গাঁড়িয়া নদীর তীরে ছোট্ট গ্রামটা, নাম কাশ্মীরা। সেখানেই থাকে আহির, জলের মতো স্বচ্ছ মনের এক ছেলে। তার জীবনে শান্তি ছিল, ছিল বসন্তের নতুন পাতার মতো একটা কোমল প্রেম, রূপসী মায়ের হাসি আর বাবার শক্ত কিন্তু ভালোবাসাপূর্ণ স্নেহ। কিন্তু এই শান্তির মাঝে ঝড় এলো বসন্তের দুপুরে; এক ঝটকায় সব পাল্টে গেল, যখন আহিরের প্রিয় বন্ধু সোনা তার জীবন থেকে বিদায় নিল, নিজের ইচ্ছায় নয়, এক দুর্ঘটনায়।
সোনার মৃত্যুর পর গ্রামে গুঞ্জন উঠলো। কেউ কেউ বললো, নদীতে স্নান করতে গিয়ে ঢেউয়ে ভেসে গেছে, কেউ আবার বললো, অন্য কোনো কারণ আছে। কিন্তু আহির জানতো, সোনার মৃত্যুর সাথে আরও একজনের জীবন শেষ হয়ে গেছে – তার কাকাতো ভাই, বাসু।
বাসু আর আহির ছোটবেলা থেকেই অবিচ্ছেদ্য ছিল। দু’জনে একসাথে খেলা, একসাথে ঝগড়া, একসাথে স্বপ্ন। কিন্তু সোনার মৃত্যুর পর বাসু রাতের আঁধারের মতো হয়ে গেলো। গ্রাম ছেড়ে চলে গেল কোথাও, আর ফিরলো না। কেবল গুঞ্জন ছিল, সে খারাপ কাজে জড়িয়ে পড়েছে।
দশ বছর কেটে গেল। আহির এখন একজন সফল শিল্পী। তার ছবিতে কাশ্মীরার নদীর স্রোত, গ্রামের সাদাসিধে মানুষের জীবন – সবকিছুই জীবন্ত হয়ে উঠতো। একদিন, কলকাতার এক নামকরা আর্ট গ্যালারিতে তার ছবির প্রদর্শনী। আহিরের মনে একটা অস্থিরতা ছিল। কেন জানি মনে হচ্ছিল, কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। আর ঠিকই ঘটলো।
গ্যালারিতে ভিড় লেগেছিল। হঠাৎ, মানুষের চিৎকারের মাঝে দেখা গেল এক ছেলেকে। বয়স বাড়লেও চোখের দৃষ্টিগুলো আহিরকে চিনিয়ে দিল। বাসু! কিন্তু আগের বাসু নেই। চোখে এক অন্ধকার, মুখে কঠিনভাব।
আহির আর বাসুর দেখা হলো। দু’জনের মধ্যে কথা বলার মতো পরিবেশন ছিল না। কিন্তু চোখের দেখা মাত্রই বুঝতে পারলো, দশ বছরের ফাঁকে অনেক কিছুই বদলে গেছে। পরের কয়েকটা দিনে আহির জানতে পারলো, বাসু জেলে ছিল, এখন মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু কেন, সেটা বাসু বলতে চাইলো না।
আহির বাসুকে দেখে খুশি হতে পারলো না। সোনার মৃত্যুর কথা মনে হচ্ছিল বারবার। বাসু কি এখনও পুরনো
অপরাধের সাথে জড়িত? কিন্তু বাসুকে দেখেও রাগ হলো না। বরং এক অদ্ভুত সহानুভূতি জাগলো। বাসু যেন একটা রহস্যে জড়িয়ে, আর সেই রহস্যের গভীরতা তার চোখে ফুটে উঠছিল। আহির বাসুকে তার ফ্ল্যাটে থাকার জায়গা দিল। শুরুতে দু’জনের মধ্যে কথা কম হতো। বেশিরভাগ সময় বাসু নিজেকে আঁটসেরে রাখতো। কিন্তু এক রাতে, ঝড়ের রাতে, বাসু তার গল্প খুলে বললো।
সেই দুর্ঘটনার রাতে, সোনা নদীতে স্নান করছিল। হঠাৎ একটা ঝড় উঠলো। বাসু নদীর ধারেই ছিল। সোনাকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। কিন্তু ঠিক সেই সময়, কয়েকজন লোক নদীর কাছে এসে সোনাকে ধরে ফেললো। তারা জোর করে নৌকায় তুললো। বাসু চিৎকার করে বাধা দিলেও কেউ শোনে নি। সেই লোকেরা কারা, কেন তারা সোনাকে নিয়ে গেল, কিছুই জানতো না সে।
পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে গেল বাসু। কিন্তু তার কথায় কেউ বিশ্বাস করলো না। সোনার সাথে তার বন্ধুত্বের কথা জেনে, সন্দেহের কালো ছায়া পড়লো তার ওপর। পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলো, ধরে নিল। দীর্ঘদিনের কারাগার জীবনের পর, বাসু এখন মুক্ত। কিন্তু সোনার কথা ভাবতেই তার বুক কেমন করে ওঠে। আর বোঝে না, সেই রাতে ঠিক কি ঘটেছিল।
আহির বাসুর গল্প শুনে চুপ থাকলো। তার মনেও অনেক প্রশ্ন জাগলো। কারা ছিল সেই লোকেরা? সোনাকে কেন নিয়ে গেল তারা? আর এই ঘটনার সাথে কি কোনো গোপন কারণ জড়িয়ে আছে?
