কলকাতার ঝমঝমিয়ে রোদের মধ্যে রেখে এসেছিলাম ঐ লেখাটা। অবুঝ কিশোরীবেলায় পড়া সেই উপন্যাস, ‘শেষের আলোকিত মুখ’। লেখিকা ছিলেন মিস ঊর্বশী সেন। এক রহস্যময় গল্প, ভালোবাসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর সমাজের চাপের জাল। ১৯৪০ এর দশকের কলকাতা, যেখানে জীবনযাত্রা ছিল অশান্ত, দেশভাগের ক্ষত এখনও শুকায়নি।
উপন্যাসটি শুরু হয় শিপ্রা আর তার মায়ের কলকাতায় পদার্পণের মধ্য দিয়ে। ধনী পরিবারের মেয়ে শিপ্রা আর তার বিধবা মা মিসেস সেন। নতুন জীবন শুরুর আশায় এসেছেন তারা। কিন্তু পরিস্থিতি ছিল কঠিন, চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দা। শিপ্রার মা যে টিউশনি করতেন, সেখান থেকেই কোনোমতে সংসার চলত।
শিপ্রার নিজের জীবনেও ঝড় এসেছিল। একদিন কলেজের ক্যান্টিনে তার দেখা হয় অভিজিৎ রায়ের সাথে। দীর্ঘদেহী, চোখে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, অভিজিৎ ছিলেন শিপ্রার সহপাঠী। তার সঙ্গীদের সাথে দেখা হয় শিপ্রার। সবাই সুশ্রী, মার্জিত যুবক। আর তার মধ্যে ছিলেন রোহন সেন, অভিজিৎয়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শিপ্রা মুগ্ধ হয়েছিলেন রোহনের চেহারায়।
কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলেন শিপ্রা, রোহনের আচরণে এক ধরণের রহস্য আছে। কখনও সহজ, কখনও আবার নিঃসঙ্গ। অভিজিৎয়ের সঙ্গে সম্পর্কটাও মনে হচ্ছিল বেশ জটিল। রোহন যেন কোনো এক চিন্তায় মগ্ন থাকতেন সবসময়।
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - অপ্রতিরোধ্য: এক পা নিয়েও হাঁটতে শেখা, দৌড়ানো, এবং জয়ী হওয়ার গল্প। বাধাকে জয় করে স্বপ্ন পূরণের মোটিভেশনাল বাংলা ছোট গল্প। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
একদিন শিপ্রা জানতে পারলেন, রোহনের কোনো বাড়ি নেই। অভিজিৎদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে থাকেন তিনি। অর্থনৈতিক দুরবস্থা, চাকরি নেই, এইসব নিয়েও রোহন যেন চিন্তিত ছিলেন না। শিপ্রার মনে আরও প্রশ্ন জাগল।
এর মধ্যে শিপ্রা জানতে পারলেন, রোহন একজন বিধবা মহিলার সাথে দেখা করতে যান। রহস্য আরও গাঢ় হলো। কৌতূহল আর সহানুভূতি মিশে এক অদ্ভুত আকর্ষণ জন্মালো শিপ্রার মধ্যে রোহনের প্রতি।
একদিন শিপ্রা রোহনকে সাহস করে জিজ্ঞাসা করলেন তার অতীত সম্পর্কে। রোহন তখন গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমার জীবনে এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে তাকে হারিয়েছি।”
রোহনের গল্প শুনে শিপ্রার মনে হলো, হয়তো রোহন ঐ বিধবা মহিলাকে ভালোবাসতেন। কিন্তু রোহন আর কিছু বলতে চাইলেন না। শিপ্রার জিজ্ঞাসায় জড়িয়ে পড়তে চাইলেন না। এই অস্পষ্টতা আরও দ্বিধা জাগালো শিপ্রার মনে।
কয়েকদিন পরে শিপ্রা দেখলেন, রোহন একটা চিঠি লিখছেন। চিঠির লেখাটা পরিচিত মনে হলো। শিপ্রা চিনতে পারলেন, লেখাটা মিসেস সেনের, তার নিজের মায়ের! কৌতূহলে আর চমকে কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে শিপ্রা জিজ্ঞাসা করলেন, “এটা কি লিখছেন রোহনবাবু?”
