ঝিরিঝিরি বাতাস যেন অশরীরি ফিসফিস করে কথা বলছে। প্রতিটি পাতার কম্পন যেন নিঃশব্দে কোনো গোপন ভাষায় কথোপকথন চলছে। সন্ধ্যা নামছে, চারপাশে ঘন্টনাশুদ্ধ জঙ্গল যেন একটা অস্বাভাবিক নীরবতায় চুপসে যাচ্ছে।
আমরা চারজন বন্ধু – সোহম, ঊর্মিলা, রোহিত আর আমি, অদিতি। কাজের চাপ, জীবনের একঘেয়েমি থেকে একটুখানি আলাদা বাতাস খেতেই এই সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলে এসেছি। কিন্তু এই নিস্তব্ধতা, এই অচেনা পরিবেশ আমাদের মনে একটা অজানা সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে।
এমন সময়, দূর থেকে একটা চিৎকার। এমন চিৎকার যা আগে কখনো শোনা যায়নি। পাখির ডাক নয়, কোনো জন্তুর গর্জন নয়, এ যেন কোনো অপার্থিব সত্ত্বার আর্তনাদ। শিহর শরীর জুড়ে বয়ে গেল। আমরা চারজন একে অপরের দিকে তাকালাম, সবার চোখে অবাক চাউনি।
সোহম, আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে বীরত্ব দেখানো ছেলে, কিন্তু এই শব্দ শোনে তার চোখেও একটা ভয়ের ছায়া পড়ে গেল। “এটা কী?” সে কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করল।
ঊর্মিলা, আমাদের বুদ্ধিদীপ্তা মেয়ে, চেষ্টা করল ব্যাপারটা সামাল দেওয়ার। “কিছু না, হয়তো কোনো রাতের পাখি।” কিন্তু তার কথায় নিজেও বিশ্বাস করতে পারল না।
রোহিত, আমাদের গ্রুপের সবচেয়ে ভীতু ছেলে, সে তো আর কথাই বলছে না। শুধু গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে, মাঝে মাঝে কাঁপা হাতে আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার গাছের আড়ালে ঢুকে যাচ্ছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার সেই চিৎকার। আরো জোরে, আরো ভয়ঙ্কর। এবার আর সন্দেহ করার কোনো জায়গা নেই। জঙ্গলে কোনো অশরীরি উপস্থিতি আছে, আর সেই উপস্থিতিই এই চিৎকারের উৎস।
আঁধার নামতে শুরু করেছে। আমরা তাড়াতাড়ি ক্যাম্পফায়ার জ্বালালাম। কাঠের ফাটার শব্দ, আগুনের ঝলকানি – যেন আমাদের একটুখানি স্বস্তি দিচ্ছে। আগুনের আলোয় বসে, আমরা গল্প করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে কোনো একটা জোড়া চোখ আমাদের দিকে অন্ধকারের ভেতর থেকে লুকিয়ে দেখছে। সেই চিৎকার আবার শোনা গেল, এবার আরো কাছ থেকে।
ঊর্মিলা হঠাৎ করে বলে উঠল, “এই জায়গায় নাকি একটা ভূত থাকে। শোনা যায় সে রাতে বের হয় আর মানুষকে খেয়ে ফেলে।”
রোহিত আরো জোরে চিৎকার করে উঠল, “আমরা এখান…..”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই আবার সেই চিৎকার। এবার এত কাছ থেকে যে আমরা চমকে উঠে পড়লাম। আগুনের আলো কাঁপতে লাগল, যেন কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি সেটা নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সোহম লাঠি হাতে উঠে দাঁড়াল, কিন্তু তার চোখেও ছিল অস্বীকারের ভাব। এই অজানা আতঙ্কের সামনে তার সাহস যেন ক্ষীণ হয়ে গেছে।
আমরা একে অপরের দিকে তাকালাম, চোখে চোখ রাখতে পারছিলাম না। ভয় যেন আমাদের শক্তি কেড়ে নিচ্ছে, কথা বলার ক্ষমতাও কেড়ে নিচ্ছে। হঠাৎ, গাছের ফাঁক দিয়ে দু’টো লালচে আলো আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। চোখ নয়, কিন্তু জ্বলন্ত কয়লা, যেন আমাদের জ্বলেপুড়ে দেবে।
চিৎকার করে উঠলাম আমরা সবাই। সোহম লাঠিটা ছুড়ে ফেলে দিল, ঊর্মিলা আর রোহিত কাঁদতে শুরু করল। আমি নিজেও কাঁটা গলায় চিৎকার করছিলাম, কিন্তু কারো কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছিলাম না। শুধু সেই লালচে আলো দ্রুত এগিয়ে আসছে।
আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করে ভগবানকে ডাকতে শুরু করলাম। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, কিছুই জানি না। শুধু সেই ভয়ঙ্কর আলো থেকে দূরে যেতে চাই।
কতক্ষণ দৌড়েছি জানি না, হঠাৎ করে পায়ে ঠোক্কর লাগল। চোখ খুলতেই দেখি একটা পুরনো, জীর্ণ মন্দির। দরজা ভাঙা, ভেতরে অন্ধকার। কিন্তু সেই লালচে আলো আর নেই।
আস্তে আস্তে মন্দিরের ভেতরে ঢুকলাম। ভেতরটা শীতল, একটা অদ্ভুত গন্ধ ছিল। কোণে একটা মূর্তি পড়ে আছে, কিন্তু ঠিক কি মূর্তি বুঝতে পারছিলাম না। আমি সেখানে গিয়ে বসে পড়লাম, আর কাঁদতে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর, মনে হলো কেউ একজন আমার পাশে বসেছে। শরীরটা জমে গেল। সরে সরে মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। আবার কাঁদতে শুরু করলাম, এবার আরো জোরে।
হঠাৎ, একটা শান্ত, বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, “কী হয়েছে বাছা?”
