বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
১৯৮০-এর দশকের পূর্ব জার্মানি। বার্লিন প্রাচীর শহরটিকে শুধু ভৌগোলিকভাবে নয়, মানুষের জীবনকেও দুই ভাগে ভাগ করেছে। পশ্চিম বার্লিনে যেখানে জীবন মুক্ত, রঙিন, এবং সম্ভাবনায় ভরপুর, পূর্ব বার্লিনে জীবন সেখানে শৃঙ্খলিত, কঠোর, এবং নিয়ন্ত্রিত। এই বিভক্ত শহরের দুই প্রান্তে বাস করে হান্স ক্লাইন এবং মারিয়া ল্যাঞ্জ—দুটি হৃদয়, যাদের মিলন বাধাগ্রস্ত এক শীতল প্রাচীরের কারণে।
১৯৮৫ সালের এক গ্রীষ্মকালীন সন্ধ্যা
পশ্চিম বার্লিনের আলো ঝলমল একটি কনফারেন্স হলে হান্স ক্লাইন নিজের পরিচিত দুনিয়া থেকে বেরিয়ে এসে নতুন কিছু দেখার প্রত্যাশায় অপেক্ষা করছিল। “ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ ফোরাম” এই নামটি তার মনে কৌতূহল জাগিয়েছিল।
“হান্স, তুমি কি সত্যিই ভাবছো এ জায়গায় কিছু বদলাতে পারবে?” তার বন্ধু পিটার মুচকি হেসে বলল।
“আমি জানি না, পিটার। তবে জানি, কথা বলা, অন্যদের অনুভূতি বোঝা—এটা একটা শুরু হতে পারে,” হান্স দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল।
অন্যদিকে, পূর্ব বার্লিন থেকে আসা মারিয়া ল্যাঞ্জ একদম ভিন্ন বাস্তবতার মুখোমুখি ছিল। কমিউনিস্ট সরকারের কড়া নজরদারির মাঝে, এই ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নেওয়া তার জন্য এক ধরনের মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল।
“মারিয়া, তুমি সাবধান থেকো। এখানে আমাদের ওপর নজর রাখা হতে পারে,” তার বন্ধু এলসা সতর্ক করল।
“আমি জানি, এলসা। তবে এই একটুকু স্বাধীনতার জন্য আমি ঝুঁকি নিতেই রাজি,” মারিয়া হেসে উত্তর দিল।
সন্ধ্যার আলো-আধারিতে যখন কনফারেন্সের মূল প্রোগ্রাম শুরু হলো, তখনই তাদের প্রথম দেখা। হান্সের নজর আচমকাই থেমে গেল এক তরুণীর উপর। মারিয়ার চোখে ছিল এক অদ্ভুত দৃঢ়তা, যা হান্সকে মুগ্ধ করল।
“হ্যালো, আমি হান্স,” সাহস করে সামনে গিয়ে বলল সে।
মারিয়া এক মুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, “মারিয়া। পূর্ব বার্লিন থেকে।”
তাদের প্রথম কথোপকথন ছিল অতি সাধারণ, কিন্তু সেই সামান্য আলাপেই তারা দুজনেই বুঝতে পারল, এই সাক্ষাৎ কিছু অদ্ভুতভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
কনফারেন্সের শেষে, হান্স এবং মারিয়া আরও কয়েকবার দেখা করল। একসাথে পশ্চিম বার্লিনের রঙিন আলোয় ঘোরা, কিংবা কনফারেন্সের মধ্য বিরতিতে চুপচাপ কথা বলা—তাদের সম্পর্কের বীজ সেদিনই বোনা হয়েছিল।
“তোমার জীবন কেমন, মারিয়া?” হান্স জানতে চাইল।
“আমাদের জীবন…” মারিয়া এক মুহূর্ত থেমে বলল, “প্রাচীরের ওপারে থাকা জীবন থেকে খুব আলাদা। আমরা শ্বাস নিতে পারি, কিন্তু মুক্তির স্বাদ পাই না।”
হান্স মুগ্ধ হয়ে শুনছিল। মারিয়ার কথাগুলো তার জন্য এক নতুন জগতের জানালা খুলে দিয়েছিল।
“তুমি জানো, মারিয়া, আমি তোমার জন্য কিছু করতে চাই,” হান্স বলল।
“তুমি যা করতে পারো, তা হলো আমাকে মনে রাখা। আমাদের দেখা হয়ে গেছে, এটাই অনেক বড় ব্যাপার,” মারিয়া মৃদু হেসে বলল।
কনফারেন্স শেষ হওয়ার পর তাদের দেখা হওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল। প্রাচীরের দুই প্রান্তে থাকা এই দুটি হৃদয়ের সংযোগ একটাই—চিঠি। কিন্তু সেই চিঠি বিনিময়ের পথ সহজ ছিল না।