পরের দিন, আহির বাসুকে নিয়ে গ্রামে ফিরলো। গ্রামে ফিরে আহির জানতে পারলো, সোনার বাবা, গোপাল, এখন আর নেই। মেয়ের মৃত্যুর শোকে তার শরীর দিন দিন খারাপ হয়েছিল। সোনার মাকেও দেখা গেল মলিন হয়ে। কিন্তু সবার চেয়ে বেশি চমকে গেল আহির, যখন জানতে পারলো, সোনার এক বিশেষ কারণে গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোথায় যাবে, বা কেন যাবে, সেটা কেউ জানতো না।
এই নতুন খবরে আহিরের মনে আরও জল্পনা জাগলো। সোনা কি কোনো গোপন জানতো? আর সেই গোপন কি তার অপহরণের সাথে জড়িয়ে? আহির বাসুকে সাথে নিয়ে সোনার মায়ের কাছে গেল। অনেক কষ্টে সোনার মা জানাল, সোনা একটা চিঠি লিখে গিয়েছিল, কিন্তু গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার আগের রাতে সেই চিঠিটা হারিয়ে ফেলে।
সোনার হারানো চিঠিটা যেন একটা হঠাৎ ঝড়ের মতো আহিরের মনের শান্তি কেড়ে নিল। সেই চিঠিতে কি লেখা ছিল, কে জানে? কিন্তু এই চিঠিই হয়তো সোনার অপহরণের রহস্যের দুয়ার খুলে দিতে পারে। আহির আর বাসু দু’জনেই মনে মনে ঠিক করলো, যেভাবেই হোক, সেই চিঠিটা খুঁজে বার করতে হবে।
পরের কয়েকদিন গ্রামে ঘুরে বেড়ালো আহির আর বাসু। সোনার সাথে খেলাধুলো করা জায়গাগুলোতে গেল, সেই গাছতলাটা দেখলো, যেখানে বসে দু’জনে স্বপ্নের কথা বলতো। কিন্তু চিঠির কোনো খোঁজ পেলো না। হতাশা গ্রাস করতে শুরু করলো আহিরকে। কিন্তু ঠিক যখন সে হাল ছেড়ে দেবার মুখে, তখন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।
একদিন সন্ধ্যায়, গ্রামের পুকুর পাড়ে বসে সোনার ছোটবেলার খেলার সাথী, লিলির সাথে দেখা হলো আহিরের। লিলি এখন বেশ বড় হয়েছে, কিন্তু চোখের সেই সরলতা এখনও আছে। কথার ফাঁকে লিলি আহিরকে জানালো, সোনার মৃত্যুর পর সে নদীর ধারে একটা কাগজের টুকরো পড়ে থাকতে দেখেছিল। কিন্তু ছেলেমানুষের বুদ্ধিতে তখন সেটা নেয়নি। কিন্তু এখন আহিরের কথা শুনে মনে পড়লো সেই ঘটনা।
আহিরের চোখ জ্বলে উঠলো আশায়। পরের দিন সকালে লিলির দেখানো জায়গায় গেল সে। অনেক খোঁজার পর, মাটির নিচে আধখানা পচা কাগজের টুকরো পাওয়া গেল। সেই কাগজের টুকরোটাই ছিল সোনার হারানো চিঠির অংশ!
