রাজের কৈশোর জুড়ে ছিল এক অদ্ভুত স্বপ্নের ছায়া। রাতের অন্ধকারে, ঝলমলে দীপের আলোয় এক জাঁকজমকপূর্ণ প্রাসাদ। আর সেই প্রাসাদের উঠোনে, রাগে উত্তেজিত এক রাজকন্যা রাজকে তাড়া করে। রাজকন্যার হাতে খাঁড়া, চোখ দুটি জ্বলজ্বলে আগুন। রাজ ছুটে চলে, কিন্তু রাজকন্যা পিছু ছাড়ে না। ঠিক যখন রাজকন্যা তাকে খুনের জন্যে খাঁড়া উঁচিয়ে নেয়, ঘুম ভেঙে যায়। ঘামে ভেজা সারা শরীর, বুকটা দ্রুত গতিতে ধপ-ধপ করে। কিন্তু সেই তীব্র ক্ষোভ আর ভয় রয়ে যায়।
বছরের পর বছর এই একই স্বপ্ন। রাজ বড় হলো, ছেলেবেলার সেই ভয় কমে এলো ঠিকই, কিন্তু রহস্যটা থেকে গেল। স্বপ্নের মধ্যে কখনো কখনো সে নিজেকে এবং রাজকন্যাকে দেখতো বিবাহের পোশাকে সাজানো। রাজকন্যা চোখে জল নিয়ে বলত, “আমি তোমার না হলে, আর কারোই হতে দেব না!” অদ্ভুত এক দৃশ্য, অদ্ভুত এক বাক্য, যা রাজকে বিভ্রান্ত করে রাখত।
কলেজ শেষ করে রাজ এখন একটা বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি করে। একদিন অফিসে নতুন জয়েনিং, মায়াকে দেখে। প্রথম দেখাতেই রাজের হৃৎপিণ্ডটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে গেল। মায়া! ঠিক সেই রাজকন্যার মতো দেখতে। একই রকম সুন্দর চোখ, একই রকম উজ্জ্বল হাসি। মায়ার সাথে কাজ করতে গিয়ে রাজের বুকে এক অদ্ভুত টান অনুভব হয়। যেন কোনো অদৃশ্য সুতোয় সে বাঁধা।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে মায়ার সাথে রাজের কথাবার্তা বাড়তে থাকে। মায়া খুবই মিষ্টি মেজাজের মেয়ে। সাহিত্য, সিনেমা, সব কিছু নিয়েই তার সাথে আড্ডা দেয়া যেত। চায়ের কাপ হাতে অফিসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে শহরের আলো দেখতে দেখতে, রাজ মায়াকে তার স্বপ্নের কথা বলতে চাইত কিন্তু পারত না। হয়তো সে পাগল বলে মনে করবে।
একদিন বৃষ্টির দিনে অফিস থেকে বেরোনোর সময় দেখা হলো রাজের আর মায়ার। বৃষ্টি থামার আশা নেই। রাজের গাড়ি নেই, মায়ারও না। দুজনেই একটা ছাটার তলায় দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ মায়া একটা অদ্ভুত কথা বললো, “এমন বৃষ্টিতে একসাথে আটকে পড়া, হয়তো কোনো পুরনো গল্পের শুরু!” রাজ অবাক হয়ে তাকালো মায়ার দিকে। মায়া যেন তার মনের কথাটা বলে ফেললো!
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টি কমে গেল। একটা রিক্সা পেয়ে দুজনে বাড়ি ফিরলো। সেদিনের পর রাজ আর মায়ার বন্ধুত্ব আরো গভীর হতে লাগলো। দুজনেই যেন একে অপরের সাথে অসম্ভব আরাম ও নিরাপত্তা অনুভব করতো। রাজ যখনই মায়ার চোখের দিকে তাকাতো, সেই রাজকন্যার কথা মনে পড়তো। কিন্তু মায়ার চোখে কোনো রাগ নেই, শুধুই আন্তরিকতা আর স্নেহ। একদিন সন্ধ্যায় কফি হাতে দুজনে অফিসের ছাদে দাঁড়িয়ে শহরের আলো দেখছিল। হঠাৎ রাজ সাহস করে মুখ খুললো, “মায়া, তোমাকে একটা অদ্ভুত কথা বলব।”
মায়া হাসল, “অদ্ভুত! কথাই শুনব।”
রাজ নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো, “ছোটবেলা থেকেই আমার একটা অদ্ভুত স্বপ্ন হয়। একটা রাজকন্যা, ঠিক তোমার মতো দেখতে। সে আমাকে তাড়া করে খুনের চেষ্টা করে। কখনো কখনো আবার আমরা দুজনেই বিবাহের পোশাকে সাজানো থাকি। সে বলে, ‘আমি তোমার না হলে, আর কারোই হতে দেব না!'”