প্রথম চিঠিতে হান্স লিখেছিল:
“মারিয়া, তোমার সাথে কাটানো দিনগুলো আমার জীবনের অন্যতম উজ্জ্বল সময়। আমি প্রতিদিন সেই মুহূর্তগুলো মনে করি। জানি না কীভাবে, কিন্তু আমি তোমার কাছে আসতে চাই।”
মারিয়ার উত্তর এসেছিল কয়েকদিন পর:
“হান্স, আমি তোমাকে অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে। কিন্তু আমাদের এই চিঠিগুলো বিপদ ডেকে আনতে পারে। তবু আমি থামতে পারব না। তুমি আমার একমাত্র মুক্তি।”
প্রতিটি চিঠি ছিল তাদের ভালোবাসার অমর সাক্ষী। তবে প্রতিটি চিঠি নিয়ে আসত নতুন বিপদের আশঙ্কা। পূর্ব জার্মানির কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা তাদের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করত।
একদিন মারিয়া লিখল:
“হান্স, প্রাচীরের ওপারে বসে আমি এক আকাশের নিচে থাকা সত্ত্বেও তোমাকে ছুঁতে পারি না। আমি জানি না কতদিন এভাবে চলবে। কিন্তু আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।”
এই চিঠিপত্রের মাধ্যমে, প্রাচীরের দুই প্রান্তে থাকা হান্স এবং মারিয়া ধীরে ধীরে তাদের ভালোবাসার এক অদ্ভুত পৃথিবী তৈরি করেছিল। তারা জানত না কীভাবে এই সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখবে, কিংবা ভবিষ্যৎ কী নিয়ে আসবে। কিন্তু তারা এটুকু জানত, ভালোবাসা শুধু অনুভূতির নাম নয়, এটি এক ধরনের প্রতিশ্রুতি—প্রাচীরের ওপারেও টিকে থাকার প্রতিশ্রুতি।
কল্পবিজ্ঞান-এর বাংলা ছোট গল্প - মুক্তির দ্বার: "মুক্তির দ্বার" একটি হৃদয়স্পর্শী কল্পবিজ্ঞান গল্প। বন্ধুত্ব, অপরাধবোধ ও মুক্তির সন্ধানে ভ্যালেরিয়ানের যাত্রা নিয়ে এই বাংলা ছোট গল্প পাঠকদের ভিন্ন এক জগতে নিয়ে যাবে। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
কঠোর বাস্তবতা
বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
পূর্ব বার্লিনের শীতল আকাশের নিচে মারিয়া ল্যাঞ্জ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। কাঁধে একটি উলের চাদর জড়ানো, তার মুখে উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট। ছোট একটি টেবিলের ওপর রাখা ছিল হান্সের শেষ চিঠি। সেখানে লেখা ছিল:
“মারিয়া, আমি জানি, এই প্রাচীর আমাদের আলাদা করেছে। কিন্তু আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। আমি তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে আসব।”
মারিয়া চিঠিটি আরেকবার পড়ল। হান্সের অটুট বিশ্বাস তাকে একদিকে আশ্বস্ত করছিল, আবার অন্যদিকে গভীর চিন্তায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল। পূর্ব জার্মানির কঠোর সরকারের নজরদারির মাঝে এমন একটি পরিকল্পনা যেন আগুন নিয়ে খেলা।
“মারিয়া, তুমি জানো না তুমি কী বিপদে জড়াচ্ছো,” মারিয়ার মা রুথ তার কণ্ঠে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করলেন।
“মা, আমি যা করছি, তা ভেবে-চিন্তেই করছি। হান্স আমাকে সাহায্য করতে চায়। আমি এই জীবনে বন্দি থাকতে পারি না,” মারিয়া ধীরে ধীরে বলল।
রুথ হতাশভাবে বলল, “তোমার বাবা যদি জানতেন, তিনি কী বলতেন? তুমি কি জানো, সরকার আমাদের পুরো পরিবারের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে যদি তারা তোমার পরিকল্পনার কথা জানতে পারে?”