বাংলা রোমান্টিক ছোট গল্প - দুই হৃদয়: অদিতি, এক ধনী পরিবারের মেয়ে, তার স্বপ্নের প্রেম খুঁজে পায় রোহন নামক এক তরুণের মধ্যে। কিন্তু, সামাজিক রীতিনীতি আর অর্থনৈতিক বৈষম্য তাদের প্রেমের পথে বাধা সৃষ্টি করে। অপেক্ষা, ত্যাগ আর বিশ্বাসের মাধ্যমে তারা কি তাদের ভালোবাসাকে টিকিয়ে রাখতে পারবে? সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
রোহন চমকে উঠলেন। চিঠিটা দ্রুত আড়াল করে ফেললেন। একটু থমকে তারপর বললেন, “একটা ভুল হয়ে গেছে। এটা আসলে অন্য একটা চিঠি।”
শিপ্রার মনে সন্দে জাগল আরও বেশি। রোহন কি তার মায়ের সাথে চিঠি চালাচি করছেন? কিন্তু কেন? এই রহস্যের জাল আরও জড়িয়ে যাচ্ছিল।
কয়েকটা দিন পরে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো। শিপ্রা তার মায়ের ঘরে গেলে দেখলেন, রোহন সেখানে দাঁড়িয়ে। দু’জনেই চমকে গেলেন। শিপ্রা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী হয়েছে রোহনবাবু? আপনি এখানে?”
রোহন কিছুটা ঘাবড়ানো গলায় বললেন, “আপনার মাকে একটা জরুরি কথা বলতে এসেছিলাম।”
শিপ্রা তার মায়ের দিকে তাকালেন। মিসেস সেনের চোখেও এক অদ্ভুত চাহনি। কথাবার্তা বলার আগে রোহন শিপ্রাকে বেরিয়ে যেতে বললেন। শিপ্রা মনে মনে রাগ সামলে বাইরে চলে গেলেন।
কিন্তু কৌতূহল আর সন্দে তাকে বসে থাকতে দিল না। দরজার ফাঁক দিয়ে সে চেষ্টা করলো কথাবার্তা শুনতে। শিপ্রা শুনতে পেল তার মায়ের কথা, “আপনি ঠিক করেছেন রোহন? এটা কি ঠিক হবে?”
রোহনের গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল, “আমার আর কোনো উপায় নেই, মিসেস সেন। আপনিই একমাত্র ভরসা।”
এর বেশি কিছু শোনা গেল না শিপ্রার। কিন্তু শোনা কয়েটা কথাই তাকে আরও বেশি বিভ্রান্ত করে দিল। রোহন তার মায়ের সাথে কি আঁটঘঁট চুক্তি করছেন?
পরের কয়েকটা দিন আরও রহস্যের মধ্যে দিয়ে গেল। রোহন মাঝেমধ্যে আসতেন শিপ্রাদের বাড়িতে। কিন্তু তার মায়ের সাথে কী গোপন কথা হতো, তা বুঝতে পারত না শিপ্রা। একদিন সন্ধ্যায় শিপ্রা দেখলেন, রোহন একটা পুরনো খাতা তার মাকে দিচ্ছেন। খাতাটা দেখে শিপ্রার মায়ের চোখে জল এসে গেল।
রোহন চলে যাওয়ার পরে শিপ্রা জিজ্ঞাসা করলেন, “কী ছিল সেই খাতাটা মা? কেন আপনার চোখে জল?”
মিसेস সেন একটু চুপ করে থেকে বললেন, “এটা…এটা রোহনের বাবার লেখা। আমার আর তার বাবার অনেকদিনের বন্ধুত্ব ছিল। রোহনের বাবা ছিলেন লেখক, আর আমি ছিলাম তার অনুপ্রেরণা।”
শিপ্রার আরও কৌতূহল জাগল। “কিন্তু মা, রোহনের সাথে আপনার এই গোপন কথাবার্তা, এই খাতা…?”