চমকে উঠে মাথা তুললাম। আমার সামনেই একটা বুড়ি দাঁড়িয়ে আছে। খুব বয়স্ক, চুলগুলো সাদা, কিন্তু চোখ দুটো অদ্ভুত ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করছে।
আমি কাঁদতে কাঁদতে সব ঘটনা বুঝিয়ে বললাম। সে শান্তভাবে শুনল সব। তারপর বলল, “ভয় পেয়ো না, বাছা। এখানে কোনো ভূত নেই। বুড়িটির কথা শেষ হওয়ার আগেই মন্দিরের বাইরে আবার সেই চিৎকার শুরু হল। এবার আরো জোরে, যেন গোটা জঙ্গল কাঁপিয়ে দিচ্ছে। আমি বুড়ির পা ধরে ফেললাম, “কি করব? ওরা আমাকে নিয়ে যাবে!”
বুড়িটি হাসল, একটা অদ্ভুত, খাঁ খাঁ শব্দ করা হাসি। “ওরা তোমাকে নিয়ে যাবে না। ওরা শুধু হারিয়ে ফেলেছে।”
“হারিয়ে ফেলেছে মানে?” আমি বুঝতে পারলাম না।
“এই জঙ্গলে একটা প্রাচীন গাছ আছে,” বুড়িটি বলল, “যেখানে রাতে আলো জ্বাললে এরকম হয়। চোখের জল গায়ে মাখলে সেই আলো আর দেখা যায় না। তবে এই জায়গায় একা থাকতে নেই।”
আমার চোখ জ্বলে উঠল। “আমার বন্ধুরা…”
“ওরা ঠিক আছে।” বুড়িটি আশ্বাস দিল, “গাছটা খুব দূরে না। আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে দেব।”
আমি আর দ্বিধা করলাম না। বুড়ির পেছনে লেগে পড়লাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, অসংখ্য গাছের ফাঁক গিয়ে, আমরা একটা বিশাল গাছের কাছে এসে পৌঁছলাম। গাছের গায়ে বেলের মালা, আর একটা মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ।
বুড়িটি বলল, “এই গাছটা। চোখের জল মোছো।”
আমি চোখের জল মুছে গায়ে মাখলাম। চারপাশটা হঠাৎ করে পরিষ্কার হয়ে গেল। সেই লাল আলো আর নেই, শুধু গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে।
আমি বুড়ির দিকে তাকালাম। কিন্তু সেখানে আর কেউ নেই। শুধু একটা হালকা সুগন্ধ ছড়িয়ে গেল।
আমি একা। কিন্তু এখন আর ভয় নেই। চোখের জল গায়ে মাখতে মাখতে গাছের চারপাশে ডাকতে শুরু করলাম, “সোহম! ঊর্মিলা! রোহিত!”
একটু দূরে ঝোপের আড়াল থেকে সোহমের গলা শোনা গেল, “অদিতি?”
আমি আরো জোরে ডাকলাম, “এখানে আছি! এসো!”
কিছুক্ষণ পর, তিনজনে আমার কাছে এসে দাঁড়াল। সবাই কাঁদছে, কাপছে। তাদের সব অভিজ্ঞতা শুনলাম। তারাও আলাদা আলাদা জায়গায় আটকে পড়েছিল, কিন্তু সেই লাল আলো দেখেছিল।
রাত কাটাতে কষ্ট হলো ঠিকই, কিন্তু ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা জঙ্গলের বাইরে বেরিয়ে এলাম। সেই জায়গায় আর ফিরে যাওয়ার ইচ্ছা করল না কারোরই। কিন্তু সেই রাতের অভিজ্ঞতা – সেটা আমাদের মনের মধ্যে চিরকাল থেকে যাবে, একটা রহস্যময়, ভয়ঙ্কর স্মৃতি হয়ে।