কাগজের টুকরোটা নিয়ে আহির ছুটলো বাসুকে দেখাতে। কাগজের টুকরোটা ছিল খুবই অস্পষ্ট। তাতে লেখা ছিল, “মামা…কলকাতা…ছাড়াতে হবে…”। বাকিটা অংশটা মাটি খেয়ে নষ্ট হয়ে গেছে।
কিন্তু এই অল্প লেখাই যথেষ্ট ছিল আহির আর বাসুর কাছে। সোনার এক মামা ছিল কলকাতায়। আর সেই মামার কাছেই হয়তো যাওয়ার কথা ভাবছিল সোনা। এই নতুন সূত্র ধরে কলকাতায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো আহির আর বাসু।
কলকাতায় এসে সোনার মামার খোঁজ নেওয়া শুরু করলো তারা। কিন্তু কাজটা সহজ ছিল না। শেষমেশ, অনেক কষ্টের পর, এক জোচ্চড় চালের বস্তিতে সোনার মামার ঠিকানা খুঁজে পেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা যে খবর পেল, তা তাদের হিমশি করে দিল।
জরাজীর্ণ বস্তিটার ভীড়ের মধ্যে ঠাসা ছিল সোনার মামার ক্ষুদ্র কুঁড়ে ঘর। ভাঙা দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা হলো এক বৃদ্ধ মানুষের সাথে। সোনার মামা, হরিদাস। কিন্তু হরিদাসের চোখে কোনো চমকের রেখা নেই। আহির নিজেকে পরিচয় দিয়ে সোনার কথা জিজ্ঞাসা করলো। হরিদাস ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো, “সোনা এসেছিল। কিন্তু বেশিদিন থাকলো না। একটা লোক এসে নিয়ে গেল।”
আহিরের হৃৎপিণ্ডটা কাঁপলো। “কে সেই লোক? কোথায় নিয়ে গেল?” উত্তেজনা আর অস্থিরতায় কণ্ঠটা ভারী হয়ে গেল তার। হরিদাস নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “জানি না। কিন্তু সোনা আমাকে জানিয়েছিল, সে একটা খतरা থেকে বাঁচার চেষ্টা করছে। কারা সেই খুনোখাঁটা লোক, কী কারণে তারা সোনার পিছনে লেগেছে, সেটা আমি জানি না।”
হরিদাসের কাছ থেকে আর কিছু জানা যায়নি। আহির হতাশ হয়ে বেরিয়ে পড়লো। বাইরে বাসু দাঁড়িয়ে ছিল। দু’জনেই চুপচাপ। হঠাৎ, বাসুর মুখে ফুটে উঠলো একটা চিন্তাভাব। “সোনা কিছু খুনোখাঁটার কথা বলেছে? সেই লোকেরা কি তার অপহরণের পিছনে থাকতে পারে?”
আহির মাথা নাড়লো। “কিন্তু কারা হতে পারে সেই লোকেরা? আর সোনা কী গোপন জানতো যে তার জীবন বিপদে পড়লো?”
এই প্রশ্নগুলো নিয়ে কয়েকদিন কলকাতায় ঘুরে বেড়ালো আহির আর বাসু। তারা পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথাও ভাবলো। কিন্তু হরিদাসের কাছে কোনো নিদিষ্ট প্রমাণ না থাকায়, পুলিশ তেমন গুরুত্ব দিলো না।
একদিন সন্ধ্যায়, একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিল আহির আর বাসু। হঠাৎ, আহিরের চোখ আটকে গেল একটা পুরনো খবরের কাগজে। সেখানে ছিল একটা নিখোঁজ ছোট বাচ্চা খোঁজার বিজ্ঞাপন। ছবিটা দেখে আহির চমকে উঠলো। ছবিটা ছিল সোনার ঠিক ছোটবেলার!
আহির কাগজটা ছুঁটে নিয়ে বাসুকে দেখালো। “এটা কি?” বাসুর চোখও কপালে উঠলো। “সোনা! কিন্তু এটা কীসের বিজ্ঞাপন?”