মায়া মুখটা গম্ভীর করে রাজের দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে বললো, “আমারও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন হয়। একটা প্রাসাদ, ঝলমলে আলো, আর এক রাজকুমার। সে ঠিক তোমার মতো দেখতে। সে আমাকে ডাকে, কিন্তু আমি তাকে ধরতে পারি না। কখনো কখনো মনে হয়, আমি তাকে খুব বেশি আঘাত দিয়েছি।”
রাজের পুরো শরীরটা কাঁটা দিয়ে উঠলো। এই কি শোনা! মায়ার স্বপ্নও কি তার মতো? দুজনেই কি কোনো অতীত জন্মের টানে বাঁধা?
মায়া রাজের হাত ধরে বললো, “রাজ, হয়তো আমাদের স্বপ্নের কোনো মানে আছে। হয়তো আমরা কোনো পুরনো গল্পের অংশ।”
রাজ মায়ার হাত চেপে ধরলো। মনের মধ্যে এক অদ্ভুত আশা জাগলো। হয়তো সত্যিই তাই। হয়তো সেই রাজকন্যা আর রাজ আজ মায়া আর রাজ হিসেবে আবার দেখা করেছে। কিন্তু সেই অতীত জন্মে ঠিক কি ঘটেছিল? আর এই জন্মে কি তাদের ভালোবাসা সফল হবে? এই প্রশ্নগুলো ঘুরপাক খেতে লাগলো রাজের মনে।
এরপরের কয়েকটা দিন রাজ আর মায়া দুজনেই তাদের স্বপ্নের কথা নিয়ে আরো আলোচনা করলো। লাইব্রেরি থেকে ইতিহাসের বই এনে পড়লো। মায়া একদিন রাজকে বললো, “রাজ, আমার স্বপনে সেই প্রাসাদটা দেখতে ঠিক এই অঞ্চলের মতোই মনে হয়।”
রাজের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে মায়াকে বললো, “চলো, একদিন সেই জায়গাটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি।”
দুই সপ্তাহ পরে এক রবিবারে রাজ আর মায়া গেলো শহরের বাইরে একটা প্রত্যন্ত গ্রামে। লাইব্রেরিতে পড়া একটা পুরোনো মানচিত্রের সাহায্যে তারা সেই গ্রামে পৌঁছল। সেখানে জীর্ণ-শীর্ণ এক প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেল। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানতে পারলো, এই প্রাসাদটা কয়েকশো বছর আগে রাজবাঁধানো হয়েছিল কিন্তু এক ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ডে প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। কিংবদন্তি আছে, সেই অগ্নিকাণ্ডে রাজকন্যা সহ রাজপরিবারের অনেক সদস্যই মারা যান। রাজ আর মায়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো। যেন অতীতের কোনো গল্প তাদের চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে।
সেই দিন রাতে হোটেলে ফিরে রাজ আর মায়া দুজনেই খুব একটা ঘুমোতে পারলো না। রাজ আবার সেই স্বপ্ন দেখলো। রাজকন্যা রাগে গর্জন করে বলছে, “আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না!” কিন্তু এবার রাজ আর পালিয়ে না গিয়ে রাজকন্যার কাছে এগিয়ে গেল। রাজকন্যা অবাক হয়ে তাকালো। রাজ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আমি এবার তোমাকে ছেড়ে যাব না।”
রাজ ঘুম থেকে উঠে দেখলো মায়া পাশেই শুয়ে আছে। মায়ার চোখ খোলা। রাজ তার স্বপ্নের কথা মায়াকে বললো। মায়াও তার অভিজ্ঞতা শেয়ার করলো। সে রাজকে স্বপ্নে দেখেছে, ঠিক সেই রকম করে জড়িয়ে ধরতে।
পরের সকালে দুজনে আবার প্রাসাদের কাছে গেল। প্রাসাদের মাঝখানে একটা বড় গর্ত ছিল। কিংবদন্তি আছে, রাজকন্যার শয়নকক্ষ সেখানেই অবস্থিত ছিল। রাজ মায়ার হাত ধরে সেই গর্তের দিকে এগিয়ে গেল। হঠাৎ একটা ঝোড়ো হাওয়া এলো। গর্তের ধারে থাকা কিছু পাথর খসে পড়ল। মায়া সরে যেতে গিয়ে পা ফসকে পড়ল। রাজ তাকে ধরার চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না। মায়া গর্তের মধ্যে পড়ে গেল।
