রাতের আকাশটা কালো মখমলের কাপড়ের মতো ঝলমলে তারাগুলোয় জড়িয়ে ছিল। কিন্তু স্নেহা-র মনটা ছিল অমাবস্যার রাতের মতো নিথর! বিদেশে কাটিয়ে আসা কয়েকটা বছর পরে ফেরা কলকাতায় নিজেকে একা, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছিল। বন্ধুরা সবাই নিজেদের জীবনে ব্যস্ত, তাদের সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছিল। শহরের চেনা উচ্ছ্বাস আর চলমান জীবনধারা রায়ের কাছে এখনো অপরিচিত মনে হচ্ছিল।
দুর্গাপূজার আলোয় ছেয়ে যাওয়া শহরে একদিন এক পুজো দেখতে বেরিয়ে পড়ল স্নেহা। ঠাকুর দেখার পরে বেরোতেই হঠাৎ করে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হল। আশ্রয় খুঁজতে ছুটে ঢুকল একটা ছোট্ট বইয়ের দোকানে। দোকানটা পুরনো, কাঠের আলমারিতে সাজানো হাজারো বই। আর দোকানির চেহারাটাও ঠিক বইয়ের মতোই মৃদু, শান্ত। ছেলেটির নাম অভিজিৎ।
কী নিবেন? – অভিজিৎ হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল।
স্নেহা জানালো বৃষ্টি থামার আশায় একটু দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। কথা হতে হতে জানা গেল অভিজিৎ এই পাড়াতেই থাকে, ছোটবেলা থেকেই বাবার বইয়ের দোকানটা সেই চালাচ্ছে। বইয়ের প্রতি তার অপার আগ্রহ, নতুন লেখক, নতুন বই, সবকিছু নিয়েই আলোচনা চলতে থাকল।
বৃষ্টি থামলো কখন বুঝতে পারল না স্নেহা। বইয়ের গল্প, শহরের পুরনো দিনের কথা, সব মিশে এক অদ্ভুত সন্ধ্যা কাটিয়ে গেল তাদের। অভিজিতের চোখের মধ্যে একটা স্নেহের ঝিলিক ছিল, যা স্নেহাকে আজব কাছে টেনে ধরেছিল।
পরের দিন ফের দেখা হলো তাদের। দুর্গাপূজার আনন্দে একসঙ্গে ভাসল স্নেহা আর অভিজিৎ। শহর জুড়ে ঘুরে বেড়ালো, পুজো দেখলো, ভোগ খেলো। রাস্তার ধারে বসে ঢাকের তালে ছেলেমেয়েদের নাচ দেখল, আকাশে ঝাঁ চড়া আতশবাজি দেখে মুগ্ধ হল। এই কয়েকটা দিনে অভিজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে স্নেহার নিজের মনের কথাগুলোও খুলে বেরিয়ে এলো। বিদেশের চাকরি, ঝকঝকে জীবন, সবকিছুই হঠাৎ ফিকে মনে হচ্ছিল। সে চাইছিল নিজের শহরে, নিজের মানুষের মাঝে কিছু সৃষ্টিশীল কাজ করতে। কিন্তু ফিরে আসার সাহস পাচ্ছিল না।
দুর্গাপূজার শেষ দিন। আকাশে শেষের আলোয় ঢাকা পড়েছে শহর। রাস্তায় বিসর্জনের আয়োজন চলছে। মায়ের বিসর্জনের আয়োজন চলছে। মায়ের বিদায়ের গান গাইছে মানুষজন। স্নেহার বুকে এক অসহ্য বোধ জাগ করল। আজকেই ফিরে যেতে হবে বিদেশে। অভিজিৎ চুপ করে তার পাশে দাঁড়িয়ে। মনে মনে স্নেহা তার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল, কিন্তু কথাটা কীভাবে বলবে বুঝতে পারছিল না।
ফিরতে হবে, না? – আস্তে করে জিজ্ঞাসা করল অভিজিৎ।
স্নেহা মাথা নাড়ল। চোখ ভিজে এলো।
কিন্তু কেন? এখানেই তো তোমার বাড়ি, তোমার শহর। – অভিজিৎ-এর কথায় একটা অস্বস্তি ফুটে উঠল।