মারিয়া কোনো উত্তর দিল না। সে জানত তার মা ঠিকই বলছেন। তবুও, হান্সের প্রতি তার ভালোবাসা এতটাই গভীর ছিল যে কোনো বিপদই তাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না।
এদিকে, পশ্চিম বার্লিনে হান্স ক্লাইন তার ছোট অ্যাপার্টমেন্টে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন ছিল। টেবিলের ওপর ছড়ানো ছিল পূর্ব জার্মানি থেকে পালানোর বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিকল্পনার নকশা।
“তুমি কি সত্যিই ভাবছো, এটা সম্ভব?” পিটার তাকে প্রশ্ন করল।
“সম্ভব না হলেও চেষ্টা করতে হবে, পিটার। আমি মারিয়াকে ওখান থেকে বের করে আনতে চাই। সে এই বন্দি জীবনের যোগ্য নয়,” হান্স দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
পিটার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি জানো, তাদের সীমান্তরক্ষীরা কাউকে ছাড়ে না। যদি ধরা পড়ে যাও, তোমার জীবন শেষ।”
“তবুও আমি চেষ্টা করব,” হান্স জোরালোভাবে বলল।
তার পরিকল্পনা ছিল একটি গোপন টানেলের মাধ্যমে মারিয়াকে বের করে আনার। সে জানত, এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। কিন্তু তার মনে হচ্ছিল, তাদের ভালোবাসার জন্য সবকিছুই সম্ভব।
পূর্ব বার্লিনে পরিস্থিতি ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিল। সরকারের নজরদারি আরও কঠোর হচ্ছিল। যেকোনো সন্দেহভাজন কার্যকলাপের জন্য মানুষকে বন্দি করা হচ্ছিল।
একদিন, মারিয়া তার সহকর্মী গ্রেটার কাছে শুনল, “তুমি শুনেছো? আমাদের অফিসের কাছের এক দম্পতি পালানোর চেষ্টা করেছিল। তাদের ধরা পড়েছে, এবং বলা হচ্ছে তারা আর জীবিত নেই।”
মারিয়া শিউরে উঠল। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। কিন্তু হান্সের কথাগুলো মনে করে তিনি নিজেকে সামলে নিল।
মারিয়া হান্সকে একটি চিঠি লিখল:
“হান্স, পরিস্থিতি ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে। আমি জানি না, তুমি কীভাবে তোমার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে। তবে আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, ভালো করে ভেবে দেখো। যদি আমি তোমার জন্য বিপদে পড়ি, আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না।”
হান্সের দ্রুত উত্তর এল:
“মারিয়া, আমি তোমার জন্য সবকিছু করতে প্রস্তুত। আমি সবকিছু নিয়ে ভেবেছি। আমাদের এই প্রাচীরকে ভাঙতেই হবে।”
তাদের পরিকল্পনার প্রস্তুতি চলতে থাকল। কিন্তু এর মধ্যেই একটি গোপন তথ্য মারিয়ার কানে এল। পূর্ব জার্মানির সীমান্তরক্ষীরা পালানোর চেষ্টা করা ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ বাহিনী নিয়োগ করেছে।
মারিয়া তার বন্ধু এলসার কাছে বলল, “এটা খুব বিপজ্জনক হয়ে উঠছে, এলসা। আমি জানি না, আমি এই ঝুঁকি নিতে পারব কিনা।”
