সোনালী আর্ট গ্যালেরির ঝলমলে আলোয় সজ্জিত বাথরুমে দাঁড়িয়ে মায়ের পুরোনো রেশমি শাড়িটা ঠিক করে নিচ্ছিলাম আমি, অহনা। কিন্তু আজ রাতে শাড়ির রং আমার চোখে ধরা পড়ল না। কালো চোখ দুটো জলে ভেজা, আর মনটা এক অসমুদ্র খাঁড়ের মতো অস্থির। আজকের এই শিল্প প্রদর্শনী ছিল আমার জীবনের বড় এক স্বপ্ন। দীর্ঘদিনের সাধনার পর, অবশেষে সোনালী গ্যালেরিতে আমার ছবিগুলো জায়গা পেয়েছিল। কিন্তু সমালোচকরা আমার ছবিকে ‘অতিমাত্রায় সাদাসী’ বলে উড়িয়ে দিলেন। ‘কোনো গভীরতা নেই’, ‘অনুভূতির অভাব’, ‘এসব তো যে কেউ আঁকতে পারে’ – এসব কথায় আমার মনটা চুর্ণবিচুর্ণ হয়ে গেল।
বাথরুমের ম্লান আলোয় নিজের মুখটা দেখে মনে হলো, যেন একটা ফ্যাল ফ্রেমের মধ্যে আটকে আছি। কোনো রং নেই, কোনো গভীরতা নেই – ঠিক আমার আঁকা ছবির মতোই। হঠাৎ মনে পড়লো, ছোটবেলায় আঁকা আমার প্রথম ছবিটা। নীল আকাশ, সবুজ গাছ, লাল ফুল – সবকিছুই এত জ্বলজ্বলে, এত জীবন্ত ছিল। কখন সেই জীবন্ততা হারিয়ে গেলাম? কখন অন্যের মতো আঁকার চেষ্টায় নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেললাম?
এই প্রশ্নগুলো যেন আমার মধ্যে একটা ঝড়ো তুফান জাগিয়ে দিল। না, আর নিজেকে আটকে রাখব না। আমার ভেতরে যে আগুন জ্বলছে, সেটা আর নিভিয়ে রাখব না। আমার ছবিতে গভীরতা থাক না থাক, আমার নিজের গভীরতা খুঁজে বের করব। খুঁজে বের করব নিজের স্বপ্নের পথ, নিজের রং, নিজের গল্প।
পরের সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হলো, যেন এক নতুন মানুষ হয়ে জেগেছি। ঘরের আলোয় শাড়িটা এক অপূর্ব নীল রঙের ঝিলিক মিছে দিচ্ছিল। মায়ের এই শাড়িটা ছিল সাহসের, স্বপ্নের প্রতীক। তাই আজ আমি পরেছিলাম নতুন স্বপ্ন নিয়ে।
প্রথম কাজ হিসেবে নিজের ছবির কালেকশনটা বের করলাম। বছরের পর বছর আঁকা ছবিগুলোতে আমার পরিবর্তনটা চোখে পড়ল। প্রথম দিকের ছবিগুলোতে ছিল জীবনের সহজ সৌন্দর্য, তারপর এলো নিরীক্ষণের তীক্ষ্ণতা। কিন্তু কোথাও ছিল না সেই অন্তর্জ্বালা, সেই গল্প বলার তাগিদ। নতুন করে ছবি আঁকা শুরু করলাম। এবার শুধু রং আর তুলির খেলা নয়, আমার নিজের অনুভূতি, আমার জীবনের গল্প ছবির ক্যানভাসে ঢেলে দিলাম। আঁকলাম শৈশবের স্মৃতি, প্রথম প্রেমের খাঁটি আবেগ, নিজের গল্প ছবিতে ফুটিয়ে তোলার সাথে সাথে আমার মনের দরজাগুলো যেন এক এক করে খুলতে লাগলো । শিল্প হলো শহরের কোলাহল ছেড়ে একা একা ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখার মুগ্ধতা, বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধ। আঁকা হলো মানুষের চোখে ফুটে ওঠা হাসি, কান্না, দুঃখ, সুখ। প্রতিটি ছবিই ছিল একটা গল্প, একটা অনুভূতির জলছবি।
এই নতুন ধারার ছবি নিয়ে যখন আবার সোনালী গ্যালেরিতে গেলাম, তখন গ্যালেরির পরিচালক, মিস্টার সেন, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন। আমি তাকে সব খুলে বললাম, সমালোচকদের কথা, আমার মনের অস্থিরতা, আর নতুন স্বপ্নের কথা। মিস্টার সেন মৃদু হাসলেন, “অহনা, শিল্পে সবার মতামতই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আপনার নিজের গল্প। আপনি যা দেখছেন, যা অনুভব করছেন, সেটাই তুলে ধরুন।”
কয়েক সপ্তাহ পরে গ্যালেরিতে হলো আমার নতুন ছবির প্রদর্শনী। এবারের শিল্প প্রদর্শনী ছিল আগেরবারের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। প্রতিটি ছবিই যেন দর্শকের মন ছুঁয়ে যাচ্ছিল। একজন বয়স্কা মহিলা আমার একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, “কি হয়েছে? ছবিটা ভাল লাগল না?”