খবরের কাগজটা আরও মনোযোগ দিয়ে পড়লো আহির। বিজ্ঞাপনে লেখা ছিল, সোনা নামের এক ছোট্ট মেয়েকে কয়েক বছর আগে কলকাতার এক ব্যস্ত রাস্তা থেকে অপহরণ করা হয়েছিল। তার বাবা-মা খুবই দুঃখিত এবং সোনাকে ফিরিয়ে আনার জন্য যে কেউ কোনো খবর দিতে পারলে পুরস্কার দেওয়া হবে।
এই খবরের কাগজটা যেন একটা বোমা ফাটলো আহির আর বাসুর মাথায়। সোনা কি আসলেই অপহৃত ছিল ছোটবেলায়? আর তারপর সেই অপহরণকারীদের কাছ থেকে কি কোনোমতে বাঁচতে পেরেছিল? কিন্তু যদি তাই হয়, তাহলে এত বছর সে কোথায় ছিল? আর কেন সে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি?
অগণিত প্রশ্নের জালে জড়িয়ে গেল আহির। কিন্তু একটা জিনিস এখন স্পষ্ট: সোনার জীবনে একটা গোপন অধ্যায় ছিল, যা তার অপহরণ এবং পরবর্তী ঘটনাবলীর সাথে জড়িয়ে। এই খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে আহির আর বাসু সোনার বাবা-মার ঠিকানা খুঁজে বার করলো।
কলকাতার এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকতেন সোনার বাবা-মা। বৃদ্ধ দম্পতির চোখে এখনও ছিল সোনাকে হারানোর শোকের ছায়া। আহির নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং সোনার খোঁজে তাদের কাছেই এসেছেন, সেটা জানালেন।
খবরের কাগজের ছবি দেখিয়ে আহির জিজ্ঞাসা করলেন, “এই কি সোনা?” সোনার মা চোখেমুখে জল এনে মাথা নাড়লেন। “না, এটা আমার সোনা না। আমার সোনা আর একটু খাঁট।”
এই কথায় আবার এক ধাক্কা খেল আহির। ছবিটা কি তাহলে ভুল ছিল? না হয়, সোনা তার পরিচয় গোপন করে বেঁচেছিল? কিন্তু কেন? আর এসবের সাথে সোনার মামার কাছে তার আসা এবং খুনোখাঁটার কথা জানানোর কী সম্পর্ক?
আহির সোনার বাবা-মাকে সমস্ত কিছু খুলে বললেন। সোনার মৃত্যুর কথা, বাসুর গ্রামে ফিরে আসা, হারানো চিঠির টুকরো, এসব সবকিছু। সোনার বাবা-মা অবাক হয়ে শুনলেন। কিন্তু তাদের কাছেও কোনো উত্তর ছিল না।
কলকাতায় আরও কয়েকটা দিন কাটালো আহির আর বাসু। তারা সোনার খোঁজে এঁকেবারে কোনো সূত্র না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ছিল। ঠিক যখন তারা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিল, তখন এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো।
একদিন সকালে, হোটেলে থাকাকালীন, আহিরের ফোনে একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন এলো। ফোন ধরতেই একটা মৃদু, কিন্তু চেনা কণ্ঠ ভেসে এলো, “আহির?”