এলসা শান্তভাবে বলল, “মারিয়া, তুমি হান্সকে ভালোবাসো। তবে নিজের জীবন, নিজের ভবিষ্যৎ, এগুলোও ভেবে দেখো।”
মারিয়া দ্বিধায় পড়ে গেল। তার একদিকে ছিল হান্সের প্রতি গভীর ভালোবাসা, অন্যদিকে তার পরিবার এবং নিজের নিরাপত্তার কথা।
অবশেষে, মারিয়া একটি কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। সে হান্সকে একটি চিঠি লিখল:
“হান্স, আমি তোমার সাহস এবং ভালোবাসার প্রশংসা করি। কিন্তু আমি চাই না তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করো। এই প্রাচীর হয়তো আমাদের আলাদা রেখেছে, কিন্তু আমাদের ভালোবাসা সবকিছু অতিক্রম করতে পারবে।”
চিঠিটি পাঠানোর পর, মারিয়া জানত যে তাদের ভালোবাসার জন্য আরও কঠিন সময় আসছে। তবুও, তিনি হান্সের অপেক্ষায় রইল, জানত, প্রাচীরের ওপারে কেউ একজন তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে।
মুক্তির স্বপ্ন
বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
১৯৮৯ সালের জানুয়ারির শীতল এক সন্ধ্যা। পূর্ব বার্লিনের রাস্তাগুলোতে উত্তেজনা টগবগ করে ফুটছে। প্রতিবাদ, ব্যানার, আর স্লোগানের মাঝে মানুষের গর্জন যেন আকাশ ভেদ করে উঠছে।
“আমরা স্বাধীনতা চাই!” “প্রাচীর ভাঙো! মানুষকে মুক্ত করো!”
মারিয়া ল্যাঞ্জ এই পরিবর্তনের হাওয়াকে গভীর মনোযোগে দেখছিল। দীর্ঘদিন ধরে এই বন্দী জীবনের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ জমছিল। আজ তা স্রোতে পরিণত হয়েছে।
হান্স চিঠিতে লিখেছিল, “মারিয়া, এখনই সময়। এটাই আমাদের সুযোগ!”
মারিয়া চিঠিটি পড়ার পর গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। পূর্ব জার্মানির সরকার এই প্রতিবাদ দমনে আরও কঠোর হয়ে উঠছে। তবুও, এই আন্দোলনের ঢেউয়ে তাদের পালানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
রাতে এলসার বাড়িতে বসে সে তার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করছিল।
“এখন কি সত্যিই নিরাপদ হবে, এলসা? যদি ধরা পড়ি…” মারিয়ার কণ্ঠে দ্বিধার ছাপ।
“মারিয়া, আমরা সবাই জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছি। কিন্তু তোমার এই সুযোগ কাজে লাগাতেই হবে। হান্স নিশ্চয়ই কিছু না ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি,” এলসা তাকে ভরসা দিল।
এদিকে, হান্স পশ্চিম বার্লিনে একটি ছোট গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলিত হয়। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন পূর্ব জার্মানি থেকে পালিয়ে আসা ব্যক্তি ছিল।
“আমাদের যা করতে হবে তা একদম নিঃশব্দে। কোনো ঝুঁকি নেওয়া যাবে না,” পিটার বলল।
“মারিয়াকে সাহায্য করতেই হবে। যদি আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিই, তাতেও সমস্যা নেই,” হান্স জবাব দিল।
তারা একটি গোপন পথ চিহ্নিত করল। পূর্ব জার্মানির কড়াকড়ি নিরাপত্তার মাঝে এটি ছিল প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।