স্নেহা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, – জানি না, হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে, হয়তো ভয় লাগে। নিজের শহরে নিজের মতো কিছু করতে পারব কিনা…
কী করতে চাও তুমি? – আগ্রহী হলো অভিজিৎ।
স্নেহা তখন তার স্বপ্নের কথা বলল। কলকাতার পুরনো এলাকাগুলোর পুনর্নির্মাণ, নতুন জীবন দেওয়া।
তাহলে থাকো না! – হঠাৎ উচ্চস্বরে বলে ফেলল অভিজিৎ, তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে আস্তে বলল, – এই শহরের, এই মানুষের খুব প্রয়োজন তোমার মতো মানুষের।
স্নেহা অভিজিতের চোখের দিকে তাকালো। চোখ দু’টো সজল ছিল।
তুমি কি চাও আমি থাকি? – কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল স্নেহা।
আমি চাই না, চায় এই শহর। তুমি থাকলে আমার খুব ভালো লাগবে, – স্বীকারোক্তিটা অভিজিতের মুখ থেকে এলো নিজের অগোচরেই।
স্নেহা চুপ করে রইল। মনের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকল। একদিকে বিদেশের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, অন্যদিকে নিজের শহর, নিজের মানুষ, নিজের স্বপ্ন। এই কয়েকটা দিনে অভিজিতের সাহচর্থ্য তার মধ্যে একটা নতুন অনুভূতি জাগিয়ে দিয়েছে। এমন একটা অনুভূতি, যা আগে কোনোদিন হয়নি।
অপেক্ষা করো, – হঠাৎ বলে উঠল স্নেহা। অভিজিৎ অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। স্নেহা তার ফোনে একটা নম্বরে কল দিল। সেটা ছিল একটা বড় নির্মাণ সংস্থার।
হ্যালো, মিস্টার সেন? – বলল স্নেহা, – আমি স্নেহা খান্না। আমি কলকাতায় ফিরে এসেছি। আমার কাছে কিছু আইডিয়া আছে, আপনি কি একবার আমার সাথে দেখা করতে পারবেন?
কলটা কাটালে স্নেহা অভিজিতের দিকে ফিরে তাকাল। তার চোখে একটা আশার আলো জ্বলে উঠল।
ঠিক আছে, – হাসিমুখে বলল রায়, – এখানেই থাকছি, এই শহরেই, তোমার আর এই শহরের পাশেই।
অভিজিৎ হাত বাড়িয়ে স্নেহার হাত ধরল। ধীরে ধীরে আকাশটা পরিষ্কার
ধীরে ধীরে আকাশটা পরিষ্কার হয়ে উঠল। মেঘ সরে গিয়ে তারাগুলো জলজলিয়ে উঠল। ঠিক যেন স্নেহার মনের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল সবকিছু। ভবিষ্যতের পথটা এখনো অস্পষ্ট, কিন্তু আশা জাগলো তার বুকে।
পরের কয়েকটা মাস কেটে গেল নিমেষের মতো। স্নেহার নির্মাণ সংস্থার সাথে দেখা হয়েছিল, তার পরিকল্পনাটা তাদের ভালো লেগেছিল। পুরনো এলাকাগুলোর পুনর্নির্মাণের প্রকল্পে তারা স্নেহাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কাজটা কঠিন, কিন্তু রায় ছিলেন উদ্যমী। অভিজিৎ সবসময় তার পাশে ছিল, প্রেরণা জোগাতো। মাঝেমধ্যে রাতে দু’জনে বইয়ের দোকানের ছাদে বসে চা খেত, শহরের রাতের আলো দেখত। এই সময়গুলোয় রায়ের বুঝতে পারল অভিজিতের মনের গভীরতা। বইয়ের মতোই ছিল অভিজিতের মন, ভরা কবিতা, গল্প, আর অপার স্নেহ দিয়ে।