রাজ চিৎকার করে উঠলো, “মায়া!” সে নিজেও গর্তের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। গর্তের নিচে অন্ধকার। রাজ মায়াকে ডাকতে লাগলো। হঠাৎ একটা দুর্বল আলোর ঝিলিক দেখতে পেল। সেই আলোর দিকে এগিয়ে গেল। দেখলো, গর্তের এক কোণে একটা খোলা দরজা। দরজাটা খুলে ঢুকলো রাজ।
এটা ছিল একটা গোপন কক্ষ। দেওয়ালে জ্বলজ্বল করা মশাল জ্বালানো। আর কক্ষের মাঝখানে একটা পাথরের কাঠামোর উপরে শুয়ে আছে এক মৃতদেহ। মৃতদেহটা এক রাজকন্যার। সেই রাজকন্যার হাতে ছিল একটা ছোট্ট ডায়েরির মত কিছু একটা। রাজ ডায়েরিটা হাতে নিল। প্রথম পাতায় ১৭৭০ সালের একটা তারিখ লেখা। সেই তারিখ ঠিক সে
রাজ ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কাছে গেল। প্রথম পাতায় লেখা ছিল – “১৮ই-মার্চ-১৭৭০”। সেই তারিখ ঠিক সেই সময়ের, যখন ঐ প্রাসাদে ভয়ঙ্কর অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল বলে কিংবদন্তি! কৌতূহলে পাতা খুললো রাজ। ডায়েরিতে লেখা ছিল রাজকন্যার নিজের কথা। সে লিখেছিল, রাজকুমারের প্রতি তার গভীর ভালোবাসার কথা, কিন্তু রাজকুমারের বাবা, রাজকুমারের অন্য রাজ্যের রাজকন্যার সাথে বিবাহের প্রস্তাব দিলে রাজকুমারের রাজার কাছে এই বিবাহ না করার জন্য অনুরোধ করেছিল। কিন্তু রাজ বাধ্য হয়ে রাজকুমারের বাবার কথা মেনে নেয়। রাজকন্যা সহ্য করতে পারে না এই বিচ্ছেদ। অগ্নিকাণ্ডের রাতে সে নিজের কামরায় আগুন ধরিয়ে দেয়। সে লিখেছিল, মৃত্যুর আগে তার একটাই আশা – পরজন্মে যেন রাজকুমারের সাথে মিলন হয়।
ডায়েরি পড়ে রাজের চোখ দিয়ে জল চলে এলো। সে বুঝতে পারলো, সেই রাজকন্যা আর সেই রাজকুমারের – হয়তো সেই তারাই আজ মায়া আর রাজ হিসেবে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু মায়া কোথায়? এই গোপন কক্ষে সে নেই। হঠাৎ তার কানে একটা ক্ষীণ শব্দ এলো। সেই শব্দ আসছিল পাথরে খোদাই করা একটা সরু সুড়ঙ্গের মধ্যে থেকে। রাজ সাবধানে সেই সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকলো। সুড়ঙ্গটা খুব একটা বড় না, হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যেতে হচ্ছিল। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সে দেখতে পেল একটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে বসে আছে মায়া।
মায়া রাজকে দেখে অবাক হয়ে গেল। রাজ সব ছেঁচে মায়াকে জড়িয়ে ধরলো। মায়াও রাজকে জড়িয়ে ধরে বললো, “কি হলো রাজ? কোথায় ছিলে?”
রাজ মায়াকে সব খুঁটিনাটি বিষয় জানালো। রাজকন্যার ডায়েরিটাও দেখালো। মায়া ডায়েরি পড়ে চোখের কোণে জল দেখিয়ে বললো, “তাহলে সত্যিই কি আমরা সেই রাজকন্যা আর রাজকুমার?”
রাজ মাথা নাড়লো, “আমি জানি না, কিন্তু এ জন্মে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না মায়া।”
সেই গোপন কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো রাজ আর মায়া। প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের মাঝে দাঁড়িয়ে তারা দুজনেই জানতো, হয়তো অতীতে তাদের ভালোবাসা সফল হয়নি, কিন্তু এই জন্মে তারা আবার একে অপরের। অতীতের বন্ধন আর পুনর্জন্মের টানে আজ তারা এক। সূর্য অস্ত যেতে থাকায় লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের উপর। রাজ মায়ার হাত ধরে রাখলো। এই লাল আভা যেন তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে দাঁড়ালো, জন্মে জন্মান্তরে অমর থাকার প্রতিজ্ঞায়।