১৯৮৯ সালের মার্চ মাসের এক সন্ধ্যা। আকাশে কালো মেঘ, বাতাসে চাপা উত্তেজনা। মারিয়া একটি পুরনো স্কার্ফ এবং গাঢ় রঙের পোশাক পরে বেরিয়ে পড়লেন। তার হাত কাঁপছিল, কিন্তু তার মন স্থির ছিল।
“তুমি নিশ্চিত?” এলসা তাকে বিদায় দেওয়ার সময় বলল।
“আমার আর কোনো পথ নেই, এলসা। আমি এখান থেকে বের হতে চাই। হান্স আমার জন্য অপেক্ষা করছে,” মারিয়া জবাব দিল।
গোপন পথটি শহরের একটি পুরনো ড্রেনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। হান্সের দেওয়া নির্দেশ মেনে, মারিয়া সেই পথে এগিয়ে চলল। বাতাস ভারী এবং পায়ের শব্দগুলো অস্বাভাবিক জোরে শোনা যাচ্ছিল।
ড্রেনের অন্ধকার পথ ধরে কিছুটা এগোনোর পর হঠাৎ তিনি টর্চলাইটের আলো দেখতে পেল। পূর্ব জার্মানির সীমান্তরক্ষীরা টহল দিচ্ছিল।
“সাবধান! এখানে কেউ লুকিয়ে থাকতে পারে,” একজন রক্ষী বলল।
মারিয়ার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠল। সে একটি কোণের আড়ালে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে রইল। রক্ষীরা কাছাকাছি চলে আসছিল।
“কিছু খুঁজে পেয়েছো?” আরেকজন রক্ষী প্রশ্ন করল।
“না, এখানে কিছু নেই,” প্রথমজন জবাব দিল।
রক্ষীরা সরে যাওয়ার পর মারিয়া দ্রুত সামনের দিকে এগোলেন। তার মন শুধু একটি কথা ভাবছিল—“হান্স, আমি আসছি!”
ড্রেনের শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর পর সে হান্সের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। পশ্চিম বার্লিনের ওই অংশে প্রবেশ করতে হলে তাকে একটি সরু রাস্তা পেরোতে হবে।
“মারিয়া!” একটি ফিসফিসে কণ্ঠ ভেসে এলো।
“হান্স!”
মারিয়া তাকে দেখতে পেল। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা হান্স তাকে ইশারা করছিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিক থেকে একটি টর্চলাইটের আলো তাদের ওপর পড়ল।
“ওখানে কে?” একজন রক্ষী চিৎকার করল।
“দৌড়াও, মারিয়া! দৌড়াও!” হান্স চিৎকার করে উঠল।
মারিয়া নিজের সমস্ত শক্তি নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল। গুলির শব্দ কানে ভেসে আসছিল। রক্ষীরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছিল। সেদিনকার মত মারিয়া প্রাণ হাতে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে।
ভুতের বাংলা ছোট গল্প - মৃত্যুর হাসি: "মৃত্যুর হাসি" একটি রহস্যময় ভুতের গল্প যেখানে দুই ভাইবোনের সাহস, মায়ের আত্মার আশীর্বাদ, ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই আপনাকে টানবে। পড়ুন এই বাংলা ছোট গল্প, যা ভয় ও আবেগে ভরা। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
প্রাচীরের পতন
বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর। বার্লিনের আকাশে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। রেডিও এবং টেলিভিশনের খবরে হঠাৎ করে এক ঘোষণা শোনা যায়—প্রাচীর খুলে দেওয়া হবে। কেউ প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেনি।