আহির চমকে উঠলেন। কণ্ঠটা ছিল সোনার! কিন্তু কিছু বলা সম্ভব হওয়ার আগেই ফোনটা কেটে গেল। আহির বারবার সেই নম্বরে ফোন করলেন, কিন্তু আর লাগলো না।
কিন্তু এই ফোন কলটা আহিরকে আশা জাগিয়ে দিল। সোনা জীবিত! সে কোথায় আছে, কী অবস্থায় আছে, সেটা জানা না গেলেও, সে যে বেঁচে আছে, এটাই যথেষ্ট। আহির আর বাসু সেই ফোন কলকে কাঠামো বানিয়ে নতুন করে তদন্ত শুরু করলো। কলকাতার পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথা ভাবলো আবার। এইবারে হাতে তাদের ছিল সোনার কণ্ঠের রেকর্ডিং, যা পুলিশকে হয়তো কিছুটা আগ্রহী করতে পারে।
পুলিশের কাছে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বললো আহির। হোটেলের রুম থেকে করা সেই ফোন কলের রেকর্ডিংটাও শোনালো। পুলিশ অফিসার কৌতূহলী হলেন। তিনি সোনার ছোটবেলার অপহরণের খবরটিও খাতা থেকে বের করলেন। কিন্তু এত বছর পর, কোনো সূত্র না থাকায়, তিনি আশ্বাস দিতে পারলেন না তেমন। তবে, তিনি আহিরকে সাহায্য করার আশ্বাস দিলেন।
পুলিশের পাশাপাশি নিজেরাই তদন্ত চালিয়ে গেল আহির আর বাসু। সোনার ফোন করা নম্বরটা ট্রেস করার চেষ্টা করলো তারা। কিন্তু সেটাও ছিল প্রি-পেইড সিম, কোনো তথ্য দেয়নি। হতাশ হলেও হাল ছেড়ে দেয়নি তারা। সোনার কণ্ঠটা মনে রেখে, শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে মানুষকে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো, এই কণ্ঠ চেনে কেউ কি?
এই খোঁজে একদিন তারা পৌঁছলো কলকাতার একটি প্রাচীন গীতিধারা গানের স্কুলে। সেখানকার একজন বয়স্ক শিক্ষিকা, সোনার কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলেন। তিনি জানালেন, এই কণ্ঠ তারই এক প্রাক্তন ছাত্রীর। সেই ছাত্রী ছিল মীরা। কিন্তু মীরা কয়েক মাস আগে স্কুল ছেড়ে দিয়েছে।
একটা নতুন নাম, মীরা। কিন্তু সোনা কেন নিজের নাম পরিবর্তন করবে? আর গীতিধারা গানের স্কুলে কেন যাবে সে? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে স্কুলের শিক্ষিকার সাথে কথা বললো আহির আর বাসু। শিক্ষিকা জানালেন, মীরা খুবই মেধাবী ছিল গানে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কখনও কথা বলতো না। শুধু জানা যে, সে একা থাকে এবং খুবই সাবধানে থাকার চেষ্টা করে।
মীরার ঠিকানা খুঁজে বার করা কঠিন ছিল। কিন্তু শেষমেশ, অনেক খোঁজের পর, তারা জানতে পারলো, মীরা শহরের এক পুরনো বাড়িতে থাকে। আহির আর বাসু দু’জনেই উত্তেজিত হয়ে সেই বাড়ির সামনে গেল। দরজা খুললো এক মৃদুস্বভাবের মেয়ে। সেই মুখ, সেই চোখ – সোনা!
কিন্তু সোনা এখন আর সেই গ্রামের সহজ সরল মেয়ে নেই। চোখে এক অব্যক্ত ভয়, চেহারায় এক অবসাদ। সোনা চমকে গেল আহির আর বাসুকে দেখে। কিন্তু আহির আশ্বস্ত করে বললো, “ভয় পেয়ো না সোনা
“…আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
কথায় সোনা চুপ থাকলো। হঠাৎ, বাড়ির ভিতর থেকে একজন বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলো। সেই লোকটিই ছিল সোনার মামা, হরিদাস। দেখে মনে হলো, কয়েকদিনের মধ্যেই সে আরও বুড়ো হয়ে গিয়েছে। হরিদাস আহির আর বাসুকে চিনলো। চিন্তিত চোখে জিজ্ঞাসা করলো, “কী হয়েছে?”