তিনি মাথা নাড়লেন, “না, লাগছে। এই ছবিতে আমার ছেলেবেলার বাড়ির উঠোনটা দেখতে পাচ্ছি। ঠিক এমনি সবুজ ঘাস, এমনি লাল গোলাপ ফুল…”
আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এটাই ছিল আমার সাফল্য। আমার নিজের গল্প বলতে পারছিলাম, আর তা ছুঁয়ে যাচ্ছিল অন্যদের মন। সেদিন বুঝতে পারলাম, শিল্প শুধু রং আর তুলির খেলা নয়, এ এক অনুভূতির ভাষা। নিজের অন্তরে ঢুকে গল্প খুঁজে বের করতে পারলেই সেই গল্প ছুঁয়ে যায় সবার হৃদয়।
আমি আর কখনো সমালোচনার ভয়ে থেমে যাইনি। নতুন নতুন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি, নতুন নতুন মানুষের সাথে দেখা হয়েছে, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা নিয়েছে আমার মনকে সমৃদ্ধ করেছে। আর সেই সমৃদ্ধিই ফুটে উঠেছে আমার ছবিতে, গল্পে গল্পে।
কয়েক বছর পরে অহনা আর সেই অচেনা, হতাশাগ্রস্ত তরুণী নেই। আজ সে স্বাধীন, সফল শিল্পী। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, এমনকী বিদেশেও হয়েছে তার একক প্রদর্শনী। কিন্তু এই সফলতার মাঝেও একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। সেটা হলো তার শিক্ষক, রতন সিংহের স্বীকৃতি। রতন সিংহ ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী, যার কাছে শিক্ষা নেওয়াটা ছিল অনেক শিল্পীর স্বপ্ন। কিন্তু অহনার ছবির প্রাথমিক ধারা রতন সিংহকে মুগ্ধ করতে পারেনি। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “অহনা, তোমার ছবিতে দক্ষতা আছে, কিন্তু কোনো নিজস্বতা নেই।”
এই কথাগুলো সেদিন অহনাকে ভেঙে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু পরবর্তীতে সেই কথাই তাকে জাগিয়ে দিয়েছিল। তাই আজ, কয়েক বছর পরে, যখন শোনা যায় রতন সিংহ কলকাতায় একটা ওয়ার্কশপ করছেন, অহনা দ্বিধা না করে নিজেকে তার শিক্ষার্থী হিসেবে এনরোল করিয়ে ফেললেন।
ওয়ার্কশপের প্রথম দিন, রতন সিংহ ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে একটা নির্দিষ্ট থিম দেওয়ার পরে আঁকার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু অহনা একটু আলাদা পথ বেছে নিলেন। তিনি রতন সিংহের দেওয়া থিমকে ব্যবহার করলেন টেকনিক হিসেবে, কিন্তু তার নিজের অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির ছাপ দিলেন। ফলে তার ছবিতে ফুটে উঠলো এক অচেন, কিন্তু অসাধারণ জগৎ।
ওয়ার্কশপ শেষে শিক্ষার্থীদের ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা হলো। রতন সিংহ প্রতিটি ছবির সমালোচনা করলেন। কিন্তু যখন এলো অহনার ছবির পালা, তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর চোখ তুলে অহনার দিকে তাকালেন, “অহনা, কী জানি, এই ছবিটা আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গেল। এটা দেখে মনে হচ্ছে, তুমি নিজের গল্প খুঁজে পেয়েছো।”
অহনার চোখে জল এসে গেল। কতটা আকাঙ্ক্ষা ছিল এই স্বীকৃতির জন্য! এই মুহূর্তে মনে হলো, এতদিনের সব পরিশ্রম, সব সংগ্রাম সার্থক হয়েছে। রতন সিংহের কাছ থেকে এই স্বীকৃতি তাকে আরও এগিয়ে যেতে, আরও নতুন উচ্চতা স্পর্শ করতে নতুন করে উদ্বুদ্ধ করল।
অহনা জানত, তার শিল্পযাত্রা এখানেই শেষ নয়। নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, নতুন নতুন মানুষ, নতুন নতুন গল্প – এগুলোই তাকে শিল্পী হিসেবে আরও সমৃদ্ধ করে তুলবে। আর সেই গল্পগুলো সে তুলির স্পর্শে ছবিতে ফুটিয়ে তুলবে, ছুঁয়ে যাবে মানুষের হৃদয়।