“শুনেছো? প্রাচীর খুলে দিচ্ছে!” এলসা চিৎকার করে মারিয়ার ঘরে ঢুকে পড়ল।
“এটা কি সত্যি? এভাবে কী করে সম্ভব?” মারিয়ার কণ্ঠে আনন্দের সঙ্গে শঙ্কার মিশ্রণ।
প্রাচীর ভাঙার এই খবরটি পূর্ব জার্মানির প্রতিটি ঘরে ছড়িয়ে পড়ে। মানুষ বুঝতে পারছিল না যে এটি প্রশাসনিক ভুল নাকি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তবে সবার মধ্যেই ছিল এক অদম্য উত্তেজনা।
হান্স পশ্চিম বার্লিনে একটি ক্যাফেতে খবরটি শুনেছিল। সে দ্রুত পিটার এবং তার দলের সঙ্গে যোগাযোগ করল।
“আমরা আর অপেক্ষা করতে পারি না। আজ রাতেই কিছু হবে। আমাকে মারিয়ার কাছে যেতে হবে,” হান্স দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
পিটার একটি মানচিত্র বের করে বলল, “প্রাচীরের চেকপয়েন্ট চার্লি এবং বোর্নহোলমার স্ট্রাসে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাবধান, কোনো বিপদ হতে পারে।”
এদিকে, পূর্ব বার্লিনে মারিয়া এবং এলসা একসঙ্গে ভিড়ের দিকে হাঁটছিলেন। হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমেছে। কারও হাতে মোমবাতি, কেউ বা লাল-সাদা-কালো পতাকা নিয়ে এগিয়ে আসছে।
“মারিয়া, তুমি কি নিশ্চিত যে হান্স আসবে?” এলসা জিজ্ঞাসা করল।
“ও আমার জন্য আসবেই। আমি জানি,” মারিয়া চুপচাপ জবাব দিল। তার হৃদয় দৌড়াচ্ছিল; একদিকে আশা, অন্যদিকে ভয়।
রাত নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে বার্লিনের দুই প্রান্ত থেকে মানুষ প্রাচীরের কাছে জমা হতে লাগল। পশ্চিম দিক থেকে হাজারো মানুষ “ফ্রি বার্লিন!” বলে স্লোগান তুলছিল। পূর্ব দিক থেকে মানুষের চিৎকার ছিল, “আমরা মুক্তি চাই!”
মারিয়া এবং এলসা জনতার সঙ্গে প্রাচীরের কাছে এসে দাঁড়াল। অপর পাশে হান্সও ভিড় ঠেলে প্রাচীরের কাছাকাছি পৌঁছেছিল।
“মারিয়া!”
মারিয়া চমকে উঠল। পশ্চিম প্রান্ত থেকে একজন চিৎকার করছিল। ভিড়ের মাঝে হান্সের চেহারা ঝাপসা হলেও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিল।
“হান্স!”
তাদের কণ্ঠ দু’দিকের কোলাহলে মিশে গেল।
প্রাচীরের ওপরে থাকা গার্ডরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল। মানুষ ধীরে ধীরে প্রাচীরের ছোট ছোট অংশ ভাঙতে শুরু করেছে। একদল লোহা দিয়ে পেটাচ্ছে, অন্যদল হাতুড়ি নিয়ে আসছে। রক্ষীরা কি করবে, তা বুঝতে পারছিল না।
মারিয়া ধীরে ধীরে প্রাচীরের কাছে এগিয়ে গেল। হান্সও ওপার থেকে আরও কাছে এল।
“তুমি কাছে এসো, মারিয়া। আমি তোমার হাত ধরতে চাই,” হান্স প্রাচীরের ওপর দিয়ে চিৎকার করল।
মারিয়া প্রাচীরের ওপর হাত রাখল। “তোমার কাছে পৌঁছাতে চাই, হান্স!”
এমন সময় প্রাচীরের একটি অংশ ধসে পড়তে শুরু করল। ভিড় চিৎকার করে উঠল, “এগিয়ে চলো!”