একদিন কাজের ফাঁকে অভিজিৎ স্নেহাকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে একটা জায়গায়। একটি পুরনো বাড়ি, ঝিমিয়ে পড়েছে, কিন্তু তার সৌন্দর্য এখনো ম্লান হয়নি।
এই বাড়িটা আমার দাদুর, – বলল অভিজিৎ, – অনেক বছর আগে ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু এটাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা।
স্নেহা চারপাশে তাকাল। বাড়িটা ঠিক করার ইচ্ছা জাগলো তার মধ্যে। অভিজিতের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, – ঠিক আছে, এই বাড়িটাই আমাদের প্রথম প্রকল্প হবে।
অভিজিৎ অবাক হয়ে গেল। স্নেহার চোখে সে দেখল ভালোবাসা, শুধু তার প্রতিই না, শহরের প্রতি, মানুষের প্রতি। সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল অভিজিৎ, রায়ের সঙ্গে থাকতে পারাটাই তার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
বাড়িটা ঠিক হতে অনেক সময় লাগল। কিন্তু যখন কাজ শেষ হলো, তখন সবাই মুগ্ধ হয়ে গেল। পুরনো সৌন্দর্য ফিরে পেল বাড়ি, আর তাতে যোগ হলো নতুনত্বের ছোঁয়া। বাড়ি উদ্বোধনের দিনটা ছিল উৎসবের মতো। অভিজিতের চোখে ছিল গর্ব আর খুশি। রাতে দোকানের ছাদে বসে থাকাকালীন অভিজিৎ স্নেহার হাত ধরে বলল, – ধন্যবাদ, স্নেহা। তুমি এ শহরকে, এই বাড়িকে আর আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছ।
স্নেহা হাসিমুখে বলল, – এখন তো আমি কোথাও যাচ্ছি না। এটাই আমার শহর, আমার বাড়ি, আর তুমিই আমার…
কথাটা শেষ করার আগেই অভিজিৎ তার ঠোঁটে একটা চুমু দেওয়ালো। চুমুটা ছিল হালকা, কিন্তু স্নেহার মনে জাগলো আনন্দের ঝড়। দুর্গাপূজার এক বৃষ্টির দিনে তাদের প্রেমের সূচনা হয়েছিল। এবারের পূজোয় তারা আর দু’জন নয়, তাদের সঙ্গে ছিল আরও কয়েকজন – রায়ের সহকর্মীরা, কয়েকজন প্রতিবেশী। পুরনো বাড়িটা এখন ঐতিহ্য হয়ে উঠেছে, এখানেই হচ্ছে সার্বজনীন পুজো।
আকাশে ঝলমলে তারা, চারপাশে পুজোর আলো, ঢাকের তালে মুখর রাস্তা – এই পরিচিত পরিবেশে দাঁড়িয়ে স্নেহা অভিজিতের হাত চেপে ধরল।
জানো, – হাসিমুখে বলল স্নেহা, – এই শহর, এই পুজো, এসব কিছু আগে আমার কাছে এতটা সুন্দর মনে হতো না।
অভিজিতের চোখে স্নেহের ঝিলিক। সে জানতো স্নেহার এই পরিবর্তনের কারণ।
তুমি আমাকে এই শহরটা নতুন করে চিনিয়েছ। – স্নেহার কথা শেষ হওয়ার আগেই অভিজিৎ বলে উঠল।
একসঙ্গে তারা দূরে তাকাল, যেখানে মা দুর্গার বিগ্রহ আর আলোর ঝলকানিতে জগৎকে আলোকিত করে রয়েছে। স্নেহা জানতো, তার সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু এখন সে একা নেই। অভিজিতের সঙ্গ, শহরের মানুষের ভালোবাসা – এইসব নিয়ে সে এগিয়ে যেতে পারবে। আর কে জানে, হয়তো এই শহরেরই কোনো এক কোণে কোনো একদিন সে তার নিজের বাড়িও গড়ে তুলবে, যেখানে থাকবে সে, অভিজিত আর তাদের ভালোবাসার গল্প।