মিसेস সেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। “শিপ্রা, অনেক কিছুই তুমি জানো না। রোহন আর আমার পরিবারের একটা পুরনো গল্প আছে। একটা ভুল, একটা বিশ্বাসঘাতকতা, যার ফলে রোহনের পরিবারের জীবনযাত্রা বদলে গিয়েছিল।”
অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্প - ঊষাশ্রীর স্বপ্ন: এই অনুপ্রেরণামূলক বাংলা ছোট গল্পটি ঊষাশ্রী নামে এক তরুণী লেখিকার লন্ডনে আসার পর লেখিকা হওয়ার স্বপ্ন পূরণের কাহিনী বর্ণনা করে। গল্পটি লেখালেখির পথে আসা বাধা, হতাশা এবং ঊষাশ্রীর অদম্য সাহস ও ধৈর্যের উপর আলোকপাত করে। ঊষাশ্রীর গল্প অন্য স্বপ্নবাজদের অনুপ্রেরণা জোগাবে এবং তাদের স্বপ্নের পিছনে ছুটতে উৎসাহিত করবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
শিপ্রা মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলেন, রোহনের বাবা ছিলেন একজন স্বনামধন্য লেখক। মিसेস সেন ছিলেন তার অনুগত পাঠিকা। কিন্তু রোহনের বাবার আর মিসেস সেনের স্বামী, শিপ্রার বাবার, ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একদিন শিপ্রার বাবা রোহনের বাবার একটি অসমাপ্ত উপন্যাস চুরি করে নিজের নামে প্রকাশ করেন। উপন্যাসটি বিরাট সাফল্য লাভ করে। কিন্তু রোহনের বাবার জীবনটা ধ্বংস হয়ে যায়। চুরির প্রমাণ না থাকায় তিনি কোনো কিছুই করতে পারেননি। মানসিক আঘাতে শিপ্রার বাবাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর কয়েক বছর পরেই মৃত্যু হয় তাঁর।
মিसेস সেন আর রোহনের বাবা এই বিশ্বাসঘাতকতা কখনও ভুলতে পারেননি। কিন্তু সামাজিক মর্যাদা আর রোহনের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে চুপ থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন।
শিপ্রা চমকে গেলেন। তার সারা জীবনের ধারণা ছিল, তাঁর বাবা একজন সম্মানিত লেখক। এখন জানলেন, সবই ছিল এক বড় মিথ্যা।
মিसेস সেন আরও বললেন, “রোহন এখন আমার কাছে এসেছে, সত্যিটা জানতে। তার বাবার অসমাপ্ত উপন্যাসটা সে খুঁজছে। আমি তাকে সেই খাতাটা দিয়েছি, যেখানে তাঁর বাবা উপন্যাসের কয়েকটা অংশ লিখে রেখেছিলেন।”
শিপ্রার মনে একটা ঝড় চলছিল। একদিকে বাবার বিশ্বাসঘাতকতা, অন্যদিকে রোহনের দুঃখ। কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিলেন না।
এর পরের কয়েকদিন খুবই কষ্টের ছিল শিপ্রার জন্য। বাবার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলতে পারছিলেন না, কিন্তু রোহনের দুঃখের কথাও ভাবতে হচ্ছিল।
একদিন শিপ্রা রোহনকে ডাকলেন। রোহন এসে হাজির হলেন। শিপ্রা সব খুলে বললেন, তার বাবার বিশ্বাসঘাতকতা, তার মায়
শিপ্রা কথা শেষ করার আগেই রোহন তাকে থামিয়ে দিলেন। কঠিন গলায় বললেন, “আমি জানি।”
শিপ্রা চমকে গেলেন। “কীভাবে জানলেন?”
রোহন তাঁর পকেট থেকে একটা পুরনো ডায়েরি বের করলেন। “আমার বাবার ডায়েরি। এটা অনেকদিন আগে আমি পেয়েছিলাম। তাঁর লেখা থেকেই সবটা জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু আপনার মা, আপনি…আপনাদের কষ্টের কথা ভেবে চুপ ছিলাম।”
শিপ্রা একটু চুপ করে রইলেন। রোহনের কথাগুলোর মধ্যে সত্যিটা খুঁজে পেলেন। তাঁর বাবার কাজটা ঠিক ছিল না, কিন্তু রোহনের বাবার লেখাগুলো প্রকাশ করার জন্য কোনো রাস্তা ছিল না।
“কী করবেন এখন রোহনবাবু?”
রোহন দৃঢ় গলায় বললেন, “আমি আমার বাবার লেখাগুলো প্রকাশ করবো। সত্যিটা সবার সামনে আসবে। কিন্তু আপনার মাকে জড়িয়ে দেব না।”
শিপ্রা স্বস্তি পেলেন একটু। তার মায়ের জীবনটা আর বিশ্রৃঙ্খল হবে না। রোহন চলে যেতে উঠলেন। শিপ্রা জিজ্ঞাসা করলেন, “আমার সাথে আপনার সম্পর্ক?”
রোহন থমকে গেলেন। একটু পরে বললেন, “আমি আপনাকে ভুল বুঝিয়েছি, শিপ্রা। আপনার বাবার কাজের জন্য আপনাকে দায়ী করা যায় না। আপনি আমার বন্ধু।”
শিপ্রা একটু মন খারাপ হলেন। কিন্তু রোহনের দুঃখের সাথে আর জড়াতে চাইলেন না নিজের ভালোবাসা।
কয়েকটা মাস পরে শহরে একটা বড়ো খবর ছড়াল। রোহন সেন, একজন নতুন লেখক, তার বাবার অসমাপ্ত উপন্যাসটা সম্পূর্ণ করে প্রকাশ করেছেন। উপন্যাসটা ঝড়ের মতো ছড়িয়ে পড়ল। সাহিত্য জগতের উচ্চশিখরে আরোহণ করল রোহন।
কিন্তু সত্যিটা কী, সেটা কেউ জানতে পারল না। শুধু শিপ্রা আর তার মা জানতেন, এই সফল লেখকের পেছনে লুকিয়ে আছে একটা বিশ্বাসঘাতকতার গল্প, একটা দীর্ঘদিনের অভিমান।