এক বৃদ্ধ লোক, যার হাতে ছিল একটি হাতুড়ি, প্রাচীরের ভাঙা অংশটি আরও বড় করে ফেলার চেষ্টা করছিল। “এটা ভাঙতেই হবে! এটা আমাদের প্রাচীর নয়, এটা আমাদের বন্দিত্ব!”
হান্স দ্রুত মারিয়ার দিকে হাত বাড়াল। প্রাচীরের ফাঁকা অংশটি দিয়ে তিনি হাত ঢুকিয়ে দিল। “তুমি আমার হাত ধরো, মারিয়া। ভয় পেও না!”
মারিয়া তার হাত ধরল। তার চোখ থেকে আনন্দের অশ্রু ঝরতে লাগল। “আমি জানতাম তুমি আসবে। আমি জানতাম।”
“আমি তোমাকে কখনো ছেড়ে যাব না,” হান্স ফিসফিস করে বলল।
প্রাচীরের আরও একটি অংশ ধসে পড়ল। মারিয়া হান্সের সাহায্যে ওপার থেকে টেনে নিয়ে গেল। ভিড়ের মধ্য থেকে মানুষ উল্লাস করে উঠল।
“তারা এক হয়েছে!” একজন চিৎকার করল।
“এটাই স্বাধীনতা!”
হান্স এবং মারিয়া একে অপরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। প্রাচীরের ওপরে সূর্যের মতো উজ্জ্বল আলো যেন তাদের মিলনের সাক্ষী ছিল।
রহস্য-রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প - অন্তিম সন্ধ্যা: "অন্তিম সন্ধ্যা" একটি রহস্য রোমাঞ্চ বাংলা ছোট গল্প, যেখানে এক তরুণীর মৃত্যু, তার পরিবার, এবং শহরের অন্ধকারে লুকানো সত্যের খোঁজে উত্তেজনা ও মর্মস্পর্শী মুহূর্তের বুনন। সম্পুর্ন্য বাংলা ছোট গল্পটি পড়তে এই লিংকটি ক্লিক করুন।
নতুন সূচনা
বাংলা ঐতিহাসিক কথাসাহিত্যের ছোট গল্পটির অডিও স্টোরি শুনতে নিচে প্লে বোতাম টি ক্লিক করুন।
প্রাচীরের পতনের পর বার্লিন যেন নতুন করে জন্ম নিল। শহরের প্রতিটি গলি, প্রতিটি দেয়াল, এবং প্রতিটি মুখে ছিল স্বাধীনতার উচ্ছ্বাস। হান্স এবং মারিয়া, যারা এতদিন প্রাচীরের দুই প্রান্তে বিচ্ছিন্ন ছিল, এখন বার্লিনের মুক্ত বাতাসে একত্রিত। কিন্তু এই স্বাধীনতা তাদের জীবনে শুধু আনন্দই নিয়ে আসেনি; নিয়ে এসেছে অতীতের দগদগে ক্ষত, যা সহজে মুছে যাওয়ার নয়।
মারিয়া ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “এই জায়গাটায় একসময় প্রাচীর ছিল।” সে একটি ভাঙা অংশের দিকে তাকিয়ে আছেন, যেখানে এখন কেবল ইট-পাথরের ধ্বংসাবশেষ।
হান্স তার হাত ধরে বলল, “এটা এখন আর প্রাচীর নয়। এটা আমাদের গল্পের সাক্ষী। আমরা এই প্রাচীরের ওপারে ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি।”
মারিয়ার চোখ ভিজে গেল। “কিন্তু কতজন এই প্রাচীরের কারণে তাদের প্রিয়জনকে হারিয়েছে, জানো? এই প্রাচীর আমাদের আলাদা করেছিল। এটা আমাদের কষ্টের স্মৃতি।”
হান্স ধীরে ধীরে বলল, “কিন্তু এটা ভেঙে যাওয়াই তো আমাদের জয়। এই ইট-পাথরের নিচেই আমাদের সাহস লুকিয়ে আছে। এগুলো আমাদের শক্তি দেয়।”
মারিয়া এবং হান্স একটি ছোট ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে। ফ্ল্যাটটি পশ্চিম বার্লিনের একটি শান্তিপূর্ণ এলাকায়। মারিয়া ধীরে ধীরে পূর্ব বার্লিনের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে মুক্ত হতে শিখল, কিন্তু তার মধ্যে অতীতের ছায়া এখনো রয়ে গেছে।
এক সন্ধ্যায়, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে মারিয়া বলল, “হান্স, তুমি কখনো ভেবেছো, আমরা যদি প্রাচীরের কারণে আলাদা হয়ে যেতাম, তবে কী হতো?”