আহির সোনার কাছে এগিয়ে গেল। সোনার হাত ধরে আস্তে বললো, “সব ঠিক আছে সোনা। আমরা জানি সব। তোমার পরিবারও তোমাকে খুঁজছে।”
সোনার চোখে জল এলো। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। হরিদাস বুঝতে পারলো পরিস্থিতি। আহিরকে একটা চা নিরাময়ের ইশারা দিয়ে, সে সোনাকে নিয়ে ভিতরে চলে গেল।
কিছুক্ষণ পর, সোনা বেরিয়ে এলো। চোখ লাল, কিন্তু মুখে একটা স্থিরতা ফুটে উঠেছে। সে আহিরের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমি তোমাদের সব বলব।”
সেই দিন সন্ধ্যায়, সোনা তার গল্প খুলে বললো। ছোটবেলায় তাকে কারা অপহরণ করেছিল, সেটা সে জানে না। কিন্তু তারা তাকে একটা দূরবর্তী শহরে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে অনেক বাচ্চাকে জোর করে ভিক্ষা করানো হতো। কয়েক বছর সেখানে কষ্টের জীবন কাটালো। কিন্তু একদিন সুযোগ পেয়ে সে পালিয়ে আসে।
কলকাতায় এসে সে আশ্রয় নেয় হরিদাসের কাছে। হরিদাস তার দূর সম্পর্কের মামা। সোনা জানতো না তার বাবা-মা জীবিত আছে কিনা। তাই হরিদাসের কাছেই থাকতে শুরু করে। কিন্তু সেই অপহরণকারীরা এখনও তার পিছনে লেগে আছে, এটা সে জানতো। তাই নিজের পরিচয় গোপন করে মীরা নামে থাকতে শুরু করে। গীতিধারা গান শেখার মাধ্যমে সে নিজের নতুন পরিচয় গড়ে তুলতে চেয়েছিল।
সোনার গল্প শুনে আহির আর বাসুর চোখে জল এলো। তারা সোনাকে আশ্বাস দিল, এবার সে নিরাপদে থাকবে। পুলিশের সাহায্য নিয়ে তারা সোনাকে তার বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলো।
কয়েকদিন পর, সোনার সাথে দেখা হলো তার বাবা-মার। মায়ের কোলে মাথা রেখে কান্না করলো সোনা। বাবা কাঁধে হাত রেখে আশ্বাস দিলেন। বহু বছর পর হারানো মেয়েকে ফিরে পেয়ে তারা অশেষ সুখী।
সোনার অপহরণের রহস্যও উদঘাটন হলো। পুলিশের তদন্তে জানা গেল, সোনা যে বাচ্চাদের সাথে থাকতো, সেই দলের কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। সোনাকে অপহরণের মূল কারণটা জানা না গেলেও, অন্যান্য বাচ্চাদের
অন্যান্য বাচ্চাদের উদ্ধারের আশা জাগলো। সোনার সাক্ষ্য পুলিশের তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল। সেই সাথে, সোনার গানের প্রতিভাও ফুটে উঠলো। পুরনো জীবনের কষ্টগুলো গানের মাধ্যমে ঢেকে দিয়ে সে নতুন করে শুরু করলো। গীতিধারার মূর্তি হয়ে উঠলো সে, অন্য অপহৃত বাচ্চাদের গল্প শোনালো গানে, তাদের আশার আলো জাগিয়ে দিল।
আহির আর বাসু খুশি মনে ফিরে গেল গ্রামে। সোনার গল্প নিয়ে গেল তারা। সেই গল্প শুনে গ্রামবাসীদের চোখে জল এলো। কিন্তু সবার মনেই জাগলো একটা প্রশ্ন – সোনা যে গাছতলায় বসে স্বপ্ন দেখতো, সেখানে সেই ছেঁড়া চিঠিটা কার লেখা ছিল? কী লিখেছিল সেখানে?
একদিন, সোনার বাবা-মা আহিরের সাথে যোগাযোগ করলেন। তারা জানালেন, পুরনো জিনিসপত্র ঘাঁটতে গিয়ে একটা পুরনো ডায়েরি পেয়েছেন। সেই ডায়েরিতে সোনার হাতের লেখায় লেখা ছিল, “মামা আসছে, কলকাতায় নিয়ে যাবে, গান শেখাবে…”।
এই ডায়েরির পাতা আর সোনার কথা মিলে গেল। মনে হলো, সোনা হয়তো নিজের মামাকেই ডেকেছিল চিঠিতে। কিন্তু কেন? কী জানতো সেই ছোট্ট মেয়েটা?
এই প্রশ্নের উত্তর হয়তো কোনোদিন পাওয়া যাবে না। কিন্তু সোনার জীবনের এই অধ্যায় শেষ হলো একটা সুখের নোটে। সে ফিরে পেল তার পরিবার, খুঁজে পেল তার গানের পথ। আর আহির আর বাসু, তারা ফিরে গেল তাদের গ্রামের জীবনে, কিন্তু সোনার স্মৃতি নিয়ে, এক অসাধারণ গল্প নিয়ে।