে, প্রশান্তি আছে। আমি চেয়েছিলাম তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে।”
সে একটা কাপড় খোলল। তার নিচে ছিল নতুন এক চিত্রকর্ম। ক্যানভাসে অঙ্কিত ছিল নদীর তীর, সূর্যাস্তের আলোয় রাঙা আকাশ, আর দূরে দুটি মানুষের ছায়া – একজন হাঁটছেন, অন্যজন হাঁটার হাত বাড়িয়ে দিয়েছ।
“এটা কারা?” অঞ্জলি জিজ্ঞাসা করল, কৌতূহল আর বিস্ময় মিশ্রিত কণ্ঠে।
“আমরা,” সোহম উত্তর দিল। “এই ছবিতে আমি আমাদের দেখেছি। আমি বিশ্বাস করি, প্রেমের পথ চলতে হলে, কখনো একজন এগিয়ে যাবে, আবার কখনো একজনকে হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।”
অঞ্জলি চুপ করে ছবিটা দেখতে থাকল। সোহমের কথায় যেন একটা আশার সুর ঝঙ্কৃত হলো। সে’ও কি সোহমের মতো বিশ্বাস করতে পারব? ভালোবাসার হাত ধরে নিজের স্বপ্নের পথে এগিয়ে যেতে পারব?
সোহমের দিকে তাকাল অঞ্জলি। তার চোখে ছিল ভালোবাসা, প্রশ্ন, আর একটু সঙ্কোচ। সোহম হাত বাড়িয়ে দিলেন অঞ্জলির দিকে। অঞ্জলি একটু দ্বিধার পর সোহমের হাত ধরল। সেই হাত ধরা মুহূর্তে যেন তাঁদের দু’জনের মনের সব দ্বিধা মুছে গেল। নদীর স্রোতের মতো জীবনের পথে একসাথে এগিয়ে চলার প্রতিজ্ঞা জন্ম নিল তাঁদের মধ্যে।
কয়েক সপ্তাহ পর, এক উৎসবের রাতে সোহমের প্রথম একক প্রদর্শনী। গ্যালেরিজুড়ে সাজের ঢেউ। অঞ্জলিও উপস্থিত ছিল। সবার নজর ছিল নতুন চিত্রের উপর। ক্যানভাসে ছিল একটি নারী, লেখাপড়ার টেবিলে বসে লেখা লিখছেন। তার চোখে ছিল স্বপ্নের জ্যোতি, আর ঠোঁটে ঈশান হাসি। কিন্তু এই চিত্রের বিশেষত্ব ছিল এর নামে – “অমর প্রেমের ক্যানভাসের পরে”
অঞ্জলি সোহমের চোখের দিকে তাকাল। সোহম হাসল, আর তাঁর চোখে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি। “এই নতুন যাত্রায় তুমি আমার সঙ্গী! তাই না?”
অঞ্জলি মাথা নাড়লেন। “না, শুধু সঙ্গী নই, আমি তোমাকে সহযাত্রী।”
অঞ্জলির বুকে এক অনবোধ্য আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। এই ছবি তাঁকেই ফুটিয়ে তুলেছেন সোহম। সে আর নিরুপায় স্বপ্নধনী নারী নয়, সে লেখিকা, তাঁর নিজের পথে এগিয়ে চলছে। সোহমের চোখের দিকে তাকালেন সে। সোহম হাসল, আর তাঁর চোখে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসার প্রতিশ্রুতি।
“এই নতুন যাত্রায় তুমি আমার সঙ্গী, তাই না?” সোহম জিজ্ঞাসা করল।
অঞ্জলি মাথা নাড়ল। “না, শুধু সঙ্গী নই, আমিও তোমাকে স্বপ্নের পথে সহায় হব। তোমার শিল্প আমাকে অনুপ্রাণিত করে লিখতে, আর আমার লেখা তোমাকে আরো দুর্দান্ত শিল্প সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করবে।”