হান্স একটু হেসে বলল, “তাহলে আমি প্রতিদিন প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা করতাম। আমার ভালোবাসা কোনো দেয়াল মানে না, মারিয়া। আমাদের জীবনের প্রাচীর তো আমরা নিজেরাই ভেঙে দিয়েছি।”
“তুমি সবসময় এতো আশাবাদী কীভাবে থাকতে পারো?” মারিয়া তার হাসি চেপে বলল।
“কারণ আমার জীবনে তুমি আছো। তুমি আমার ভালোবাসা, আমার শক্তি,” হান্স গভীর কণ্ঠে বলল।
তারা প্রায়ই শহরের বিভিন্ন জায়গায় হাঁটতে যেত। প্রতিটি গলিতে, প্রতিটি দেয়ালের টুকরোয় তাদের অতীতের গল্প যেন লেখা ছিল। একদিন তারা বার্লিনের সেই জায়গায় ফিরে গেল, যেখানে তারা প্রথমবার প্রাচীরের দুই পাশে দাঁড়িয়ে একে অপরকে দেখেছিল।
“মনে আছে, মারিয়া? এখানে আমরা একে অপরের দিকে হাত বাড়িয়ে ছিল। তখন মনে হয়েছিল, প্রাচীরটা আমাদের চিরকালের জন্য আলাদা করে দেবে।”
মারিয়া মাথা নাড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, কিন্তু আমরা তো প্রাচীরকেও জিততে দেইনি। আমরা ভালোবাসায় বিশ্বাস রেখেছিলাম।”
তারা সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকল। বার্লিনের ঠাণ্ডা বাতাস তাদের চুল উড়িয়ে দিচ্ছিল। মারিয়া হান্সের হাত শক্ত করে ধরল।
একদিন মারিয়া হান্সকে বলল, “তুমি কি কখনো ভেবেছো, আমাদের নিজের একটা পরিবার গড়ার কথা? স্বাধীন জার্মানিতে আমাদের একটা নতুন অধ্যায় শুরু হতে পারে।”
হান্স তার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সবসময়ই এটা ভেবেছি। আমাদের ভালোবাসার ফলাফল হতে পারে এমন একটি পরিবার, যেখানে আমাদের সন্তানদের কোনো প্রাচীরের ভয় থাকবে না।”
তারা একসঙ্গে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করতে লাগল। তাদের স্বপ্ন ছিল একটি শান্তিপূর্ণ জীবন, যেখানে তাদের সন্তানরা মুক্ত আকাশের নিচে বড় হতে পারবে, যেখানে কোনো দেয়াল তাদের ভালোবাসাকে আলাদা করবে না।
একদিন তারা বার্লিনের ভাঙ্গা প্রাচীর থেকে প্রাচীরের একটি ছোট অংশ নিয়ে আনল। সেই ভাঙা অংশটি তারা তাদের ফ্ল্যাটের একটি কোণায় রাখল। মারিয়া বলল, “এই টুকরোটা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেবে যে আমরা কী হারিয়েছি এবং কী পেয়েছি।”
হান্স মাথা নাড়িয়ে বলল, “এটা আমাদের স্মৃতি। এটা আমাদের গল্পের অংশ।”