সোহমের মুখে ফুটে উঠল চওড়া হাসি। তিনি অঞ্জলির হাত ধরল। সেই হাতের মধ্যে ছিল তাঁদের ভালোবাসার গল্প, স্বপ্নের প্রতিশ্রুতি আর দুটি আত্মার অবিচ্ছেদ্য বন্ধন।
মাস কয়েক চলে গেল। অঞ্জলি লেখার কাজে ডুবে থাকত। আর সোহম তাঁর নতুন চিত্রকর্মে মগ্ন থাকত। কখনো অঞ্জলি তাঁকে গল্পের চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে সাহায্য করত, আবার কখনো সোহম তাঁকে রঙের মিশেলে নতুন কিছু সৃষ্টি করার অনুপ্রেরণা জোগাত। তাঁদের দু’জনের জীবনে এল এক অদ্ভুত মিল।
একদিন সন্ধ্যায়, অঞ্জলি সোহমকে একটা খাতা দেখাল। তাঁর প্রথম উপন্যাসের খসড়া ছিল সেখানে। সোহম পড়তে শুরু করল। প্রতিটি পৃষ্ঠায় অঞ্জলির স্বপ্ন, তাঁর ভাবনা ফুটে উঠেছিল। গল্পের নাটকীয়তা, চরিত্রের গভীরতা – সবকিছুই সোহমকে মুগ্ধ করে ফেলল।
খাতা শেষ করে সোহম উচ্চাস্বরে বলল, “অসাধারণ! এটা অবশ্যই প্রকাশিত হবে।”
অঞ্জলির চোখে জল এসে গেল। সোহমের বিশ্বাস তাঁকে আরো শক্তি জোগাল।
কয়েক মাস পর, অঞ্জলির প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হলো। বইমেলায় সারি সারি লাগলো তাঁর বই। অঞ্জলির লেখা পাঠকদের মন কাড়ল। প্রশংসার ঢেউ এলো সর্বত্র থেকে। সোহম অঞ্জলির চেয়েও বেশি গর্বিত ছিল। সে নিজের একটি নতুন চিত্রকর্মের উন্মোচন অনুষ্ঠানে অঞ্জলির উপন্যাসের প্রশংসা করে কথা বলল।
এই সাফল্যের পরে অঞ্জলি আরো বেশি লেখালেখিতে মন দিল। সোহমের শিল্পেও নতুন মাত্রা যোগ হলো। তাঁদের দু’জনের প্রেমের গল্প শিল্প ও সাহিত্যের জগতে ছড়িয়ে পড়ল। অনেকেই তাঁদের “অমর প্রেমের সঙ্গী” বলে ডাকতে শুরু করল।
একদিন সকালে, অঞ্জলি সোহমের কাছে এসে বলল, “এই শহরে থাকতে আর মন চাইছে না। আমি আরো বেশি ঘুরে দেখতে চাই, নতুন জায়গা, নতুন মানুষের সঙ্গে মেশতে চাই।”
সোহম একটু চুপ করে রইল। অঞ্জলির স্বপ্নের কথা সে জানত। কিন্তু তাঁদের একসঙ্গে থাকাটাও তাঁর ইচ্ছা ছিল।
অঞ্জলি আবার বলল, “তুমি কি আমার সাথে আসবে? তোমার শিল্পের অনুপ্রেরণা তো সর্বত্রই পাওয়া যাবে।”
সোহম অঞ্জলির হাত ধরল। সে জানত, অঞ্জলির সঙ্গ ছাড়া তাঁর শিল্প অসম্পূর্ণ থাকবে। সে বলল, “অবশ্যই, আমি তোমার সঙ্গেই আছি।”
অঞ্জলির মুখে ফুটে উঠল চওড়া হাসি। তাঁদের যাত্রা শুরু হলো নতুন দিগন্তের দিকে। একসঙ্গে ঘুরে বেড়ালেন নতুন নতুন জায়গা। অঞ্জলি তাঁর উপন্যাসের জন্য নতুন গল্পের খোঁজ পেয়েছে, আর সোহম বিভিন্ন সংস্কৃতি থেকে নতুন অনুপ্রেরণা পেয়ে নতুন চিত্রকর্ম সৃষ্টি করেছে। তাঁদের ভালোবাসা ছিল এক ক্যানভাসের মতো, যেখানে প্রতিটি অভিজ্ঞতা নতুন রঙের ছোঁয়াচ দিয়ে আরো সজীব হয়ে উঠেছিল।